গন্ধবণিকের গন্ধেশ্বরী
দেবী গন্ধেশ্বরী হলেন আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গারই চতুর্ভুজা রূপ। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমার পবিত্র তিথিতে বাঙালি গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের মানুষেরা দেবীর আরাধনা করে থাকেন। ব্যবসায়ীগণ তাঁদের ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত হিসাবের খাতা, পরিমাপক যন্ত্রসহ বিবিধ সামগ্রী দেবীর সম্মুখে রেখে তাঁদের ব্যবসায়ের সমৃদ্ধি প্রার্থনা করেন। বাংলায় গন্ধ বণিক সম্প্রদায় অনেক পুরাতন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েনের ভ্রমণ বিবরণীতেও এই বঙ্গীয় গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের দেখা মেলে। গন্ধবণিক সম্প্রদায় হলেন তারা যারা পরম্পরাগতভাবে বিবিধ প্রকারের সুগন্ধি দ্রব্যাদির ব্যবসা করেন। তারা এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনিসহ বিবিধ প্রকারের সুগন্ধি মশলা; সিঁদুর, কুমকুমসহ নারীর বিবিধ প্রসাধনী; চন্দন কাঠ, কর্পূর, অগুরু, গুগগুল, সুগন্ধি ধূপ, হরিণের দেহজাত কস্তুরীসহ বিভিন্ন প্রকারের মশলা এবং সুগন্ধি দ্রব্যাদির ব্যবসা করে। এ বৈশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের কুলদেবী হলেন সিংহবাহিনী দেবী গন্ধেশ্বরী। দেবীর গন্ধেশ্বরী নামের অন্যতম দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত সাধারণ দৃষ্টিতে সুগন্ধি দ্রব্যাদির ব্যবসা বাণিজ্য যারা করতেন, সেই সকল বণিকেরা তাঁদের ব্যবসার বাণিজ্যের প্রসার এবং সংরক্ষণের জন্য দেবীর পূজা করতেন। তাই দেবীর নাম গন্ধ দ্রব্যাদির অধিশ্বরী গন্ধেশ্বরী। দেবীর গন্ধেশ্বরী নামের দ্বিতীয় আরেকটি কারণ হল, দেবী গন্ধরূপা পৃথিবীর অধিশ্বরী। গন্ধকে বলা হয় পঞ্চভূতের ক্ষিতি তত্ত্বের সমষ্টিগত রূপ বা পৃথিবী। গন্ধযুক্তা, গন্ধস্বরূপিণী, গন্ধপ্রসবিনী গন্ধেশ্বরী দেবী পৃথিবীরূপা। জীব শরীরে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক, জিহবা এ পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের পাঁচটি উপলব্ধি বা অনুভব রয়েছে। পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাথে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এ পাঁচটি তন্মাত্র রয়েছে। ক্ষিতি বা পৃথিবী তত্ত্বে শব্দ,স্পর্শ, রূপ,রস এবং গন্ধ এ পঞ্চ তন্মাত্রেরই উপস্থিতি রয়েছে। ঋগ্বেদ সংহিতায় শিবকে সুগন্ধিরূপ পৃথিবীর পুষ্টিবর্ধনকারী এবং বেঁচে থাকার জন্য সুন্দর পরিবেশ ও পুষ্টিকর খাদ্যের পরম দাতা বলে অবিহিত করা হয়েছে।
ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবিদর্দ্ধনম্।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাৎ।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা:০৭.৫৯.১২)
"অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বা জন্ম,জীবন ও মৃত্যু -এ ত্রয়ীদ্রষ্টা রুদ্ররূপ হে পরমেশ্বর, তোমার বন্দনা করি।তুমি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সুন্দর পরিবেশ ও পুষ্টিকর খাদ্যের দাতা।পাকা উর্বারুক ফলের ন্যায় আমরা যেন পূর্ণায়ু পেয়েই মৃত্যুর বন্ধন হতে মুক্ত হতে পারি। তোমার অমৃতরূপ হতে যেন বঞ্চিত না হই।"
বণিক কুলের কুল দেবী সিংহবাহিনী দেবী গন্ধেশ্বরী ত্রিনয়নী, চতুর্ভুজা, চারহাতে শঙ্খ,চক্র, ধনুক এবং বাণ ধারণ করে আছেন। বৈশাখের পূর্ণিমা যে পূর্ণিমাকে বুদ্ধ পূর্ণিমা নামেও অবিহিত করা হয় সেই পূর্ণিমা তিথিতে হিন্দু- বৌদ্ধ বঙ্গের বণিক সমাজ দেবীর পূজা করে থাকে। দেবী গন্ধেশ্বরীর ধ্যানমন্ত্র হল:
ওঁ সিংহস্থা শশিশেখরা মরকতপ্রেক্ষা চতুর্ভির্ভুজৈঃ ।
শঙ্খং চক্র- ধনুঃশরাংশ্চ দধতী নেত্রৈস্ত্রিভিঃ শোভিতা ।।
আমুক্তাঙ্গদহার- কঙ্কণরণৎ- কাঞ্চীক্কণন্নূপুরা ।
দুর্গা দুর্গতিহারিণী ভবতু নো রত্নোল্লসৎকুণ্ডলা ।।
"দেবী গন্ধেশ্বরী সিংহারুঢ়া , ললাটে চন্দ্রকলা যুক্তা , মরকত মনির ন্যায় প্রভাময়ী , চারহাতে শঙ্খ , চক্র, ধনুর্বাণধারিণী। তিনি ত্রিনয়ন শোভিতা। কেয়ূর হার , বলয় , শব্দায়মান মেখলা এবং পায়ে ঝংকৃত নূপুর পরিহিতা । রত্নের মতো উজ্জ্বল কুণ্ডল দ্বারা ভূষিতা, সেই দেবী দুর্গা আমাদের সকল দুর্গতি বিনাশ করুন।"
দেবী গন্ধেশ্বরী যে স্বয়ং দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা এ বিষয়টি দেবীর ধ্যানমন্ত্রের শেষপাদেই সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, "দুর্গা দুর্গতিহারিণী"। দেবী গন্ধেশ্বরী 'গন্ধাসুরনাশিনী', অর্থাৎ তিনি বাণিজ্যে বণিকের অসুররূপ সকল প্রকারের বাধাবিপত্তি বিনাশ করেন ।
গন্ধেশ্বরী জগন্মাত গন্ধাসুর নাশিনী।
বানিজ্য সম্পদ প্রদে দেবী মহামায়ে নমঽস্তুতে।।
আদ্যাশক্তি মহামায়ার দুটি প্রধান রূপ জগদ্ধাত্রী দুর্গা এবং ধনপ্রদাত্রী লক্ষ্মীর মিশ্ররূপ গন্ধেশ্বরী। বৈশ্য বণিকদের কাছে যেমন ধনের প্রয়োজন, তেমনি ধনের সংরক্ষণও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই মহামায়া মহাশক্তির দুইরূপের মিশ্রণে কল্পিত হয় বৈশ্য বণিকের আরাধ্যা দেবী গন্ধেশ্বরী। দেবী অচিন্ত্য, তাঁর কোন সুনির্দিষ্ট মূর্তি নেই। ভক্তই তাঁকে বিবিধরূপে বিবিধ মূর্তিতে কল্পনা করে আরাধনা করে। আদতে তিনি এক এবং অদ্বিতীয়াই শুধু নন, তিনি জীবের চিন্তার অতীত।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : গন্ধবণিকের গন্ধেশ্বরী, আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গারই চতুর্ভুজা রূপ।
ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook