মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে বলা হয়েছে, মানুষ যেমন লোকের সান্নিধ্যে থেকে তাদের সেবা করে এবং যেমন হওয়ার ইচ্ছা করে; তারা ঠিক তেমনিই হয়।
যাদৃশৈঃ সংবিবদতে যাদৃশাংশ্চোপসেবতে।
যাদৃগিচ্ছেচ্চ ভবিতুং তাদৃগ্ ভবতি পুরুষঃ ॥
(মহাভারত: উদ্যোগ পর্ব, ৩৬.১৩)
"মানুষ যেমন লোকের সাথে বিবাদ করে, যেমন লোকের সেবা করে এবং যেমন হওয়ার ইচ্ছা করে, তেমনিই হয়ে থাকে।"
মানুষ যেমন হওয়ার ইচ্ছা করে, সে চাইলে তেমনই হতে পারে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ একটি শক্তি আছে। বলা চলে যে, অনন্ত শক্তি আছে। জগতে দৃশ্যমান কোন কাজই অসম্ভবত নয়। যদি বিশ্বাস করা হয়, যে এই কাজটি আমি করতে পারবে। তবেই করা সম্ভব। কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি, যে আমাদের মাঝে অনন্ত শক্তি আছে।শুধু আমাদের ইচ্ছাশক্তি প্রয়োজন। এ ইইচ্ছাশক্তি বলে সকল কিছুই সম্ভব। তীব্রতর ইচ্ছা ব্যক্তিকে সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন থেকে বলতে পারি, যখন প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি কোন বিষয়ের আকাঙ্ক্ষা করেছি; সেই অভীষ্ট বিষয়টি কোন না কোনভাবে লাভ করেছি। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেয়া যায়। প্রায় একদশক আগে একবার বৈদিক যুগের শিক্ষা সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে আমি জানতে পারলাম যে বেদের গোপথ ব্রাহ্মণে বৈদিক যুগের শিক্ষা সম্পর্কে প্রচুর তথ্য রয়েছে। ছাত্রের করনীয় প্রসঙ্গে বলা আছে। তাই বৈদিক শিক্ষা নিয়ে লেখার পূর্বে, আমার গোপথ ব্রাহ্মণটি আগে পড়া প্রয়োজন। আমি ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার খুঁজে ব্রাহ্মণটি পেলাম না। এমনিভাবে প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি নিয়ে যখন আমি বইটির খোঁজ করছি। বইটি কোথায় পেতে পারি, এ নিয়ে চিন্তা করছি। ঠিক সেসময়েই আমাকে হঠাৎ ভারত থেকে কল করলেন, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য করুণাসিন্ধু দাশ স্যার। করুণাসিন্ধু দাশ স্যার জানতেন যে, আমি বেদ নিয়ে গবেষণা করার চেষ্টা করি। তিনি তখন আমাকে আমার গবেষণা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন। জানতে চাইলেন যে, গবেষণা কেমন চলছে। তিনি ব্যক্তি হিসেবে অসাধারণ এবং অমায়িক ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে আমাকে পরামর্শ দিয়ে জানালেন যে, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে 'বেদবিদ্যা চর্চা কেন্দ্র' নামে প্রতিষ্ঠান আছে। অনেক পণ্ডিত শিক্ষকেরা সেখানে বেদ নিয়ে গবেষণা করেন। তাদের অনেক প্রকাশনাও আছে।বেদবিদ্যা চর্চা কেন্দ্রের শিক্ষকদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা প্রসঙ্গে স্যার জানালেন, একজন শিক্ষক গোপথ ব্রাহ্মণ বাংলায় অনুবাদ করেছে। সরল ভাষায় অনুবাদটি ভালো হয়েছে। আমি আগ্রহ নিয়ে স্যারের কথা শুনতে শুনতে বিস্মিত হয়ে যাই। মনে মনে ভাবলাম, যে গ্রন্থটি আজ কয়েকদিন থেকে আমি রাতদিন খোঁজ করে যাচ্ছি, সেই গ্রন্থটির তথ্য স্যার নিজেই আমাকে প্রসঙ্গক্রমে বললেন। বিষয়টি আমাকে প্রচণ্ড বিস্মিত করে। আমি উপলব্ধি করলাম যে, ইচ্ছার একটি অনন্ত শক্তি আছে। মানুষ চাইলে সেই ইচ্ছশক্তিকে জাগিয়ে তুলে প্রাপ্ত বস্তুকে পেতে পারে। এতে এর জন্যে দৃঢ় ইচ্ছা প্রয়োজন। অবশ্য বিষয়টির সাথে যেহেতু দৈব সংযুক্ত। তাই দৈব বিষয়টি ফলপ্রসূতার জন্য দৈবানুগ্রহ প্রয়োজন। দৈবানুগ্রহ তখনই হবে, যখন ইচ্ছাটি সমষ্টিগত ইচ্ছা হবে। সেই ইচ্ছায় কোন অহংকার থাকবে না, থাকবে শুধুই আত্মসমর্পণ। ঈশ্বরের ইচ্ছাই পূর্ণ হবে সে ইচ্ছার মাঝে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়:
"আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে,
তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবনমাঝে।
যাচি হে তোমার চরম শান্তি, পরানে তোমার পরম কান্তি,
আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও হৃদয়পদ্মদলে।
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।