-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

একান্নবর্তী পরিবার।

একান্নবর্তী পরিবার।  একান্নবর্তী পরিবার বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের পারিবারিক জৌলুশ এবং ঐক্যবদ্ধতা দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। এর বিপরিতে ছোট ছোট অণু পরিবারের উৎপত্তি হচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবার বড় হওয়া কোন ব্যক্তির মানসিকতা অনেক প্রশস্ত হয়। সকলের সাথে মিলেমিশে থাকাটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। একান্নবর্তী পরিবারে দাদু, ঠাকুমা, জেঠা, জেঠিমা, কাকা, কাকিমা সকলেই থাকে। এদের প্রত্যেকেরই আলাদা নামে ডাকা হত। ডাকগুলো যে কত মধুর, তা আজ ভাবলে চোখের সামনে ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে দেখে শুধু মনে হতাশা চলে আসে। বাবার মা ঠাকুমাকে ঠাকুরদিদি বা ঠানদিদি; জেঠিমা কাকিমাদের বড়মা, ছোটমা, মামনি, মণিমা, রাঙামা, সোনামা, লক্ষ্মীমা ; বৌদিদের বড় বৌদি, ছোট বৌদি, রাঙা বৌদি অথবা দেবর-ননদদের ঠাকুরপো, ঠাকুরঝি কত নামে ডাকা হত। পরিবারের পুরুষ বয়োজ্যেষ্ঠদের রাঙা কাকু, সোনা কাকু, ফুল কাকু, রাগী জেঠু, বড় দাদু, ছোট দাদু ইত্যাদি কত নামের কত ভালোবাসা কত বন্ধন। শ্বশুরকে ঠাকুরকর্তা, শ্বাশুড়িকে ঠাকুরকর্ত্রী। এর বিপরীতে আজ শহরের অণু পরিবারে বাবা-মা আর হয় একা অথবা দুইভাইবোন। এই শহরের ছেলেমেগুলো মামনি, মণিমা, রাঙামা, সোনামা, লক্ষ্মীমা দূরে থাক তারা কে মাসি, কে মামি, কে পিসি তাও অনেকে ভালো করে বুঝতে পারে না।এরা শুধু দুটি শব্দই জানে পুরুষদের 'আঙ্কেল' এবং মহিলাদের 'আন্টি'। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং পরিহাসের। এভাবেই হারিরে যাচ্ছে এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতি। এবং সেই স্থানে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে বৈদেশিক সংস্কৃতি। বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী ভাষা সংস্কৃতি প্রতিনিয়তগ্রাস করেছে এদেশীয় সংস্কৃতিকে। সেই অভিঘাতে একান্নবর্তী 'আমাদের' থেকে আমরা কবে যে শুধুই 'আমি এবং আমি' হয়ে গেলাম, তা হয়ত নিজেরাও টের পাইনি। অবশ্য টের পাবই বা কি করে, আমরা তো এগোনোর নামে শুধুই দৌড়াচ্ছি। অথচ মাঝে মাঝে একবারও পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি না যে কতটা এগোতে পারলাম এবং কতটা পিছিয়ে। হয়ত আমি মনে করছি, নগরায়নের নামে সভ্যতার নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই নৌকার সহবস্থান, মানবিকবোধ, মিত্রতা, পারিবারিক সম্প্রীতি নামক যাত্রী যে খুঁটিতে বাঁধা আছে তা হয়ত ঘুণাক্ষরেও টেরও পাচ্ছি না। শহরায়নের নামে কতগুলো ইট, বালু, সিমেন্টের তৈরি কংক্রিটের বস্তিতে পরিণত হচ্ছি আমরা। এ কংক্রিটের বস্তিতে বসবাস করে আমাদের মনও কংক্রিটের মত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। "এরপর, কোথায় যাবে তোমরা? নগরায়ণের নামে, অজানা উল্টারথে চলছি আমরা, গন্তব্য যার ধ্বংস রুদ্রের আসন। প্রলয়ের রথে চলছি অবুঝ শিশু হয়ে আমাদের সাথে যাবে? তোমাদের সাথি করে নিতে চাই, যেতে না চাইলেও তোমাদের যেতে হবে, আমাদের সাথে। ধ্বংসের নিষ্ঠুর শোভাযাত্রায়।" আজ পরিবার গুলো ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যাচ্ছে সর্বনাশের পথে। এই ভাঙা অণু পরিবারের মাঝে যে কত শিশুর একাকিত্বের যন্ত্রণা রয়েছে তা হয়ত অনেকে কখনো ভেবেও দেখেনি। একান্নবর্তী পরিবারে সে খেলার সঙ্গী পেত, কথা বলার সঙ্গী পেত দাদু ঠাকুমার গল্পের ঝুলি উজার করে গল্প শুনতে পারত। এভাবে শৈশব, কৈশোর, বয়ঃসন্ধির সময়গুলো আরও সুন্দর হতে পারত, আরও রঙিন হতে পারত। কিন্তু পরিবারের থেকে কেড়ে নেয়া সুন্দর শৈশব, কৈশোর, বয়ঃসন্ধির সময়গুলোতে সে পেয়েছে সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসেবে হাতে মোবাইল। এ মোবাইলে বিভিন্ন প্রকারের গেম খেলে, কার্টুন দেখে বা বিভিন্ন প্রকারের ভিডিও দেখে সে তার একটি স্নিগ্ধ শৈশব- কৈশোর পাচ্ছে কি? না পাচ্ছে না, একদমই পাচ্ছে না। দুধের সাধ কখনো ঘোলে মিটে না।পৃথিবী তাঁর হৃত যৌবন ফিরে পাবে, কালের নিয়মে। কিন্তু আমরা আমাদের সেই একান্নবর্তী পরিবারের স্নেহ, মায়া, মমতার আঁচল কি আর ফিরে পাবো? এ প্রশ্নের উত্তর হয়ত আমাদের জানা নেই। কোন পরিস্থিতিতেই কখনো আত্মীয় পরিজন জ্ঞাতিগুষ্টিদের সাথে বিরোধ করতে নেই। বিখ্যাত যদুবংশ ধ্বংস হয়েছে, শুধুই আত্মীয় পরিজন জ্ঞাতিগুষ্টিদের সাথে বিরোধ করে। এ প্রসঙ্গে মনুসংহিতায় বলা হয়েছে: ঋত্বিক্‌পুরোহিতাচাৰ্যৈমাতুলাতিথিসংশ্ৰিতৈঃ। বালবৃদ্ধাতুরৈর্বৈদ্যৈর্জ্ঞাতিসম্বন্ধিবান্ধবৈঃ ॥ মাতাপিতৃভ্যাং যামীভির্ভ্রাত্ৰা পুত্ৰেণ ভাৰ্যয়া। দুহিত্রা দাসবর্গেণ বিবাদং ন সমাচরেৎ ॥ এতৈর্বিবাদান্ সন্ত্যজ্য সর্বপাপৈঃ প্ৰমুচ্যতে । এভিৰ্জিতৈশ্চ জয়তি সর্বান্ লোকানিমান্ গৃহী॥ (মনুসংহিতা:৪.