-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

গুরুকে অতিরিক্ত স্তুতি করে, ভগবান বানিয়ে ফেলা অনুচিত ।

গুরুকে অতিরিক্ত স্তুতি করে,  ভগবান বানিয়ে ফেলা অনুচিত  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় জগন্নাথ হলের পার্শ্ববর্তী শিববাড়িতে দেখেছি, কৌপীন পড়া এক সাধু ব্রজানন্দের ছবি পূজিত। মন্দিরের ভিতরে আমি তার শিবরূপের ছবি, মাথার উপরে অনন্ত নাগ সহ বিষ্ণুরূপের ছবি, কৃষ্ণরূপের ছবি দেখে প্রথমে হতবাক হই। তার শিষ্যরা তাকে কৃষ্ণ কল্পরূপে মনে করত। ১৯৭১ সালে স্বয়ং শিবের অবতার ব্রজানন্দ বাবা থাকার পরেও শিববাড়ি এবং এর আশেপাশের অসংখ্য সাধারণ হিন্দুকে পাকিস্তানিসেনারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ২৫ মার্চ কালরাত্রে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবী গোবিন্দ চন্দ্র দেব এবং ব্রজানন্দ সাধু পাশাপাশি থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ব্রজানন্দ বাবা তখন ভারতের ত্রিপুরাতে চলে যান, সম্ভবত আর তিনি শিববাড়িতে আসেননি। তার একটি দোলনা ছিল, তিনি বসে তাতে দোল খেতেন। দোলনাটি এখনও আছে। শিব, বিষ্ণু কৃষ্ণের দেহে ব্রজানন্দ বাবার মুখমণ্ডল বসিয়ে ছবিগুলো এডিট করে তৈরি করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ ১ নং রেলগেটে অবস্থিত প্রিন্স স্টুডিওর মালিক অমর ঘোষ। ব্রজানন্দ বাবাকে অবতার বানাতে তিনি বিভিন্ন প্রচেষ্টা করেছিলেন। কিছু পেইন্টিং ছবি তৈরি করা হয়, তিনি কৌপীন পরে বসে আছেন, পেছনে শ্রীকৃষ্ণ। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে জানতে পারি, এ ছবিগুলো এঁকেছিলেন বরিশালের শ্রেষ্ঠ শিল্পী জগন্নাথ দে। তৎকালীন সময়ে তাকে ব্যপক অনুরোধ করা হয়, তাই মনে সায় না দিলেও তিনি ছবিগুলো এঁকেছিলেন। ব্রজানন্দ বাবা কিন্তু নিজেকে শিবের সেবক হিসেবে পরিচয় দিতে পারতেন বা হয়ত দিতেন। ছবি দেখে তাকে আমার সহজসরল সাধুই মনে হয়েছ, ভণ্ড মনে হয়নি।কিন্তু তাকেও তার ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক শিবের অবতার হতে হয়েছে, কৃষ্ণের অবতার হতে হয়েছে, শিষ্য অমর ঘোষদের কারণে। অমর ঘোষ গুরুর প্রতি অন্ধ ভালবাসা অথবা ব্যক্তিগত স্বার্থে, গুরুকে নিয়ে এ অবতারের প্রচারণা শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিধিবাম, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশের টালমাটাল পরিস্থিতি সকল ভণ্ডুল করে দিয়েছে।১৯৭১ সালে ব্রজানন্দ বাবা এবং তার শিষ্য অমর ঘোষ যদি ভারতে চলে না যেতেন, তবে ঢাকা শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী অবতার রূপে হয়ত আমরা ঢাকাসহ ঘরে ঘরে ব্রজানন্দ বাবাকেই পূজিত হতে দেখতাম।  