-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

বৈদিক গৃহ্যসূত্রের বিধানে, অন্নপ্রাশনে মাংসের প্রয়োগ ।

বৈদিক বেদাঙ্গের অন্যতম 'কল্প' হল বেদবিহিত কর্মের নিয়মানুসারী ব্যবস্থা বিধায়ক শাস্ত্র। কল্পসূত্র প্রধানত দুই প্রকারের শ্রৌতসূত্র এবং গৃহ্যসূত্র।শ্রৌতসূত্রের সাথে রয়েছে বৈদিক যজ্ঞের জন্য অত্যাবশকীয় শুল্বসূত্র এবং গৃহ্যসূত্রের সাথে রয়েছে ধর্মসূত্র। এভাবে কল্পসূত্র চার প্রকার: ১. গৃহ্যসূত্র, ২.ধর্মসূত্র, ৩.শ্রৌতসূত্র এবং ৪.শুল্বসূত্র।গূহ্যসূত্রকে বর্তমানকালে এক কথায় সনাতন পারিবারিক আইন বলা হয়। অর্থাৎ সনাত ধর্মীয় সকল প্রথা, সংস্কৃতি, করণীয় অকরণীয় প্রায় সকল নির্দেশনাই গৃহসূত্রে পাওয়া যায়। একজন মানুষের পরিবারে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত করণীয় এবং অকরণীয় সকল কর্তব্যই গৃহসূত্রে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। চার প্রকারের বেদের সাথে একাধিক গৃহ্যসূত্র রয়েছ। ঋগ্বেদের গৃহ্যসূত্র : আশ্বলায়ন, শাংখায়ন, কৌষিতকী। সামবেদের গৃহ্যসূত্র: গোভিল, দ্রাক্ষ্যায়ন,জৈমিনীয়, খাদির। কৃষ্ণযজুর্বেদীয় গৃহ্যসূত্র : বৌধায়ন, আপস্তম্ব, মানব, হিরণ্যকেশী, ভারদ্বাজ, বারাহ, কাঠক, লৌগাক্ষি, বৈখানস, বাধুল। শুক্ল যজুর্বেদীয় গৃহ্যসূত্র :পারস্কর বা বাজসনেয়। অথর্ববেদের গৃহ্যসূত্র: কৌশিক। বৈদিক এ গৃহসূত্রের উপরেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিবিধ প্রকারের বিধিবিধান সংস্থাপিত। এ গৃহসূত্রের মধ্যে ঋগ্বেদ এবং যজুর্বেদ নির্বিশেষে অধিকাংশ স্থানেই মাংসাহারের বিধান দৃষ্ট হয়। এমনকি একটি শিশু মাতৃদুগ্ধ এবং গোদুগ্ধ ছয়মাস ভক্ষণের পরে প্রথম যখন সে কঠিন খাদ্য গ্রহণ করে, বৈদিক সেই সংস্কারকে অন্নপ্রাশন বলে।ঋগ্বেদীয় আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে বলা হয়েছে, অন্নপ্রাশনের পুত্রকে ছাগমাংস খাওয়াতে। সন্তানের পিতা যদি পুত্রের ব্রহ্মতেজকামনা করে তবে সেই সন্তানকে অন্নপ্রাশনে পিতা তিত্তির পাখীর মাংস খাওয়াবে। পুত্রের শুধু তেজ কামনায় ঘৃত-সংস্কৃত অন্ন খাওয়াতে হবে। অর্থাৎ অন্নের মধ্যে ঘিয়ের স্পর্শ থাকবে। ষষ্ঠে মাস্যন্নপ্রাশনম্।১ আজম্ অন্নাদ্যকামঃ।।২ তৈত্তিরং ব্রম্মবর্চসকামঃ।।৩ ঘৃতৌদনং তেজস্কামঃ ।। ৪ দধিমধুঘৃতমিশ্রম্ অন্নং প্রাশয়েত্।  অন্নপতেঽন্নস্য নো দেহানমীবস্য শুষ্মিণঃ।  প্র প্রদাতারং তারিষ ঊর্জং নো ধেহি দ্বিপদে চতুষ্পদ ইতি৷৷ ৫ (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র: ১.১৬.১-৫) "ষষ্ঠমাসে হবে অন্নপ্রাশন।  ভক্ষ্য-অন্ন-কামনাকারী পুত্রকে ছাগমাংস খাওয়াবে। পুত্রের ব্রহ্মতেজকামনাকারী পিতা তিত্তির পাখীর মাংস খাওয়াবে। পুত্রের তেজঃকামনায় ঘৃত-সংস্কৃত অন্ন খাওয়াবে। দধি, মধু ও ঘৃতমিশ্রিত অন্ন শিশুকে 'অন্নপতে'–(অন্নপতি, দুঃখহীন ও বলকারক অন্ন দাও। দাতাকে অগ্রণী করাও। আমাদের, আমাদের লোকজনকে ও চতুষ্পদ পশুদের বল প্রদান কর) এই মন্ত্রে খাওয়াবে।" "আজম্ অন্নাদ্যকামঃ" এর পরবর্তী সূত্রে তৈত্তিরের কথা থাকায় ছাগের দুধ, দই বা ঘি নয়, মাংসই খাওয়াতে হবে। শুধু মাংস কেউ খায় না, তাই অন্নের সঙ্গে তা খেতে হবে। ঘৃতমিশ্রিত নয়, ঘৃতসংস্কৃত অন্নই খাওয়াতে হবে। বৃত্তি অনুযায়ী অন্ন সিদ্ধ হলে, সেই অন্নে ঘৃত ছড়িয়ে তা খাওয়াতে হবে। ঘি অন্নের সাথে একসাথে পাক করা যাবে না। খাওয়ানোর মন্ত্র সর্বত্রই এই ‘অন্নপতে—'। কোন কামনা না থাকলে দধি, মধু ও ঘৃত মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।  ঋগ্বেদের  শাঙ্খায়ন গৃহ্যসূত্রর প্রথম অধ্যায়ে আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রের মতই অন্নপ্রাশনের বিধি বর্ণিত হয়েছে। শিশুকে উত্তরমুখী বসিয়ে ষষ্ঠমাসে হয় অন্নপ্রাশন করতে হবে।অন্নপ্রাশনে দিনে, অর্থাৎ শিশুকে কঠিন খাদ্যের প্রথম ভক্ষণের সময় ছাগমাংস ভক্ষণ করাতে হবে। পিতা যদি সন্তানের ব্রহ্মতেজ কামনা করে তবে তিত্তির পাখীর মাংস ভক্ষণ করাবে। পিতা যদি সন্তানের দ্রুতগতি কামনা করলে অন্নপ্রাশনে মাছ ভক্ষণ করাবে। সন্তানের তেজ কামনা করলে ঘৃতমিশ্রিত অন্ন ভক্ষণ করাবে । ‘অন্নপতয়ে' মন্ত্র উচ্চারণ করে দধি, মধু ও ঘৃত দিয়ে প্রস্তুত খাদ্য শিশুকে ভক্ষণ করাতে হবে। ষষ্ঠে মাস্যন্নপ্রাশনম্ ।। ১।।  আজমন্নাদ্যকামঃ ৷৷২৷৷ তৈত্তিরং ব্রহ্মবর্চসকামঃ ।।৩।।  মাৎস্যং জবনকামঃ ।। ৪।। ঘৃতৌদনং তেজস্কামঃ ।।৫।।  দধিমধুঘৃতমিশ্ৰঅন্নং প্রাশয়েত্ ।।৬।।   ‘অন্নপতেঽন্নস্য নো দেহানমীবস্য শুষ্মিণঃ।  প্র-প্রদাতারং তারিষ ঊর্জং নো ধেহি দ্বিপদে চতুষ্পদে’ ।।  ‘যচ্চিদ্ধি’ ‘মহশ্চিৎ’ ‘ইমমগ্ন আয়ুষে বৰ্চসে তিগ্মমোজো বরুণ সোম রাজন্।  মাতেবাস্মা অদিতিঃ শৰ্ম যংসদ্ বিশ্বে দেবা জরদষ্টির্যথাসদ্‌’ ইতি।। হুত্বা ।।৭।।   ‘অগ্ন আয়ূংষী’তি অভিমন্ত্র্য ৷৷৮৷৷  উদগগ্রেষু কুশেষ ‘স্যোনা পৃথিবি ভবে’তি উপবেশ্য ।। ৯।।  মহাব্যাহৃতিভিঃ প্রাশনম্ ।। ১০।। শেষং মাতা প্রাশ্নীয়াত্ ৷৷১১৷৷ (শাঙ্খায়ন গৃহ্যসূত্র:১.২৭.১-১১) "ষষ্ঠ মাসে হয় অন্নপ্রাশন( কঠিন খাদ্যের প্রথম ভক্ষণ)। ভক্ষ্য-অন্ন-প্রার্থী ব্যক্তি শিশুকে ছাগমাংস ভক্ষণ করাবেন। ব্রহ্মতেজপ্রার্থী তিতির পাখীর মাংস ভক্ষণ করান, দ্রুতগতিপ্রার্থী মৎস্য ভক্ষণ করান, তেজপ্রার্থী ঘৃতমিশ্রিত অন্ন ভক্ষণ করাবে। দধি, মধু ও ঘৃত দিয়ে প্রস্তুত খাদ্য শিশুকে ভক্ষণ করাবেন। ‘অন্নপতয়ে—’(খাদ্যের অধিপতি, আমাদের তুমি দাও ব্যথারহিত ও শক্তিশালী খাদ্য; দাতাকে এগিয়ে দাও; আমাদের, মানুষ ও প্রাণীদের তুমি শক্তি দাও), “যচ্চিদ্ধি” (ঋগ্বেদ:৪.১২.৪), “মহশ্চিদ্—” (ঋগ্বেদ:৪.১২.৫), ইমমগ্ন—' (অগ্নি, তাকে দীর্ঘজীবন ও দ্যুতি দাও; তুমি হও ক্ষুরধার। বরুণ, রাজা সোম, অদিতি যেন মায়ের মত তাকে রক্ষা করেন; সব দেবতা যেন তাকে রক্ষা করেন, যাতে সে বার্ধক্য পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে) এই মন্ত্রে অভিমন্ত্রণ করে, “স্যোনা পৃথিবি—” (ঋগ্বেদ: ১.২২.১৫) এই মন্ত্র দিয়ে শিশুকে উত্তরমুখী কুশ-গুলির উপর বসিয়ে, মহাব্যাহৃতিগুলি দিয়ে তাকে ভক্ষণ করানো শেষ করা হয়। অবশিষ্ট অংশ শিশুর মাতা ভোজন করবে।" অনুরূপ দৃষ্টান্ত শুক্ল যর্জুবেদের পারস্কর গৃহ্যসূত্রের প্রথম কাণ্ডে পাওয়া যায়।যেখানে অন্নপ্রাশনে আটী পাখির মাংস, ভরদ্বাজ পক্ষিনীর মাংস, গৌরবর্ণের তিত্তির পাখির মাংস দ্বারা সন্তানকে অন্নপ্রাশন করানোর কথা বলা হয়েছে।বিবিধ প্রকারের মাংসের সাথে মাছ ও কাঁকড়া খাওয়ানো কথা বলা হয়েছে।  ষষ্ঠে মাসেঽপ্রাশনম্ ॥১  স্থালীপাকং শ্রপয়িত্বাঽঽজ্যভাগাবিষ্ট্বাঽঽজ্যাহুতী  জুহোতি দেবীং বাচমজনয়ন্ত দেবাস্তাং বিশ্বরূপাঃ পশবো বদন্তি ৷  সা নো মন্দ্রেষমূর্জং দুহানা ধেনর্বাগম্মানুপসুষ্টুতৈ তু স্বাহেতি ॥২   বাজো নো অদ্যেতি চ দ্বিতীয়াম ॥৩   স্থালীপাকস্য জুহোতি প্রাণেনান্নমশীয় বাহাঽপানেন  গন্ধানশীয় স্বাহা চক্ষুষা রূপাণ্যশীয় স্বাহা শ্রোত্রেণ যশোঽশীয় স্বাহেতি ॥৪   প্রাশনান্তে সর্বান, সর্বমন্নমেকত উদ্ধত্যাথৈনং প্ৰাশয়েৎ ॥৫  তৃষ্ণীং হন্তেতি বা হন্তকারং মনুষ্যা ইতি শ্রুতেঃ ॥৬  ভরদ্বাজ্যা মাংসেন বাক্ -প্রসারকামস্যঃ।।৭  কপিঞ্জলমাংসেনান্নাদ্যকামস্য।।৮  মৎসৈর্জবন কামস্য।।৯  কৃকষায়া আয়ুষ্কামস্য।।১০  আট্যা ব্রহ্মবর্চসকামস্য।।১১  সর্বৈঃ সর্বকামস্য।।১২।।  (পারস্কর গৃহ্যসূত্র: ১.১৯.১-১২) "জন্ম থেকে ষষ্ঠ মাসে পুত্রের ‘অন্নপ্রাশন’ নামক সংস্কারটি করতে হয়।  অতঃপর অন্নপ্রাশনের ইতিকর্তব্যতা সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হল—  এরপর স্থালীপাক অর্থাৎ চরু দ্বারা 'প্রাণেনান্নমশীয় স্বাহা" (প্রাণ বায়ু, দ্বারা আমি যেন খাদ্য ভক্ষণ করতে পারি); 'অপানেন গন্ধানশীয় স্বহা'(অপান বায়ু, দ্বারা আমি যেন গন্ধ গ্রহণ করতে পারি); 'চক্ষুষা রূপান্যশীয় স্বাহা' ( চোখ দ্বারা আমি যেন দৃশ্যবস্তু সমূহ দর্শন করতে পারি); 'শ্রোত্রেণ যশোঽশীয় স্বাহা'(শ্রোত্র বা কর্ণ দ্বারা যেন আমি যশ শুনতে পারি ) এই চারটি মন্ত্র বলে বলে অগ্নিতে চারটি আহতি প্রদান করতে হবে। প্রাশনান্তে স্বিষ্টকৃদ হোম থেকে শুরু করে দক্ষিণান্ত পর্যন্ত কর্মানুষ্ঠানের শেষ সমস্ত রস, সমস্ত লেহ্য, পেয়, চোষ্য এ চতুর্বিধ অন্ন একটি পাত্রে তুলে রাখবে। কিন্তু অন্ন কুমারকে ভক্ষণ করাবে না । মন্ত্র না বলে কেবল ‘হন্ত' কথাটি বলে অথবা ‘হস্তকারং মনুষ্যো উপজীবন্তি' এই শ্রতিবচনটি বলে কুমারকে পরবর্তীতে পাত্রের অন্ন ভক্ষণ করাবে। পিতা যদি মনে করে তার শিশু বাগ্মী হবে, এই ইচ্ছা করলে পিতা তাকে ভরদ্বাজ পক্ষিনীর মাংস মিশ্রিত কিরে খাওয়াবে। অন্ন, ভক্ষণের যোগ্য হওয়ার ইচ্ছা হলে, শিশুকে কপিঞ্জল বা গৌরবর্ণের তিত্তির পাখির মাংস দ্বারা অন্নপ্রাশন করাবে। শিশু বেগবান হবে, পিতা এমন ইচ্ছা করলে তাকে মাছ দিয়ে খাওয়াবে। শিশু চিরায়ু হবে এই আশা করলে, কাঁকড়ার মাংস দ্বারা অন্নপ্রাশন করাবে। পিতা শিশুর ব্রহ্মতেজ কামনা করলে আটী পাখির মাংস খাওয়াবে। আর যদি একত্রে সবগুণ ইচ্ছে করে তবে এই সব খাদ্য দ্বারা একত্রে সন্তানকে অন্নপ্রাশন করাবে।" তথ্য সহায়তা: ১.অমরকুমার চট্টোপাধ্যায়(সম্পা.), ঋগ্বেদীয় গৃহসূত্র, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা: ১ম প্রকাশ ২০০১ ২. অশোককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পারস্কর গৃহ্যসূত্র, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা: ১৪০৬ শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ। ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক :   বৈদিক গৃহ্যসূত্রের বিধানে, অন্নপ্রাশনে মাংসের প্রয়োগ । ফেসবুক পেজ লিঙ্ক :  Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook
বৈদিক বেদাঙ্গের অন্যতম 'কল্প' হল বেদবিহিত কর্মের নিয়মানুসারী ব্যবস্থা বিধায়ক শাস্ত্র। কল্পসূত্র প্রধানত দুই প্রকারের শ্রৌতসূত্র এবং গৃহ্যসূত্র।শ্রৌতসূত্রের সাথে রয়েছে বৈদিক যজ্ঞের জন্য অত্যাবশকীয় শুল্বসূত্র এবং গৃহ্যসূত্রের সাথে রয়েছে ধর্মসূত্র। এভাবে কল্পসূত্র চার প্রকার: ১. গৃহ্যসূত্র, ২.ধর্মসূত্র, ৩.শ্রৌতসূত্র এবং ৪.শুল্বসূত্র।গূহ্যসূত্রকে বর্তমানকালে এক কথায় সনাতন পারিবারিক আইন বলা হয়। অর্থাৎ সনাত ধর্মীয় সকল প্রথা, সংস্কৃতি, করণীয় অকরণীয় প্রায় সকল নির্দেশনাই গৃহসূত্রে পাওয়া যায়। একজন মানুষের পরিবারে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত করণীয় এবং অকরণীয় সকল কর্তব্যই গৃহসূত্রে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। চার প্রকারের বেদের সাথে একাধিক গৃহ্যসূত্র রয়েছ। ঋগ্বেদের গৃহ্যসূত্র : আশ্বলায়ন, শাংখায়ন, কৌষিতকী। সামবেদের গৃহ্যসূত্র: গোভিল, দ্রাক্ষ্যায়ন,জৈমিনীয়, খাদির। কৃষ্ণযজুর্বেদীয় গৃহ্যসূত্র : বৌধায়ন, আপস্তম্ব, মানব, হিরণ্যকেশী, ভারদ্বাজ, বারাহ, কাঠক, লৌগাক্ষি, বৈখানস, বাধুল। শুক্ল যজুর্বেদীয় গৃহ্যসূত্র :পারস্কর বা বাজসনেয়। অথর্ববেদের গৃহ্যসূত্র: কৌশিক।
বৈদিক এ গৃহসূত্রের উপরেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিবিধ প্রকারের বিধিবিধান সংস্থাপিত। এ গৃহসূত্রের মধ্যে ঋগ্বেদ এবং যজুর্বেদ নির্বিশেষে অধিকাংশ স্থানেই মাংসাহারের বিধান দৃষ্ট হয়। এমনকি একটি শিশু মাতৃদুগ্ধ এবং গোদুগ্ধ ছয়মাস ভক্ষণের পরে প্রথম যখন সে কঠিন খাদ্য গ্রহণ করে, বৈদিক সেই সংস্কারকে অন্নপ্রাশন বলে।ঋগ্বেদীয় আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে বলা হয়েছে, অন্নপ্রাশনের পুত্রকে ছাগমাংস খাওয়াতে। সন্তানের পিতা যদি পুত্রের ব্রহ্মতেজকামনা করে তবে সেই সন্তানকে অন্নপ্রাশনে পিতা তিত্তির পাখীর মাংস খাওয়াবে। পুত্রের শুধু তেজ কামনায় ঘৃত-সংস্কৃত অন্ন খাওয়াতে হবে। অর্থাৎ অন্নের মধ্যে ঘিয়ের স্পর্শ থাকবে।
ষষ্ঠে মাস্যন্নপ্রাশনম্।১
আজম্ অন্নাদ্যকামঃ।।২
তৈত্তিরং ব্রম্মবর্চসকামঃ।।৩
