হিন্দু ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলোতে ঐতিহ্য ছিল, জন্মদিনে গুরুজনেরা মাথায় ধানদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করবে, মিষ্টান্ন তৈরি করা হবে ইত্যাদি। এদেশীয় সংস্কার অনুসারে দূর্বাকে অমর বলা হয়। কারণ, দূর্বা যেখানেই পরে সেখান থেকেই নতুনভাবে বংশবৃদ্ধি ঘটায়। এ কারণে জীবনে শতবছর পূর্ণায়ুর জন্যে দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করা হয়। ধান সমৃদ্ধি এবং অন্নের প্রতীক, তাই আশীর্বাদ করতে দূর্বাঘাসের সাথে মাথায় ধান দেয়া হয় সমৃদ্ধি এবং পূর্ণায়ুর কামনা করে। জন্মদিনে, যার জন্মদিন তার কল্যাণ কামনা করে দেবতাদের ভোগ নিবেদন করা করা হয়, দুধের মিষ্টান্ন তৈরি করে দেয়া হয়। আমাদের স্মৃতিশাস্ত্রে জন্মদিনের কৃত্যাদি বর্ণনা করা আছে। সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কিভাবে জন্মদিন পালন করতে হবে। দীর্ঘায়ু কামনায় অথর্ববেদে অত্যন্ত সুন্দর একটি প্রার্থনা রয়েছে। এ পঞ্চ মন্ত্রাত্মক সূক্তটি পাঠ করা যায়। সূক্তটিতে দেবতাদের কাছে দীর্ঘ ও শ্রেষ্ঠ জীবনের কামনা করা হয়েছে:
জীবা স্থ জীব্যাসং সর্বমায়ুজীর্ব্যাসম।।
উপজীবা স্থোপ জীব্যাসং সর্বমায়ুর্জীব্যাসম্।।
সঞ্জীবা স্থ সং জীব্যাসং সর্বমায়ুর্জীব্যাসম।।
জীবলা স্থ জীব্যাসং সর্বমায়ুর্জীব্যাসম্।।
ইন্দ্র জীব সূর্য জীব দেবা জীবা জীব্যাসমহম্।
সর্বমায়ুজীর্ব্যাসহম্।।
(অর্থববেদ: ১৯.৭.১১.১-৫)
"হে দেবগণ, তোমরা আয়ুষ্মান হও, তোমাদের অনুগ্রহে আমিও আয়ুষ্মান হবো, শতবছর প্রাণ ধারণ করব। তুমি তোমার সন্নিহিত উপাসকদের আয়ুষ্মান কর, আমিও উপজীব্যদের আয়ুষ্মান করব, শতবছর প্রাণ ধারণ করব। তুমি সমীচীন জীবন লাভ কর, তোমার অনুগ্রহে আমিও সমীচীন জীবন লাভ করব অর্থাৎ জীবনকালে একক্ষণও যেন বৃথা না যায়। পরোপকারের দ্বারা জীবন অতিবাহিত করে শতবছর জীবন ধারণ করব। তুমি প্রাণ ধারণ কর, তোমার অনুগ্রহে আমিও শতবছর প্রাণ ধারণ করব। হে ইন্দ্র, পরম ঐশ্বর্যযুক্ত সর্বেন্দ্রিয়ের প্রকাশক, তুমি আয়ুষ্মান হও। হে সর্বপ্রেরক সূর্য, তুমি আয়ুষ্মান হও। হে দেবগণ, তোমরা আয়ুষ্মান হও, তোমাদের প্রসাদে আমি চিরকাল প্রাণ ধারণ করব।"
ইদানীং সেই শাস্ত্রীয় করনীয় বিষয়গুলো থেকে আমাদের মনযোগ সরে গিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি অনেকটা ধাবিত হয়ে গেছে।শাস্ত্রীয় জন্মদিনের পদ্ধতির সাথে অধুনা পশ্চিমা সংস্কৃতির কয়েকটি আচার যুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম দুটি আচার হল কেককাটা এবং কেককাটার আগে মোমবাতি নিভিয়ে ফেলা। কেক শব্দটির বাংলা অর্থ হয় পিঠা। জন্মদিনে এই কেক বা পিঠা কেন কাটতে হয়, তা আমার ঠিক বোধগম্য নয়। তবে জীবনের অখণ্ড পরমায়ু কেটেকেটে ভাগ করে আমরা ভোগ করে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছি; কেক কাটার মূলে এ দার্শনিক ভাবটি কিছুটা গ্রহণ করা যায়। তাই কেককাটা পশ্চিমা সংস্কৃতি হলেও আপত্তিকর নয়। আমাদের শিশুদের কাছে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। শিশুরা কেক না কাটতে পারলে তাদের মন খারাপ হয়ে যায়। শিশুমন অত্যন্ত ব্যথিত হয়।কিন্তু জন্মদিনে পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে আসা আরেকটি আচার হল কেককাটার আগে মোমবাতি নিভিয়ে ফেলা। এ আচারটি যদিও আপত্তিকর। আমাদের এ ভূখণ্ডের সংস্কৃতির সাথে একদম মানানসই নয়। জন্মদিনে আমরা চাই সকলের জীবনের প্রদীপগুলো, আশার প্রদীপগুলো আরও বেশী করে প্রজ্জ্বলিত হোক। প্রদীপের আলোয় জীবনের অন্ধকার আলোকিত হয়ে উঠুক। তাই বেদমন্ত্রে আছে:
অসতো মা সদ্গময়,
তমসো মা জ্যোতির্গময়,
মৃত্যোর্মামৃতং গময়েতি।
(বৃহদারণ্যকোপনিষদ:১.৩.২৮)
"হে প্রভু, অসৎ পথ হতে আমাকে সৎ পথে নিয়ে যাও, অন্ধকার হতে আলোতে নিয়ে যাও, মৃত্যু হতে অমৃতে নিয়ে যাও।"
জীবনের প্রতীক প্রদীপটি আমরা চাই প্রজ্জ্বলিত থাকুক, জীবনের প্রত্যেকটি বছরের প্রতীক মোমবাতিগুলো জ্বলতে থাক সাধ্যমত। আমরা চাইনা মোমগুলো হঠাৎ নিভে যাক, আমরা চাইনা জীবনের আলো নিভে যাক। তাই আমরা প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করে জন্মদিন করতে চাই, নিভিয়ে দিয়ে জীবনকে অন্ধকার করে দিয়ে নয়। অন্যান্য সংস্কৃতির অপ্রয়োজনীয় অংশ ছুড়ে ফেলে আমরা বিভিন্ন সংস্কৃতির ভাল অংশটুকু গ্রহণ করতে চাই। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, পশ্চিমের জ্ঞানের সাথে ভারতবর্ষের জ্ঞানের দ্বারকে যুক্ত করতে হবে। তাদের থেকে যতটুকু প্রয়োজনীয় ততটুকুই গ্রহণ করব। অন্ধের মত অনুসরণ নয়। "দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে" -এভাবেই জ্ঞানের আদানপ্রদানেই আমরা সমৃদ্ধ হব।পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুসরণে মোমবাতি নিভিয়ে জন্মদিন পালন করাটা আমাদের সংস্কৃতির সাথে ঠিক যায় না। আমরা মন্দিরে গেলে প্রথমেই দীপ প্রজ্জ্বলিত করি, সকল পূজা, গৃহ প্রবেশ, দীপাবলি সহ সকল উৎসবে আমরা প্রদীপ বা মোমবাতির আলোয় আলোকিত করি। অন্ধকার করে কোন মাঙ্গলিক কাজ আমরা শুরু করি না। ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের লঙ্কায় রাবনকে হত্যা করে অযোধ্যা আগমন উপলক্ষে অযোধ্যাবাসী সারা নগরের দুইপাশে প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করেছিল। সেই দিনটিকে স্মরণ করে আজও পালিত হয় দীপাবলি উৎসব। জন্মদিন আনন্দের দিন, তাই আনন্দের দিনে প্রদীপ নিভিয়ে, মোমবাতি নিভিয়ে জন্মদিন পালন করাটা অযৌক্তিক। কেকের পাশে জীবনের প্রত্যেকটি বছরের নামে একএকটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সেই মোমবাতিগুলো নিভিয়ে দিয়ে, নিজের অজান্তেই আমরা সেই ব্যক্তির জীবনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন হবার জন্য আশীর্বাদ করছি। বেদে বলা হয়েছে, অন্ধকার হতে আলোতে নিয়ে যাওয়ার জন্য, অথচ আমরা জন্মদিনের মত আনন্দের উৎসবকে মোমবাতি নিভিয়ে অন্ধকার বানিয়ে পালন করছি; বিষয়টি হাস্যকর। প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করার শ্লোকগুলো অসাধারণ। সেই শ্লোকগুলোতে প্রদীপের জ্যোতিকে শক্তিস্বরূপা বলা হয়েছে এবং প্রসন্নতা, সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য, ধনসম্পদের প্রাচুর্য্য, শত্রুবুদ্ধিকে বিনাশ সহ সকল কল্যাণের আধার বলা হয়েছে।
ত্বং জ্যোতিঃ শ্রী রবিশ্চন্দ্রো বিদ্যুৎসৌবর্ণতারকাঃ।
সর্বেষাং জ্যোতিষাং জ্যোতি-দীপজ্যোতিঃস্থিতে নমঃ।।
শুভং করোতি কল্যাণং আরোগ্যং ধনসম্পদা।
শত্রুবুদ্ধি বিনাশায় দীপ জ্যোতির্নমোঽস্তুতে।।
"হে জ্যোতির্ময়ী, তুমি সূর্য, চন্দ্র,বিদ্যুৎ, সুবর্ণ এবং নক্ষত্রসহ সকল জ্যোতির্ময় বস্তুর জ্যোতি। এই প্রদীপের জ্যোতিতেও তুমি বিরাজিতা, তোমায় প্রণাম।
আমি দীপজ্যোতিঃকে প্রণাম জানাই, যা প্রসন্নতা, সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য, ধনসম্পদের প্রাচুর্য্য আনে এবং শত্রুবুদ্ধিকে বিনাশ করে।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : সনাতন ঐতিহ্যে, জন্মদিন পালনের রীতি ।
ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook