-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

যে শুয়ে থাকে,তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে; যে এগিয়ে যায়,তার ভাগ্যও এগিয়ে যায়


জীবন মানেই চলা, থেমে যাওয়ার নামই মৃত্যু। তাই মানুষকে আমৃত্যু ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছাতেই হোক চলতেই হয়।আমরা চলতে চলতে হয়ত বিভিন্ন স্টেশনে সাময়িক স্বল্প সময়ের জন্যে বিরতি দেই,পরক্ষণেই আবার চলতে হয়। ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম যেতে হলে সম্পূর্ণ সময়টা ট্রেনে বসেই থাকতে হবে। ট্রেন থেকে নেমে গেলে, আর গন্তব্যে যাওয়া হবে না।মানবজীবনের এ আমৃত্যু প্রবাহমানতা নিয়ে অসংখ্য বাউল কবিরা গান তৈরি করেছেন।দেহের এ আমৃত্যু নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহমানতাকে কেউ ঘড়ির সাথে, কেউ গাড়ির সাথে, কেউ আবার মাটির প্রদীপের সাথে তুলনা করেছেন।এর মধ্যে আব্দুর রহমান বয়াতির, পরমায়ুকে চাবির সাথে তুলনা করে এবং দেহকে ঘড়ির সাথে তুলনা করে অত্যন্ত সুন্দর একটি গান আছে। দেহঘড়িটি আমৃত্যু চলতেই থাকে, এর থেমে যাওয়াকেই মৃত্যু বলে।
"একটা চাবি মাইরা দিলা ছাইড়া,
জনম ধরে চলিতে আছে,
মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি,
কোন মিস্ত্ররী বানাইয়াছে।
মাটির একটা কেস বানাইয়া
মেশিন দিলো তার ভিতর,
ওরে, রং বেরংয়ের বার্নিশ করা
দেখতে ঘড়ি কি সুন্দর।"
ট্রেনে করে যদি আমরা গন্তব্যে যেতে চাই, তবে সম্পূর্ণ সময়টা আমাদের ট্রেনেই বসে থাকতে হবে।আধ্যাত্মিক জগতে যদি অগ্রসর হতে চাই, তাহলে মোহনিদ্রা ত্যাগ করে আমাদের জাগ্রত হয়ে আমৃত্যু সচেষ্ট হতে হবে। থেমে গেলে চলবে না। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য -এ ছয়টিকে দেহের ষড়রিপু বলে। আমাদের মনুষ্যজীবনে ষড়রিপু একটি ফাঁদের মত, তাই এ ফাঁদে না পড়ে মুক্তির পথে অগ্রসর হতে শাস্ত্রে বিভিন্ন ভাবে বলা হয়েছে।আত্মতত্ত্বের অর্থাৎ যিনি নিজেকে জেনেছেন, সেই শ্রেষ্ঠ আচার্যের কাছে গিয়ে মুক্তির সম্যক জ্ঞান লাভ করতে বলা হয়েছে। কঠ উপনিষদ অনুসারে এ অধ্যাত্মবোধের পথটি অত্যন্ত কঠিন। এখানে অধিকারী হতে হয়। মনে চাইলাম, সন্ন্যাস নিলাম এবং মুক্ত হলাম। বিষয়টি এমন সরল নয়। অত্যন্ত কঠিন।তাই ক্ষুরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ যেমন দুরতিক্রমনীয়, এর উপর দিয়ে সহজে হেটে যাওয়া যায় না, পা কেটে রক্তপাত হয়। তেমনি আত্মবোধ লাভের পথও অত্যন্ত ক্ষুরধার এবং দুর্গম।
উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।
ক্ষুরস্যধারা নিশিতা দুরত্যয়া
দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।।
(কঠ উপনিষদ: ১.৩.১৪)

