ব্যবহারিক ধর্ম দৃশ্যমান হয় সদাচারের দৃঢ় ভীত্তির উপরে। মহাভারত সহ বিভিন্ন শাস্ত্রে সদাচার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। এর মধ্যে বিষ্ণুপুরাণের গৃহস্থ সদাচার অংশটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিষ্ণু পুরাণের তৃতীয় অংশের দ্বাদশ অধ্যায়ে গার্হস্থ জীবনের সদাচারগুলো সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছ। এই সদাচারের কয়েকটি বিষয় মূখ্য আত্মকল্যাণের সাথে সাথে জগতের কল্যাণ। এই সদাচারগুলো নিয়মিত আচরণের কারণে মানুষের মধ্যে প্রভূত পরিবর্তন হয়। ধীরেধীরে পর্যায়ক্রমে মানুষ নিজেকে পরিবর্তিত করে নিতে পারে। সদাচারগুলোর লক্ষ্য কয়েকটি বিষয়। অশুদ্ধ বা অপবিত্র বস্তু বা বিষয়ের সংস্পর্শে না যাওয়া এবং তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা। তেমনি ক্ষতিকর বস্তু বা বিষয়ের থেকে দূরে থাকা। শ্লীলের মাত্রা অতিক্রম করে যা, তাই অশ্লীলতা। সেই অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকা। বিষ্ণুপুরাণে মহর্ষি ঔর্ধ্ব রাজা সগরকে গৃহস্থের অবশ্যপালনীয় সদাচার সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে বলেন:
ঔর্ধ্ব উবাচ।
দেব-গো-ব্রাহ্মণান্ সিদ্ধবৃদ্ধাচাৰ্যাংস্তথার্চ্চয়েৎ ।
দ্বিকালঞ্চ নমেৎ সন্ধ্যামগ্রীনুপচরেৎ তথ্য ॥১
সদানুপহতে বস্ত্রে প্রশস্তাশ্চ তথৌষধীঃ ।
গারুড়ানি চ রত্নানি বিভৃয়াৎ প্রযতো নরঃ ॥২
প্রস্নিগ্ধামলকেশশ্চ সুগন্ধিশ্চারুবেশদধৃক্ ।
সিতাঃ সুমনসো হৃদ্যা বিভৃয়াচ্চ নরঃ সদা ॥৩
"মহর্ষি ঔর্ধ বললেন,—গৃহস্থ প্রতিদিন দেবতা, গো, ব্রাহ্মণ, সিদ্ধপুরুষ ও বৃদ্ধ আচার্য্যগণের পূজা করবে। দুই সন্ধ্যায় ঈশ্বরকে নমস্কার করবে। অগ্নিসকলের হোমাদি দ্বারা উপচরণ করবে। গৃহস্থ সর্বদা প্রযত হয়ে অচ্ছিন্ন বস্ত্রদ্বয়, মহৌষধি ও গারুড় রত্নসকল শরীরে ধারণ করবে৷ কেশগুলি সর্বদা পরিষ্কার পরিছন্ন রাখবে। সুগন্ধযুক্ত মনোহর বেশধারী হবে এবং সম্ভব হলে দেহে উত্তম শুক্ল পুষ্প ধারণ করবে।"
গৃহের আরাধ্য দেববিগ্রহকে প্রতিদিন পূজা করাকে নিত্যপূজা বলে। এই নিত্যপূজা নিত্যপ্রয়োজনীয়, তাই কখনো এ পূজা বন্ধ করতে নেই। শ্লোকের মাত্রা সংখ্যা ঠিক রাখতে শ্লোকের প্রয়োজনে দেবতা, গো, ব্রাহ্মণ, সিদ্ধপুরুষ ও বৃদ্ধ আচার্য্য সবার ক্ষেত্রেই 'অর্চয়েৎ'।ক্রিয়াপদটি ব্যবহৃত হয়েছে। যার অর্থ অর্চনা করা, পূজা করা, সন্তুষ্ট করা।