আজ বৃদ্ধ বাবা-মাকে মােবাইল অপারেট করা শেখাতে গিয়ে, কম্পিউটার সহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শিখাতে গিয়ে আমরা সন্তানেরা সামান্যতেই বিরক্ত হয়ে যাই। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মনজগতের ভূগোলের পাঠ না করে চিন্তা না করে অবলীলায় যা মনে আসে, তাই তাদের বলে ফেলি।আমার কথায় বাবা-মা কি মনে করবে, দুঃখ পাবে কিনা একবারও ভেবে দেখি না। কথায় কথায় বলে বসি, "তোমরা বুঝবে না ; তোমরা পারবে না ; তোমাদের দিয়ে আর হবে না" ইত্যাদি কথাগুলো। কথাগুলো শুনে মা-বাবার মন কেমন হতে পারে একবারও ভেবে দেখি না। তারা কষ্ট পেতে পারে, বিষয়টি কখনও ধর্তব্যের মধ্যেই আনি না। তাই বাবা-মাকে আধুনিক যান্ত্রিক প্রযুক্তি শেখাতে, আমরা সামান্যতেই বিরক্ত হয়ে বলে ফেলি, "অনেক হয়েছে, আমার আর ধৈর্য নেই, আমি আর শিখাতে পারব না। তোমরা একটু নিজেই কষ্ট করে শিখে নাও না, প্লিজ।" কিন্তু আমরা একবারও একটু ভেবে দেখেছি কি, যে বাবা-মাকে শেখাতে সামান্যতেই আমরা অধৈর্য হয়ে যাই; সেই তারাই যদি পরম ধৈর্য নিয়ে ছোটবেলায় আমাদের বর্ণমালা শেখাতে গিয়ে এমনি বিরক্ত হতেন, তবে আমাদের আর বর্ণপরিচয় হত না। উচ্চতর শিক্ষা লাভ করে, শিক্ষিত হয়ে ভাল চাকুরি করাও আর সম্ভব হত না। এত গর্ব, অহংকার কোথায় ধূলিসাৎ হয়ে যেত, যা চিন্তাই করা যায় না।
বর্তমানে তথাকথিত শিক্ষিত চাকুরিজীবী কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, বাসায় কে কে থাকেন? শহরে বসবাসকারী অধিকাংশই তো খুবই ছোট অণুপরিবারে বসবাস করে। এদের পরিবারে মা-বাবা ভাইবোন সচরাচর থাকে না। যারা মা-বাবার সহ একসাথে বসবাস করে, তাদের সংখ্যা একদম নগন্য। বাবা-মা প্রসঙ্গে কেউ জিজ্ঞাসা করলে তাদের সহজ একটি কমন উত্তর পাওয়া যায়। তারা বলেন, "আমার বাসায়, আমার সাথে মা-বাবা থাকে।" কিন্তু অধিকাংশক্ষেত্রেই বলতে শুনিনা মা-বাবার সাথে আমি থাকি। এমনও দেখা যায়, মা-বাবা যে শহরে তার বাসায় থাকে, এটা বিভিন্ন অজুহাতে আত্মীয়, পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের জানাতে চাই। জানানোর প্রধান উদ্দেশ্য, তিনি অন্যদের থেকে আলাদা বা মহান ; বিষয়টি যেন আশেপাশের মানুষ জানে।
আজ দেশে আইন করে পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য অকর্তব্য শেখানো হচ্ছে। জগতে এর থেকে লজ্জার আর কি হতে পারে। আমাদের ধর্মে পিতা মাতার প্রতি সন্তানের কি কর্তব্য তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তবুও বর্তমান সমাজে অসংখ্য সন্তান নামক কুলাঙ্গারদের পাওয়া যায়; যারা স্বার্থের সুতার টানে জন্মদাতা-জন্মদাত্রী পিতামাতাকে অসম্মানজনক পরিস্থিতিতে ফেলতে পিছপা হয় না। এর দৃষ্টান্ত আমাদের চারিপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমাদের মানসিক বিকাশ এবং পারিবারিক সংস্কারে ছিদ্রপথেই এ হৃদয় বিদারক ঘটনাগুলোর অভিঘাত আজও আসে। শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অগ্রজ বলরামকে সাথে নিয়ে পিতামাতা দেবকী এবং বসুদেবকে উদ্দেশ্য করে, বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি সন্তানের করণীয় প্রসঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন।