ঘৃতৌদনং তেজস্কামঃ ।। ৪
দধিমধুঘৃতমিশ্রম্ অন্নং প্রাশয়েত্।
অন্নপতেঽন্নস্য নো দেহানমীবস্য শুষ্মিণঃ।
প্র প্রদাতারং তারিষ ঊর্জং নো ধেহি দ্বিপদে চতুষ্পদ ইতি৷৷ ৫
(আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র: ১.১৬.১-৫)
"ষষ্ঠমাসে হবে অন্নপ্রাশন।
ভক্ষ্য-অন্ন-কামনাকারী পুত্রকে ছাগমাংস খাওয়াবে।
পুত্রের ব্রহ্মতেজকামনাকারী পিতা তিত্তির পাখীর মাংস খাওয়াবে।
পুত্রের তেজঃকামনায় ঘৃত-সংস্কৃত অন্ন খাওয়াবে।
দধি, মধু ও ঘৃতমিশ্রিত অন্ন শিশুকে 'অন্নপতে'–(অন্নপতি, দুঃখহীন ও বলকারক অন্ন দাও। দাতাকে অগ্রণী করাও। আমাদের, আমাদের লোকজনকে ও চতুষ্পদ পশুদের বল প্রদান কর) এই মন্ত্রে খাওয়াবে।"
"আজম্ অন্নাদ্যকামঃ" এর পরবর্তী সূত্রে তৈত্তিরের কথা থাকায় ছাগের দুধ, দই বা ঘি নয়, মাংসই খাওয়াতে হবে। শুধু মাংস কেউ খায় না, তাই অন্নের সঙ্গে তা খেতে হবে। ঘৃতমিশ্রিত নয়, ঘৃতসংস্কৃত অন্নই খাওয়াতে হবে। বৃত্তি অনুযায়ী অন্ন সিদ্ধ হলে, সেই অন্নে ঘৃত ছড়িয়ে তা খাওয়াতে হবে। ঘি অন্নের সাথে একসাথে পাক করা যাবে না। খাওয়ানোর মন্ত্র সর্বত্রই এই ‘অন্নপতে—'। কোন কামনা না থাকলে দধি, মধু ও ঘৃত মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
ঋগ্বেদের শাঙ্খায়ন গৃহ্যসূত্রর প্রথম অধ্যায়ে আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রের মতই অন্নপ্রাশনের বিধি বর্ণিত হয়েছে। শিশুকে উত্তরমুখী বসিয়ে ষষ্ঠমাসে হয় অন্নপ্রাশন করতে হবে।অন্নপ্রাশনে দিনে, অর্থাৎ শিশুকে কঠিন খাদ্যের প্রথম ভক্ষণের সময় ছাগমাংস ভক্ষণ করাতে হবে। পিতা যদি সন্তানের ব্রহ্মতেজ কামনা করে তবে তিত্তির পাখীর মাংস ভক্ষণ করাবে। পিতা যদি সন্তানের দ্রুতগতি কামনা করলে অন্নপ্রাশনে মাছ ভক্ষণ করাবে। সন্তানের তেজ কামনা করলে ঘৃতমিশ্রিত অন্ন ভক্ষণ করাবে । ‘অন্নপতয়ে' মন্ত্র উচ্চারণ করে দধি, মধু ও ঘৃত দিয়ে প্রস্তুত খাদ্য শিশুকে ভক্ষণ করাতে হবে।
ষষ্ঠে মাস্যন্নপ্রাশনম্ ।। ১।।
আজমন্নাদ্যকামঃ ৷৷২৷৷
তৈত্তিরং ব্রহ্মবর্চসকামঃ ।।৩।।
মাৎস্যং জবনকামঃ ।। ৪।।
ঘৃতৌদনং তেজস্কামঃ ।।৫।।
দধিমধুঘৃতমিশ্ৰঅন্নং প্রাশয়েত্ ।।৬।।
‘অন্নপতেঽন্নস্য নো দেহানমীবস্য শুষ্মিণঃ।
প্র-প্রদাতারং তারিষ ঊর্জং নো ধেহি দ্বিপদে চতুষ্পদে’ ।।
‘যচ্চিদ্ধি’ ‘মহশ্চিৎ’ ‘ইমমগ্ন আয়ুষে বৰ্চসে তিগ্মমোজো বরুণ সোম রাজন্।
মাতেবাস্মা অদিতিঃ শৰ্ম যংসদ্ বিশ্বে দেবা জরদষ্টির্যথাসদ্‌’ ইতি।। হুত্বা ।।৭।।
‘অগ্ন আয়ূংষী’তি অভিমন্ত্র্য ৷৷৮৷৷
উদগগ্রেষু কুশেষ ‘স্যোনা পৃথিবি ভবে’তি উপবেশ্য ।। ৯।।
মহাব্যাহৃতিভিঃ প্রাশনম্ ।। ১০।।
শেষং মাতা প্রাশ্নীয়াত্ ৷৷১১৷৷
(শাঙ্খায়ন গৃহ্যসূত্র:১.২৭.১-১১)
"ষষ্ঠ মাসে হয় অন্নপ্রাশন( কঠিন খাদ্যের প্রথম ভক্ষণ)। ভক্ষ্য-অন্ন-প্রার্থী ব্যক্তি শিশুকে ছাগমাংস ভক্ষণ করাবেন। ব্রহ্মতেজপ্রার্থী তিতির পাখীর মাংস ভক্ষণ করান, দ্রুতগতিপ্রার্থী মৎস্য ভক্ষণ করান, তেজপ্রার্থী ঘৃতমিশ্রিত অন্ন ভক্ষণ করাবে। দধি, মধু ও ঘৃত দিয়ে প্রস্তুত খাদ্য শিশুকে ভক্ষণ করাবেন। ‘অন্নপতয়ে—’(খাদ্যের অধিপতি, আমাদের তুমি দাও ব্যথারহিত ও শক্তিশালী খাদ্য; দাতাকে এগিয়ে দাও; আমাদের, মানুষ ও প্রাণীদের তুমি শক্তি দাও), “যচ্চিদ্ধি” (ঋগ্বেদ:৪.১২.৪), “মহশ্চিদ্—” (ঋগ্বেদ:৪.১২.৫), ইমমগ্ন—' (অগ্নি, তাকে দীর্ঘজীবন ও দ্যুতি দাও; তুমি হও ক্ষুরধার। বরুণ, রাজা সোম, অদিতি যেন মায়ের মত তাকে রক্ষা করেন; সব দেবতা যেন তাকে রক্ষা করেন, যাতে সে বার্ধক্য পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে) এই মন্ত্রে অভিমন্ত্রণ করে, “স্যোনা পৃথিবি—” (ঋগ্বেদ: ১.২২.১৫) এই মন্ত্র দিয়ে শিশুকে উত্তরমুখী কুশ-গুলির উপর বসিয়ে, মহাব্যাহৃতিগুলি দিয়ে তাকে ভক্ষণ করানো শেষ করা হয়। অবশিষ্ট অংশ শিশুর মাতা ভোজন করবে।"
অনুরূপ দৃষ্টান্ত শুক্ল যর্জুবেদের পারস্কর গৃহ্যসূত্রের প্রথম কাণ্ডে পাওয়া যায়।যেখানে অন্নপ্রাশনে আটী পাখির মাংস, ভরদ্বাজ পক্ষিনীর মাংস, গৌরবর্ণের তিত্তির পাখির মাংস দ্বারা সন্তানকে অন্নপ্রাশন করানোর কথা বলা হয়েছে।বিবিধ প্রকারের মাংসের সাথে মাছ ও কাঁকড়া খাওয়ানো কথা বলা হয়েছে।
ষষ্ঠে মাসেঽপ্রাশনম্ ॥১
স্থালীপাকং শ্রপয়িত্বাঽঽজ্যভাগাবিষ্ট্বাঽঽজ্যাহুতী
জুহোতি দেবীং বাচমজনয়ন্ত দেবাস্তাং বিশ্বরূপাঃ পশবো বদন্তি ৷
সা নো মন্দ্রেষমূর্জং দুহানা ধেনর্বাগম্মানুপসুষ্টুতৈ তু স্বাহেতি ॥২
বাজো নো অদ্যেতি চ দ্বিতীয়াম ॥৩
স্থালীপাকস্য জুহোতি প্রাণেনান্নমশীয় বাহাঽপানেন
গন্ধানশীয় স্বাহা চক্ষুষা রূপাণ্যশীয় স্বাহা শ্রোত্রেণ যশোঽশীয় স্বাহেতি ॥৪
প্রাশনান্তে সর্বান, সর্বমন্নমেকত উদ্ধত্যাথৈনং প্ৰাশয়েৎ ॥৫
তৃষ্ণীং হন্তেতি বা হন্তকারং মনুষ্যা ইতি শ্রুতেঃ ॥৬