শ্লোকে সকলের ক্ষেত্রেই 'অর্চয়েৎ'' শব্দটি ব্যবহৃত হলেও প্রত্যেকের ক্ষেত্রে একই অর্থে প্রযুক্ত নয়। যেমন দেবতাদের ক্ষেত্রে 'অর্চয়েৎ' শব্দটির অর্থ পূজা করা উপাসনা করা। তেমনি গো এবং ব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে শব্দটির অর্থ সন্তুষ্ট করা। সনাতন জীবন ধারায় ত্রিসন্ধ্যা হলো অতি অত্যাবশকীয় একটি পবিত্র নিত্যকর্ম। দিনের তিনটি সন্ধিক্ষণে তিনবার এই সন্ধ্যাপ্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিদিন তিনবার ত্রিসন্ধ্যা না করলে পাপ হয়। তিনবার যদি সন্ধ্যা করতে সময় না হয়, তবে প্রভাত এবং সন্ধ্যাকালের সন্ধ্যাপ্রার্থনা বাধ্যতামূলক। এই সন্ধ্যাপ্রার্থনায় সন্ধ্যাদেবী গায়ত্রীকে আহ্বান করে শুদ্ধ হৃদয়ে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা হয়। গৃহে স্থাপিত গার্হপত্য অগ্নিতে প্রতিদিন বিবিধ উপাচারের সাথে যজ্ঞ করতে হবে। মহৌষধি গুণযুক্ত ও গারুড় রত্নসকল শরীরে ধারণ করতে বলা হয়েছে। গারুড় রত্ন বলতে, পান্না বা সংস্কৃতে মরকত মণি বলা হয়। রত্নটি বুধগ্রহের রত্ন। সবুজ, রক্তাভ, হরিদ্রাভ এবং নীলাভ বর্ণের হয়। শুদ্ধ পান্নার বর্ণ দূর্বার ন্যায়, স্বচ্ছ এবং দাগ শূন্য। সবুজ দূর্বার ন্যায় বর্ণবিশিষ্ট পান্না শেষ্ঠ। রক্তাভা এবং হরিদ্রাভ পান্নাও ফল দেয়। কিন্তু রক্তাভ পান্না অপমৃত্যুর কারণ হতে পারে। শুধু গ্রহের সন্তুষ্টি নয়, মণির বস্তুগত উপকারিতা রয়েছে।মরকতমণি বিষনাশক বলে শাস্ত্রে বলা আছে। এই মণির ব্যবহারে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং আচরণ সংযত হয়।সম্পূর্ণ শরীরের সাথে সাথে চুলকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। চুলে যেন ময়লা জমে ভারি হয়ে না যায়। সাধ্যমত প্রসাধন ব্যবহার করতে হবে। পুরুষেরা মালা তৈরি করে গলায় এবং নরীরা গলায় সাথে চুলের খোপাতে প্রতিদিন সাদা রঙের ফুল ব্যবহার করবে। এতে মন প্রসন্ন থাকে। এই প্রথাটি আজও দেখা যায়। এই ফুলের ব্যবহারটি দ্রাবিড় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।
কিঞ্চিৎ পরস্বং ন হরেন্নাল্পমপ্যপ্রিয়ং বদেৎ ।
প্রিয়ঞ্চ নানৃতং ব্রূয়ান্নান্যদোষাসুদীরয়েৎ ॥৪
নান্যশ্রিয়ং তথা বৈরং রোচয়েৎ পুরুষেশ্বর ।
ন দুষ্টং যানমারোহেৎ কূলচ্ছায়াং ন সংশ্ৰয়েৎ ॥৫
"বিন্দুমাত্রও কারো পরস্ব হরণ করবে না। কাউকে অল্প মাত্রও অপ্রিয় বাক্য বলবে না, মিথ্যা প্রিয়বাক্য ব্যবহার করিবে না। অন্যের দোষ বর্ণন করবে না। হে পুরুষেশ্বর! অন্যের সম্পদ দেখে লোভ করবে না, কারও সাথে শত্রুতাও করবে না। নিন্দিত যানে আরোহণ করবে না এবং নদীকূলচ্ছায়াকে আশ্রয় করবে না।"
শুক্ল যজুর্বেদে বলা হয়েছে, এ জগত ঈশ্বরের ; তাই জগতের সকল কিছুই ত্যাগের সাথে ভোগ করতে। শাস্ত্রে ভোগ করতে নিষেধ করা হয়নি। ভোগ করা যাবে শুধুই প্রয়োজন অনুসারে এবং অনাসক্তভাবে। কারো দ্রব্যে লোভ করা উচিত নয় এবং চুরি করা উচিত নয়। অন্যের ধনে লোভ সকল সদগুণের বিনাশ ঘটায়। আমাদের উচিত অন্যের দোষ প্রকাশ্যে তুলে না ধরে, তাকে যথাসম্ভব সংশোধনের প্রচেষ্টা করা। দোষ প্রকাশ্যে তুলে ধরলে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে যায়। তখন আর সে সংশোধিত হয় না বা হতে চায় না। যাতায়াতের জন্য যানবাহনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু সকল যানবাহনেই চলাচল করা উচিত নয়। দুষ্ট বা নিন্দিত যানে চলাচল করা উচিত নয়। যে সকল যানে দুর্ঘটনা বিপদের সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং যে সকল যান অমানবিক তাকেই নিন্দিত যান বলে। যেমন, মানুষের পিঠে চড়ে চলাচল করা অমানবিক এবং দৃষ্টিকটু। এই এই প্রকারের যান বর্জনীয়।
বিদ্বিষ্টপতিত্যেন্মত্তবহু বৈরাতিকীটকৈঃ।
বন্ধকী-বন্ধকীভর্ত্তৃ-ক্ষুদ্রানৃতকথৈঃ সহ ॥৬
তথ্যতিব্যয়ণীলৈশ্চ পরিবাদরতৈঃ শঠৈঃ।
বুধো ন মৈত্রীং কুর্বীত নৈকপস্থানমাশ্রয়েৎ ॥৭
নাবগাহেজ্জলৌঘস্য বেগমগ্নে নরেশ্বর।
প্রদীপ্তং বেশ্ম বিশেষান্নারোহেচ্ছিখরং তরোঃ ॥৮
ন কুৰ্য্যাদ্দন্তসংঘর্ষং ন কুঞ্চীয়াচ্চ নাসিকাম্ ।
নাসংবৃতমুখো জৃম্ভেৎ শ্বাস-কাসৌ চ বর্জয়েৎ ॥
"লোকবিদ্বিষ্ট ব্যক্তির সাথে, পতিত ব্যক্তির সাথে, উন্মত্ত ব্যক্তির সাথে, বহুশত্রুসমন্বিত লোকের সাথে , কুদেশস্থিত মনুষ্যের সহিত, বেশ্যা ও বেশ্যাপতির সাথে, অল্পলাভগর্বিত ব্যক্তির সাথে, মিথ্যাবাদীর সাথে, অতি ব্যয়কারী মনুষ্যের সাথে, পরনিন্দাপরায়ণ ব্যক্তির সাথে ও শঠের সাথে মিত্রতা করবে না এবং একসাথে পথও চলবে না। হে নরেশ্বর ! স্রোতস্বতী নদ্যাদির স্রোতোরহিত জলে স্নান করবে না; প্রজ্বলিত গৃহে প্রবেশ বা বৃক্ষের শিখরে আরোহণ করবে না। দন্তে দন্তে ঘর্ষণ করবে না, নাসিকা কুঞ্চিত করবে না। মুখ আবৃত না করে হাই তুলবে না। শ্বাস ও কাস অনাবৃত মুখ হয়ে বর্জ্জন করিবে।"
যে ব্যক্তিকে সকল মানুষ ঘৃণা করে অথবা তিনি মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার করে ঘৃণার পাত্র হয়েছেন সেই ব্যক্তির সাথে কখনো বন্ধুত্ব করা উচিত নয় এবং তার সাথে একাকী চলাচল করা উচিত নয়। একইকথা পতিত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পতিত ব্যক্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়, বিবেকবোধ লুপ্ত হয়ে যায়।অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের সম্ভাবনা থেকে, তাই তার সঙ্গ সর্বদা পরিত্যাজ্য। পাগল ব্যক্তি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়। সে নিজেও বুঝতে পারে না যে, সে কি বলছে এবং কি করছে। তাই পাগলের সঙ্গ এড়িয়ে চলা মঙ্গল। যে দেশের মানুষ সভ্য নয়, নৃশংসতা যাদের চিন্তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ; সেইসকল দেশের মানুষের সাথে কখনো মিত্যতা করা উচিত নয়।বেশ্যা ও বেশ্যাপতি অর্থের বিনিময়ে যেকোন নিরপরাধ মানুষের নামে অপবাদ দিতে পারে। তাই তাদের সাথে মিত্রতা বা চলাফেরা করা উচিত নয়। সামান্যতেই যে সকল ব্যক্তি গর্বিত হয়, তারা প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক আত্মপ্রচারপ্রিয় হয়, তাদের থেকে দূরে থাকাই মঙ্গলজনক। মিথ্যাবাদী নিজের স্বার্থে যেকোন অপবাদ দিতে পারে, তাই মিথ্যাবাদীকে সর্বদা এড়িয়ে থাকা উচিত। তার সাথে মিত্রতার সম্পর্ক তৈরি করা অত্যন্ত বোকামি। অতিব্যয়কারী মানুষেরা দুহাতে অর্থ ব্যয় করে। পরবর্তীতে যখন অর্থের ঘাটতি দেখা যায়, তখন অনুশোচনায় ভোগে। এবং সেই অনুশোচনা থেকে যাদের জন্য অর্থব্যয় করেছে তাদের মানসিকভাবে নিপীড়িত করে। অতিব্যয়কারীর সঙ্গী হয়ে তার অর্থ ভোগ করতে নেই। শঠ এবং পরনিন্দাপরায়ণ ব্যক্তি নিজেরাও শান্তিতে থাকে না, তাই তাদের আশেপাশের কোন সুখে শান্তিতে বসবাস করতে দেয় না। তাই এ সকল ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকতে হয়। স্রোতস্বিনী খাল এবং নদীতে যখন স্রোত থাকে না, তখন সেই জলে স্নান করা উচিত নয়। স্রোতস্বিনী নদীর জলে স্রোত না থাকলে ময়লা এবং কচুরিপানা জমে স্নানের অনুপযোগী করে ফেলে। কোন গৃহে যদি আগুন লাগে, তবে সেই প্রজ্জ্বলিত আগুনযুক্ত গৃহে প্রবেশ করা উচিত নয়। এতে জীবনসংকট হতে পারে। আগুনের মধ্যে প্রবেশের পরে আর বের হওয়ার পথ থাকে না। বৃক্ষের শিখরে উঠা উচিত নয়। বৃক্ষের থেকে পরে গিয়ে মৃত্যু হতে পারে। দাঁতে দাঁতে ঘর্ষণ করা উচিত নয়, বিষয়টি দাঁতের প্রচণ্ড ক্ষতি হয় বটে; এর সাথে বিষয়টি অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। সমাজে সকলের সামনে নাক কুঞ্চন করলে, মানুষ বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে গ্রহণ করে। বিষয়টি অসামাজিকতার পর্যায়ে পরে। নিয়মিত নাক কুঞ্চন করলে নাকে দ্রুত বলি রেখা দৃশ্যমান হয়। শরীর অবসন্ন বা ক্লান্ত হলে মুখমণ্ডলে হাই চলে আসে।এ হাই তোলার সময়ে মুখমণ্ডল কিছুটা তাৎক্ষণিক বিকৃত দেখায়, তাই হাই তোলার সময়ে মুখমণ্ডল ঢেকে হাই দেয়া উচিত।