১৭৯-১৮১) "ঋত্বিক্, পুরোহিত, আচার্য, মাতুল, অতিথি, আশ্রিত লোক, বালক, বৃদ্ধ, পীড়িত ব্যক্তি, চিকিৎসক, জ্ঞাতি, জামাতা শ্যালকাদি কুটুম্ব, মাতুল পক্ষের আত্মীয়, মাতা, পিতা, যামি (ভগিনী, ভ্রাতৃবধূ প্রভৃতি), ভ্রাতা, পুত্র, পত্নী, কন্যা ও ভৃত্যবর্গের সঙ্গে বিবাদ করবে না । এদের সঙ্গে বিবাদ পরিত্যাগ করে সকল পাপ থেকে গৃহস্থ মুক্ত হয় এবং এদের ভালোবাসা দ্বারা জয় করলে গৃহী জগতের সকলকেই জয় করতে পারে।" তন্ত্রে বলা হয়েছে, পরিবার, পরিজন, আত্মীয় স্বজনদের প্রথমে পরিবারের পালনের ব্যবস্থা করতে হবে, কিন্তু পরিবার যদি অর্থনৈতিক বা কোন কারণে একেবারেই অসমর্থ হয় তবে দেশের রাজা তাদের পালন করবেন। এটা পরিবারের সাথে রাজারও দায়িত্ব। মাতুর্মাতা পিতা ভ্রাতা মাতুর্ভ্রাতুঃ সুতাস্তথা । মাতুঃ পিতুঃ সোদরাশ্চ বিজ্ঞেয়া মাতৃবান্ধবাঃ ॥ পিতুর্মাতা পিতা ভ্রাতা পিতৃর্ভ্রাতুঃ স্বসুঃ সুতাঃ। পিতুঃ পিতুঃ সোদরাশ্চ বিজ্ঞেয়াঃ পিতৃবান্ধবাঃ ॥  পত্যুর্মাতা পিতা ভ্রাতা পত্যুর্ভ্রাতুঃ স্বসুঃ সুতাঃ । পত্যুঃ পিতুঃ সোদরাশ্চ বিজ্ঞেয়াঃ পতিবান্ধবাঃ ॥ পিত্ৰে মাত্রে পিতুঃ পিত্ৰে পিতামহ্যৈ তথা স্ত্ৰিয়ৈ ।  অযোগ্যসূনবে পুত্র হীনমাতামহায় চ ॥ মাতামহ্যৈ দরিদ্রেভ্য এভ্যো বাসস্তথাশনম্ । দাপয়েন্নৃপতিঃ পুংসা যথাবিভবমম্বিকে ॥ (মহানির্বাণতন্ত্র: একাদশ উল্লাস, ৫৯-৬৩) "মাতামহী, মাতামহ, মাতুল, মাতুলপুত্র এবং মাতামহ-সহোদর প্রভৃতি এরা সকলেই 'মাতৃবন্ধু'। পিতামহী, পিতামহ, পিতৃব্য, পিতৃব্যপুত্র, পিতৃষ্বস্রেয়, পিতামহ-সহোদর প্রভৃতিকে 'পিতৃবন্ধু' বলা হয়। আর স্বশ্রূ, শ্বশুর, দেবর, ভ্রাতৃশ্বশুর বা ভাশুর, ভ্রাতৃশ্বশুরপুত্র, দেবরপুত্র, ভর্তৃভগিনীপুত্র, শ্বশুরসোদর প্রভৃতিকে 'পতিবান্ধব' বলে। হে অম্বিকে! পিতা, মাতা, পিতামহ, পিতামহী, পত্নী, অযোগ্য পুত্র এবং পুত্রহীন মাতামহ, ও পুত্রহীন মাতামহী যদি দরিদ্র হয় এবং পরিবারের পালনে অসমর্থ হয়, তবে রাজা বিষয় অনুসারে এদের অন্ন বস্ত্রের ব্যবস্থা করবেন।" এই করোনাকালে একান্নবর্তী পরিবারের প্রয়োজনীয়তা হারেহারে টের পাওয়া গেছে। হাতের পাঁচটি আঙুল যেমন সমান নয়। তেমনি সংসারে সকলের উপার্জন সমান হয় না। সে উপার্জনে কম-বেশি থাকবেই। করোনাকালে ঢাকা, চট্টগ্রাম শহরের অনেক অণু পরিবার আবার নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছে। দেখা যায়, অর্থনৈতিক দূরাবস্থায় যাদের শহরে বেঁচে থাকা দায়, তারাই গ্রামের বাড়িতে দিব্যি সুখে আছে। সবাই মিলেমিশে থাকলে, সকলেই সুখে থাকতে পারে। একান্নবর্তী পরিবারের সুবিধা বা প্রয়োজনীয়তাই সেখানে। বাড়িতে অনেক ঝামেলার মাঝেও, একটা শান্তি আছে। আমরা এখনও একান্নবর্তী পরিবারের অংশ।অশান্তি হবে, ঝগড়া হবে কিন্তু পরিবার ভাঙবো না। পরিবার ভাঙায় কোন আনন্দ নেই, আনন্দ সকল বৃদ্ধির মাঝে। বাঙালি পরিবারে প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী দেবীর পাঁচালী পাঠ করা হয়।এ পাঁচালীর একটি বড় শিক্ষা হলো যৌথ একান্নবর্তী পরিবারের শিক্ষা। পাঁচালীতে বলা হয়েছে: "মিলিল ভ্রাতারা পুনঃ আর বধূগণ। সাধুর সংসার হল পূর্বের মতন।।" পরিবারের সকল সদস্য মিলেমিশে একসাথে থাকা। কিন্তু বর্তমানে নাগরিক জীবনে আমরা দিনেদিনে অত্যন্ত স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। আমাদের পূর্বের যৌথ পরিবারগুলো দিনেদিনে ভেঙে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে একটু একটু করে আমরা দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। আজও আমাদের অধিকাংশ পরিবারের সম্পত্তি যৌথ সম্পত্তি।এই যৌথ একান্নবর্তী পরিবারগুলো আমাদের শক্তির ভিত্তিমূল। তাই সেই ভিত্তিমূলকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। তবেই সেই ভিত্তিতে এক ঐক্যবদ্ধতার সুদৃঢ়, সুউচ্চ মনোরম ভবন নির্মিত হবে। শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ। ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : একান্নবর্তী পরিবার। ফেসবুক পেজ লিঙ্ক :  Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook

একান্নবর্তী পরিবার

বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের পারিবারিক জৌলুশ এবং ঐক্যবদ্ধতা দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। এর বিপরিতে ছোট ছোট অণু পরিবারের উৎপত্তি হচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবার বড় হওয়া কোন ব্যক্তির মানসিকতা অনেক প্রশস্ত হয়। সকলের সাথে মিলেমিশে থাকাটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। একান্নবর্তী পরিবারে দাদু, ঠাকুমা, জেঠা, জেঠিমা, কাকা, কাকিমা সকলেই থাকে। এদের প্রত্যেকেরই আলাদা নামে ডাকা হত। ডাকগুলো যে কত মধুর, তা আজ ভাবলে চোখের সামনে ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে দেখে শুধু মনে হতাশা চলে আসে। বাবার মা ঠাকুমাকে ঠাকুরদিদি বা ঠানদিদি; জেঠিমা কাকিমাদের বড়মা, ছোটমা, মামনি, মণিমা, রাঙামা, সোনামা, লক্ষ্মীমা ; বৌদিদের বড় বৌদি, ছোট বৌদি, রাঙা বৌদি অথবা দেবর-ননদদের ঠাকুরপো, ঠাকুরঝি কত নামে ডাকা হত। পরিবারের পুরুষ বয়োজ্যেষ্ঠদের রাঙা কাকু, সোনা কাকু, ফুল কাকু, রাগী জেঠু, বড় দাদু, ছোট দাদু ইত্যাদি কত নামের কত ভালোবাসা কত বন্ধন। শ্বশুরকে ঠাকুরকর্তা, শ্বাশুড়িকে ঠাকুরকর্ত্রী। এর বিপরীতে আজ শহরের অণু পরিবারে বাবা-মা আর হয় একা অথবা দুইভাইবোন। এই শহরের ছেলেমেগুলো মামনি, মণিমা, রাঙামা, সোনামা, লক্ষ্মীমা দূরে থাক তারা কে মাসি, কে মামি, কে পিসি তাও অনেকে ভালো করে বুঝতে পারে না।