সুপ্রাচীন অশ্বত্থ গাছের কথা
যুগযুগান্তর থেকে একটি সুপ্রাচীন অশ্বত্থ গাছ সবাইকে ছায়া দিয়ে আসছে। গাছটির জন্ম কবে হয়েছে কেউ জানে না। কালের প্রবাহে সেই অশ্বত্থ গাছটিও তার গৌরবদীপ্ত অতীতকে অনেকটা ভুলে যেতে শুরু করে। এমনি সময়ে সেই গাছে বেশ কয়েকটি পরগাছার জন্ম হয়। পরগাছাগুলো ধীরেধীরে বড় হতে থাকে। তারা তখন তাদের মাতা স্বরূপা গাছকে অস্বীকার করা শুরু করে তার সম্পর্কে বিদ্বেষ করা শুরু করে দেয়। সুপ্রাচীন অশ্বত্থ গাছের সম্পর্কে বিবিধ মিথ্যা বানোয়াট অপপ্রচার করতে থাকে সাধ্যমত। পরগাছারা অশ্বত্থ গাছকে বলে, "তুই মিথ্যা গাছ। তোর কোন অস্তিত্ব নেই। কবে তোর জন্ম হয়েছে তাও কেউ জানে না। কে জন্ম দিয়েছে তাও কেউ জানে না ইত্যাদি।" এক পরগাছা অশ্বত্থ গাছকে বলে, "এই দেখো আমার পাঁচশত বছর পূর্বে জন্ম হয়েছে, কে আমার জন্মদাতা পিতা তাও আমি জানি; তুমি কিছুই জান না!" কোন পরগাছা গর্বোদ্ধত হয়ে বলে, আমার একহাজার বছর পূর্বে জন্ম হয়েছে, ছি ছি! তোমার জন্ম কবে তুমি কিছুই জান না! তোমার কি লজ্জা করে না?" আরেক পরগাছা আত্মবিশ্বাসের সাথে গায়ের জোর খাটিয়ে বলে, " শোন অশ্বত্থ গাছ তোমার তো জন্মের কোন সন-তারিখ নেই, কে জন্ম দিয়েছে তাও জান না। এই দেখ আমার পনেরশো বছর পূর্বে জন্ম হয়েছে, সবই খাতাপত্রে লিখিত আছে। তোমার কি এমন আমার মত খাতাপত্রে লেখা আছে?" একই ধারাবাহিকতায় এমনি করে আরেকটি পরগাছা বলে, "আমার দুইহাজার বছর পূর্বে জন্ম হয়েছে, তাই আমি গর্বিত, আমার থেকে গর্বিত আর কেউ নয় এবং কখনো হবেও না।"আরেকটি পরগাছা বলে, " অশ্বত্থ গাছ তুমি জান আমি কত প্রাচীন? আমার তিন হাজার বছর পূর্বে জন্ম হয়েছে।"
অশ্বত্থ গাছকে তার গায়ে জন্ম নেয়া সকল পরগাছাই সুযোগ পেলে নিত্যদিনই অপমানিত করে। কিন্তু সর্বংসহা অশ্বত্থ বৃক্ষ, ওদের কথায় কান না দিয়ে, পরগাছাদের আরও বেশি করে ভালোবাসা দিতে থাবে। সে ভাবে হয়ত ভালোবাসা দিলে আস্তে আস্তে তারা তাদের ভুলগুলো বুঝতে পেরে নিজেদের সংশোধন করে নিবে।অশ্বত্থ গাছে জন্ম নেয়া পরগাছাদের অহেতুক আস্ফালনে অশ্বত্থ গাছের খুব কষ্ট হয়। সে নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয় এ বলে যে- ওরা অবুঝ তাই বুঝতে পারছে না। ওরা তো আমার দেহের খাদ্যরসেই জন্ম নেয়া। আমি না থাকলে এই পরগাছাদের একটিরও অস্তিত্ব থাকবে। আমার দেহে জন্ম নিয়ে, আমার খাদ্যরসে পরিপুষ্ট হয়ে ওরা আমাকেই গালমন্দ করছে, আমার জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। অথচ এই অবুঝ বালক নাদান পরগাছার দল একবারও ভেবে দেখে না যে, আমার জন্ম না হলে এই একটিরও জন্ম হত না।