সর্বার্থসম্ভবো দেহো জনিতঃ পোষিতো যতঃ।
ন তয়োর্যাতি নির্বেশং পিত্রোর্মর্ত্যঃ শতায়ুষা।।
যস্তয়োরাত্মজঃ কল্প আত্মানা চ ধনেন চ।
বৃত্তিং ন দদ্যাত্তং প্রেত্য স্বমাংসং খাদয়ন্তি হি।।
(শ্রীমদ্ভাগবত:১০.৪৫.০৫-০৬)
" মানুষের পক্ষে এ পাঞ্চভৌতিক দেহটি সর্বার্থসম্ভব। চতুর্বর্গের সকলেই লাভ হতে পারে দেহটি দ্বারা। সেই দেহের জন্ম, পালনপোষণ যাঁদের মাধ্যমে। যাঁদের স্নেহে এবং দয়ায় আমাদের এ জীবনের সবচেয়ে অসহায় সময়ে আমরা সুরক্ষিত থাকি; সেই পিতামাতার ঋণ কোন মানুষই শতবর্ষ পরমায়ুতে একনিষ্ঠ সেবার দ্বারাও শোধ করতে পারে না।
যে পুত্র সক্ষম হয়েও নিজের দেহ এবং ধন সম্পদের দ্বারা তার পিতামাতার সর্বপ্রকার সেবা এবং তাঁদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করেনা, সেই ব্যক্তির মৃত্যুর পর পরলোকে যমদূতেরা তাকে নিজ মাংস ভক্ষণ করায়।"
একইকথা মহাভারতের শান্তিপর্বের ১০৫ তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে।যারা মনে মনে অথবা কার্যদ্বারা পিতা, মাতা এবং শিক্ষকের অপকার করে; তাদের জীব ভ্রুণহত্যা পাপ গ্রাস করে। তাদের থেকে বড় পাপী আর পৃথিবীতে নেই; যারা বৃদ্ধ পিতামাতাকে ভরণপোষণ করে না। তারা পতিত হয়ে অন্ধকারলোকে নিমজ্জিত হয়।
উপাধ্যায়ং পিতরং মাতরঞ্চ
যেঽভিদ্রুহ্যন্তে মনসা কর্মণা বা।
তেষাং পাপং ভ্রণহত্যাবিশিষ্টং
তস্মান্নান্যঃ পাপকৃদস্তি লোকে।।
ভৃতো বৃদ্ধো যো ন বিভর্ত্তি পুত্রঃ
স্বযোনিজঃ পিতরং মাতরঞ্চ।
তদ্বৈ পাপং ভ্রণহত্যাবিশিষ্টং
তস্মান্নান্যঃ পাপকৃদস্তি লোকে।।
যেঽভিদ্রুহ্যন্তে মনসা কর্মণা বা।
তেষাং পাপং ভ্রণহত্যাবিশিষ্টং
তস্মান্নান্যঃ পাপকৃদস্তি লোকে।।
ভৃতো বৃদ্ধো যো ন বিভর্ত্তি পুত্রঃ
স্বযোনিজঃ পিতরং মাতরঞ্চ।
তদ্বৈ পাপং ভ্রণহত্যাবিশিষ্টং
তস্মান্নান্যঃ পাপকৃদস্তি লোকে।।
(মহাভারত:শান্তিপর্ব, ১০৫ অধ্যায়,৩০-৩১)
"যারা মানসিকভাবে অথবা কার্যদ্বারা পিতা, মাতা এবং শিক্ষকের অপকার করে; তাদের ভ্রুণহত্যা থেকেও অধিক পাপ হয়। তাদের থেকে বড় পাপী আর পৃথিবীতে নেই।
স্বীয় পিতা-মাতা কর্ত্তৃক পরিপালিত ও পরিবর্দ্ধিত হয়ে যে-পুত্র ঐ পিতামাতাকে ভরণপোষণ করে না; তারা ভ্রণহত্যার পাপের সমতুল্য পাপ করে। তাদের থেকে বড় পাপী আর পৃথিবীতে নেই।"
যে সমর্থ মানুষ তার বৃদ্ধ পিতা মাতা, ও আশ্রিতজনকে যে অবজ্ঞা করে, সে জীবিত হলেও মৃতবৎ বিবেচিত হয়।এ কারণেই তৈত্তিরীয় উপনিষদে বৈদিক শিক্ষা সমাপনান্তে বৈদিক সমাবর্তন ভাষণে, পিতামাতাকে স্বয়ং মূর্তিমান দেবতা বলা হয়েছে (০১.১১.০২)।
"মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেবো ভব।"
এ কথাটিই প্রতিধ্বনিত হয়েছে মনুসংহিতায়। সেখানে পিতামাতাকে সবার থেকে শ্রেষ্ঠ বলে, গর্ভধারিণী মাতাকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। যিনি টাকার বিনিময়ে শিক্ষা দেন, সেই বেতনভোগী শিক্ষক থেকে জন্মদাত্রী মাতা একলক্ষগুণে শ্রেষ্ঠ।
উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য আচার্যাণাং শতং পিতা।
সহস্রং তু পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে।।
সহস্রং তু পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে।।