মানুষের এই অতিরিক্ত স্তুতি একদিনে শুরু হয় না। ধীরেধীরে একটু একটু করে তৈরি হয়। মানুষকে অতিরিক্ত স্তুতি করে ভগবান বানিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে বাংলার প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেব এক বড় দৃষ্টান্ত। এ প্রসঙ্গে তাঁর জীবনের একটি ঘটনা পাওয়া যায়। শ্রীচৈতন্যদেব জীবনের শেষপর্বে যতদিন উড়িষ্যাতে ছিলেন, এর শেষের কয়েকবছর বাদে প্রত্যেকবছরই জগন্নাথদেবের রথযাত্রার পূর্বে শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর শিষ্যদের নিয়ে গুণ্ডিচামন্দির পরিষ্কার এবং ধৌত করতেন। গুণ্ডিচা দেহের অভ্যন্তরে হৃদরের প্রতীক। দেহকে পবিত্র না করলে দেহের অভ্যন্তরে হৃদয়ে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করা যায় না। একবার এমনি রথযাত্রার পূর্বে গুণ্ডিচা মন্দির পরিষ্কারের শেষে এক বাঙালি ভক্ত ভক্তির আতিশয্যে এক ঘটি জল নিয়ে শ্রীচৈতন্যদেবের চরণে দিয়ে তাঁর চরণ ধৌত করে দেয়। এতটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু এরপরে সে এক কাণ্ড করে ফেলে। যে আকস্মিক কাণ্ডে শ্রীচৈতন্যদেবও প্রচণ্ড দুঃখ পান এবং সাথে রুষ্ট হয়ে উঠেন। সেই বাঙালি ভক্ত শ্রীচৈতন্যদেবের পা ধোয়া জল চরণামৃত ভেবে পান করে ফেলে। শ্রীচৈতন্যদেব সেই ভক্তকে তাঁর পা ধোয়া জল পান করতে নিষেধ করেন। সম্ভবত স্বরূপ দামোদরের সেই ভক্তটি পরিচিত ছিল। তাই স্বরূপ দামোদরের কাছে এই 'ফৈজতি' কর্মের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। কিন্তু বর্তমানেও আমরা অনেক গুরুদের দেখি শিষ্যদের পা ধোয়া জল খাওয়ায়। বিষয়টি দুঃখজনক, এক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্যদেব একটি বড় দৃষ্টান্ত।  "ঈশ্বর-মন্দিরে মোর পদ ধোয়াইল। সেই জল লইয়া আপনে পান কৈল।। এই অপরাধে মোর কাঁহা হবে গতি। তোমার গৌড়িয়া করে এতেক ফৈজতি।।" (চৈতন্যচরিতামৃত : মধ্য, ১২) এই মানুষ পূজার বিরুদ্ধে ভারিভুরি উদাহরণ শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনে পাওয়া যায়। যে সকল মানুষ নিজেকে ভগবানের সেবক না মনে করে ভগবান সাজতে চায়, শ্রীচৈতন্যদেব তাঁদের 'পাষণ্ডী' নামে অভিহিত করেছেন। যেই মূঢ় কহে জীব ঈশ্বর হয় সম। সেই ত পাষণ্ডী হয় দণ্ডে তবে যম।।" (চৈতন্যচরিতামৃত : মধ্য, ১৮)  পাষণ্ড, পাষণ্ডী এবং পাখণ্ড এ শব্দগুলো অভিন্ন শব্দ।বেদপথবিরদ্ধ পথের পথিক দুরাচারী পাষণ্ডীদের মৃত্যুর পরে যমরাজ ভয়ংকর দণ্ড প্রদান করেন। মনুসংহিতায় এ পাষণ্ডীদের বাক্যদ্বারা সম্মান বা সম্ভাষণ করতেও  নিষেধ করা হয়েছে।  পাষণ্ডিনো বিকর্মস্থান্ বৈড়ালব্ৰতিকান্ শঠান্।  হৈতুকান্ বকবৃত্তীংশ্চ বাঙ্মাত্রেণাপি নাৰ্চয়েৎ।। (মনুসংহিতা:৪.