ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে, এক নির্ভীক ক্ষণজন্মা বিপ্লবী অগ্নিশিশু ছিলেন ক্ষুদিরাম বসু। ক্ষুদিরাম বসু ১৮৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মেদিনীপুর জেলা শহরের কাছাকাছি কেশপুর থানার অন্তর্গত মোহবনী (মৌরনি) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ত্রৈলক্যনাথ বসু ছিলেন নাড়াজোল শহরের আয় এজেন্ট। তাঁর মায়ের নাম লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। তিন কন্যার পর তিনি তাঁর মায়ের চতুর্থ সন্তান। তাঁর মায়ের দুই পুত্র আগেই মৃত্যুবরণ করেন। অপর পুত্রের মৃত্যুর আশঙ্কায় তিনি তখনকার সমাজের নিয়ম অনুযায়ী পুত্রকে তাঁর বড় বোনের কাছে তিনমুঠি খুদের (শস্যের খুদ) বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। খুদের বিনিময়ে ক্রয়কৃত বলে শিশুটির নাম পরবর্তীকালে ক্ষুদিরাম রাখা হয়। খুব অল্প বয়সেই ক্ষুদিরাম বসু তাঁর মাতাপিতাকে হারিয়ে পরবর্তিতে তার বড় বোনের কাছেই লালিত পালিত হন।
ক্ষুদিরাম বসু তাঁর অবিশ্বাস্য সাহসী কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলা সহ সারা ভারতবর্ষের বিপ্লবীদের অন্যতম প্রধান আইকনে পরিণত হয়ে যান।তিনি ন্যাকামি করা সুবিধাবাদী তৈলমর্দনকারী রাজনীতির তীব্র বিরোধী ছিলেন,তাই তো তিনি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ তৎকালীন কংগ্রেসে মধ্যপন্থী ব্রিটিশ দালালী মার্কা রাজনীতির তীব্র বিরোধী ছিলেন। তিনি চাইতেন সশস্ত্র পন্থায় ব্রিটিশদের ভারতবর্ষ থেকে তাড়াতে।
বঙ্গভঙ্গ পরবর্তীকালে স্বদেশী বিপ্লবী আন্দোলনের সদস্যদের নির্মমভাবে দমন ও নিপিড়ন শুরু করে কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড। কিংসফোর্ডের নির্মম দমননীতির কারণে, অতিদ্রুতই স্বদেশীদের কাছে তিনি অত্যন্ত ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়ে যান। এর প্রতিরোধকল্পে যুগান্তর বিপ্লবীদল ১৯০৮ সালে তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং এ হত্যার দায়িত্ব অর্পিত হয় প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসুর উপরে।
কিছু ঘটনার পপরম্পরায় ব্রিটিশ সরকার কিংসফোর্ডকে কলকাতা থেকে মুজাফ্ফরপুরে সেশন জাজ হিসেবে বদলি করে দেয়। প্রফুল্ল চাকী এবং ক্ষুদিরাম বসু ৩০ এপ্রিল স্থানীয় ইউরোপীয় ক্লাবের গেটের কাছে একটি গাছের আড়ালে অতর্কিত আক্রমণের জন্য অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু কিংসফোর্ডের গাড়ির মত অন্য একটি গাড়িতে তারা ভুলবশত বোমা নিক্ষেপ করে ফেলে। আক্রমণে গাড়ির ভেতরে একজন ইংরেজ মহিলা ও তার মেয়ে মারা যায়। ঘটনার ধারাবাহিকতায় ক্ষুদিরাম ওয়ানি রেলস্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পরে যায় ।তিনি বোমা নিক্ষেপের সমস্ত দায়িত্ব নিজের উপর নিয়ে, অপর কোন সহযোগী বিপ্লবীর নাম-পরিচয় দিতে বা কোনো গোপনতথ্য দিতে অস্বীকার করেন। ক্ষুদিরামকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে মুজাফ্ফরপুর কারাগারে ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তিনি সহাস্যমুখে নির্ভীকচিত্তে গীতার আত্মতত্ত্বে উক্ত আত্মার অবিনাশীতাকে স্মরণ করে ফাঁসির মঞ্চে আত্মাহুতি দেন দেশমাতৃকার জন্যে। তিনি জানতেন আত্মা অবিনাশী, তাকে ধ্বংস করা যায় না। তাঁর বিশ্বাস ছিল,যতদিন এ ভূখণ্ড বিদেশীদের থেকে স্বাধীন না হবে, ততদিনই এ মাতৃভূমিতে তিনি ফিরেফিরে আসবেন।
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্ণাতি নরোঽপরাণি৷
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা-
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী৷৷
নৈনং ছিন্দন্তি শাস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ৷
ন চৈনং ক্লেদযন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:২.২২-২৩)
" মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নূতন বস্ত্র পরিধান করে, তেমনি আত্মাও জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীর গ্রহণ করে।
আত্মাকে শস্ত্রের দ্বারা ছেদন করা যায় না, অগ্নিতে দগ্ধ করা যায় না, জলে ভেজানো যায় না এবং বায়ু তাকে শুষ্ক করতে পারে না।"
আত্মাকে শস্ত্রের দ্বারা ছেদন করা যায় না, অগ্নিতে দগ্ধ করা যায় না, জলে ভেজানো যায় না এবং বায়ু তাকে শুষ্ক করতে পারে না।"
শুধু ক্ষুদিরাম বসু নয়, বিপ্লবী স্বদেশী অধিকাংশদেরই সহায় ছিল শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বর্ণিত আত্মতত্ত্ব। ব্রিটিশরা এ কারণেই যেখানে গীতা পেতেন, মনে করতেন এখানে একটি স্বদেশী আছে। সারা পৃথিবীতে বিস্তৃত ব্রিটিশের সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত হত না, সেই ব্রিটিশ শুধু ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনের মত বিপ্লবীদের কাছে অসহায় হয়ে যায় ; শুধু তাঁদের মনবলের কারণে। মানুষের শক্তি তার দেহে যতটা দৃশ্যমান ; অদৃশ্য হয়ে মনজগতে ততটাই বিস্তৃত। শুধু সাহস নিয়ে দাড়িয়ে গেলেই হয়। বিপ্লবীরা যখন উপলব্ধি করেছে, আত্মা অবিনাশী, দেহের মৃত্যুতেও আত্মার বিনাশ হয় না; তখন তাঁরা সামনে যতবড়ই ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদী হানাদার হোক, সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। এর পরিণামেই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশেরা এ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ঘরে বসে চরকায় সুতা কেটে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়নি, হয়েছে ক্ষুদিরামদের মত অসংখ্য বিপ্লবীদের আত্মত্যাগে। শ্রীমদ্ভগবদগীতাই তাঁদের শিখিয়েছে, প্রত্যেকটি মানুষের অন্তঃস্থিত আত্মাকে শস্ত্রের দ্বারা ছেদন করা যায় না, অগ্নিতে দগ্ধ করা যায় না, জলে ভেজানো যায় না এবং বায়ু তাকে শুষ্ক করতে পারে না। আত্মাকে যেহেতু কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করা যায় না, তবে কিসের মৃত্যুভয়?
অগ্নিশিশু ক্ষুদিরামের আত্মাহুতিতে সারা বাংলায় দাবানলের মত ছড়িয়ে পরে ব্রিটিশ বিরোধী অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। সেই সময়ে বাকুড়ার পীতাম্বর দাস নামের এক চারণকবি লিখলেন এক অমর গীত
"একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি।"এ গানটি শুধুমাত্র গান নয় ; ক্ষুদিরাম পরবর্তীকালে হয়ে উঠে বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্র।প্রায় শতবছর পরে আজও আমরা এ গানটির দ্বারা সমান প্রভাবিত এবং উদ্দীপ্ত হই। ক্ষুদিরামের হামলা, মামলা সহ সকল ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ আছে গানটিতে। সাথে আছে, পরাধীন মাতৃভূমিতে আবার জন্ম নেয়ার সংকল্প।
"একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি।"এ গানটি শুধুমাত্র গান নয় ; ক্ষুদিরাম পরবর্তীকালে হয়ে উঠে বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্র।প্রায় শতবছর পরে আজও আমরা এ গানটির দ্বারা সমান প্রভাবিত এবং উদ্দীপ্ত হই। ক্ষুদিরামের হামলা, মামলা সহ সকল ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ আছে গানটিতে। সাথে আছে, পরাধীন মাতৃভূমিতে আবার জন্ম নেয়ার সংকল্প।
"একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি,
হাসি হাসি পরব
ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী।।
কলের বোমা তৈরি করে
দাঁড়িয়ে ছিলেম রাস্তার
ধারে মাগো,
বড়লাটকে মারতে গিয়ে
মারলাম আরেক ইংল্যান্ডবাসী।।
শনিবার বেলা দশটার পরে
জজকোর্টেতে লোক না ধরে, মাগো
হল অভিরামের দ্বীপ চালান
মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি।
দশ মাস দশদিন পরে
জন্ম নেব মাসির ঘরে, মাগো
তখন যদি না চিনতে পারিস
দেখবি গলায় ফাঁসি।।"
ফাঁসির মঞ্চেও তাঁরা জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন। যার প্রেরণায় আজও আমরা তাদের স্মরণ করি। জীবনে যারা কোনমনে বাঁচতে চায়, এরা বাঁচতে পারে না। জগত এদের কোনদিনই মনে রাখে না। কিন্তু যাঁরা বাঁচা-মরাকে তোয়াক্কা না করে সামনে এগিয়ে যায়; তাঁরাই অনন্তকাল মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকে। তাঁদেরই মানুষ প্রতিদিন স্মরণ করে।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়