ভরদ্বাজ্যা মাংসেন বাক্ -প্রসারকামস্যঃ।।৭
কপিঞ্জলমাংসেনান্নাদ্যকামস্য।।৮
মৎসৈর্জবন কামস্য।।৯
কৃকষায়া আয়ুষ্কামস্য।।১০
আট্যা ব্রহ্মবর্চসকামস্য।।১১
সর্বৈঃ সর্বকামস্য।।১২।।

(পারস্কর গৃহ্যসূত্র: ১.১৯.১-১২)
"জন্ম থেকে ষষ্ঠ মাসে পুত্রের ‘অন্নপ্রাশন’ নামক সংস্কারটি করতে হয়।
অতঃপর অন্নপ্রাশনের ইতিকর্তব্যতা সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হল—
এরপর স্থালীপাক অর্থাৎ চরু দ্বারা 'প্রাণেনান্নমশীয় স্বাহা" (প্রাণ বায়ু, দ্বারা আমি যেন খাদ্য ভক্ষণ করতে পারি); 'অপানেন গন্ধানশীয় স্বহা'(অপান বায়ু, দ্বারা আমি যেন গন্ধ গ্রহণ করতে পারি); 'চক্ষুষা রূপান্যশীয় স্বাহা' ( চোখ দ্বারা আমি যেন দৃশ্যবস্তু সমূহ দর্শন করতে পারি); 'শ্রোত্রেণ যশোঽশীয় স্বাহা'(শ্রোত্র বা কর্ণ দ্বারা যেন আমি যশ শুনতে পারি ) এই চারটি মন্ত্র বলে বলে অগ্নিতে চারটি আহতি প্রদান করতে হবে।
প্রাশনান্তে স্বিষ্টকৃদ হোম থেকে শুরু করে দক্ষিণান্ত পর্যন্ত কর্মানুষ্ঠানের শেষ সমস্ত রস, সমস্ত লেহ্য, পেয়, চোষ্য এ চতুর্বিধ অন্ন একটি পাত্রে তুলে রাখবে। কিন্তু অন্ন কুমারকে ভক্ষণ করাবে না ।
মন্ত্র না বলে কেবল ‘হন্ত' কথাটি বলে অথবা ‘হস্তকারং মনুষ্যো উপজীবন্তি' এই শ্রতিবচনটি বলে কুমারকে পরবর্তীতে পাত্রের অন্ন ভক্ষণ করাবে।
পিতা যদি মনে করে তার শিশু বাগ্মী হবে, এই ইচ্ছা করলে পিতা তাকে ভরদ্বাজ পক্ষিনীর মাংস মিশ্রিত কিরে খাওয়াবে।
অন্ন, ভক্ষণের যোগ্য হওয়ার ইচ্ছা হলে, শিশুকে কপিঞ্জল বা গৌরবর্ণের তিত্তির পাখির মাংস দ্বারা অন্নপ্রাশন করাবে।
শিশু বেগবান হবে, পিতা এমন ইচ্ছা করলে তাকে মাছ দিয়ে খাওয়াবে।
শিশু চিরায়ু হবে এই আশা করলে, কাঁকড়ার মাংস দ্বারা অন্নপ্রাশন করাবে।
পিতা শিশুর ব্রহ্মতেজ কামনা করলে আটী পাখির মাংস খাওয়াবে। আর যদি একত্রে সবগুণ ইচ্ছে করে তবে এই সব খাদ্য দ্বারা একত্রে সন্তানকে অন্নপ্রাশন করাবে।"
তথ্য সহায়তা:
১.অমরকুমার চট্টোপাধ্যায়(সম্পা.), ঋগ্বেদীয় গৃহসূত্র, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা: ১ম প্রকাশ ২০০১
২. অশোককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পারস্কর গৃহ্যসূত্র, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা: ১৪০৬
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