৩০) "পাষণ্ডী অর্থাৎ বেদপথবিরদ্ধব্রতধারী;  বিকর্মস্থ অর্থাৎ নিষিদ্ধবৃত্তিজীবী; বৈড়ালব্রতিক অর্থাৎ ভণ্ড ধার্মিক, যারা ধর্মবুদ্ধিতে ধর্ম পালন করে না কেবল লোককে আকৃষ্ট করার জন্যই অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ করে; শঠ অর্থাৎ যে বেদে শ্রদ্ধারহিত হয়ে অন্যকে প্রতারণা করে; হৈতুক অর্থাৎ অকারণে বেদরিরুদ্ধ তর্কপরায়ণ বা নাস্তিক যারা বলে পরলোক নেই, দানেরও কোনও ফল নেই, অগ্নিহোত্রাদি কর্মের কোনও ফল নেই ইত্যাদি বেদবিরুদ্ধ ধর্মবিরুদ্ধ বাক্য; এবং বকবৃত্তিধারী  অর্থাৎ ধর্মের নামে কপটবিনয়ী প্রবঞ্চক ব্যক্তি— এই সকল ব্যক্তি যদি কখনো গৃহে অতিথি হয়েও উপস্থিত হয়; তবে বাক্যের দ্বারাও তাদের সম্ভাষণ করবে না।"  অবশ্য বেদান্ত মতে সাধনায় জীব শিব হতে পারে। সাধক যখন সাধনার ফলে ইষ্টের দর্শন পায়, তখন ধীরেধীরে পর্যায়ক্রমে তাঁর সাথে একাত্ম হয়ে প্রথমে জীবন্মুক্তি লাভ করে। পরবর্তীতে শরীর ত্যাগের পরে বিদেহমুক্তি লাভ করে। তখন সাধকের মধ্যে ব্রহ্মানুভূতি লাভ হয়ে "অহং ব্রহ্মাস্মি" (বৃহদারণ্যক উপনিষদ: ১.৪.১০) ভাব চলে আসে। অর্থাৎ আমিই সেই এ ভাব সাধক নিজের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারে। সাধক যখন ব্রহ্মময় হয়ে যায়, তখন তাঁর কোন জাগতিক আকাঙ্ক্ষা থাকে না। যে সত্যিকারের সাধক সে কখনো ব্রহ্মের অনুভূতির বিষয়টি নিয়ে আত্মপ্রচার করে, শিষ্যদের কাছে এরজন্যে পূজা প্রার্থনা করবে না। পক্ষান্তরে যিনি ভণ্ড, তিনি আকারে ইঙ্গিতে অন্ধ অনুগত শিষ্যদের দিয়ে এ কাজটি করাবেন। যিনি আত্মপ্রচারে নামবেন, তিনি অন্ততপক্ষে সাধক তো নয়ই ; বরং তাদের ভক্তও বলা যায় না।শ্রীচৈতন্যদেবের ভাষায় তাদের আমরা পাষণ্ডী নামে অবিহিত করতে পারি। শ্রীচৈতন্যদেবের বিবিধ শিক্ষার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হলো- মানুষকে অতিস্তুতি করে যেন ঈশ্বর বানিয়ে না ফেলা হয়। তিনি ছিলেন এর ঘোরতর বিরোধী। আজকে বাংলায় যে গত দেড়শো বছরে আমরা অবতারের হাইব্রীড ফসল দিয়ে ভরে ফেলেছি। তা হয়তো শ্রীচৈতন্যদেব আগেই বুঝতে পেরেছেন তার দূরদৃষ্টি দিয়ে। শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজের ভাষায়: "প্রভু কহে বিষ্ণু বিষ্ণু ইহা না কহিহ। জীবধামে কৃষ্ণজ্ঞান কভু না করিহ।। জীব ঈশ্বর তত্ত্ব কভু নহে সম। জলদগ্নি রাশি যৈছে স্ফুলিঙ্গের কণ।।" (চৈতন্যচরিতামৃত : মধ্য, ১৮)  মনুষ্য গুরুদের অতিরিক্ত স্তুতি করে ভগবানের স্থানে বসানো অশাস্ত্রীয়। গুরুর স্থান গুরুর স্থানে। যেমন পিতামাতার স্থান পিতামাতার স্থানে এবং সর্বোপরি ভগবানের স্থান ভগবানের স্থানে। সকলেরই নিজ নিজ স্থান রয়েছে।একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে গুরু পূজনীয় বটে, কিন্তু সে কখনই ঈশ্বরের সমকক্ষ নয়। তিনিও ঈশ্বরের সৃষ্টি।তাই অতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে মনুষ্য গুরুদের ভগবান সাজিয়ে পূজা করা অনুচিত এবং যুগপৎ অপ্রয়োজনীয়।  শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ। ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক :  গুরুকে অতিরিক্ত স্তুতি করে,  ভগবান বানিয়ে ফেলা অনুচিত । ফেসবুক পেজ লিঙ্ক :  Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় জগন্নাথ হলের পার্শ্ববর্তী শিববাড়িতে দেখেছি, কৌপীন পড়া এক সাধু ব্রজানন্দের ছবি পূজিত। মন্দিরের ভিতরে আমি তার শিবরূপের ছবি, মাথার উপরে অনন্ত নাগ সহ বিষ্ণুরূপের ছবি, কৃষ্ণরূপের ছবি দেখে প্রথমে হতবাক হই। তার শিষ্যরা তাকে কৃষ্ণ কল্পরূপে মনে করত। ১৯৭১ সালে স্বয়ং শিবের অবতার ব্রজানন্দ বাবা থাকার পরেও শিববাড়ি এবং এর আশেপাশের অসংখ্য সাধারণ হিন্দুকে পাকিস্তানিসেনারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ২৫ মার্চ কালরাত্রে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবী গোবিন্দ চন্দ্র দেব এবং ব্রজানন্দ সাধু পাশাপাশি থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ব্রজানন্দ বাবা তখন ভারতের ত্রিপুরাতে চলে যান, সম্ভবত আর তিনি শিববাড়িতে আসেননি। তার একটি দোলনা ছিল, তিনি বসে তাতে দোল খেতেন। দোলনাটি এখনও আছে। শিব, বিষ্ণু কৃষ্ণের দেহে ব্রজানন্দ বাবার মুখমণ্ডল বসিয়ে ছবিগুলো এডিট করে তৈরি করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ ১ নং রেলগেটে অবস্থিত প্রিন্স স্টুডিওর মালিক অমর ঘোষ। ব্রজানন্দ বাবাকে অবতার বানাতে তিনি বিভিন্ন প্রচেষ্টা করেছিলেন। কিছু পেইন্টিং ছবি তৈরি করা হয়, তিনি কৌপীন পরে বসে আছেন, পেছনে শ্রীকৃষ্ণ। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে জানতে পারি, এ ছবিগুলো এঁকেছিলেন বরিশালের শ্রেষ্ঠ শিল্পী জগন্নাথ দে। তৎকালীন সময়ে তাকে ব্যপক অনুরোধ করা হয়, তাই মনে সায় না দিলেও তিনি ছবিগুলো এঁকেছিলেন। ব্রজানন্দ বাবা কিন্তু নিজেকে শিবের সেবক হিসেবে পরিচয় দিতে পারতেন বা হয়ত দিতেন। ছবি দেখে তাকে আমার সহজসরল সাধুই মনে হয়েছ, ভণ্ড মনে হয়নি।কিন্তু তাকেও তার ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক শিবের অবতার হতে হয়েছে, কৃষ্ণের অবতার হতে হয়েছে, শিষ্য অমর ঘোষদের কারণে। অমর ঘোষ গুরুর প্রতি অন্ধ ভালবাসা অথবা ব্যক্তিগত স্বার্থে, গুরুকে নিয়ে এ অবতারের প্রচারণা শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিধিবাম, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশের টালমাটাল পরিস্থিতি সকল ভণ্ডুল করে দিয়েছে।১৯৭১ সালে ব্রজানন্দ বাবা এবং তার শিষ্য অমর ঘোষ যদি ভারতে চলে না যেতেন, তবে ঢাকা শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী অবতার রূপে হয়ত আমরা ঢাকাসহ ঘরে ঘরে ব্রজানন্দ বাবাকেই পূজিত হতে দেখতাম।