"তোমরা ওঠ, মোহ নিদ্রা ত্যাগ করে জাগ্রত হও,শ্রেষ্ঠ আচার্যের নিকট গমন করে আত্মতত্বের সম্যক জ্ঞান লাভ কর।বিবেকবান ব্যক্তিগণ বলেন, ক্ষুরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ যেমন দুরতিক্রমনীয়, আত্মজ্ঞান লাভের পথও সেইরূপ ক্ষুরধারের মত দুর্গম।"
আত্মবোধে সদা জাগ্রত থাকাটাই মুক্তির লক্ষণ। এ পথে অধিকারী হয়ে জাগ্রত হয়েও, অনেক সময়ে মানব মুক্ত হয় না। পূর্ব জন্মের প্রারব্ধকর্ম রয়ে যায়। আবার কারো পূর্বজন্মজন্মান্তরের সুকৃতির ফলে এজন্মে সামান্যতেই মুক্তি লাভ হয়। বিষয়টি নিয়ে একটি সুন্দর মর্মস্পর্শী গল্প আছে। এক ব্যক্তি বনের মধ্যে সঙ্গীদের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পথহারা হয়ে যায়। এমন সময় বনের মধ্যে অন্ধকার নেমে, রাত্রি হয়ে যায়। সে তখন চিন্তা করে এমনিতেই আজ অমাবস্যা, এরপরে রাত্রি হয়ে গেছে, এ ঘোর জঙ্গলে যেকোন অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ ঘটতে পারে। এ কথা চিন্তা করে, সে একটি বৃহৎ গাছের উপরে আশ্রয় নেয়। সারাদিন পরিশ্রান্ত থাকার কারণে, সে গাছের ডাল ধরেই ঘুমিয়ে পরে। ঠিক মধ্যরাত্রে তার ঘুম ভেঙে যায়, কিছু শব্দে। তিনি লক্ষ্য করলেন গাছের নিচে একব্যক্তি তান্ত্রিকমতে মা কালীর সাধনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সকল প্রস্তুতি নিয়ে তিনি যখন, দেবীর মন্ত্রজপ শুরু করবেন; ঠিক তখনই কোথা থেকে এক হিংস্র বাঘ এসে তাকে আক্রমণ করে এবং শরীরের কিছু অংশ খাবলে নিয়ে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে চলে যায়।
বাঘের আক্রমণে আহত ব্যক্তিটি মৃতপ্রায় হয়ে যায়।এবং ঘটনায় আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় গাছের উপরের ব্যক্তিটি। কিছু পরে বাঘটি কি মনে করে, লোকটিকে সম্পূর্ণ গলাধঃকরণ না করেই চলে যায়। বাঘটি চলে যাওয়ার পরে গাছের উপরের ব্যক্তিটি সাহস করে নিচে নেমে আসে। সে শুনেছে বাঘ কখনো পেছনে আসে না, শুধুই সামনে যায়।তাই তার ধারণা হল, বাঘ আর এ পথে পিছনে আসবে না। গাছে আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিটি,গাছ থেকে নেমে আক্রান্ত মৃতপ্রায় ব্যক্তিটির কাছে যায়। মৃতপ্রায় ব্যক্তিটি গাছের উপরে মানুষটিকে দেখে হতবাক হয়। তখন গাছে আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিটি, তার গাছে আশ্রয় নেয়ার কাহিনীটি খুলে বলে।
