-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

সৌন্দর্য-ভালবাসার দেহে, সর্বদাই থাকে নিষ্ঠুর প্রতারণা ।



প্রেম নিয়ে আলোচনা সমালোচনার অন্ত নেই। বিশ্বব্যাপী সাহিত্যেরও অন্ত নেই। বাহ্যিকভাবে মানব সভ্যতার কাঠামোগত পরিবর্তন হলেও, মানবিক অনুভব অনুভূতিগুলো এখনও সেই পূর্বের মতই আছে; শুধু প্রেমিক প্রেমিকার প্রেম প্রকাশের পদ্ধতি হয়ত পরিবর্তিত হয়েছে।কেউ প্রেম করি, কেউ আবার প্রেমে পড়ি।আমরা যখন প্রেমে পড়ি, তখন হিতাহিতজ্ঞান থাকে না, মোহাচ্ছন্নতা পেয়ে বসে আমাদের।এর বিপরীতে সচেতনভাবে যদি প্রেম করি, তবে নিজের প্রেমরূপ গাড়ির ড্রাইভার নিজেকেই হতে হবে। গাড়ির স্টিয়ারিংটা যদি অন্যের হাতে থাকে, তাহলেই সর্বনাশ। আর সেই ড্রাইভার যদি ছলাকলা এবং প্রবঞ্চনা যুক্ত মানসিকতার হয় তাহলে তো কথাই নেই।ড্রাইভারের উপরেই গাড়ির গন্তব্য নির্ভরশীল। তাই ড্রাইভার ঠিকঠাক থাকলে, আর দুর্ঘটনা ঘটে না। তা না হলে দুর্ঘটনা ঘটবেই। নারীপুরুষের সাম্যাবস্থা আকাঙ্ক্ষিত, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে আদৌ সম্ভব না। প্রেম শুরু হয় চোখ সহ পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে, পরে আস্তে আস্তে ভাললাগা, আরো পরে ভালবাসা; পরবর্তীতে  দায়িত্ব দায়বদ্ধতা এসে সম্পর্ককে দৃঢ় করে।প্রেমকে সূত্রবদ্ধ করা যায় না। আমরা আমাদের আশেপাশের ঘটনাবলী দেখে যতবেশি সূত্রায়িত করার চেষ্টা করি, ততই সে সূত্রকে ভেঙে নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত হয়। এ জগত একটি নাট্যমঞ্চ -এ নাট্যমঞ্চে আমরা সবাই এক একজন অভিনেতা। শ্রীশঙ্করাচার্য এ কারণেই তাঁর জগদ্বিখ্যাত 'মোহমুদগর' গ্রন্থে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এ বিচিত্র জগতের দিনশেষে কেউ কারো নয়। এরপরেও আমরা আপন আপন ভাব করে যাচ্ছি, সম্পর্ক নামক খেলা খেলে যাচ্ছি একে অন্যের সাথে। কখনো শান্তি পাচ্ছি, কখনও ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি। কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ  সংসারোঽয়মতীববিচিত্রঃ। কস্য ত্বং বা কুত আয়াতঃ  তত্ত্বং চিন্তয় তদিদং ভ্রাতঃ॥ "কে তোমার স্ত্রী ? কে বা তোমার সন্তান? অতীব বিচিত্র এ সংসার। তুমি কার? তুমি কোথা থেকে এসেছ? এ তত্ত্বটি গভীরে চিন্তা করে দেখ।" প্রেম বিশেষ করে টিনএজ বয়সের প্রেম যতটা না প্রেম, এর থেকে বেশী আবেগের বশীভূত থাকে। এ আবেগের তীব্রতা বাড়তেই আসে মোহাচ্ছন্নতা। তখন মানুষের হিতাহিতজ্ঞান থাকে না। আকাশে মেঘ আসলে হঠাৎ যেমন, সূর্য ঢেকে যায়। কিছু সময়ের জন্যে আলো কমে যায়। আবার যখন মেঘ কেটে যায়, তখন চারিদিকে আলো জ্বলজ্বল করে উঠে। ভাল করে তখন পর্যবেক্ষণ করলে মেঘের খপ্পর টের পাওয়া যায়। আবেগের বশীভূত অবস্থায় মা-বাবার কারো কথাই ভাল লাগে না। একটু সময় চলে গেলে এই ছেলেমেয়েরাই বুঝতে পারে যে, তারা বিপদে ছিল, পাহাড়ের চূড়ার খাদে ছিল, যে কোন সময়ে পড়ে যেতে পারত। বিষয়টি পতঙ্গের আগুনে ঝাঁপ দেয়ার মত। পরিবারগুলিতে প্রেমের নামে দুর্ঘটনাগুলি এ টিনএজ সময়েই বেশী ঘটে। পতঙ্গরা চোখের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে, আগুনকে প্রিয় মনে করে আগুনে ঝাঁপ দেয়। পরিণামে তাদের কি হয়, তা আমরা সকলেই জানি। এ কাণ্ডজ্ঞানহীন আত্মঘাতী ভালবাসার কথাগুলি সাহিত্যে শুনতে হয়ত ভাল লাগে, চরিত্রগুলিকে অমর করে; কিন্তু বাস্তবে অনেকটাই অপ্রয়োজনীয়।  পরিবেশের কারণে আমরা প্রেমসাগরে ঝাঁপ দেই বা আবার আমাদের ঝাঁপ দিতে আকৃষ্ট করে। কেউ হয়ত সে সমুদ্রে ভালবাসার মণিমুক্তা পাই, আবার কেউ হয়ত দুর্ভাগ্যবশত হিংস্র কুমিরের পেটে চলে গিয়ে তাদের খাদ্য হয়ে যাই। প্রেমসমুদ্রে দুটোই হতে পারে। তাই সচেতন ভাবে, "নিজে বাঁচলে বাপের নাম" স্টাইলে প্রেমসমুদ্রে সাঁতার কাটতে হবে। এ সমুদ্রে স্বার্থপর বিশ্বাসঘাতক প্রতি পদে পদে। নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম নামে এক ফিতাকৃমির মত দেখতে প্যারাসাইট আছে, তারা তাদের নিজেদের প্রজনন স্বার্থে ঘাসফড়িং -এর মস্তিষ্ককে সংক্রমিত করে ফেলে; তখন ঘাসফড়িং জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে ফেলে। ঘাসফড়িং আত্মহত্যা না করলে এই প্যারাসাইটগুলি বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। নিজেদের স্বার্থে দুষ্ট প্যারাসাইটগুলি নির্দোষ ঘাসফড়িংগুলিকে  ভিক্টিম করে। এ প্যারাসাইটগুলির মত এমন নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে আমরা অনেককেই ব্যবহার করি। এ ব্যবহার করতে যেয়ে আমরা অনেকের জীবন নিয়ে, আবেগ অনুভূতি নিয়ে খেলে, তাদের জীবনীশক্তিকে শেষ করে দেই। আশেপাশের প্রতিদিনের অসংখ্য ঘটনা এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এ ভয়ংকর প্যারাসাইটরূপী ভালবাসার অভিঘাতে ছেলেরা বেশী আত্মহত্যা করে না, মেয়েরা বেশী করে এটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। ভালবাসায় যদি একবার প্রবঞ্চনার ঘুণ ধরে তবে আত্মহত্যা করুক বা না করুক বহু ছেলেমেয়েরা এর স্বার্থান্বেষী অভিঘাতে জীবন্মৃত হয়ে যায়। অবশ্য সত্যিকারের ভালবাসা মানুষকে প্রেরণা দেয়, জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে। আবার অনেকে আছে সে জানে সে ভালবাসার নামে ব্যবহৃত হচ্ছে, এরপরেও মুখ ফুটে না বলতে পারে না। নিজেই চলতে পারেনা, এরপরেও যদি কেউ প্রেমের নামে জীবনে বোঝার উপরে শাকের আঁটি চাপিয়ে দেয়, অনেকেই তাতে না নামক ন্যায্য অসঙ্গতি জানাতে পারে না। বিশেষ করে ছেলেরা তো মেয়েদের বিভিন্ন আবদারে একদমই না বলতে পারে না, এটা সত্যি। জগন্নাথ হলে আমার একজন রুমমেট ছিলেন, সে ৭/৮ টা টিউশনি করত, তারা সকলেই মেয়ে। টিউশনি শেষে রুমে এসে সারাক্ষণ তার ছাত্রীদের গল্পই করত, আর আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুনতে হত।আমরা বলতাম, এত টিউশনি করছেন আপনি নিজের পড়া পড়বেন কখন? এই ছাত্রীদের গল্প ছাড়া কি আপনার আর গল্প নেই? দাদাটির সরল উত্তর, "ঠাকুর আমি মেয়েদের না বলতে পারিনা।" কি আর করা, আমরাও যখন বুঝলাম সে না বলতে পারেন না, সারাক্ষণ এ গল্পও ছাড়তে পারবেন না; তখন আমরাও হাল ছেড়ে দিলাম। মনে পড়ল শ্রীশঙ্করাচার্যের মোহমুদগরের বিখ্যাত শ্লোকটি: বালস্তাবৎ ক্রীড়াসক্ত-স্তরুণস্তাবৎ তরুণীরক্তঃ। বৃদ্ধস্তাবচ্চিন্তামগ্নঃ পরমে ব্রহ্মণি কোঽপি ন লগ্নঃ॥ "বালকেরা খেলায় আসক্ত, তরুণেরা তরুণীদের প্রতি আসক্ত, বৃদ্ধেরা বিষয় চিন্তায় আসক্ত থাকে, সকল বয়সের সকলেই ভোগ নিয়ে ব্যস্ত ; শুধু পরম ব্রহ্মকে জানার জন্য কারো সময় নেই।" নারী এবং পুরুষদের এ দৈহিক মানসিক প্রকারভেদকে উপলক্ষ করে, বিখ্যাত সংস্কৃত আলঙ্কারিকরা বিশেষ করে শ্রীবিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর "সাহিত্যদর্পণ" গ্রন্থে নায়ক বা পুরুষদের ৪৮ প্রকারে এবং নায়িকা বা নারীদের ৩৮৪ প্রকারে ভাগ করেছেন।এখানে অবাক হওয়ার বিষয়, একজন নারীর মনজগতের প্রকারভেদ পুরুষের থেকে ৮ গুন বেশী। এ কারণেই নারীকে বুঝতে বহু পুরুষেরা ধোঁকা খেয়ে যায়। সৌন্দর্য দেখে এগিয়ে পরে বিপদগ্রস্ত হয়ে যায়। অনেকে কাটিয়ে উঠতে পারে আবার অনেকে ত্রিশঙ্কুর মত মধ্যগগনে ঝুলে থাকে, উপরে নিচে কোথাও যেতে পারে না। ফুলের জগতে ব্লিডিং হার্ট বা রক্তাক্ত হৃদয় নামে এমনি একটি রহস্যময় ফুল আছে। গাঢ় গোলাপি, বেগুনি বা সাদা রঙের ফুলগুলি হার্ট বা হৃদয় আকৃতির দেখতে। তাতে রক্তক্ষরণের চিহ্ন স্বরূপ দুটি পাঁপড়ি একটু বাইরে বেরোনো। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, হৃদয় থেকে রক্তপাত হচ্ছে।  শীতের শেষ এবং বসন্তের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডার সহ বেশ কয়েকটি দেশে ফুলটি দেখা যায়। ব্লিডিং হার্ট ফুলের বাগান দেখলে, দু’দণ্ড না দাঁড়িয়ে পারবেন না। এতই তার সৌন্দর্য, এতই তার আকর্ষণ।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এত সৌন্দর্য থাকার পরও ব্লিডিং হার্টের গোটা শরীর বিষে ভরা। বৃন্ত থেকে পাঁপড়ি ফুলটির সকল স্থানেই বিষে জর্জর। ফুলটি একবার মানুষের ত্বকের সংস্পর্শে এলেই শুরু হয়ে যায় বিপদ। প্রচণ্ড চুলকানি, অস্বস্তি, লাল হয়ে যাওয়া সহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। ধীরে ধীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। পরিণাম, বমি-বমি ভাব, শ্বাসকষ্ট এবং অসুস্থতা। এ অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে বহু সময় লেগে যায়, আবার অনেকে হয়ত সুস্থ নাও হতে পারেন। আমাদের ভালবাসা যখন ব্লিডিং হার্টের মত পঞ্চেন্দ্রিয় সর্বস্ব হয়ে যায় তখন নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম প্যারাসাইটের মত আমাদের দুর্ঘটনায় প্ররোচিত করে। সৌন্দর্য দেখে আমরা অনেকেই ব্লিডিং হার্টের কাছে যাই, আর বিষগ্রস্থ হই। কেউ যদি আগে থেকে সাবধান করে আমরা তাদের শত্রুর মত মনে করি। এ সময়ে বাবা-মা আত্মীয় পরিজন সহ যারা সাবধান করে, সকলকেই তখন শত্রুর মত মনে হয়। জীবন চলার পথে কোথায় কোথায় লাগাম দিতে হয়, তা আমরা অনেকেই জানি না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর "মানসী" কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত "মেঘদূত" কবিতায় বলেছেন পূর্ণ ভালবাসা -এ এক মানসসরসীতীরের কল্পপুরী; এ কল্পপুরীতে সশরীরে কেউ আদৌও গিয়েছেন কিনা এ নিয়ে কবির সংশয় । তিনি হতাশ হৃদয়ে প্রশ্ন করেছেন, প্রকৃত প্রেম  তার নিজের গন্তব্য কেন খুঁজে পায় না? "কেন ঊর্ধ্বে চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ? কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ? সশরীরে কোন্ নর গেছে সেইখানে, মানসসরসীতীরে বিরহশয়ানে, রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে জগতের নদী গিরি সকলের শেষে।"  মানুষের জীবনে যেখানেই  ভালবাসার ফল্গুধারা থাকবে, সেখানেই থাকবে একরাশ আবেগ এবং সেখানেই অযাচিতভাবে থাকবে বাধাবিপত্তি নামক আশীবিষের দংশন। ভালবাসার যথাযথ প্রকাশ সর্বক্ষেত্রে করা যায় না; কিছু ভালবাসা শুধুই হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। নিশব্দে শুনতে হয় ভালবাসার বৃষ্টির বিরামহীন রিমঝিম নান্দনিক শব্দ। শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
প্রেম নিয়ে আলোচনা সমালোচনার অন্ত নেই। বিশ্বব্যাপী সাহিত্যেরও অন্ত নেই। বাহ্যিকভাবে মানব সভ্যতার কাঠামোগত পরিবর্তন হলেও, মানবিক অনুভব অনুভূতিগুলো এখনও সেই পূর্বের মতই আছে; শুধু প্রেমিক প্রেমিকার প্রেম প্রকাশের পদ্ধতি হয়ত পরিবর্তিত হয়েছে।কেউ প্রেম করি, কেউ আবার প্রেমে পড়ি।আমরা যখন প্রেমে পড়ি, তখন হিতাহিতজ্ঞান থাকে না, মোহাচ্ছন্নতা পেয়ে বসে আমাদের।এর বিপরীতে সচেতনভাবে যদি প্রেম করি, তবে নিজের প্রেমরূপ গাড়ির ড্রাইভার নিজেকেই হতে হবে। গাড়ির স্টিয়ারিংটা যদি অন্যের হাতে থাকে, তাহলেই সর্বনাশ। আর সেই ড্রাইভার যদি ছলাকলা এবং প্রবঞ্চনা যুক্ত মানসিকতার হয় তাহলে তো কথাই নেই।ড্রাইভারের উপরেই গাড়ির গন্তব্য নির্ভরশীল। তাই ড্রাইভার ঠিকঠাক থাকলে, আর দুর্ঘটনা ঘটে না। তা না হলে দুর্ঘটনা ঘটবেই। নারীপুরুষের সাম্যাবস্থা আকাঙ্ক্ষিত, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে আদৌ সম্ভব না।
প্রেম শুরু হয় চোখ সহ পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে, পরে আস্তে আস্তে ভাললাগা, আরো পরে ভালবাসা; পরবর্তীতে দায়িত্ব দায়বদ্ধতা এসে সম্পর্ককে দৃঢ় করে।প্রেমকে সূত্রবদ্ধ করা যায় না। আমরা আমাদের আশেপাশের ঘটনাবলী দেখে যতবেশি সূত্রায়িত করার চেষ্টা করি, ততই সে সূত্রকে ভেঙে নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত হয়। এ জগত একটি নাট্যমঞ্চ -এ নাট্যমঞ্চে আমরা সবাই এক একজন অভিনেতা। শ্রীশঙ্করাচার্য এ কারণেই তাঁর জগদ্বিখ্যাত 'মোহমুদগর' গ্রন্থে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এ বিচিত্র জগতের দিনশেষে কেউ কারো নয়। এরপরেও আমরা আপন আপন ভাব করে যাচ্ছি, সম্পর্ক নামক খেলা খেলে যাচ্ছি একে অন্যের সাথে। কখনো শান্তি পাচ্ছি, কখনও ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি।
কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ
সংসারোঽয়মতীববিচিত্রঃ।
কস্য ত্বং বা কুত আয়াতঃ
তত্ত্বং চিন্তয় তদিদং ভ্রাতঃ॥
"কে তোমার স্ত্রী ? কে বা তোমার সন্তান? অতীব বিচিত্র এ সংসার। তুমি কার? তুমি কোথা থেকে এসেছ? এ তত্ত্বটি গভীরে চিন্তা করে দেখ।"
প্রেম বিশেষ করে টিনএজ বয়সের প্রেম যতটা না প্রেম, এর থেকে বেশী আবেগের বশীভূত থাকে। এ আবেগের তীব্রতা বাড়তেই আসে মোহাচ্ছন্নতা। তখন মানুষের হিতাহিতজ্ঞান থাকে না। আকাশে মেঘ আসলে হঠাৎ যেমন, সূর্য ঢেকে যায়। কিছু সময়ের জন্যে আলো কমে যায়। আবার যখন মেঘ কেটে যায়, তখন চারিদিকে আলো জ্বলজ্বল করে উঠে। ভাল করে তখন পর্যবেক্ষণ করলে মেঘের খপ্পর টের পাওয়া যায়। আবেগের বশীভূত অবস্থায় মা-বাবার কারো কথাই ভাল লাগে না। একটু সময় চলে গেলে এই ছেলেমেয়েরাই বুঝতে পারে যে, তারা বিপদে ছিল, পাহাড়ের চূড়ার খাদে ছিল, যে কোন সময়ে পড়ে যেতে পারত। বিষয়টি পতঙ্গের আগুনে ঝাঁপ দেয়ার মত। পরিবারগুলিতে প্রেমের নামে দুর্ঘটনাগুলি এ টিনএজ সময়েই বেশী ঘটে। পতঙ্গরা চোখের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে, আগুনকে প্রিয় মনে করে আগুনে ঝাঁপ দেয়। পরিণামে তাদের কি হয়, তা আমরা সকলেই জানি। এ কাণ্ডজ্ঞানহীন আত্মঘাতী ভালবাসার কথাগুলি সাহিত্যে শুনতে হয়ত ভাল লাগে, চরিত্রগুলিকে অমর করে; কিন্তু বাস্তবে অনেকটাই অপ্রয়োজনীয়।
প্রেম নিয়ে আলোচনা সমালোচনার অন্ত নেই। বিশ্বব্যাপী সাহিত্যেরও অন্ত নেই। বাহ্যিকভাবে মানব সভ্যতার কাঠামোগত পরিবর্তন হলেও, মানবিক অনুভব অনুভূতিগুলো এখনও সেই পূর্বের মতই আছে; শুধু প্রেমিক প্রেমিকার প্রেম প্রকাশের পদ্ধতি হয়ত পরিবর্তিত হয়েছে।কেউ প্রেম করি, কেউ আবার প্রেমে পড়ি।আমরা যখন প্রেমে পড়ি, তখন হিতাহিতজ্ঞান থাকে না, মোহাচ্ছন্নতা পেয়ে বসে আমাদের।এর বিপরীতে সচেতনভাবে যদি প্রেম করি, তবে নিজের প্রেমরূপ গাড়ির ড্রাইভার নিজেকেই হতে হবে। গাড়ির স্টিয়ারিংটা যদি অন্যের হাতে থাকে, তাহলেই সর্বনাশ। আর সেই ড্রাইভার যদি ছলাকলা এবং প্রবঞ্চনা যুক্ত মানসিকতার হয় তাহলে তো কথাই নেই।ড্রাইভারের উপরেই গাড়ির গন্তব্য নির্ভরশীল। তাই ড্রাইভার ঠিকঠাক থাকলে, আর দুর্ঘটনা ঘটে না। তা না হলে দুর্ঘটনা ঘটবেই। নারীপুরুষের সাম্যাবস্থা আকাঙ্ক্ষিত, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে আদৌ সম্ভব না। প্রেম শুরু হয় চোখ সহ পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে, পরে আস্তে আস্তে ভাললাগা, আরো পরে ভালবাসা; পরবর্তীতে  দায়িত্ব দায়বদ্ধতা এসে সম্পর্ককে দৃঢ় করে।প্রেমকে সূত্রবদ্ধ করা যায় না। আমরা আমাদের আশেপাশের ঘটনাবলী দেখে যতবেশি সূত্রায়িত করার চেষ্টা করি, ততই সে সূত্রকে ভেঙে নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত হয়। এ জগত একটি নাট্যমঞ্চ -এ নাট্যমঞ্চে আমরা সবাই এক একজন অভিনেতা। শ্রীশঙ্করাচার্য এ কারণেই তাঁর জগদ্বিখ্যাত 'মোহমুদগর' গ্রন্থে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এ বিচিত্র জগতের দিনশেষে কেউ কারো নয়। এরপরেও আমরা আপন আপন ভাব করে যাচ্ছি, সম্পর্ক নামক খেলা খেলে যাচ্ছি একে অন্যের সাথে। কখনো শান্তি পাচ্ছি, কখনও ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি। কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ  সংসারোঽয়মতীববিচিত্রঃ। কস্য ত্বং বা কুত আয়াতঃ  তত্ত্বং চিন্তয় তদিদং ভ্রাতঃ॥ "কে তোমার স্ত্রী ? কে বা তোমার সন্তান? অতীব বিচিত্র এ সংসার। তুমি কার? তুমি কোথা থেকে এসেছ? এ তত্ত্বটি গভীরে চিন্তা করে দেখ।" প্রেম বিশেষ করে টিনএজ বয়সের প্রেম যতটা না প্রেম, এর থেকে বেশী আবেগের বশীভূত থাকে। এ আবেগের তীব্রতা বাড়তেই আসে মোহাচ্ছন্নতা। তখন মানুষের হিতাহিতজ্ঞান থাকে না। আকাশে মেঘ আসলে হঠাৎ যেমন, সূর্য ঢেকে যায়। কিছু সময়ের জন্যে আলো কমে যায়। আবার যখন মেঘ কেটে যায়, তখন চারিদিকে আলো জ্বলজ্বল করে উঠে। ভাল করে তখন পর্যবেক্ষণ করলে মেঘের খপ্পর টের পাওয়া যায়। আবেগের বশীভূত অবস্থায় মা-বাবার কারো কথাই ভাল লাগে না। একটু সময় চলে গেলে এই ছেলেমেয়েরাই বুঝতে পারে যে, তারা বিপদে ছিল, পাহাড়ের চূড়ার খাদে ছিল, যে কোন সময়ে পড়ে যেতে পারত। বিষয়টি পতঙ্গের আগুনে ঝাঁপ দেয়ার মত। পরিবারগুলিতে প্রেমের নামে দুর্ঘটনাগুলি এ টিনএজ সময়েই বেশী ঘটে। পতঙ্গরা চোখের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে, আগুনকে প্রিয় মনে করে আগুনে ঝাঁপ দেয়। পরিণামে তাদের কি হয়, তা আমরা সকলেই জানি। এ কাণ্ডজ্ঞানহীন আত্মঘাতী ভালবাসার কথাগুলি সাহিত্যে শুনতে হয়ত ভাল লাগে, চরিত্রগুলিকে অমর করে; কিন্তু বাস্তবে অনেকটাই অপ্রয়োজনীয়।  