মহান হৃদয়ের অশ্বত্থ গাছ তার মহানুভবতা থেকে তার গায়ে পাঁচশত, হাজার, পনেরশো, দুইহাজার, তিনহাজার বছর পূর্বে জন্ম নেয়া পরগাছাদের একদিন বলে: "দেখ ভাইয়েরা, আমার গায়ে তোমরা জন্ম নিয়েছো, তোমরা আমার সন্তানতুল্য এবং আমি তোমাদের জননীতুল্য। এরপরেও, তোমরা পরগাছা হওয়া সত্ত্বেও আমি তোমাদের গাছ বলে স্বীকৃতি দিয়ে আমি তোমাদের আমার ভাই বলে সম্বোধন করছি। অথচ তোমরা সেই ভ্রাতৃত্বের মর্যাদা না রেখে আমার সাথে অহেতুক বিদ্বেষমূলক আচরণ করছো। কিন্তু দেখ ভাই অহেতুক বিদ্বেষের কি প্রয়োজন? তোমরাও বৃক্ষ, আমিও বৃক্ষ; আমিও সত্য বৃক্ষ, তেমনি তোমরাও সত্য বৃক্ষ। জগতের সকল বৃক্ষই সত্য। যত বৃক্ষ, তত সত্য। এসো সকল বৃক্ষ মিলেমিশে একসাথে সম্প্রতির বন্ধনে থাকি।" কিন্তু সহজ সরল জননী স্বরূপা অশ্বত্থ বৃক্ষটি যতই শান্তি এবং সম্প্রতির আকাঙ্ক্ষায় বলে, সকল গাছই সত্য। পরগাছার দল ততই বেশি করে অশ্বত্থ বৃক্ষের পিছনে লেগে যায়। পরগাছারা সকলেই নিজেকে নিজেকে একমাত্র সত্যবৃক্ষ বলে আত্মপ্রচার করতে থাকে। অশ্বত্থবৃক্ষ যত বেশি সমন্বয়, সম্প্রতি এবং শান্তির কথা বলে পরগাছারা ততই ক্ষুব্ধ হয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে গিয়ে জননীস্বরূপা অশ্বত্থ বৃক্ষকে অপদস্ত করতে থাকে।
পরগাছাদের আচরণে অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে মহৎপ্রাণের অশ্বত্থগাছটি ভগবানকে কাতরস্বরে ডেকে বলতে থাকে: "হে ভগবান, তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ। শুরু থেকে আমি একাই আছি। তোমার সৃষ্টির বৈচিত্রের জন্য তোমার ইচ্ছাতেই আমার দেহে এই পরগাছাদের জন্ম হয়। আমিও সাদরে তাদের বেড়ে উঠতে সহায়তা করি। তারা আমারই দেহের খাদ্যরস খেয়ে তরতর করে বেড়ে উঠে। হে ভগবান, গাছ হিসেবে তারা দেখতে হলেও, তাদের গাছের মত ডালে পালা, লতা, পাতা, ফুল থাকলেও তোমার ইচ্ছাতেই তারা কেউই ফল ধারণে সামর্থ্যযুক্ত নয়। অর্থাৎ কোন প্রাণীকুল তাদের কাছে ফল পায় না। তারা শুধু ডাল-পালা এবং ফুল-পাতাই বিস্তার করে চলে। যেহেতু কোন ফল ধারণ করতে পারে না, তাই অনেক বনবাসীরাই এসে মাঝেমধ্যে তাদের ডালপালা ছেটেছুটে দিয়ে, সে ডালপালা চুলায় রান্না করতে নিয়ে যায়। এটাও পরগাছাদের একটি আমার প্রতি ক্ষোভ যে আমার গাছে ফল ধরে। সেই ফল খেতে বিভিন্ন পাখিসহ প্রাণীরা আসে। কিন্তু পক্ষান্তরে এই পরগাছাদের দেহে শুধু ডালপালাই বিস্তার লাভ করে। এর কারণে অকারণে এই পরগাছাদের অগণিত ক্ষোভ আমার উপরে এসে পরছে। তারা আমার দেহ থেকে জন্ম নিয়েও, আমাকে দিনরাত্রি শাপশাপান্ত করছে। আমার সর্বপ্রকার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে এবং আমাকেই মিথ্যা গাছ বলে প্রচার করছে। তবে এটাও সত্যি যে তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করে না। প্রথমে অনেক করলেও, পপরবর্তীতে যখন সত্য-মিথ্যা উপলব্ধি করতে পারে, তখন পরগাছাদের থেকে দূরে সরে যায়। এবং পরগাছাদের মিথ্যাচারের কারণে তাদের ঘৃণা করে।