এরা শুধু দুটি শব্দই জানে পুরুষদের 'আঙ্কেল' এবং মহিলাদের 'আন্টি'। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং পরিহাসের। এভাবেই হারিরে যাচ্ছে এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতি। এবং সেই স্থানে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে বৈদেশিক সংস্কৃতি। বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী ভাষা সংস্কৃতি প্রতিনিয়তগ্রাস করেছে এদেশীয় সংস্কৃতিকে। সেই অভিঘাতে একান্নবর্তী 'আমাদের' থেকে আমরা কবে যে শুধুই 'আমি এবং আমি' হয়ে গেলাম, তা হয়ত নিজেরাও টের পাইনি। অবশ্য টের পাবই বা কি করে, আমরা তো এগোনোর নামে শুধুই দৌড়াচ্ছি। অথচ মাঝে মাঝে একবারও পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি না যে কতটা এগোতে পারলাম এবং কতটা পিছিয়ে। হয়ত আমি মনে করছি, নগরায়নের নামে সভ্যতার নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই নৌকার সহবস্থান, মানবিকবোধ, মিত্রতা, পারিবারিক সম্প্রীতি নামক যাত্রী যে খুঁটিতে বাঁধা আছে তা হয়ত ঘুণাক্ষরেও টেরও পাচ্ছি না। শহরায়নের নামে কতগুলো ইট, বালু, সিমেন্টের তৈরি কংক্রিটের বস্তিতে পরিণত হচ্ছি আমরা। এ কংক্রিটের বস্তিতে বসবাস করে আমাদের মনও কংক্রিটের মত কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
"এরপর, কোথায় যাবে তোমরা?
নগরায়ণের নামে,
অজানা উল্টারথে চলছি আমরা,
গন্তব্য যার ধ্বংস রুদ্রের আসন।
প্রলয়ের রথে চলছি অবুঝ শিশু হয়ে
আমাদের সাথে যাবে?
তোমাদের সাথি করে নিতে চাই,
যেতে না চাইলেও
তোমাদের যেতে হবে, আমাদের সাথে।
ধ্বংসের নিষ্ঠুর শোভাযাত্রায়।"
আজ পরিবার গুলো ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যাচ্ছে সর্বনাশের পথে। এই ভাঙা অণু পরিবারের মাঝে যে কত শিশুর একাকিত্বের যন্ত্রণা রয়েছে তা হয়ত অনেকে কখনো ভেবেও দেখেনি। একান্নবর্তী পরিবারে সে খেলার সঙ্গী পেত, কথা বলার সঙ্গী পেত দাদু ঠাকুমার গল্পের ঝুলি উজার করে গল্প শুনতে পারত। এভাবে শৈশব, কৈশোর, বয়ঃসন্ধির সময়গুলো আরও সুন্দর হতে পারত, আরও রঙিন হতে পারত। কিন্তু পরিবারের থেকে কেড়ে নেয়া সুন্দর শৈশব, কৈশোর, বয়ঃসন্ধির সময়গুলোতে সে পেয়েছে সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসেবে হাতে মোবাইল। এ মোবাইলে বিভিন্ন প্রকারের গেম খেলে, কার্টুন দেখে বা বিভিন্ন প্রকারের ভিডিও দেখে সে তার একটি স্নিগ্ধ শৈশব- কৈশোর পাচ্ছে কি? না পাচ্ছে না, একদমই পাচ্ছে না। দুধের সাধ কখনো ঘোলে মিটে না।পৃথিবী তাঁর হৃত যৌবন ফিরে পাবে, কালের নিয়মে। কিন্তু আমরা আমাদের সেই একান্নবর্তী পরিবারের স্নেহ, মায়া, মমতার আঁচল কি আর ফিরে পাবো? এ প্রশ্নের উত্তর হয়ত আমাদের জানা নেই। কোন পরিস্থিতিতেই কখনো আত্মীয় পরিজন জ্ঞাতিগুষ্টিদের সাথে বিরোধ করতে নেই। বিখ্যাত যদুবংশ ধ্বংস হয়েছে, শুধুই আত্মীয় পরিজন জ্ঞাতিগুষ্টিদের সাথে বিরোধ করে। এ প্রসঙ্গে মনুসংহিতায় বলা হয়েছে:
ঋত্বিক্‌পুরোহিতাচাৰ্যৈমাতুলাতিথিসংশ্ৰিতৈঃ।
বালবৃদ্ধাতুরৈর্বৈদ্যৈর্জ্ঞাতিসম্বন্ধিবান্ধবৈঃ ॥
মাতাপিতৃভ্যাং যামীভির্ভ্রাত্ৰা পুত্ৰেণ ভাৰ্যয়া।
দুহিত্রা দাসবর্গেণ বিবাদং ন সমাচরেৎ ॥
এতৈর্বিবাদান্ সন্ত্যজ্য সর্বপাপৈঃ প্ৰমুচ্যতে ।
এভিৰ্জিতৈশ্চ জয়তি সর্বান্ লোকানিমান্ গৃহী॥
(মনুসংহিতা:৪.১৭৯-১৮১)
"ঋত্বিক্, পুরোহিত, আচার্য, মাতুল, অতিথি, আশ্রিত লোক, বালক, বৃদ্ধ, পীড়িত ব্যক্তি, চিকিৎসক, জ্ঞাতি, জামাতা শ্যালকাদি কুটুম্ব, মাতুল পক্ষের আত্মীয়, মাতা, পিতা, যামি (ভগিনী, ভ্রাতৃবধূ প্রভৃতি), ভ্রাতা, পুত্র, পত্নী, কন্যা ও ভৃত্যবর্গের সঙ্গে বিবাদ করবে না ।
এদের সঙ্গে বিবাদ পরিত্যাগ করে সকল পাপ থেকে গৃহস্থ মুক্ত হয় এবং এদের ভালোবাসা দ্বারা জয় করলে গৃহী জগতের সকলকেই জয় করতে পারে।"
তন্ত্রে বলা হয়েছে, পরিবার, পরিজন, আত্মীয় স্বজনদের প্রথমে পরিবারের পালনের ব্যবস্থা করতে হবে, কিন্তু পরিবার যদি অর্থনৈতিক বা কোন কারণে একেবারেই অসমর্থ হয় তবে দেশের রাজা তাদের পালন করবেন। এটা পরিবারের সাথে রাজারও দায়িত্ব।
মাতুর্মাতা পিতা ভ্রাতা মাতুর্ভ্রাতুঃ সুতাস্তথা ।
মাতুঃ পিতুঃ সোদরাশ্চ বিজ্ঞেয়া মাতৃবান্ধবাঃ ॥
পিতুর্মাতা পিতা ভ্রাতা পিতৃর্ভ্রাতুঃ স্বসুঃ সুতাঃ।
পিতুঃ পিতুঃ সোদরাশ্চ বিজ্ঞেয়াঃ পিতৃবান্ধবাঃ ॥ 
পত্যুর্মাতা পিতা ভ্রাতা পত্যুর্ভ্রাতুঃ স্বসুঃ সুতাঃ ।
পত্যুঃ পিতুঃ সোদরাশ্চ বিজ্ঞেয়াঃ পতিবান্ধবাঃ ॥
পিত্ৰে মাত্রে পিতুঃ পিত্ৰে পিতামহ্যৈ তথা স্ত্ৰিয়ৈ । 
অযোগ্যসূনবে পুত্র হীনমাতামহায় চ ॥
মাতামহ্যৈ দরিদ্রেভ্য এভ্যো বাসস্তথাশনম্ ।
দাপয়েন্নৃপতিঃ পুংসা যথাবিভবমম্বিকে ॥
(মহানির্বাণতন্ত্র: একাদশ উল্লাস, ৫৯-৬৩)