সকল কথা শুনে তখন মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তিটি বলে, এ স্থানটি একটি মাহাত্ম্যপূর্ণ স্থান এবং আজকের তিথিটিও মাহাত্ম্যপূর্ণ। আমি সারাজীবন বিভিন্ন তান্ত্রিকদের সাথে ঘুরে এ স্থানটি এবং তিথিটির মাহাত্ম্য জানতে পেরেছে। আজকের সাধনে এক রাত্রেই মায়ের দর্শন লাভ সম্ভব। মাকে দর্শনের জন্যে আজকে সাধনার প্রত্যেকটি বিষয় এবং উপাদান আমি সংগ্রহ করেছিলাম। যা তুমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছ বাবা। শুধু একটি বিষয় সংগ্রহ করতে পারিনি, তা হল একটি শব। আমার মনে হয় আমি আর বেশীক্ষণ বাঁচব না। আমার এ সাজানো তান্ত্রিক উপাচারে, তুমি দেবীর মন্ত্রজপ কর। আমি তোমাকে মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছি। আমি মৃত্যুবরণ করলে, তুমি আমার মৃতদেহের উপরে বসেই মন্ত্রজপ করবে। মন্ত্র এবং শবসাধনার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়ে বাঘে আক্রান্ত ব্যক্তিটি মুক্তির এক অতৃপ্তি নিয়ে মৃত্যুবরণ করে।
গাছে আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিটি, মৃতব্যক্তিটির নির্দেশিত সকল নির্দেশনা অনুসরণ করে তার শবের উপরে পদ্মাসনে বসে দেবীর মন্ত্রজপ শুরু করে। আশেপাশে ভয়ংকর শব্দ হতে থাকে, কিন্তু সে একাগ্র মনে দেবীকে স্মরণ করে তাঁর সিদ্ধমন্ত্র জপ করতে থাকে। রাত্রির শেষ প্রহরে দেবী তাকে দর্শন দেন। সমস্ত বন আলোকিত হয়ে যায়। দেবীর জ্যোতিপ্রভায় চর্মনেত্রে তাকানো অসম্ভব হয়ে পরে। দেবীকালী তখন তাঁকে মুক্তির বরদান করেন। স্বল্প সময়ে একরাত্রের সাধনাতে দেবীর দর্শনে; সে আনন্দিত হয়ে ওঠে। তখন সে দেবীর কাছে জিজ্ঞাসা করে, মা আমি না চাইতেই তুই আমাকে দর্শন দিলি; মুক্তির আশ্বাসবাণী দিলি।কিন্তু মা যিনি এ সকল আয়োজন করলো তাকে কেন হিংস্র বাঘের মুখে পড়ে মৃত্যুবরণ করতে হল?
তখন দেবী স্মিত হাসি দিয়ে বললেন, বৎস তুমি এমনি এমনিতেই আজ এখানে আসোনি, আর তাকে এমনিতেই বাঘে খায়নি। তুমি কি জান যে পূর্ববর্তী কতশত জন্মে আমাকে পাবার জন্যে, সাধনা করতে গিয়ে তোমাকে এমন কত বাঘের পেটে গিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে? কত সাপে কেঁটেছে, কত বনের পশুরা হত্যা করেছে, তুমি জান না। কারণ পূর্ববর্তী জন্মের ঘটনাগুলো তোমার মনে নেই। যদি মনে থাকত তাহলে ভয়ে শিউরে উঠতে। যে মারা গিয়ে শব হয়েছে, সেও আমার দর্শন পাবে।ওর কিছু কর্মফল অসমাপ্ত আছে; তা খণ্ডিত হলেই আগামী কোন এক জন্মে সে আমার দর্শনে মুক্তি লাভ করবে।এ বলেই দেবী অন্তর্হিত হলেন।
ব্যক্তিটি তখন মৃতদেহটিকে অগ্নিসংস্কার করে তার গৃহে চলে গেছেন। তার কাছে গতরাত্রের ঘটনাগুলো সকলই একটি স্বপ্নের মত বোধ হল।এ কারণেই আশাবাদী হয়ে যার যার সাধ্যানুসারে সাধনপথে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। মুক্তি যদি তীব্র ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা থাকে, তবে কোন না কোন জন্মে সে মুক্ত হবেই। পথ কঠিন, এ মনে করে বসে থাকা যাবে না।শ্রীশঙ্করাচার্য বলেছেন, মনু্ষ্যদেহে জন্ম লাভ,সংসারবন্ধন থেকে মুক্তির ইচ্ছা ও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের সঙ্গ, এ তিনটি বিষয়ই জগতে দুর্লভ। কেউ যদি দুর্লভ মনুষ্যজন্ম ও বেদান্তে পারদর্শিতা লাভ করেও যে নিজের মুক্তির জন্যে যত্ন করে না, সেই আত্মঘাতী পুরুষ মূঢ়। সে নিজেকেই নিজে সজ্ঞানে বিনষ্ট করে।