মানুষের এই অতিরিক্ত স্তুতি একদিনে শুরু হয় না। ধীরেধীরে একটু একটু করে তৈরি হয়। মানুষকে অতিরিক্ত স্তুতি করে ভগবান বানিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে বাংলার প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেব এক বড় দৃষ্টান্ত। এ প্রসঙ্গে তাঁর জীবনের একটি ঘটনা পাওয়া যায়। শ্রীচৈতন্যদেব জীবনের শেষপর্বে যতদিন উড়িষ্যাতে ছিলেন, এর শেষের কয়েকবছর বাদে প্রত্যেকবছরই জগন্নাথদেবের রথযাত্রার পূর্বে শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর শিষ্যদের নিয়ে গুণ্ডিচামন্দির পরিষ্কার এবং ধৌত করতেন। গুণ্ডিচা দেহের অভ্যন্তরে হৃদরের প্রতীক। দেহকে পবিত্র না করলে দেহের অভ্যন্তরে হৃদয়ে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করা যায় না। একবার এমনি রথযাত্রার পূর্বে গুণ্ডিচা মন্দির পরিষ্কারের শেষে এক বাঙালি ভক্ত ভক্তির আতিশয্যে এক ঘটি জল নিয়ে শ্রীচৈতন্যদেবের চরণে দিয়ে তাঁর চরণ ধৌত করে দেয়। এতটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু এরপরে সে এক কাণ্ড করে ফেলে। যে আকস্মিক কাণ্ডে শ্রীচৈতন্যদেবও প্রচণ্ড দুঃখ পান এবং সাথে রুষ্ট হয়ে উঠেন। সেই বাঙালি ভক্ত শ্রীচৈতন্যদেবের পা ধোয়া জল চরণামৃত ভেবে পান করে ফেলে। শ্রীচৈতন্যদেব সেই ভক্তকে তাঁর পা ধোয়া জল পান করতে নিষেধ করেন। সম্ভবত স্বরূপ দামোদরের সেই ভক্তটি পরিচিত ছিল। তাই স্বরূপ দামোদরের কাছে এই 'ফৈজতি' কর্মের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। কিন্তু বর্তমানেও আমরা অনেক গুরুদের দেখি শিষ্যদের পা ধোয়া জল খাওয়ায়। বিষয়টি দুঃখজনক, এক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্যদেব একটি বড় দৃষ্টান্ত।
"ঈশ্বর-মন্দিরে মোর পদ ধোয়াইল।
সেই জল লইয়া আপনে পান কৈল।।
এই অপরাধে মোর কাঁহা হবে গতি।
তোমার গৌড়িয়া করে এতেক ফৈজতি।।"
(চৈতন্যচরিতামৃত : মধ্য, ১২)
এই মানুষ পূজার বিরুদ্ধে ভারিভুরি উদাহরণ শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনে পাওয়া যায়। যে সকল মানুষ নিজেকে ভগবানের সেবক না মনে করে ভগবান সাজতে চায়, শ্রীচৈতন্যদেব তাঁদের 'পাষণ্ডী' নামে অভিহিত করেছেন।
যেই মূঢ় কহে জীব ঈশ্বর হয় সম।
সেই ত পাষণ্ডী হয় দণ্ডে তবে যম।।"
(চৈতন্যচরিতামৃত : মধ্য, ১৮)
পাষণ্ড, পাষণ্ডী এবং পাখণ্ড এ শব্দগুলো অভিন্ন শব্দ।বেদপথবিরদ্ধ পথের পথিক দুরাচারী পাষণ্ডীদের মৃত্যুর পরে যমরাজ ভয়ংকর দণ্ড প্রদান করেন। মনুসংহিতায় এ পাষণ্ডীদের বাক্যদ্বারা সম্মান বা সম্ভাষণ করতেও নিষেধ করা হয়েছে।
পাষণ্ডিনো বিকর্মস্থান্ বৈড়ালব্ৰতিকান্ শঠান্।
হৈতুকান্ বকবৃত্তীংশ্চ বাঙ্মাত্রেণাপি নাৰ্চয়েৎ।।
(মনুসংহিতা:৪.৩০)