এতে দিনেদিনে তাদের ক্ষোভ বেড়ে গিয়ে তারা হিংসাত্মক তৎপরতা শুরু করে দিচ্ছে। হে ভগবান, তুমি বলে দাও এখন আমি কি করবো। তুই আমাকে সৃষ্টি করেছ, তুমিই আমাকে পথ দেখাও।"
অত্যন্ত কাতর এবং দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে পরগাছাদের জননী স্বরূপা অশ্বত্থ গাছটি যখন রোদন করছে। ঠিক সেময়ে সে গাছের নিচে এক মুনি সাধনায় মগ্ন ছিলেন। তিনি বৃক্ষ-লতাপাতার ভাষা বুঝতে পারতেন। ভগবানের উদ্দেশ্যে অশ্বত্থ গাছের রোদনে মুনির ধ্যানভঙ্গ হয়ে যায়। তিনি অশ্বত্থ গাছকে সম্বোধন করে, হে জননীস্বরূপা অশ্বত্থ বৃক্ষ, আমি তোমার সকল কথাই শুনলাম। তোমার কথায় আমার হৃদয় দুঃখে বিগলিত হয়ে গেলো। দেখ মা, দুঃখ করবে না। জগতের এটাই নিয়ম যে, সর্বোচ্চ উপকারীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এই পরগাছাদের তোমার প্রতি ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক। তারা যখন দেখে যে, একটি পরিপূর্ণ গাছ থেকে জন্ম নিয়েও, তারা পরিপূর্ণ একটি গাছ আজও হয়ে উঠতে পারেনি। তাই তাদের তোমার প্রতি ক্ষুব্ধতা আসা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। যদিও তারা ইচ্ছাতেই জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু এরপরেও তুমি চাইলেও ভগবানের কাছে অনুরোধ করে এবং তুমি কিছু সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়ে এদের জন্ম আটকে দিতে পারতে। কারণ তুমিই সুপ্রাচীনকাল থেকেই আছ। তুমি পরগাছাদের মত কোন সন-তারিখ বা ইতিহাসে আবব্ধ নও। সর্বস্ব ত্যাগী মুনির বাক্যে অশ্বত্থ গাছ কান্না থামিয়ে চোখের জল সম্বরণ করে মুনিকে অভিবাদন জানায়, প্রণাম হে মুনিবর! আমি জানি আমার সহৃদয়তা, মহানুভবতা, বাৎসল্য প্রেম এবং ভালোবাসার সুযোগেই এই পরগাছাদের প্রবৃদ্ধি। আমি তাদের সন্তুনতুল্য স্নেহেই শুধু দেখিনি, আমি তাদের বৃক্ষের মর্যাদা পর্যন্ত দিয়েছি। যদিও তারা পরিপূর্ণ বৃক্ষ নয়, পরগাছা। কিন্তু আমার সকল আদর, স্নেহ এবং ভালোবাসাকে তারা দুর্বলতা মনে করে। তারা তাদের জন্মগত এবং স্বোপার্জিত রাজসিক এবং তামসিক বিবিধ আচরণ আমার প্রতি করেই চলছে। এক্ষেত্রে এখন আমি কি করতে পারি? আমাকে আপনি করণীয় প্রসঙ্গে বলুন।
সত্ত্বেগুণসম্পন্ন মুনি তখন অশ্বত্থ গাছকে বললেন: দেখ মা, সাধু-সন্ন্যাসী এবং ঋষিমুনিদের কখনো কারো প্রতি বিদ্বেষ ভাব রাখতে নেই। তাদের সকল জীবের প্রতিই সমদর্শী হতে হয়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, সাধুসজ্জনদের যেমন শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রদান করতে হবে তেমনি, দুর্জনদেরও দমন করতে হবে। যদিও দুর্জন পাপিষ্ঠদের ভগবানই সৃষ্টি করেন সত্যের মহিমাকে প্রকাশিত করতে। একটি বিষয় মনে করবে, তা হল সত্যই ধর্ম এবং ধর্ম স্বয়ং সত্যস্বরূপ। মিথ্যা সাময়িক যতই