দুর্লভং ত্রয়মেবৈতদ্দেবানুগ্রহহেতুকম্ ।
মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ ॥
লব্ধ্বা কথঞ্চিন্নরজন্ম দুর্লভং
তত্রাপি পুংস্ত্বং শ্রুতিপারদর্শনম্ ।
যস্ত্বাত্মমুক্তৌ ন য়তেত মূঢধীঃ
স হ্যাত্মহা স্বং বিনিহন্ত্যসদ্গ্রহাত্ ॥
ইতঃ কো ন্বস্তি মূঢাত্মা যস্তু স্বার্থে প্রমাদ্যতি ।
দুর্লভং মানুষং দেহং প্রাপ্য তত্রাপি পৌরুষম্ ॥

"মনু্ষ্য-জন্ম লাভ, সংসারবন্ধন থেকে মুক্তির ইচ্ছা ও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের সঙ্গ, এই তিনটি এ জগতে দুর্লভ। ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহ হলে তবে এগুলি পাওয়া যায়।
কোনও রকমে দুর্লভ নরজন্ম আর সেই জন্মে পুরুষশরীর ও বেদান্তবিচারে পারদর্শিতা লাভ করেও যে মূঢ়বুদ্ধির মানুষ নিজের মুক্তির জন্যে যত্ন করে না, সেই আত্মঘাতী পুরুষ অসৎ-বস্তু গ্রহণের ফলে নিজেকেই বিনষ্ট করে।
দুর্লভ মনুষ্যদেহ, তার ওপর আবার পুরুষশরীর পেয়েও যে নিজের স্বার্থ বুঝতে ভুল করে বসে তার থেকে বেশী নির্বোধ আর কে আছে?"
(বিবেকচূড়ামণি: ৩-৫)
কথাগুলো যেমন আধ্যাত্মিক জীবনের জন্যে প্রযোজ্য, ঠিক তেমনি জাগতিক জীবনেও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ঋগ্বেদীয় ঐতরেয় ব্রাহ্মণে এ কারণেই বারবার সকল বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে,"যে শুয়ে থাকে, তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে।"জীবনে অদৃষ্ট যেমন আছে, তেমনি অদৃষ্টই সকল কিছুর নির্ণায়ক নয়।
"যে বসে থাকে, তার ভাগ্যও বসে থাকে।যে দাঁড়ায়, তার ভাগ্যও উঠে দাঁড়ায়।যে শুয়ে থাকে,তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে।আর যে এগিয়ে যায়, তার ভাগ্যও এগিয়ে যায়। তাই এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও।"
(ঋগ্বেদীয় ঐতরেয় ব্রাহ্মণ:৩৩.৩)
কর্মহীন অদৃষ্টের আশায় বসে থাকাটা অশাস্ত্রীয়। সাধ্যমত নিষ্কাম কর্ম আমাদের প্রতিনিয়ত করে যেতে হবে। এ নিষ্কাম কর্মে মানুষের ভাগ্যের গতিপথ পরিবর্তিত হয়। তাই পূর্ববর্তী জন্মজন্মান্তরের প্রারব্ধ কর্ম, এ জন্মে নিষ্কাম কর্ম এবং দৈবানুগ্রহ ; মুখ্যত এ তিনটি বিষয়ের অধিকারী ব্যক্তিই মুক্তির পথে অগ্রসর হয়ে মুক্ত হয়।জগতে চারিপাশে আমরা যা প্রতিনিয়ত দেখি, তার সকলই সত্যি নয়, আবার যা যা দেখতে পাইনা তার সকলই মিথ্যা নয়।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