"পাষণ্ডী অর্থাৎ বেদপথবিরদ্ধব্রতধারী; বিকর্মস্থ অর্থাৎ নিষিদ্ধবৃত্তিজীবী; বৈড়ালব্রতিক অর্থাৎ ভণ্ড ধার্মিক, যারা ধর্মবুদ্ধিতে ধর্ম পালন করে না কেবল লোককে আকৃষ্ট করার জন্যই অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ করে; শঠ অর্থাৎ যে বেদে শ্রদ্ধারহিত হয়ে অন্যকে প্রতারণা করে; হৈতুক অর্থাৎ অকারণে বেদরিরুদ্ধ তর্কপরায়ণ বা নাস্তিক যারা বলে পরলোক নেই, দানেরও কোনও ফল নেই, অগ্নিহোত্রাদি কর্মের কোনও ফল নেই ইত্যাদি বেদবিরুদ্ধ ধর্মবিরুদ্ধ বাক্য; এবং বকবৃত্তিধারী অর্থাৎ ধর্মের নামে কপটবিনয়ী প্রবঞ্চক ব্যক্তি— এই সকল ব্যক্তি যদি কখনো গৃহে অতিথি হয়েও উপস্থিত হয়; তবে বাক্যের দ্বারাও তাদের সম্ভাষণ করবে না।"
অবশ্য বেদান্ত মতে সাধনায় জীব শিব হতে পারে। সাধক যখন সাধনার ফলে ইষ্টের দর্শন পায়, তখন ধীরেধীরে পর্যায়ক্রমে তাঁর সাথে একাত্ম হয়ে প্রথমে জীবন্মুক্তি লাভ করে। পরবর্তীতে শরীর ত্যাগের পরে বিদেহমুক্তি লাভ করে। তখন সাধকের মধ্যে ব্রহ্মানুভূতি লাভ হয়ে "অহং ব্রহ্মাস্মি" (বৃহদারণ্যক উপনিষদ: ১.৪.১০) ভাব চলে আসে। অর্থাৎ আমিই সেই এ ভাব সাধক নিজের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারে। সাধক যখন ব্রহ্মময় হয়ে যায়, তখন তাঁর কোন জাগতিক আকাঙ্ক্ষা থাকে না। যে সত্যিকারের সাধক সে কখনো ব্রহ্মের অনুভূতির বিষয়টি নিয়ে আত্মপ্রচার করে, শিষ্যদের কাছে এরজন্যে পূজা প্রার্থনা করবে না। পক্ষান্তরে যিনি ভণ্ড, তিনি আকারে ইঙ্গিতে অন্ধ অনুগত শিষ্যদের দিয়ে এ কাজটি করাবেন। যিনি আত্মপ্রচারে নামবেন, তিনি অন্ততপক্ষে সাধক তো নয়ই ; বরং তাদের ভক্তও বলা যায় না।শ্রীচৈতন্যদেবের ভাষায় তাদের আমরা পাষণ্ডী নামে অবিহিত করতে পারি। শ্রীচৈতন্যদেবের বিবিধ শিক্ষার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হলো- মানুষকে অতিস্তুতি করে যেন ঈশ্বর বানিয়ে না ফেলা হয়। তিনি ছিলেন এর ঘোরতর বিরোধী। আজকে বাংলায় যে গত দেড়শো বছরে আমরা অবতারের হাইব্রীড ফসল দিয়ে ভরে ফেলেছি। তা হয়তো শ্রীচৈতন্যদেব আগেই বুঝতে পেরেছেন তার দূরদৃষ্টি দিয়ে। শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজের ভাষায়:
"প্রভু কহে বিষ্ণু বিষ্ণু ইহা না কহিহ।
জীবধামে কৃষ্ণজ্ঞান কভু না করিহ।।
জীব ঈশ্বর তত্ত্ব কভু নহে সম।
জলদগ্নি রাশি যৈছে স্ফুলিঙ্গের কণ।।"
(চৈতন্যচরিতামৃত : মধ্য, ১৮)
মনুষ্য গুরুদের অতিরিক্ত স্তুতি করে ভগবানের স্থানে বসানো অশাস্ত্রীয়। গুরুর স্থান গুরুর স্থানে। যেমন পিতামাতার স্থান পিতামাতার স্থানে এবং সর্বোপরি ভগবানের স্থান ভগবানের স্থানে। সকলেরই নিজ নিজ স্থান রয়েছে।একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে গুরু পূজনীয় বটে, কিন্তু সে কখনই ঈশ্বরের সমকক্ষ নয়। তিনিও ঈশ্বরের সৃষ্টি।তাই অতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে মনুষ্য গুরুদের ভগবান সাজিয়ে পূজা করা অনুচিত এবং যুগপৎ অপ্রয়োজনীয়।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