আস্ফালন করুক না কেন, মিথ্যা কখনই বা কোনদিনও জয়লাভ করতে পারবে না। হে অশ্বত্থ মাতা, তোমার প্রথম ভুল হয়েছে পরগাছাদের জন্মের সময় বাঁধা না দেয়া; দ্বিতীয় ভুল হয়েছে তোমার শরীর থেকে খাদ্যরস প্রদান করে তাদের বেঁচে থাকতে সহায়তা করা; তৃতীয় ভুল হয়েছে, এরা পরগাছা হওয়া সত্ত্বেও এদের বৃক্ষ বলে স্বীকৃতি দেয়া; চতুর্থ ভুল হয়েছে তাদের সাথে অকারণে সম্প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে বৃক্ষ এবং বৃক্ষের গায়ে বেড়ে উঠা পরান্নজীবী পরগাছাদের মাঝে সকল বৃক্ষ সত্য এ তত্ত্বের প্রচার করা; পঞ্চম ভুল হলো, তোমার শক্ত ডালপালা দিয়ে পরগাছাদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঝড়-ঝাপটা এবং বিপদ থেকে রক্ষা করেছ। হে অশ্বত্থ মাতা, সমস্যা যেহেতু তোমার কারণে জটিল হয়েছে, সমাধান তোমার কাছেই আছে। তুমি আজই একটু ধড়ফড়িয়ে উঠে, গা ঝাড়া দিয়ে নড়ে-চড়ে উঠ। তবে পরগাছারা বুঝতে পারবে তাদের অস্তিত্বের মূলে কে? তুমি কে, তোমার পরিচয় কি, তাদের জীবনে তোমার অবদান কি ইত্যাদি।
শান্তিপ্রিয় শান্তস্বভাবের মুনির কথা শুনে অশ্বত্থ গাছ অনেকটা হৃদয়ে শান্তি পায় এবং আস্বস্ত হয়। সে তখন তার ডালপালাটে তীব্রভাবে ঝাকাতে শুরু করে। তার সেই ঝাকুনিতে পরগাছারা ভয় পেয়ে যায়। এ কি করছ অশ্বত্থ গাছ! তুমি কি পাগলিনী হয়ে গেলে নাকি? তোমার ঝাকুনিতে আমরা পরগাছারা তো তোমার ডাল থেকে পড়ে যাচ্ছি। এগুলো করো না লক্ষ্মীটি, শান্ত হও মা। তুমি না আমাদের মায়ের মত, মা কি কখনো সন্তানের ক্ষতি চাইতে পারে? অশ্বত্থ গাছ তখন হেসে বলে, ও আমি মা; তাই না? তো বলি, এই মধুরস্বরে ' মা' ডাকটি এতকাল কোথায় ছিলো শুনি? আমি কারো মা নই, আমার কোন সন্তান নেই। বেচারা পরগাছাগুলো অস্তিত্বের সংকটে পড়ে অসম্ভব ভয় পেয়ে যায়। বারবার অশ্বত্থ গাছকে শান্ত হতে বলে। তাদের অনুরোধে অশ্বত্থ গাছ আরও অশান্ত হয়ে বলে, আমার যা মনে আসে আমি তাই করবো। আমার এখন খুব শিবঠাকুরের তাণ্ডব নৃত্য করতে ইচ্ছা করছে। তাই আমি যতক্ষণ আমার মনে চায়, আমি তাণ্ডব নৃত্য করেই যাব।
অশ্বত্থ গাছকে এমন ভয়ংকররূপে এই পরগাছারা আগে কখনো দেখেনি। তাদের অস্তিত্বে ভয় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তারা প্রমাদ গুণতে থাকে। তারা বুঝতে পারে যে তাদের দৌড় কতটুকু। তারা তখন কাতরস্বরে করজোড়ে বলতে থাকে, হে অশ্বত্থ মাতা রক্ষা কর! আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি। আমাদের শক্তি সামর্থ্য এবং সর্বোপরি অস্তিত্ব সম্পর্কে যে গর্ব ছিলো, তা সবই ছিলো মিথ্যা। আমরা প্রকৃত সত্যটা জেনেও, একটি অলীক মিথ্যা দিবাস্বপ্নের বাস্তবতায় বাস করতাম। সর্বদা নিজেরাও মিথ্যা আচরণ করতাম এবং তোমার সম্পর্কে মিথ্যা বানোয়াট কথা প্রচার করতাম। আমাদের ধারণা ছিলো