আমরা উজাড় করে আমাদের সর্বস্ব ভগবানকে দিতে পারিনা,তাই সমস্যা। সকল ভালবাসা, সকল অনুরাগ, সকল অভিমান, সকল দুঃখ, সকল শ্রদ্ধা, সকল ভক্তি জগতের নয় প্রকার রসে উৎপন্ন যত ভাব আছে, তা সকলই ভগবানকে সমর্পণ করতে পারি। আমাদের সামানে দৈবদায় হিসেবে যে কর্ম উপস্থিত হয়, তা যদি নিষ্কামভাবে করে যেতে পারি ; তবে এমনিতেই ঈশ্বরের অনুভব এবং কৃপা আমাদের জীবনে আসবে। সকল সৃষ্টি, সকল ভাবের মধ্যেই তিনি আছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা তা উপলব্ধি করতে পারিনা।
ভগবানকে কিছুই দেয়ার নেই আমাদের, শুধুই প্রেম-ভক্তি ছাড়া। এ জগত ভগবানের।এর প্রত্যেকটি অণুতে পরমাণুতে তিনি বিরাজিত। জগতের সকল ঐশ্বর্যের অধিপতি তিনি, তাই তাঁর নাম ভগবান। অনন্যচিত্তে তাঁর স্মরণ নিয়ে, শুদ্ধতর প্রেম-ভক্তির মাধ্যমে যদি তাঁর আপনজন হয়ে উঠতে পারি ; তবে সকল কিছুই সম্ভব। এ অবস্থায় তিনি ভক্তের আকাঙ্ক্ষিত সকল কিছুই শুধু দানই করেন না ; নিজে পিঠে বহনও করে চলেন, ভক্তের বোঝা। ভক্তের ভক্তি যদি পাকা হয়, তবে ভক্তের বোঝাও ভগবান বহন করেন। অসংখ্য উদাহরণ আছে এর জগতে। শ্রীরামপ্রসাদ সেনের জন্যে ব্রহ্মস্বরূপা মাকালী নিজে তাঁর মেয়ে হয়ে এসে ঘরের বেড়া বেঁধে দিয়ে গেছেন। ভক্তের অনন্য ভক্তিতে ভগবান বদ্ধ। ভারতবর্ষের সাধক সাধিকাদের জীবনে এমন অসংখ্য দৈবঘটনা দেখা যায়।
এমনি আরেকটি ঘটনা, দরিদ্র ব্রাহ্মণ ভক্ত অর্জুন মিশ্রের জীবনে দেখা যায়।তাঁর জন্যে ভগবান নিজে বলরাম সহ সাকার রূপে এসে; পিঠে করে খাবারের বস্তা বহন করে অর্জুন মিশ্রের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, পরম ভক্ত হয়েও তাঁর শ্রীমদ্ভগবদগীতার একটি শ্লোকের প্রতি অবিশ্বাস হয়েছিল। সে অবিশ্বাসকে দূর করতেই লীলাময় ভগবান ভক্তের সাথে লীলাটি করেন।সে সময়ে প্রিন্টিং প্রেস ছিল না, সকল গ্রন্থই হাতে লেখা হত। এ হাতে লেখা গ্রন্থগুলোকে হস্তলিখিত পুঁথির বলা হত। তখন হাতে লিখেই সকল গ্রন্থের অনুলিপি করে নিতে হত। পণ্ডিত অর্জুন মিশ্র একদিন শ্রীমদ্ভগবদগীতা অনুলিপি করতে গিয়ে নবম অধ্যায়ে এসে সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে যান। তিনি দেখলেন নবম অধ্যায়ের বাইশ নম্বর শ্লোকে, 'যোগক্ষেমং বহাম্যহম্' লেখা।
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৯.২২)
"যে সকল ভক্তগণ অনন্যচিত্ত হয়ে সর্বদা আমাকে উপাসনা করে; আমাতে নিত্য অনন্যচিত্ত সে সমস্ত ভক্তের যোগ ( প্রয়োজনীয় অলব্ধ বস্তুর সংস্থান) এবং ক্ষেম ( লব্ধ বস্তুর সংরক্ষণ) আমিই বহন করে থাকি।"
এ শ্লোকে ভগবান বলেছেন, অনন্যচিত্ত হয়ে যে সর্বদা ভগবানকে উপাসনা করে; সে সমস্ত ভক্তের প্রয়োজনীয় অলব্ধ বস্তুর সংস্থান এবং লব্ধ বস্তুর সংরক্ষণ সকলই তিনি বহন করে থাকেন। পণ্ডিত অর্জুন মিশ্র চিন্তা করলেন, ভগবান কি করে বহন করবেন। তিনি তো জীবকে সকল অলব্ধ বস্তু দান করবেন। জীবের সকল প্রয়োজনীয় বিষয় তিনি কেন বহন করবেন? এ চিন্তা করে তিনি শ্লোক থেকে 'বহাম্যহম্' শব্দটি কেটে 'দদাম্যহম্' শব্দটি বসিয়ে দেন। এর প্রেক্ষিতে অর্থ সম্পূর্ণ পাল্টে যায়; ভগবান ভক্তের বোঝা বহন করেনের বদলে হয়ে গেল, তিনি ভক্তকে দান করেন।
এরমধ্যেই অর্জুন মিশ্রের স্ত্রী তাঁকে বলে ঘরে কোন খাবার নেই, বাইরে গিয়ে কিছু ভিক্ষা করে নিয়ে আসতে। অর্জুন মিশ্র ভিক্ষার সন্ধানে বের হলেন। অর্জুন মিশ্র ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার কিছু পরেই অপূর্ব সুন্দর দুটি বালক এসে বিভিন্ন রকমের খাবারের বস্তা পিঠে করে বয়ে নিয়ে এসে হাজির হয়। অর্জুন মিশ্রের স্ত্রী হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, বাবা তোমরা কোথা থেকে এসেছ? তখন সুদর্শন বালক দুটি বলে, আমরা রাজবাড়ী থেকে এসেছি; পণ্ডিত অর্জুন মিশ্র আমাদের এগুলো পাঠিয়ে দিয়ে বললেন তাঁর ঘরে পৌছে দিতে। তাই আমরা তাঁর ঘরে পৌঁছে দিচ্ছি। মিশ্রের স্ত্রী লক্ষ্য করলেন, ছেলেদুটির পিঠ থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বাবারা তোমাদের পিঠ থেকে রক্ত কেন পড়ছে? বালক দুটি তখন বললেন, আমরা নাকি ভার বহন করতে পারিনা, তাই অর্জুন মিশ্রই আমাদের পিঠে আঘাত করে ক্ষত করে দিয়েছেন। তাঁর আঘাতেই আমাদের পিঠ থেকে রক্তপাত হচ্ছে। আপনিই তো স্বচক্ষে দেখলেন, আমরা ভার বইতে পারি, তাই গৃহে এসে খাবারের বস্তা বহন করে দিয়ে গেলাম। আপনার স্বামী গৃহে আসলে তাঁকে কথাটি বলবেন।
ব্রাহ্মণী খুবই বিস্মিত হলেন, অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের তাঁর স্বামী কি করে এই নিস্পাপ বালকদের গায়ে আঘাত করতে পারে? তিনি ভাবলেন অভাবের তাড়নায় তাঁর স্বামীর মাথা বুঝি নষ্টই হয়ে গেছে। দুপুরের পরে ভগ্নহৃদয়ে অর্জুন মিশ্র তাঁর গৃহে আসলেন। এসেই ঘরের দাওয়ায় বসে স্ত্রীকে বললেন, আজ সারাদিন এত ঘুরেও কিছুই ভিক্ষা পেলাম না। আজ হয়ত উপবাস করেই কাটাতে হবে।
মিশ্রের কথা শুনে স্ত্রী হতবাক হয়ে বলে, কি বল তুমি? তুমিই তো দুটি বালকের পিঠে সকল খাবার পাঠিয়ে দিয়েছ, তারা বললো, তারা রাজবাড়ী থেকে এসেছে। একজন কালো এবং অন্যজন ধবধবে সাদা; অপূর্ব মনোহর তাঁদের মুখখানা। স্ত্রীর কথাগুলো শুনে অর্জুন মিশ্রের শ্লোকে 'বহাম্যহম্' শব্দটি কেটে 'দদাম্যহম্' করার কথা মনে পড়ে যায়। তাঁর চোখ আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে যায়। স্ত্রীকে খুলে বলেন সকল ঘটনা। তখন দুজনে বুঝতে পারেন, এ অপূর্ব দর্শন বালক দুটি আর কেউ নয়; তাঁরা হলে শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীবলরাম ভাত্রিদ্বয়। বিরামহীন চোখের জলে ভিজে যায়, তাঁর বস্ত্র। তখন অর্জুন মিশ্র বুঝতে পারেন ভগবানের পিঠে রক্তাক্ত হয়ে যাওয়ার কারণ তিনিই।তিনিই না বুঝে 'বহাম্যহম্' শব্দটি কেটে দিয়েছে। সকল ভুল বুঝতে পেরে অর্জুন মিশ্র তাঁর নিজের লেখা 'দদাম্যহম্' শব্দটি কেটে সে স্থানে তিনবার 'বহাম্যহম্' শব্দটি লিখে দিয়ে ভগবানের কাছে অপরাধ মার্জনা করেন।
প্রেমময় ভগবানকে আমরা অধিকাংশই সর্বস্ব আত্মসমর্পণ করে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারিনি। পারিনি বলেই আমরা তাঁর বড় কাছের আপনজন হতে পারেনি।ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ ভগবান জীবের কাছে কিছুই চান না; শুধু তাঁর প্রতি অহৈতুকী প্রেম-ভক্তি ছাড়া। এ জগত তাঁর, জগতের সকল ঐশ্বর্যও তাঁর। তিনি 'ভাবগ্রাহী জনার্দন', আমরা শুধু দিতে পারি আমাদের ভেতরের শুদ্ধ ভাবকে।যতটুকুই আমরা ভগবানকে দিব, ততটুকুই হিরণ্ময় রূপে আমাদের আছে ফিরে আসবে। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'কৃপণ' কবিতায় অত্যন্ত সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন। রাজপথে এক অজানা রহস্যময় ভিখারি "আমায় কিছু দাও গো"বলে ভিক্ষা চাইলো এক ভিক্ষুকের কাছে। ভিক্ষুক নিজেই তো ভিক্ষা করে বেড়ায়, কি আর তাঁকে দিবে! তখন ঝুলি থেকে একটি ছোট্ট কণা তাঁকে দেয়। পরে ভিখারি বাসায় এসে দেখলেন যে ছোট্ট কণাটি তিনি দান করেছেন। সেই কনাটিই স্বর্ণময় হয়ে তার ভিক্ষাপাত্রে জ্বলজ্বল রয়েছে। তখন তার উপলব্ধি হয়, সকল শূন্য করে কেন তিনি সর্বস্ব দিতে পারেননি। তাহলে সর্বস্বই তার স্বর্ণময় হয়ে যেত। কবিতাটি রূপক হলেও, এর তত্ত্বটি অনেক গভীরে ;এরমধ্যে অনেক ভাব অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছে।
"দিলেম যা রাজ-ভিখারীরে
স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে,
তখন কাঁদি চোখের জলে
দুটি নয়ন ভরে--
তোমায় কেন দিই নি আমার
সকল শূন্য করে।"
ভগবানকে আমরা আমাদের জীবনের নিশ্চিত ধ্রুবতারা মনে করে, তাঁকে সর্বদা অনুসরণ করি না বা করতে পারিনা।শুধু বিপদেই তাঁকে আমাদের মনে পড়ে, বিপদ কেটে গেলে আবার তথৈবচ অবস্থা। লক্ষ্য ঠিক না থাকলে, কোনদিনও গন্তব্যে পৌছানো যায় না। আমরা গন্তব্যে যেতে পারি না, কারণ আমাদের লক্ষ্য নির্দিষ্ট নয়। এ কারণেই পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে থাকি পথে। যখন হাসপাতালে মানুষের রোগব্যাধি দুঃখ দুর্দশা দেখি অথবা শ্মশানে মৃত মানুষকে দেখি তখন সাময়িক আমাদের ভগবানের স্মরণ হয়। পরক্ষণেই মায়ার প্রবঞ্চনায় সকলই ভুলে গিয়ে আমি এবং আমিত্ব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ভগবানকে যদি জীবনের ধ্রুবতারা করতে পারি, তবে কখনও জীবন সমুদ্রে আমরা পথহারা হব না। তিনি সর্বদাই জীবনে প্রকাশিত থেকে তাঁর অমৃত কিরণধারায় দীপ্ত করবেন।
"তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।
যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো,
আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা।।"
ভগবানকে জীবনের ধ্রুবতারা নির্দিষ্ট করে, অনন্যচিত্তে তাঁকে স্মরণ নিতে হবে, তবেই তিনি কৃপা করবেন। আমাদের সকল ভার বহন করবেন। অনন্যচিত্তে স্মরণ নিলে তিনি কৃপা করবেনই। যেহেতু তিনি শ্রীমদভগবদগীতাতে কথা দিয়েছেন, তাঁর কথা অব্যর্থ। এরপরেও আমরা তাঁকে ডাকার সময় পাই না। বিষয়টি নিয়ে ভক্তকবি রজনীকান্ত সেনের অপূর্ব একটি সংগীত আছে।
"আমি সকল কাজের পাই হে সময়
তোমারে ডাকিতে পাই নে,
আমি চাহি দারা-সুত সুখ-সম্মিলন
তব সঙ্গ সুখ চাই নে।
আমি কতই যে করি বৃথা পর্যটন
তোমার কাছে তো যাই নে,
আমি কত কি যে খাই ভস্ম আর ছাই
তব প্রেমামৃত খাই নে।
আমি কার তরে দেই আপনা বিলায়ে
ও পদতলে বিকাই নে,
আমি সবারে শিখাই কত নীতি-কথা
মনেরে শুধু শিখাই নে।"
ভগবানকে সর্বস্ব সমর্পণ করতে পারিনা। বা প্রচেষ্টাও করি না। কারণ এ পথ অনেক কষ্টের, ত্যাগের এবং বৈরাগ্যের। তাই সকল কাজেই আমাদের সময় আছে শুধু ভগবানকে স্মরণের ক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন অজুহাত। আমরা বাহির পানে চোখ মেলেছি, কিন্তু একবারও নিজের ভেতরপানে চেয়ে দেখি না। যিনি পরম বন্ধু স্বরূপে আমাদের রক্ষা করেন। দ্রৌপদী কৌরব রাজসভায় যতক্ষণ নিজে তাঁর শাড়িটিকে যথাসাধ্য রক্ষার চেষ্টা করেছেন, ততক্ষণই তাঁর দেহ থেকে শাড়ি খুলে গিয়েছে। যখন অসহায় হয়ে ভগবানের কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেছেন; তখনই অনন্ত শাড়ির যোগান চলে এসেছে তাঁর দেহে। কৌরবেরা হাজার চেষ্টা করেও তাঁকে বস্ত্রহীন করতে পারেনি। ভগবানের প্রতি দ্রৌপদীর সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ কৌরবদের সকল দুষ্ট প্রচেষ্টাকে ব্যার্থতায় পর্যবসিত করেছে। দ্রৌপদীর মত এমন আত্মসমর্পণ আমাদের প্রয়োজন, তবেই ভগবান আমাদের সকল কিছুই বহন করবেন। শুধু ছোট্ট একটি শর্ত, তাঁকে অনন্যচিত্তে স্মরণ করতে হবে, ভালবাসতে হবে।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়