(মনুসংহিতা : ২.১৪৫)
"দশজন উপাধ্যায় (যিনি জাগতিক শিক্ষা দেন) থেকে একজন আচার্য (যিনি বিনে পয়সায় বৈদিক জ্ঞান দান করেন) শ্রেষ্ঠ ; একশজন আচার্য থেকে একজন জন্মদাতা পিতা শ্রেষ্ঠ ; এবং জন্মদাত্রী মাতা পিতা থেকেও সহস্র সহস্রগুণে শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ মা একজন উপাধ্যায় যিনি টাকার বিনিময়ে শিক্ষা দেন, সেই বেতনভোগী শিক্ষক থেকে একলক্ষগুণে শ্রেষ্ঠ। "
আজ দুঃখজনক হলেও সত্য, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভাগবতে পিতামাতার সর্বপ্রকার সেবা এবং তাঁদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু ভগবানের এ নির্দেশনা আমরা কতজন ঠিকমত অনুসরণ করি? শাস্ত্রের বিভিন্ন মানবিক মূল্যবোধের নির্দেশনাগুলো শাস্ত্রের ধূসর পাতাতেই রয়ে যাচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর স্বার্থপর মনুষ্য সমাজকে সর্বক্ষেত্রে স্পর্শ করতে পারছে না। আজ আমরা বিভিন্ন স্থানে বৃদ্ধাশ্রম দেখি। অনেকেই নিজের বিকৃত মানসিক প্রবৃত্তি, স্ত্রীর স্বার্থপর প্ররোচনা এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ইন্ধনে অসহায় বৃদ্ধ মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। এ সকল ঘৃণ্য, বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডে বোধবুদ্ধি, বিবেক হারিয়ে বোধনাশা হয়ে ভুলে যায়; পিতামাতাই যে আমাদের জীবনের ভিত্তিভূমি। অবশ্য বৃদ্ধ বয়সে এদের অধিকাংশই নিজের সন্তান দ্বারা নিজের পিতামাতার সাথে করা ঘটনার পুনরাবৃত্তি পায়। দুঃখ, বেদনা শতগুণ এবং ভয়ংকর বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে তাদের কাছে।পিতামাতা প্রসঙ্গে শ্রীঅনুকূল ঠাকুরের (১৪ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮ - ২৬ জানুয়ারি ১৯৬৯) খুবই গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিকনির্দেশক ছড়াবাণী আছে। তিনি বলেছেন পিতামাতার উপরেই জীবনের স্বভাব, চরিত্র গড়ে ওঠে। যদি পিতামাতাকে কেউ জীবনে ইষ্ট বা আরাধ্যদেবতা হিসেবে গ্রহণ করে, তবে তাকে কখনও জীবনে নিগৃহীত হতে হয় না। পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং আত্যন্তিক টানেই সন্তান সাম্যপ্রাণ হয়।পিতামাতায় প্রতি অটুট টান বা ঝোঁক যে সকল সন্তানের; একমাত্র তারাই ভবিষ্যতে মহান বলে স্বীকৃত হয়।
"পিতা মাতায় ভক্তি জানিস্ প্রথম শিষ্ট ভাব,
তার উপরেই গজিয়ে ওঠে জীবনের স্বভাব।"
"ইষ্ট জানিস্ পিতা মাতার শিষ্ট বেদন-বিগ্রহ,
তাঁহার প্রতি থাকলে নতি নিরুদ্ধ হয় নিগ্রহ।"
"পিতায় শ্রদ্ধা, মায়ে টান
সেই ছেলে হয় সাম্যপ্রাণ।।"
"পিতামাতায় অটুট টান পূরনপ্রবণ ঝোঁক,
সেই ছেলেই ভবিষ্যতের মহান একটি লোক।"
মনুষ্যত্ব এবং দেবত্বের উদ্বোধন আকাঙ্ক্ষায় শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর অনুসারীদের প্রতি দ্বাদশ আজ্ঞা প্রধান করেছেন। আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক সাধন বিষয়ে দ্বাদশ আজ্ঞার প্রত্যেকটি আজ্ঞা সনাতন ধর্মাবলম্বী সকলের অবশ্যপালনীয়। এ দ্বাদশ আজ্ঞার দ্বিতীয় আজ্ঞাতেই শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন, "পিতা-মাতাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করবে।" বেদাদি শাস্ত্রের সাথে সাথে পিতামাতা প্রসঙ্গে আমাদের অধিকাংশ মহাপুরুষেরা একই নির্দেশনা বারবার পুনরাবৃত্তি করেছেন।
শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থানে নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও, এরপরেও বৃদ্ধ পিতামাতাকে পরিবার পরিজন থেকে পরিত্যাগ করতে সমাজে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধাশ্রম হচ্ছে। অনেক সময়ে মন্দিরের সাথেই বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রম দেখা যায়। বৃদ্ধাশ্রম অশাস্ত্রীয়; তাই মন্দিরের সাথে তো হতেই পারে না। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যে বাক্য,"পিতামাতার সর্বপ্রকার সেবা এবং তাঁদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা" এ বাক্যটির লঙ্ঘন হয়। শহরায়ণের বৈশিষ্ট্য হল, পালিশ করা কৃত্রিম লোকদেখানো সাজানো গোছানো আচরণ। যে আচরণের অধিকাংশই মুখোশ পরা মেকি। মুখের মুখোশটি সরিয়ে ফেললেই ব্যক্তিদের রক্তমাংসের আসল স্বরূপ দেখা যায়। বাংলাদেশের তুলনায় কোলকাতায় বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা অনেক বেশি। এর অন্যতম কারণ, তাদের শহরায়ণ এবং অত্যাধিক শহরায়ণের ছোঁয়া আগে লেগেছে। তাই তাদের পালিশ করা কৃত্রিম লোকদেখানোপনা মেকি আচরণ বাংলাদেশের বাঙালিদের থেকে একটু বেশি। তবে হ্যাঁ, যাদের স্ত্রীসন্তান নেই, তারা আমৃত্যু কোন আশ্রমে বাস করতে পারে। অথবা শুধু এ জাতীয় অসহায় মানুষদের জন্যে বাণপ্রস্থ আশ্রম হতে পারে। যেখানে আমৃত্যু থেকে তারা ধর্মচর্চা করবে। এমনিতেই আমাদের ধর্মে পঞ্চাশ বছরের পরে সংসার থেকে একটু আলগা হয়ে ঈশ্বরের শরণে বাণপ্রস্থ আশ্রমে যেতে বলা হয়েছে। পঁচাত্তর বয়সের পরবর্তীতে সন্ন্যাস নিয়ে সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের শরণ নিতে শাস্ত্রে বলা হয়েছে। বৃদ্ধাশ্রম সীমিত পরিসরে সমর্থনযোগ্য, যদি তা শাস্ত্রীয় বাণপ্রস্থ আশ্রমের মত হয়। যেখানে পরিবারের বৃদ্ধজনেরা স্বেচ্ছায় গিয়ে ঈশ্বরের সাধন, ভজন এবং উপাসনা করবে। আধ্যাত্মিক পথে অগ্রগতির আশায়। পিতামাতার মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে গরুড় পুরাণের উত্তরখণ্ডে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গরুড়কে উদ্দেশ্য করে বলেন:
পিতৃমাতৃসমং লোকে নাস্তান্যদ্দৈবত পরম।
তস্মাৎ সর্বপ্রযত্নেন পূজয়েত পিতরৌ সদা।।
হিতানামুপদেষ্টা হি প্রত্যক্ষদৈবতং পিতা।
অন্য যা দেবতা লোকে ন দেহপ্রভব হি সা।।
শরীরমেব জন্তুনাং স্বর্গমোক্ষৈকসাধনম্।
দেহো দত্তো হি যেনৈবং কোঽন্যঃ পুজ্যতমস্ততঃ।।
(গরুড় পুরাণ:উত্তর খণ্ড,২১.২৭-২৯)
"কোন লোকেই পিতামাতার তুল্য পরম দেবতা আর কেউ নেই।অতএব সর্বপ্রযত্নে পিতামাতার যথাসাধ্য সেবা করবে।পিতা সর্বদা হিতোপদেশ প্রদান করেন অতএব তিনি প্রত্যক্ষ দেবতারূপী পরম গুরু। অন্য দেবতা ইহলোকে শরীর প্রভব নয়।শরীরই জীবগণের নরকভোগ,স্বর্গলাভ ও মোক্ষপ্রাপ্তির হেতু; সেই শরীর যিনি প্রদান করেছেন তদপেক্ষা পূজ্যতম আর কে অধিক জগতে হতে পারে?"