যে, যতই তোমার সাথে অন্যায় আস্ফালন করি না কেন, তুমি সর্বদা আমাদের ক্ষমা করেই যাবে। হয়তো মনে কষ্ট পাবে, কিন্তু দিনশেষে আমাদের বাৎসল্য স্নেহে ক্ষমা করে দিবে। আর এই সুযোগে আমরা তোমার বিরুদ্ধে বিবিধ মিথ্যা বানোয়াট অপপ্রচার করেই যাব। কিন্তু আমরা কখনো ধারণা করতে পারিনি যে, সেই মাতৃস্বরূপা তুমি কখনো এমন রুদ্রচণ্ডীরূপ ধারণ করবে। তাই আমরা আজ অনেক কিছুই বুঝতে পেরেছি, যে আমাদের অস্তিত্বের মূলে তুমি। তুমি না থাকলে বা তুমি না চাইলে আমরা বেঁচে থাকতে পারবো না। তাই রক্ষা কর হে মা, ক্ষমা কর হে মা, দয়া কর হে মা! আমরা আর মিথ্যা বানোয়াট বৃক্ষের মর্যাদা চাই না। আমরা পরগাছা নামেইও তোমার ডালপালায় থেকে বেঁচে থাকতে চাই। কারণ অনন্তকাল মিথ্যাচার করা যায় না। মিথ্যাচারের কাল পরিসীমা আছে। মিথ্যাচারের কলশী পূর্ণ হতে গেলে, আর মিথ্যাচার রাখা যায় না এবং করাও যায় না। আমাদের কলশী বুঝি পূর্ণ হয়ে গেছে। তাই আজ থেকে আমরা আর মিথ্যাচার করবো না। আমরা পরগাছারা তোমারই সন্তান বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে গর্বিত হব। হে মা, এখন অন্তত রাগ তোমার প্রশমিত কর।
পরগাছাদের সকরুণ অনুরোধে অশ্বত্থ বৃক্ষ তার অভূতপূর্ব রুদ্রচণ্ডী রূপের তাণ্ডব নৃত্য পরিত্যাগ করে শান্ত হয়। এবং পরগাছাদেরও তাদের নিজেদের শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে চিরতরে শান্ত হয়ে অশ্বত্থ বৃক্ষের অনুগত হয়ে যায়। কিন্তু অশ্বত্থ বৃক্ষের প্রচণ্ড ঝাকুনিতে পরগাছাদের শিকড়্গুলো অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে যায়। তারা আর আগের মতন অশ্বত্থ বৃক্ষ থেকে খাদ্যরস গ্রহণ করতে পারে না। এরই ধারাবাহিকতায় পরগাছাগুলো একটু একটু করে শুকিয়ে যেতে থাকে। শুকিয়ে যাওয়ার পূর্বে তারা সকলেই একজন অন্যজনকে অভিযুক্ত করতে থাকে। তাদের মধ্যে যে প্রবীণ পরগাছা একবুক হতাশা নিয়ে বলে, "তোদের কারণেই আজ আমাদের ধীরেধীরে শুকিয়ে অন্তিমদশা গুণতে হচ্ছে। সকলে তো ভালই ছিলাম, দিব্যি আরামে আয়েশে ছিলাম।শুধু শুধুই মায়ের মত অশ্বত্থ বৃক্ষকে আমরা অপদস্ত করেছি, অপমানিত করেছি নিন্দা করেছি। নবীন পরগাছাগুলোই অশান্তি সৃষ্টির মূলে ছিল। ওরা কারো কথা শুনেনি। এমনকি আমি যে ওদের সবার থেকে বয়সে প্রবীণ, সেই আমাকে নূন্যতম সম্মান তো দেইনি ; এমনি আমার সুপরামর্শও শোনে নি। ফলে ওদের উগ্রতায় আজ আমাদের সকলের ভাগ্য জড়িয়ে গেলো। যদি নূন্যতম সংযত থাকতো, তবে এই দিন আমাদের দেখতে হত না। এ কারণেই কথায় বলে, বেশি বাড় বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে; অতি ছোট হইয়ো না ছাগলে মুড়ে খাবে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : সুপ্রাচীন অশ্বত্থ গাছের কথা
ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook