-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

"নামাংসো মধুপর্কো ভবতি"; বৈদিক গৃহসূত্রে 'মধুপর্ক'।

"নামাংসো মধুপর্কো ভবতি"; বৈদিক গৃহসূত্রে 'মধুপর্ক'।  মধুপর্ক সাধারণত দেবপূজা এবং যজ্ঞে ব্যবহৃত হয়। দেবতার সন্তুষ্টির জন্য দধি, ঘৃত, জল, মধু ও শর্করা- এই পাঁচ প্রকার উপকরণ দ্বারা মধুপর্ক তৈরী করতে হয়। দধি-সর্পিঃ-জলম্ ক্ষৌদ্রম্ সিতা-এতাভিঃ-তু পঞ্চভিঃ।  প্রোচ্যতে মধুপর্কঃ-তু সৰ্বদেবৌঘ-তুষ্টয়ে ॥  "দধি, ঘৃত, জল, মধু ও শর্করা- এই পাঁচ প্রকার উপকরণ দ্বারা মধুপর্ক তৈরী করতে হয়। সর্বদেবতা মধুপর্কে তুষ্টিলাভ করেন। এতে জলের পরিমাণ মধুর চেয়ে কম রাখতে হয়। শর্করা, দধি ও ঘৃত সমভাগে, কেবল মধুই বেশী পরিমাণে দিতে হবে। সোনা, রূপা, কাঁসা প্রস্তরপাত্রে মধুপর্ক তৈরী করতে হয়।" মধুপর্ক এবং পঞ্চামৃত এ দুটোতেই পাঁচ প্রাকারের উপাদান থাকে। এ পঞ্চ উপাদান প্রায় একই বলা চলে। শুধুপর্কের জলের স্থানে পঞ্চামৃতে দুধ থাকে।সর্ব প্রকার দৈবকর্মে পঞ্চামৃত প্রশস্ত।  দধি দুগ্ধং ঘৃতম্-চ-এব শর্করা-সংযুতং মধু।    পঞ্চামৃতম্-ইদম্ প্রোক্তং বিধেয়ঃ সৰ্বকৰ্মসু ॥  "দধি, ঘৃত, দুধ, মধু ও শর্করা দ্বারা পঞ্চামৃত তৈরী করা হয়। সর্বকর্মে ইহা প্রশস্ত।" শ্রীশঙ্করাচার্য বিরচিত শ্রীমৃত্যুঞ্জয় মানসিক পূজা স্তোত্রের মধ্যেও শ্রীশঙ্করাচার্য মৃত্যুহরণকারী ত্রিলোকপূজ্য ভগবানকে গুড় দধি, মধু, উৎকৃষ্ট ঘৃতযুক্ত গোদুগ্ধ বিশিষ্ট, শুভকারী মধুপর্ক গ্রহণ করতে বলেছেন। গুড়দধিসহিতং মধুপ্রকীর্ণং সুঘৃতসমন্বিতধেনুদুগ্ধয়ুক্তম্ । শুভকর মধুপর্কমাহর ত্বং ত্রিনয়ন মৃত্যুহর ত্রিলোকবন্দ্য।।  (শ্রীমৃত্যুঞ্জয় মানসিক পূজাস্তোত্র:৭) "গুড় দধিযুক্ত, মধুমিশ্রিত, উৎকৃষ্ট ঘৃতযুক্ত গোদুগ্ধ বিশিষ্ট, শুভকারী মধুপর্ক হে ত্রিনয়ন! মৃত্যুহর! ত্রিলোকপূজ্য তুমি গ্রহণ কর।" বৈদিককাল থেকেই দেবতার উদ্দেশ্যে মধুপর্ক ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মহাভারত উদ্যোগ পর্বে (৩৮.৩) মধুপর্ক দিয়ে আপ্যায়িত করার কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি মহাভারতের অনুশাসন পর্বেও পাওয়া যায়, রাজপুরোহিত ,স্নাতক ব্রাহ্মণ, গুরু ও শ্বশুরসহ সকল সম্মানিত ব্যক্তিদের মধুপর্ক দ্বারা আপ্যায়িত করতে। বৈদিক বা মহাভারতের যুগে মধুপর্কে দুধ, দধি, ঘি মধুর সাথে মাংস ব্যবহৃত হত। কিন্তু দুধ, দধি, ঘি মধু, মাংস সকলই একসাথে মিলিয়ে পরিবেশন করা হত না। এখন আমরা মধুপর্ক বলতে যা বুঝি, সে সময়ে বিষয়টি বেশ আলাদা ছিল। বর্তমানে সোনা, রূপা, কাঁসা প্রস্তরপাত্রের বাটিতে দধি, ঘৃত, জল, মধু ও শর্করা- এই পাঁচ প্রকার উপকরণ একসাথে মিলিয়ে দেবতাকে সমর্পণ করা হয়। কিন্তু বৈদিকযুগে মধুপর্ক ছিল আচার্য, পিতা, বন্ধুসহ সম্মানিত অতিথির আগমনে বিবিধ উপাদেয় দ্রব্যের ভোজন। সেই ভোজন দ্রব্যের মধ্যে মধু, দুধ এবং দুধের পায়সসহ বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টান্ন থাকত। সাথে যজ্ঞে দেবতাকে সমর্পিত সুসংস্কৃত পশু মাংসও থাকত। বর্তমানে যেমন নিমন্ত্রিত বাড়িতে বিবিধ প্রকারের মাছ, মাংস ভোজন করে, পরিশেষে দুধের তৈরি দই, মিষ্টি ভোজন করানো হয়; ঠিক তেমনি ছিল প্রাচীনকালের মধুপর্ক। এ কারণেই মধুপর্ক সম্পর্কে আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে, মাংসবিহীন মধুপুর্ক প্রদান করতে নিষেধ করা হয়েছে: নামাংসো মধুপর্কো ভবতি।। (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র:১.২৪.২৬) "মধুপর্ক মাংসশূন্য হবে না।" ঋগ্বেদীয় শাঙ্খায়ণ গৃহ্যসূত্রে মহর্ষি মনু নির্দেশনা হিসেবে বলা হয়েছে, মধুপর্কে, সোমযাগে, পিতৃশ্রাদ্ধে ও দেবযাগে পশুদের বধ করা যায়। দেবযাগের পশুর মাংস দিয়ে গৃহে আগত আচার্য, পিতা, বন্ধু, অতিথিকে আপ্যায়িত করা যায়। এতে পশুহত্যার পাপ হয় না। কারণ একে বিহিত ধর্ম বলা হয়েছে।  মধুপর্কে চ সোমে চ পিতৃদৈবতকর্মণি। অত্রৈব পশবো হিংস্যা নান্যত্রেত্যব্রবীন্ মনুঃ।। আচার্যশ্চ পিতা চোভৌ সখা চানতিথিগৃর্হে। তে যদ্ বিদধ্যুস্তৎ কুর্যাদ্ ইতি ধর্মো বিধীয়তে।। (শাঙ্খায়ণ গৃহ্যসূত্র: ২.১৬.১-২)  "মহর্ষি মনু বলেছেন-মধুপর্কে, সোমযাগে, পিতৃশ্রাদ্ধে ও দেবযাগে পশুদের বধ করা যায়।আচার্য, পিতা, বন্ধু, অতিথির আগমনে তাদের আপ্যায়নে এটিই বিহিত ধর্ম।" শাঙ্খায়ণ গৃহ্যসূত্রের এ সূত্রগুলোই ঋগ্বেদীয় অন্য আরেকটি গৃহসূত্র, যার নাম কৌষিতকী গৃহ্যসূত্র; সেই গৃহসূত্রে (৩.১০.৩৫) উক্ত হয়েছে। অর্থাৎ পশুমাংস সহ মধুপর্ক দিয়ে পূজনীয় ব্যক্তি এবং গৃহে আগত অতিথিদের আপ্যায়িত করার বিষয়টি ঋগ্বেদীয় সকল গৃহসূত্রেই রয়েছে। বৈদিক শাঙ্খায়ণ এবং কৌষিতকী গৃহ্যসূত্রে মধুপর্কে মাংস প্রয়োগে মহর্ষি মনুর যে বিধানটি বলা হয়েছে ; সেই বিধানটি মনুসংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ে পাওয়া যায়।সেখানে মহর্ষি মনু বলেন, কেবলমাত্র মধুপর্কাদি প্রয়োজনে যদি পণ্ডবধ করেন, তবে সেই ব্যক্তির কোন পাপ আশ্রয় করে না। বরং এ দৈবকর্মে সে পশুটিকে উৎকৃষ্ট গতি প্রাপ্ত করিয়ে উভয়েরই সদ্‌গতি লাভ করেন। মধুপর্কে চ যজ্ঞে চ পিতৃদৈবতকর্মণি।  অত্রৈব পশবো হিংস্যা নান্যত্রেত্যব্রবীন্মনুঃ।।  এষ্বর্থেষু পশূন্ হিংসন্ বেদতত্ত্বার্থবিদ দ্বিজঃ।  আত্মানঞ্চ পশুঞ্চৈব গময়ত্যুত্তমাং গতিম্।।  (মনুসংহিতা:৫.৪১-৪২) "মধুপর্কের, যজ্ঞে,পিতৃকার্যে এবং দেবকার্যেই পশু বধ করবে, কিন্তু অন্য কোনও উদ্দেশ্যে এই পশুহিংসা কর্তব্য নয়। এ কথা মনু বলেছেন। বেদার্থতত্ত্বজ্ঞ দ্বিজাতিরা কেবলমাত্র মধুপর্কাদি প্রয়োজনে যদি পণ্ডবধ করেন, তবে তার দ্বারা তিনি নিজেকে এবং সেই পশুটিকে উৎকৃষ্ট গতি প্রাপ্ত করিয়ে দেন—উভয়েরই সদ্‌গতি লাভ হয়৷" মনুসংহিতার মত বিষ্ণু সংহিতায় বলা হয়েছে, মধুপর্কের জন্য পশুহত্যা করা যায়। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে পশুহিংসা করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।  মধুপর্কে চ যজ্ঞে চ পিতৃদৈবতকর্মণি অত্রৈব পশবো হিংসা নান্যেত্রেতি কথঞ্চন।।  (বিষ্ণু সংহিতা:৫১.৬৪) "মধুপর্ক, যজ্ঞ, পিতৃশ্রাদ্ধ ও দেবকার্যে- এ সকল কর্মে পশুহত্যা করা যায়। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে পশুহিংসা করবে না।" দেবতাকে আসন, পাদ্য, অর্ঘ্য, বস্ত্র, আচমনীয়, স্নানীয়, নৈবেদ্য, মধুপর্ক ইত্যাদি সমর্পণ করে আরাধনা করা হয়। এ পরম্পরা বৈদিককাল থেকে আজও বহমান। তাই দেবতার উপাসনায় মধুপর্কের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ষোড়শোপচারের পূজায় মধুপর্ক অত্যাবশকীয় উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিষয়টি শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থানেই রয়েছে।ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে একাদশী ব্রতের বর্ণনায় পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, একাদশী তিথির মধ্যেই ব্রতদ্রব্য সংগ্রহ করতে হবে। ষোড়শোপচারে দেবতাদের পূজা করতে ষোড়শোপচার দ্রব্যই বিধিনির্দিষ্ট হয়ে আছে। এ ব্রতের দ্রব্যের মধ্যে অন্যতম হল মধুপর্ক। নিত্যপূজাং দিনে কৃত্বা ব্রতদ্রব্যং সমাহরেৎ। দ্রব্যং ষোড়শোপচারং প্রকৃষ্টং বিধিবোধিতম্।। আসনং বসনং পাদ্যমর্ঘ্যং পুষ্পানুলেপনম্। ধূপদীপঞ্চ নৈবেদ্যং যজ্ঞসূত্রঞ্চ ভূষণম্।। গন্ধস্নানীয়তাম্বূলং মধুপর্কঃ পুনর্জলম্। ত্রতান্যাহৃত্য দিবসে ব্রতং নক্তং সমাচরেৎ।। (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ : শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড,২৬.৪৪-৪৬) "নিত্যপূজা সম্পাদন করে দিনের মধ্যেই ব্রতদ্রব্য আহরণ করবে ; এতে ষোড়শোপচার দ্রব্যই প্রকৃত বিধিনির্দিষ্ট। আসন,বস্ত্র, পাদ্য,অর্ঘ্য, পুষ্প, অনুলেপন, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, যজ্ঞসূত্র, ভূষণ,গন্ধ, স্নানীয়, তাম্বূল, মধুপর্ক(ঘি, মধু,দধি, দুধ এবং চিনি) এবং আচমনীয় ; ব্রতী এ ষোড়শোপচারের দ্রব্য সকল দিবসে আহরণ করে রাত্রিতে ব্রত করবে।" কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী  সহকারী অধ্যাপক,  সংস্কৃত বিভাগ,  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মধুপর্ক সাধারণত দেবপূজা এবং যজ্ঞে ব্যবহৃত হয়। দেবতার সন্তুষ্টির জন্য দধি, ঘৃত, জল, মধু ও শর্করা- এই পাঁচ প্রকার উপকরণ দ্বারা মধুপর্ক তৈরী করতে হয়।