নোচ্চৈর্হসেৎ সশব্দঞ্চ ন মুঞ্চেৎ পবনং বুধঃ।
নখান্ন বাদয়েচ্ছিন্দ্যান্ন তৃণং ন মহীং লিখেৎ ॥
ন শ্মশ্রু ভক্ষয়েল্লোষ্টং ন মৃদনীয়াদ্ বিচক্ষণঃ ।
জ্যোতীংষ্যমেধ্যঃ শস্তানি নাভিবীক্ষেত চ প্রভো ॥১০
নগ্নাং পরস্ত্রিয়ঞ্চৈব সূৰ্য্যঞ্চাস্তমনোদয়ে ॥১১
ন হূং কুৰ্য্যাচ্ছবঞ্চৈব শবগন্ধো হি সোমজঃ ॥১২
চতুষ্পথান্ চৈত্যতরূন শ্মশানোপবনানি চ ।
দুষ্টস্ত্রীসন্নিকর্ষঞ্চ বৰ্জ্জয়েন্নিশি সৰ্ব্বদা ॥১৩
"উচ্চ হাস্য বা শব্দপূৰ্ব্বক অধোবায়ু পরিত্যাগ করবে না। নথবাঘ বা নখ দ্বারা ভূমিতে লিখবে না। বিচক্ষণ ব্যক্তি শ্মশ্রুচর্বণ বা লোষ্ট্রমৰ্দ্দন করবেন না। হে প্রভো ! অপবিত্র অবস্থায় সূৰ্য্য প্রভৃতি জ্যোতিঃপদার্থ ও ব্রাহ্মণাদি প্রশস্ত পদার্থ নিরীক্ষণ করা উচিত নয়। উলঙ্গ পরস্ত্রী ও উদয়াস্তকালীন দিবাকর দর্শন করবে না। শব দর্শন করে ও শবগন্ধ আঘ্রাণ করে ঘৃণা করবে না; যেহেতু, শবগন্ধ সোমের অংশ। রাত্রিকালে চতুষ্পথ, চৈত্যবৃক্ষ, শ্মশান, উপবন ও দুষ্টনারী—এই সমুদায়ের সহিত সম্পর্ক পরিত্যাগ করবে। "
পূজ্যদেবধ্বজজ্যোতিশ্ছায়াং নাতিক্ৰমেদ্ বুধঃ।
নৈকঃ শূন্যাটবীং গচ্ছেন্ন চ শূন্যগৃহে বসেৎ ॥১৪
কেশাস্থি-কণ্টকামেধ্য-বহ্নি-ভস্ম-তুষাংস্তথা।
স্নানাদ্রাং ধরণীঞ্চৈব দূরতঃ পরিবৰ্জ্জয়েৎ ॥১৫
নানাৰ্য্যানাশ্রয়েৎ কাংশ্চিন্নজিহ্মান্ রোচয়েদ্ বুধঃ ।
উপসর্পেত ন ব্যালান্ চিরং তিষ্ঠেন্ন চোত্থিতঃ ॥১৬
অতীব জাগরস্বপ্নে তদ্বৎ স্নানাসনে বুধঃ ।
ন সেবেত তথা শয্যাং ব্যায়ামঞ্চ নরেশ্বর ॥১৭
"পূজ্য ব্যক্তি, দেবতা, ধ্বজা ও তেজঃপদার্থ—এ সকলের ছায়া অতিক্রম করা বিজ্ঞ ব্যক্তির উচিত নয় । শূন্যগৃহে বাস বা একাকী শূন্য অরণ্যে গমন করবে না। কেশ, অস্থি, কণ্টক, অপবিত্র বস্তু, অগ্নি, ভস্ম, তুষ ও স্নানজল দ্বারা আর্দ্র ভূমি দূর হতে পরিত্যাগ করবে। অনার্য ব্যক্তিকে আশ্রয় করবে না, কুটিল লোকের প্রতি আসক্ত হবে না। হিংস্র জন্তুর নিকট গমন করবে না। নিদ্রাভঙ্গের পর অধিকক্ষণ দণ্ডায়মান থাকবে না। অধিকক্ষণ নিদ্রা, অধিকক্ষণ জাগরণ, অধিকক্ষণ অবস্থান, অধিকক্ষণ স্নান, অধিকক্ষণ উপবেশন, অধিকক্ষণ শয্যাসেবন ও অধিকক্ষণ ব্যায়াম করবে না।"
দংষ্ট্রিণং শৃঙ্গিণঞ্চৈব প্রাজ্ঞো দূরেণ বর্জ্জয়েৎ ।
অবশ্যায়ঞ্চ রাজেন্দ্র পুরোবাতাতপৌ তথা ॥১৮
ন স্নায়ান্ন স্বপেন্নয়ো ন চৈবোপস্পৃশেদ্ বুধঃ ।