"মাতামহী, মাতামহ, মাতুল, মাতুলপুত্র এবং মাতামহ-সহোদর প্রভৃতি এরা সকলেই 'মাতৃবন্ধু'। পিতামহী, পিতামহ, পিতৃব্য, পিতৃব্যপুত্র, পিতৃষ্বস্রেয়, পিতামহ-সহোদর প্রভৃতিকে 'পিতৃবন্ধু' বলা হয়। আর স্বশ্রূ, শ্বশুর, দেবর, ভ্রাতৃশ্বশুর বা ভাশুর, ভ্রাতৃশ্বশুরপুত্র, দেবরপুত্র, ভর্তৃভগিনীপুত্র, শ্বশুরসোদর প্রভৃতিকে 'পতিবান্ধব' বলে।
হে অম্বিকে! পিতা, মাতা, পিতামহ, পিতামহী, পত্নী, অযোগ্য পুত্র এবং পুত্রহীন মাতামহ, ও পুত্রহীন
মাতামহী যদি দরিদ্র হয় এবং পরিবারের পালনে অসমর্থ হয়, তবে রাজা বিষয় অনুসারে এদের অন্ন বস্ত্রের ব্যবস্থা করবেন।"
এই করোনাকালে একান্নবর্তী পরিবারের প্রয়োজনীয়তা হারেহারে টের পাওয়া গেছে। হাতের পাঁচটি আঙুল যেমন সমান নয়। তেমনি সংসারে সকলের উপার্জন সমান হয় না। সে উপার্জনে কম-বেশি থাকবেই। করোনাকালে ঢাকা, চট্টগ্রাম শহরের অনেক অণু পরিবার আবার নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছে। দেখা যায়, অর্থনৈতিক দূরাবস্থায় যাদের শহরে বেঁচে থাকা দায়, তারাই গ্রামের বাড়িতে দিব্যি সুখে আছে। সবাই মিলেমিশে থাকলে, সকলেই সুখে থাকতে পারে। একান্নবর্তী পরিবারের সুবিধা বা প্রয়োজনীয়তাই সেখানে। বাড়িতে অনেক ঝামেলার মাঝেও, একটা শান্তি আছে। আমরা এখনও একান্নবর্তী পরিবারের অংশ।অশান্তি হবে, ঝগড়া হবে কিন্তু পরিবার ভাঙবো না। পরিবার ভাঙায় কোন আনন্দ নেই, আনন্দ সকল বৃদ্ধির মাঝে। বাঙালি পরিবারে প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী দেবীর পাঁচালী পাঠ করা হয়।এ পাঁচালীর একটি বড় শিক্ষা হলো যৌথ একান্নবর্তী পরিবারের শিক্ষা। পাঁচালীতে বলা হয়েছে:
"মিলিল ভ্রাতারা পুনঃ আর বধূগণ।
সাধুর সংসার হল পূর্বের মতন।।"
পরিবারের সকল সদস্য মিলেমিশে একসাথে থাকা। কিন্তু বর্তমানে নাগরিক জীবনে আমরা দিনেদিনে অত্যন্ত স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। আমাদের পূর্বের যৌথ পরিবারগুলো দিনেদিনে ভেঙে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে একটু একটু করে আমরা দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। আজও আমাদের অধিকাংশ পরিবারের সম্পত্তি যৌথ সম্পত্তি।এই যৌথ একান্নবর্তী পরিবারগুলো আমাদের শক্তির ভিত্তিমূল। তাই সেই ভিত্তিমূলকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। তবেই সেই ভিত্তিতে এক ঐক্যবদ্ধতার সুদৃঢ়, সুউচ্চ মনোরম ভবন নির্মিত হবে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : একান্নবর্তী পরিবার।
ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