দধি-সর্পিঃ-জলম্ ক্ষৌদ্রম্ সিতা-এতাভিঃ-তু পঞ্চভিঃ।
প্রোচ্যতে মধুপর্কঃ-তু সৰ্বদেবৌঘ-তুষ্টয়ে ॥
"দধি, ঘৃত, জল, মধু ও শর্করা- এই পাঁচ প্রকার উপকরণ দ্বারা মধুপর্ক তৈরী করতে হয়। সর্বদেবতা মধুপর্কে তুষ্টিলাভ করেন। এতে জলের পরিমাণ মধুর চেয়ে কম রাখতে হয়। শর্করা, দধি ও ঘৃত সমভাগে, কেবল মধুই বেশী পরিমাণে দিতে হবে। সোনা, রূপা, কাঁসা প্রস্তরপাত্রে মধুপর্ক তৈরী করতে হয়।"
মধুপর্ক এবং পঞ্চামৃত এ দুটোতেই পাঁচ প্রাকারের উপাদান থাকে। এ পঞ্চ উপাদান প্রায় একই বলা চলে। শুধুপর্কের জলের স্থানে পঞ্চামৃতে দুধ থাকে।সর্ব প্রকার দৈবকর্মে পঞ্চামৃত প্রশস্ত।
দধি দুগ্ধং ঘৃতম্-চ-এব শর্করা-সংযুতং মধু।
পঞ্চামৃতম্-ইদম্ প্রোক্তং বিধেয়ঃ সৰ্বকৰ্মসু ॥
"দধি, ঘৃত, দুধ, মধু ও শর্করা দ্বারা পঞ্চামৃত তৈরী করা হয়। সর্বকর্মে ইহা প্রশস্ত।"
শ্রীশঙ্করাচার্য বিরচিত শ্রীমৃত্যুঞ্জয় মানসিক পূজা স্তোত্রের মধ্যেও শ্রীশঙ্করাচার্য মৃত্যুহরণকারী ত্রিলোকপূজ্য ভগবানকে গুড় দধি, মধু, উৎকৃষ্ট ঘৃতযুক্ত গোদুগ্ধ বিশিষ্ট, শুভকারী মধুপর্ক গ্রহণ করতে বলেছেন।
গুড়দধিসহিতং মধুপ্রকীর্ণং
সুঘৃতসমন্বিতধেনুদুগ্ধয়ুক্তম্ ।
শুভকর মধুপর্কমাহর ত্বং
ত্রিনয়ন মৃত্যুহর ত্রিলোকবন্দ্য।।
(শ্রীমৃত্যুঞ্জয় মানসিক পূজাস্তোত্র:৭)
"গুড় দধিযুক্ত, মধুমিশ্রিত, উৎকৃষ্ট ঘৃতযুক্ত গোদুগ্ধ বিশিষ্ট, শুভকারী মধুপর্ক হে ত্রিনয়ন! মৃত্যুহর! ত্রিলোকপূজ্য তুমি গ্রহণ কর।"
বৈদিককাল থেকেই দেবতার উদ্দেশ্যে মধুপর্ক ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মহাভারত উদ্যোগ পর্বে (৩৮.৩) মধুপর্ক দিয়ে আপ্যায়িত করার কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি মহাভারতের অনুশাসন পর্বেও পাওয়া যায়, রাজপুরোহিত ,স্নাতক ব্রাহ্মণ, গুরু ও শ্বশুরসহ সকল সম্মানিত ব্যক্তিদের মধুপর্ক দ্বারা আপ্যায়িত করতে। বৈদিক বা মহাভারতের যুগে মধুপর্কে দুধ, দধি, ঘি মধুর সাথে মাংস ব্যবহৃত হত। কিন্তু দুধ, দধি, ঘি মধু, মাংস সকলই একসাথে মিলিয়ে পরিবেশন করা হত না। এখন আমরা মধুপর্ক বলতে যা বুঝি, সে সময়ে বিষয়টি বেশ আলাদা ছিল। বর্তমানে সোনা, রূপা, কাঁসা প্রস্তরপাত্রের বাটিতে দধি, ঘৃত, জল, মধু ও শর্করা- এই পাঁচ প্রকার উপকরণ একসাথে মিলিয়ে দেবতাকে সমর্পণ করা হয়। কিন্তু