মুক্তকচ্ছশ্চ নাচামেৎ দেবাভ্যৰ্চ্চাঞ্চ বৰ্জ্জয়েৎ ॥১৯
হোমদেবার্চ্চনাদ্যাস্থ ক্রিয়াস্বাচমনে তথা।
নৈকবস্ত্রঃ প্রবৰ্ত্তেত দ্বিজবাচনিকে জপে ॥২০
"হে রাজেন্দ্র প্রাজ্ঞ ব্যক্তি দংষ্ট্রী ও শৃঙ্গীর নিকটে কাছাকাছি যাবে না। সম্মুখ বায়ু, সম্মুখ রৌদ্র এবং নীহার পরিত্যাগ করবে। উলঙ্গ হয়ে স্নান, নিদ্রা ও আচমন করবে না। কাছা খুলে আচমন বা দেবপূজা - করবে না, হোম দেবপূজা আদি ক্রিয়া, আচমন, পুণ্যাহবাচন ও জপকাৰ্য্যে একবস্ত্র হয়ে প্রবৃত্ত হওয়া উচিত নয়।"
নাসমঞ্জসশীলৈস্তু সহাসীত কদাচন।
সদ্ বৃত্তসন্নিকর্ষো হি ক্ষণাৰ্দ্ধমপি শস্যতে ॥২১
বিরোধং নোত্তমৈৰ্গচ্ছেন্নাবরৈশ্চ সদা বুধঃ।
বিবাদশ্চ বিবাহশ্চ সমশীলৈর্নৃপেষ্যতে ॥২২
নারভেত কলিং প্রাজ্ঞঃ শুষ্কবৈরং ন কারয়েৎ।
অপ্যল্পহানিঃ সোঢ়ব্যা বৈরেণার্থাগমং ত্যজেৎ ॥২৩
স্নাতো নাঙ্গানি নির্মার্জ্জেৎ স্নানশট্যা ন পাণিনা ।
ন চ নির্ধূনয়েৎ কেশানাচামেন্নৈব চোত্থিতঃ ॥২৪
পাদেন নাক্রামেৎ পাদং ন পূজ্যাভিমুখং নয়েৎ।
বীরাসনং গুরোরগ্রে ত্যজেত বিনয়ান্বিতঃ ॥২৫
অপসব্যং ন গচ্ছেচ্চ দেবাগারচতুষ্পথান্।
মঙ্গল্যপূজ্যাংশ্চ ততো বিপরীতান্ন দক্ষিণান্ ॥২৬
সোমাগ্ন্যর্ক্যাম্বুবায়ূনাং পূজ্যানাঞ্চ ন সম্মুখম্।
কুৰ্য্যাৎ নিষ্ঠীবনবিন্মূত্রসমুৎসগঞ্চ পণ্ডিতঃ ॥২৭
"কুটিলচিত্ত মানুষের সাথে কখনই একত্র অবস্থান করবে না। ক্ষণার্দ্ধ কালও সাধু ব্যক্তির সংসর্গ প্রশস্ত। জ্ঞানী ব্যক্তি উত্তম বা অধম লোকের সাথে বিরোধ করবে না। হে নৃপ ! বিবাদ ও বিবাহ সমশীল লোকের সহিত করাই কৰ্ত্তব্য। বস্তুতঃ জ্ঞানবান্ ব্যক্তি কারও সাথে বিবাদ আরম্ভ করবে না, নিষ্ফল শত্রুতা করবে না। অল্প ক্ষতিও সহ্য করা উচিত, তথাপি কারও সাথে শত্রুতা দ্বারা অর্থ লাভ করা উচিত নহে। স্নান করে পরিধেয় বস্ত্র বা হস্ত দ্বারা গাত্রসকল মান করিবে না। কেশ কম্পন করবে না। স্নানের পর জল হতে উঠে স্থলে আচমন করবে না। পদ দ্বারা পদ আক্রমণ করবে না। পূজ্য ব্যক্তির অভিমুখে পদ স্থাপন করবে না। গুরুজনের সম্মুখে বিনয়ী হবে ও বীরাসন পরিত্যাগ করবে । দেবাগার, চতুষ্পথ, মাঙ্গলিক দ্রব্য ও পূজ্য ব্যক্তি—এই সমুদায়ের বামভাগ দিয়ে গমন করবে না। এতদ্বিপরীত বস্তু বা ব্যক্তির দক্ষিণ দিক্ দিয়ে যাবে না। পণ্ডিত ব্যক্তি বা সকলের অভিমুখে নিষ্ঠীবন (থুথু), মূত্র বা বিষ্ঠা (মল) পরিত্যাগ করবে না।"
তিষ্ঠন্ন মূত্রয়েৎ তদ্বৎ পন্থানং নাবযুত্রয়েৎ।
শ্লেষ্মবিণ্মূত্ররক্তানি সর্বদৈব ন লঙ্ঘয়েৎ ॥২৮
শ্লেষ্ম সিংহানকোৎসর্গো নান্নকালে প্রশস্যতে।
বলিমঙ্গলজপ্যাদৌ ন হোমে ন মহাজনে ॥২৯
যোষিতো নাবমন্যেত ন চাসাং বিশ্বসেদ্ বুধঃ ।
ন চৈবের্ষুর্ভবেৎ তাসু নাধিকুৰ্য্যাৎ কদাচন ॥৩০
"দণ্ডায়মান হয়ে প্রস্রাব করবে না, পথেও প্রস্রাব করবে না । শ্লেষ্মা, মল, মূত্র, ও রক্ত কদাচ লঙ্ঘন করবে না। আহারের সময়, দেবপূজা, মাঙ্গলিক কাৰ্য্য ও জপ হোম কর প্রভৃতি কার্য্যকালে এবং মহাজনসমীপে শ্লেষ্মা ত্যাগ করবে না; হাঁচবে না। স্ত্রীলোককে অতিরিক্ত বিশ্বাস করবে না, তাদের উপর অবজ্ঞা করা কর্তব্য নহে, তাদের প্রতি ও ঈর্ষান্বিত হবে না এবং তাহাদের উপর কোন বিষয়ের কর্তৃত্বও দিবে না।"
মাঙ্গল্যপুষ্পরত্নাজ্যপূজ্যাননভিবাদ্য চ ।
ন নিষ্ক্রামেদ্ গৃহাৎ প্রাজ্ঞঃ সদাচারপরো নৃপ ॥৩১
চতুষ্পত্থান্ নমস্কুৰ্য্যাৎ কালে হোমপরো ভবেৎ।
দীনানভ্যুদ্ধরেৎ সাধুনুপাসীত বহুশ্ৰুতান্ ॥৩২
দেবর্ষিপূজকঃ সম্যক্ পিতৃপিণ্ডোদকপ্রদঃ ।
সৎকর্তা চাতিথীনাং যঃ স লোকানুত্তমান্ ব্ৰজেৎ ॥৩৩
"সদাচারপরায়ণ বিদ্বান্ ব্যক্তি মাঙ্গলিক বস্তু, পুষ্প, পর রত্ন, ধৃত ও পূজ্য ব্যক্তিকে নমস্কার না করে গৃহ হতে বহির্গত হবে না। চতুষ্পথসমূহকে নমস্কার করবে।যথাকালে হোম-পর হইবে, দীন ব্যক্তিকে উদ্ধার ও বিদ্বান সাধু ব্যক্তির সম্মান করবে। যিনি দেবগণের ও ঋষিগণের পূজক, যিনি পিতৃলোকের শ্রাদ্ধ ও তর্পণকারী এবং যিনি অতিথি-সৎকার করে থাকেন, তিনি উত্তম লোকে গমন করেন। "
হিতং মিতং প্রিয়ং কালে বশ্যাত্মা যোঽভিভাষতে ।
স যাতি লোকানাহলাদ-হেতুভূতান্ নৃপাক্ষয়ান্ ॥৩৪
ধীমান হ্রীমানৃ ক্ষমাযুক্ত আস্তিকো বিনয়ান্বিতঃ ।
বিদ্যাভিজনবৃদ্ধানাং যাতি লোকাননুত্তমান্॥৩৫
অকালগজ্জিতাদৌ তু পৰ্বস্বাশৌচকাদিযু ।
অনধ্যায়ং বুধঃ কুৰ্য্যাদুপরাগাদিকে তথ্য ॥৩৬
শমং নয়তি যঃ ক্রুদ্ধান্ সর্ববন্ধুর মৎসরী।
ভীতাশ্বাসনকৃৎ সাধুঃ স্বৰ্গস্তস্যাল্পকং ফলম্ ॥৩৭
বর্ষাতপাদিকে ছত্রী দণ্ডী রাত্র্যটবীষু চ ।
শরীরত্রাণকামো বৈ সোপানৎকঃ সদা ব্ৰজেং ॥৩৮
নোর্দ্ধং ন তির্য্যগ্ দূরং বা নিরীক্ষন্ পর্য্যটেদ্ বুধঃ ।
যুগমাত্রং মহীপৃষ্ঠং নরো গচ্ছেদ্ বিলোকয়ন্ ॥৩৯
দোষহেতূেনশেষাংস্ত বশ্যাত্মা যো নিরস্যতি ।
তস্য ধর্মার্থকামানাং হানিৰ্নাল্পাপি জায়তে ॥৪০
"যিনি জিতেন্দ্রিয় হইয়া সময়ে মিত, হিত ও প্রিয়বাক্য বলেন, তিনি দেহাবসানে আনন্দ - জনক অক্ষয় লোকে গমন করেন। বিনি ধীমান হ্রীমান ক্ষমাবান্, আস্তিক ও বিনীত, তিনি সৎকুলজাত বিদ্যা কুলধর্মপরায়ণ বৃদ্ধব্যক্তির যোগ্য উত্তম লোকে গমন করেন। সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণকালে, পর্ববদিবসে, অশৌচ সময়ে অকালে মেঘগর্জ্জনে এবং পণ্ডিত ব্যক্তি অধ্যয়ন করবেন না। যিনি কুপিত ব্যক্তির ক্রোধের উপশম করেন, যিনি সকলের বন্ধু ও অমৎসর এবং সাধু ভীত ব্যক্তিকে আশ্বস্ত করেন, তার পক্ষে স্বর্গলাভ অতি সামান্য ফল। যিনি শরীর রক্ষা করতে ইচ্ছা করেন, তিনি বর্ষার ও রৌদ্রের সময় ছত্র ব্যবহার করবেন। রাত্রিতে গমন বা বনমধ্যে প্রবেশের সময় দণ্ডপাণি হয়ে চলিবেন এবং গমনকালে সর্বদাই পায়ে পাদুকা বাবহার করবেন। পার্শ্ব বা ঊদ্ধ বা দূরতর প্রদেশ দেখিতে দেখিতে পণ্ডিতদের যাওয়া উচিত নয়।গমনকালে সম্মুখবর্তী চারি হস্ত ভূমি পৰ্যবেক্ষণ করতে হবে। যে ব্যক্তি জিতেন্দ্রিয় হয়ে পূর্বোক্ত সমুদায় ও অন্যান্য দোষের হেতুকে বিনষ্ট করেন, তার ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের কখনো সামান্যতম ব্যাঘাত ঘটে না।"
পাপেঽপ্যপাপঃ পরুষেঽপ্যভিধত্তে প্রিয়াণি যঃ।
মৈত্রীদ্রবান্তঃকরণস্তস্য মুক্তিঃ করে স্থিতা ॥৪১
যে কামক্রোধলোভানাং বীতরাগা ন গোচরে।
সদাচারস্থিতাস্তেষামনুভাবৈর্ধৃতাং মহী॥৪২
তস্মাৎ সত্যং বদেৎ প্রাজ্ঞো যৎ পরপ্রীতিকারণম্।
সত্যং যৎ পরদুঃখায় তত্র মৌনপরো ভবেৎ ॥৪৩
প্রিয়ং যুক্তং হিতং নৈতদিতি মত্বা ন তদ্বদেৎ।
শ্রেয়স্তত্র হিতং বাক্যং যদ্যপত্যন্তমপ্রিয়ম্ ॥৪৪ a
প্রাণিনামুপকারায় যদেবেহ পরত্র চ।
কৰ্ম্মণা মনসা বাচা তদেব মতিমান ভ॥৪৫
ইতি বিষ্ণুপুরাণে তৃতীয়াংশে দ্বাদশ অধ্যায়ঃ ॥
"পাপী ব্যক্তির প্রতি যিনি পাপ ব্যবহার না করেন, কোন ব্যক্তি নিষ্ঠুর বাক্য বললে, যিনি তাকে প্রিয় বাক্য বলেন, যিনি সমুদায় প্রাণীর বন্ধু এবং সেই বন্ধুতানিবন্ধন যাঁর চিত্ত আর্দ্র থাকে, মুক্তি তার হস্তগত। সর্বদা সাচারপরায়ণ ও বীতরাগ, ব্যক্তি কাম ক্রোধ ও লোভকে জয় করে সেই প্রভাবেই পৃথিবীতে অবস্থান করেন। অতএব বিজ্ঞ ব্যক্তি সকল সময়ে সত্য বাক্য বলবেন। সত্যই সকলের প্রীতি উৎপাদন করে, যে স্থলে সত্য কথা বললে কারো অনিষ্ট হয়, সে সময়ে মৌনী হয়ে থাকবে। বিষয়টি প্রিয়, যুক্তিযুক্ত ও হিতকর নহে, এই মনে করিয়া তাদৃশ সত্যকথা বলবে না, যে সত্যকথায় অন্যের অনিষ্ট হয়। কারণ, হিতবাক্য যদিও নিতান্ত অপ্রিয় হয়, তথাপি তাহাও বলা শ্রেয়। যে কাৰ্য্য ইহলোকে প্রাণিগণের মঙ্গলকারী হয়, মতিমান সেই কাৰ্য্যই কায়মনোবাক্যে ভজনা করবে।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : বিষ্ণু পুরাণের গার্হস্থ্য সদাচার, প্রতিটি পরিবারে আজও প্রাসঙ্গিক
(লেখাটি সমাপ্ত নয়, তাই কপি করবেন না; শেয়ার দিবেন।)