পিতা যদি চোর হয়, মাতা যদি পতিতাও হয়; এর পরেও সন্তানের কাছে তাদের জন্মদাতা জন্মদাত্রী পিতামাতা পরমশ্রদ্ধেয় এবং পরমপূজনীয়। শব্দ এবং শব্দের অর্থের মত করে সম্পৃক্ত জগতের আদি পিতা-মাতা শিব এবং পার্বতী। সকল প্রকার বিদ্যা, কলার প্রতিপত্তি এবং মুক্তির জন্যে জগতের আদি পিতামাতা পার্বতী-পরমেশ্বর যেমন জীবের সদা বন্দনীয়। তেমনি সন্তানের কাছে ঈশ্বরের সাথে সাথে সদা বন্দনীয় হল, জন্মদাতা জন্মদাত্রী পিতামাতা। তারাই হলেন সন্তানের কাছে দৃশ্যমান সচল পার্বতী-পরমেশ্বর এবং মুক্তির অবলম্বন।মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে -যে ব্যক্তি বিদ্যার গর্বে বা ধনের গর্বে উন্মত্ত হয়ে পিতামাতাকে অবহেলা করে, সে ধর্ম থেকে বহিষ্কৃত হয়ে, মৃত্যু পরবর্তীতে ঘোরতর নরকে প্রবেশ করে।
ঔদ্ধতাং পরিহাসঞ্চ তর্জনং পরিভাষণম্ ৷
পিত্রোরগ্রে ন কুর্বীত যদীচ্ছেদাত্মনো হিতম্ ॥
মাতরং পিতরং বীক্ষ্য নত্বোত্তিষ্ঠেৎ সসম্ভ্রমঃ।
বিনাজ্ঞয়া নোপবিশেৎ সংস্থিতঃ পিতৃশাসনে ॥
বিদ্যাধনমদোন্মত্তো যঃ কুর্য্যাৎ পিতৃহেলনম্।
স যাতি নরকং ঘোরং সর্বধর্মবহিষ্কৃতঃ।।
(মহানির্বাণতন্ত্র: ৮.৩০-৩২)
" যে ব্যক্তি নিজের হিতকামনা করে, সে কখনো পিতামাতার সম্মুখে ঔদ্ধত্য, পরিহাস, চঞ্চলতা ও ক্রোধ প্রকাশ করবে না। পিতামাতার সমীপে কখনো কর্কশ কুবচন প্রকাশ করবে না।
পিতামাতাকে দর্শন করলেই সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান পূর্বক প্রণাম করবে।তাঁদের আজ্ঞা ব্যতিরেক আসনে উপবেশন করবে না। অর্থাৎ যতক্ষণ না পিতামাতা বসতে অনুমতি প্রদান করেন, ততক্ষণ আসনে বসবে না। সন্তান পিতামাতার আদেশ পালনে সতত উন্মুখ হয়ে থাকবে।
যে ব্যক্তি বিদ্যা বা ধনমদে মত্ত হয়ে পিতামাতাকে অবহেলা করে, সে সর্বধর্ম থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ঘোরতর নরকে গমন করে।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : পিতামাতার ঋণ, শোধ হয় না।