বৈদিকযুগে মধুপর্ক ছিল আচার্য, পিতা, বন্ধুসহ সম্মানিত অতিথির আগমনে বিবিধ উপাদেয় দ্রব্যের ভোজন। সেই ভোজন দ্রব্যের মধ্যে মধু, দুধ এবং দুধের পায়সসহ বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টান্ন থাকত। সাথে যজ্ঞে দেবতাকে সমর্পিত সুসংস্কৃত পশু মাংসও থাকত। বর্তমানে যেমন নিমন্ত্রিত বাড়িতে বিবিধ প্রকারের মাছ, মাংস ভোজন করে, পরিশেষে দুধের তৈরি দই, মিষ্টি ভোজন করানো হয়; ঠিক তেমনি ছিল প্রাচীনকালের মধুপর্ক। এ কারণেই মধুপর্ক সম্পর্কে আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে, মাংসবিহীন মধুপুর্ক প্রদান করতে নিষেধ করা হয়েছে:
নামাংসো মধুপর্কো ভবতি।।
(আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র:১.২৪.২৬)
"মধুপর্ক মাংসশূন্য হবে না।"
ঋগ্বেদীয় শাঙ্খায়ণ গৃহ্যসূত্রে মহর্ষি মনু নির্দেশনা হিসেবে বলা হয়েছে, মধুপর্কে, সোমযাগে, পিতৃশ্রাদ্ধে ও দেবযাগে পশুদের বধ করা যায়। দেবযাগের পশুর মাংস দিয়ে গৃহে আগত আচার্য, পিতা, বন্ধু, অতিথিকে আপ্যায়িত করা যায়। এতে পশুহত্যার পাপ হয় না। কারণ একে বিহিত ধর্ম বলা হয়েছে।
মধুপর্কে চ সোমে চ পিতৃদৈবতকর্মণি।
অত্রৈব পশবো হিংস্যা নান্যত্রেত্যব্রবীন্ মনুঃ।।
আচার্যশ্চ পিতা চোভৌ সখা চানতিথিগৃর্হে।
তে যদ্ বিদধ্যুস্তৎ কুর্যাদ্ ইতি ধর্মো বিধীয়তে।।
(শাঙ্খায়ণ গৃহ্যসূত্র: ২.১৬.১-২)
"মহর্ষি মনু বলেছেন-মধুপর্কে, সোমযাগে, পিতৃশ্রাদ্ধে ও দেবযাগে পশুদের বধ করা যায়।আচার্য, পিতা, বন্ধু, অতিথির আগমনে তাদের আপ্যায়নে এটিই বিহিত ধর্ম।"
শাঙ্খায়ণ গৃহ্যসূত্রের এ সূত্রগুলোই ঋগ্বেদীয় অন্য আরেকটি গৃহসূত্র, যার নাম কৌষিতকী গৃহ্যসূত্র; সেই গৃহসূত্রে (৩.১০.৩৫) উক্ত হয়েছে। অর্থাৎ পশুমাংস সহ মধুপর্ক দিয়ে পূজনীয় ব্যক্তি এবং গৃহে আগত অতিথিদের আপ্যায়িত করার বিষয়টি ঋগ্বেদীয় সকল গৃহসূত্রেই রয়েছে।
বৈদিক শাঙ্খায়ণ এবং কৌষিতকী গৃহ্যসূত্রে মধুপর্কে মাংস প্রয়োগে মহর্ষি মনুর যে বিধানটি বলা হয়েছে ; সেই বিধানটি মনুসংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ে পাওয়া যায়।সেখানে মহর্ষি মনু বলেন, কেবলমাত্র মধুপর্কাদি প্রয়োজনে যদি পণ্ডবধ করেন, তবে সেই ব্যক্তির কোন পাপ আশ্রয় করে না। বরং এ দৈবকর্মে সে পশুটিকে উৎকৃষ্ট গতি প্রাপ্ত করিয়ে উভয়েরই সদ্‌গতি লাভ করেন।
মধুপর্কে চ যজ্ঞে চ পিতৃদৈবতকর্মণি।
অত্রৈব পশবো হিংস্যা নান্যত্রেত্যব্রবীন্মনুঃ।।
এষ্বর্থেষু পশূন্ হিংসন্ বেদতত্ত্বার্থবিদ দ্বিজঃ।
আত্মানঞ্চ পশুঞ্চৈব গময়ত্যুত্তমাং গতিম্।।
(মনুসংহিতা:৫.৪১-৪২)
"মধুপর্কের, যজ্ঞে,পিতৃকার্যে এবং দেবকার্যেই পশু বধ করবে, কিন্তু অন্য কোনও উদ্দেশ্যে এই পশুহিংসা কর্তব্য নয়। এ কথা মনু বলেছেন।
বেদার্থতত্ত্বজ্ঞ দ্বিজাতিরা কেবলমাত্র মধুপর্কাদি প্রয়োজনে যদি পণ্ডবধ করেন, তবে তার দ্বারা তিনি নিজেকে এবং সেই পশুটিকে উৎকৃষ্ট গতি প্রাপ্ত করিয়ে দেন—উভয়েরই সদ্‌গতি লাভ হয়৷"
মনুসংহিতার মত বিষ্ণু সংহিতায় বলা হয়েছে, মধুপর্কের জন্য পশুহত্যা করা যায়। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে পশুহিংসা করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
মধুপর্কে চ যজ্ঞে চ পিতৃদৈবতকর্মণি
অত্রৈব পশবো হিংসা নান্যেত্রেতি কথঞ্চন।।
(বিষ্ণু সংহিতা:৫১.৬৪)
"মধুপর্ক, যজ্ঞ, পিতৃশ্রাদ্ধ ও দেবকার্যে- এ সকল কর্মে পশুহত্যা করা যায়। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে পশুহিংসা করবে না।"
দেবতাকে আসন, পাদ্য, অর্ঘ্য, বস্ত্র, আচমনীয়, স্নানীয়, নৈবেদ্য, মধুপর্ক ইত্যাদি সমর্পণ করে আরাধনা করা হয়। এ পরম্পরা বৈদিককাল থেকে আজও বহমান। তাই দেবতার উপাসনায় মধুপর্কের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ষোড়শোপচারের পূজায় মধুপর্ক অত্যাবশকীয় উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিষয়টি শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থানেই রয়েছে।ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে একাদশী ব্রতের বর্ণনায় পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, একাদশী তিথির মধ্যেই ব্রতদ্রব্য সংগ্রহ করতে হবে। ষোড়শোপচারে দেবতাদের পূজা করতে ষোড়শোপচার দ্রব্যই বিধিনির্দিষ্ট হয়ে আছে। এ ব্রতের দ্রব্যের মধ্যে অন্যতম হল মধুপর্ক।
নিত্যপূজাং দিনে কৃত্বা ব্রতদ্রব্যং সমাহরেৎ।
দ্রব্যং ষোড়শোপচারং প্রকৃষ্টং বিধিবোধিতম্।।
আসনং বসনং পাদ্যমর্ঘ্যং পুষ্পানুলেপনম্।
ধূপদীপঞ্চ নৈবেদ্যং যজ্ঞসূত্রঞ্চ ভূষণম্।।
গন্ধস্নানীয়তাম্বূলং মধুপর্কঃ পুনর্জলম্।
ত্রতান্যাহৃত্য দিবসে ব্রতং নক্তং সমাচরেৎ।।
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ : শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড,২৬.৪৪-৪৬)
"নিত্যপূজা সম্পাদন করে দিনের মধ্যেই ব্রতদ্রব্য আহরণ করবে ; এতে ষোড়শোপচার দ্রব্যই প্রকৃত বিধিনির্দিষ্ট। আসন,বস্ত্র, পাদ্য,অর্ঘ্য, পুষ্প, অনুলেপন, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, যজ্ঞসূত্র, ভূষণ,গন্ধ, স্নানীয়, তাম্বূল, মধুপর্ক(ঘি, মধু,দধি, দুধ এবং চিনি) এবং আচমনীয় ; ব্রতী এ ষোড়শোপচারের দ্রব্য সকল দিবসে আহরণ করে রাত্রিতে ব্রত করবে।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