পরিবেশের কারণে আমরা প্রেমসাগরে ঝাঁপ দেই বা আবার আমাদের ঝাঁপ দিতে আকৃষ্ট করে। কেউ হয়ত সে সমুদ্রে ভালবাসার মণিমুক্তা পাই, আবার কেউ হয়ত দুর্ভাগ্যবশত হিংস্র কুমিরের পেটে চলে গিয়ে তাদের খাদ্য হয়ে যাই। প্রেমসমুদ্রে দুটোই হতে পারে। তাই সচেতন ভাবে, "নিজে বাঁচলে বাপের নাম" স্টাইলে প্রেমসমুদ্রে সাঁতার কাটতে হবে। এ সমুদ্রে স্বার্থপর বিশ্বাসঘাতক প্রতি পদে পদে। নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম নামে এক ফিতাকৃমির মত দেখতে প্যারাসাইট আছে, তারা তাদের নিজেদের প্রজনন স্বার্থে ঘাসফড়িং -এর মস্তিষ্ককে সংক্রমিত করে ফেলে; তখন ঘাসফড়িং জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে ফেলে। ঘাসফড়িং আত্মহত্যা না করলে এই প্যারাসাইটগুলি বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। নিজেদের স্বার্থে দুষ্ট প্যারাসাইটগুলি নির্দোষ ঘাসফড়িংগুলিকে  ভিক্টিম করে। এ প্যারাসাইটগুলির মত এমন নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে আমরা অনেককেই ব্যবহার করি। এ ব্যবহার করতে যেয়ে আমরা অনেকের জীবন নিয়ে, আবেগ অনুভূতি নিয়ে খেলে, তাদের জীবনীশক্তিকে শেষ করে দেই। আশেপাশের প্রতিদিনের অসংখ্য ঘটনা এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এ ভয়ংকর প্যারাসাইটরূপী ভালবাসার অভিঘাতে ছেলেরা বেশী আত্মহত্যা করে না, মেয়েরা বেশী করে এটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। ভালবাসায় যদি একবার প্রবঞ্চনার ঘুণ ধরে তবে আত্মহত্যা করুক বা না করুক বহু ছেলেমেয়েরা এর স্বার্থান্বেষী অভিঘাতে জীবন্মৃত হয়ে যায়। অবশ্য সত্যিকারের ভালবাসা মানুষকে প্রেরণা দেয়, জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে। আবার অনেকে আছে সে জানে সে ভালবাসার নামে ব্যবহৃত হচ্ছে, এরপরেও মুখ ফুটে না বলতে পারে না। নিজেই চলতে পারেনা, এরপরেও যদি কেউ প্রেমের নামে জীবনে বোঝার উপরে শাকের আঁটি চাপিয়ে দেয়, অনেকেই তাতে না নামক ন্যায্য অসঙ্গতি জানাতে পারে না। বিশেষ করে ছেলেরা তো মেয়েদের বিভিন্ন আবদারে একদমই না বলতে পারে না, এটা সত্যি। জগন্নাথ হলে আমার একজন রুমমেট ছিলেন, সে ৭/৮ টা টিউশনি করত, তারা সকলেই মেয়ে। টিউশনি শেষে রুমে এসে সারাক্ষণ তার ছাত্রীদের গল্পই করত, আর আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুনতে হত।আমরা বলতাম, এত টিউশনি করছেন আপনি নিজের পড়া পড়বেন কখন? এই ছাত্রীদের গল্প ছাড়া কি আপনার আর গল্প নেই? দাদাটির সরল উত্তর, "ঠাকুর আমি মেয়েদের না বলতে পারিনা।" কি আর করা, আমরাও যখন বুঝলাম সে না বলতে পারেন না, সারাক্ষণ এ গল্পও ছাড়তে পারবেন না; তখন আমরাও হাল ছেড়ে দিলাম। মনে পড়ল শ্রীশঙ্করাচার্যের মোহমুদগরের বিখ্যাত শ্লোকটি: বালস্তাবৎ ক্রীড়াসক্ত-স্তরুণস্তাবৎ তরুণীরক্তঃ। বৃদ্ধস্তাবচ্চিন্তামগ্নঃ পরমে ব্রহ্মণি কোঽপি ন লগ্নঃ॥ "বালকেরা খেলায় আসক্ত, তরুণেরা তরুণীদের প্রতি আসক্ত, বৃদ্ধেরা বিষয় চিন্তায় আসক্ত থাকে, সকল বয়সের সকলেই ভোগ নিয়ে ব্যস্ত ; শুধু পরম ব্রহ্মকে জানার জন্য কারো সময় নেই।" নারী এবং পুরুষদের এ দৈহিক মানসিক প্রকারভেদকে উপলক্ষ করে, বিখ্যাত সংস্কৃত আলঙ্কারিকরা বিশেষ করে শ্রীবিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর "সাহিত্যদর্পণ" গ্রন্থে নায়ক বা পুরুষদের ৪৮ প্রকারে এবং নায়িকা বা নারীদের ৩৮৪ প্রকারে ভাগ করেছেন।এখানে অবাক হওয়ার বিষয়, একজন নারীর মনজগতের প্রকারভেদ পুরুষের থেকে ৮ গুন বেশী। এ কারণেই নারীকে বুঝতে বহু পুরুষেরা ধোঁকা খেয়ে যায়। সৌন্দর্য দেখে এগিয়ে পরে বিপদগ্রস্ত হয়ে যায়। অনেকে কাটিয়ে উঠতে পারে আবার অনেকে ত্রিশঙ্কুর মত মধ্যগগনে ঝুলে থাকে, উপরে নিচে কোথাও যেতে পারে না। ফুলের জগতে ব্লিডিং হার্ট বা রক্তাক্ত হৃদয় নামে এমনি একটি রহস্যময় ফুল আছে। গাঢ় গোলাপি, বেগুনি বা সাদা রঙের ফুলগুলি হার্ট বা হৃদয় আকৃতির দেখতে। তাতে রক্তক্ষরণের চিহ্ন স্বরূপ দুটি পাঁপড়ি একটু বাইরে বেরোনো। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, হৃদয় থেকে রক্তপাত হচ্ছে।  শীতের শেষ এবং বসন্তের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডার সহ বেশ কয়েকটি দেশে ফুলটি দেখা যায়। ব্লিডিং হার্ট ফুলের বাগান দেখলে, দু’দণ্ড না দাঁড়িয়ে পারবেন না। এতই তার সৌন্দর্য, এতই তার আকর্ষণ।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এত সৌন্দর্য থাকার পরও ব্লিডিং হার্টের গোটা শরীর বিষে ভরা। বৃন্ত থেকে পাঁপড়ি ফুলটির সকল স্থানেই বিষে জর্জর। ফুলটি একবার মানুষের ত্বকের সংস্পর্শে এলেই শুরু হয়ে যায় বিপদ। প্রচণ্ড চুলকানি, অস্বস্তি, লাল হয়ে যাওয়া সহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। ধীরে ধীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। পরিণাম, বমি-বমি ভাব, শ্বাসকষ্ট এবং অসুস্থতা। এ অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে বহু সময় লেগে যায়, আবার অনেকে হয়ত সুস্থ নাও হতে পারেন। আমাদের ভালবাসা যখন ব্লিডিং হার্টের মত পঞ্চেন্দ্রিয় সর্বস্ব হয়ে যায় তখন নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম প্যারাসাইটের মত আমাদের দুর্ঘটনায় প্ররোচিত করে। সৌন্দর্য দেখে আমরা অনেকেই ব্লিডিং হার্টের কাছে যাই, আর বিষগ্রস্থ হই। কেউ যদি আগে থেকে সাবধান করে আমরা তাদের শত্রুর মত মনে করি। এ সময়ে বাবা-মা আত্মীয় পরিজন সহ যারা সাবধান করে, সকলকেই তখন শত্রুর মত মনে হয়। জীবন চলার পথে কোথায় কোথায় লাগাম দিতে হয়, তা আমরা অনেকেই জানি না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর "মানসী" কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত "মেঘদূত" কবিতায় বলেছেন পূর্ণ ভালবাসা -এ এক মানসসরসীতীরের কল্পপুরী; এ কল্পপুরীতে সশরীরে কেউ আদৌও গিয়েছেন কিনা এ নিয়ে কবির সংশয় । তিনি হতাশ হৃদয়ে প্রশ্ন করেছেন, প্রকৃত প্রেম  তার নিজের গন্তব্য কেন খুঁজে পায় না? "কেন ঊর্ধ্বে চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ? কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ? সশরীরে কোন্ নর গেছে সেইখানে, মানসসরসীতীরে বিরহশয়ানে, রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে জগতের নদী গিরি সকলের শেষে।"  মানুষের জীবনে যেখানেই  ভালবাসার ফল্গুধারা থাকবে, সেখানেই থাকবে একরাশ আবেগ এবং সেখানেই অযাচিতভাবে থাকবে বাধাবিপত্তি নামক আশীবিষের দংশন। ভালবাসার যথাযথ প্রকাশ সর্বক্ষেত্রে করা যায় না; কিছু ভালবাসা শুধুই হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। নিশব্দে শুনতে হয় ভালবাসার বৃষ্টির বিরামহীন রিমঝিম নান্দনিক শব্দ। শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
পরিবেশের কারণে আমরা প্রেমসাগরে ঝাঁপ দেই বা আবার আমাদের ঝাঁপ দিতে আকৃষ্ট করে। কেউ হয়ত সে সমুদ্রে ভালবাসার মণিমুক্তা পাই, আবার কেউ হয়ত দুর্ভাগ্যবশত হিংস্র কুমিরের পেটে চলে গিয়ে তাদের খাদ্য হয়ে যাই। প্রেমসমুদ্রে দুটোই হতে পারে। তাই সচেতন ভাবে, "নিজে বাঁচলে বাপের নাম" স্টাইলে প্রেমসমুদ্রে সাঁতার কাটতে হবে। এ সমুদ্রে স্বার্থপর বিশ্বাসঘাতক প্রতি পদে পদে। নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম নামে এক ফিতাকৃমির মত দেখতে প্যারাসাইট আছে, তারা তাদের নিজেদের প্রজনন স্বার্থে ঘাসফড়িং -এর মস্তিষ্ককে সংক্রমিত করে ফেলে; তখন ঘাসফড়িং জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে ফেলে। ঘাসফড়িং আত্মহত্যা না করলে এই প্যারাসাইটগুলি বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। নিজেদের স্বার্থে দুষ্ট প্যারাসাইটগুলি নির্দোষ ঘাসফড়িংগুলিকে ভিক্টিম করে। এ প্যারাসাইটগুলির মত এমন নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে আমরা অনেককেই ব্যবহার করি। এ ব্যবহার করতে যেয়ে আমরা অনেকের জীবন নিয়ে, আবেগ অনুভূতি নিয়ে খেলে, তাদের জীবনীশক্তিকে শেষ করে দেই। আশেপাশের প্রতিদিনের অসংখ্য ঘটনা এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এ ভয়ংকর প্যারাসাইটরূপী ভালবাসার অভিঘাতে ছেলেরা বেশী আত্মহত্যা করে না, মেয়েরা বেশী করে এটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। ভালবাসায় যদি একবার প্রবঞ্চনার ঘুণ ধরে তবে আত্মহত্যা করুক বা না করুক বহু ছেলেমেয়েরা এর স্বার্থান্বেষী অভিঘাতে জীবন্মৃত হয়ে যায়। অবশ্য সত্যিকারের ভালবাসা মানুষকে প্রেরণা দেয়, জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে।
আবার অনেকে আছে সে জানে সে ভালবাসার নামে ব্যবহৃত হচ্ছে, এরপরেও মুখ ফুটে না বলতে পারে না। নিজেই চলতে পারেনা, এরপরেও যদি কেউ প্রেমের নামে জীবনে বোঝার উপরে শাকের আঁটি চাপিয়ে দেয়, অনেকেই তাতে না নামক ন্যায্য অসঙ্গতি জানাতে পারে না। বিশেষ করে ছেলেরা তো মেয়েদের বিভিন্ন আবদারে একদমই না বলতে পারে না, এটা সত্যি। জগন্নাথ হলে আমার একজন রুমমেট ছিলেন, সে ৭/৮ টা টিউশনি করত, তারা সকলেই মেয়ে। টিউশনি শেষে রুমে এসে সারাক্ষণ তার ছাত্রীদের গল্পই করত, আর আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুনতে হত।আমরা বলতাম, এত টিউশনি করছেন আপনি নিজের পড়া পড়বেন কখন? এই ছাত্রীদের গল্প ছাড়া কি আপনার আর গল্প নেই? দাদাটির সরল উত্তর, "ঠাকুর আমি মেয়েদের না বলতে পারিনা।" কি আর করা, আমরাও যখন বুঝলাম সে না বলতে পারেন না, সারাক্ষণ এ গল্পও ছাড়তে পারবেন না; তখন আমরাও হাল ছেড়ে দিলাম। মনে পড়ল শ্রীশঙ্করাচার্যের মোহমুদগরের বিখ্যাত শ্লোকটি:
বালস্তাবৎ ক্রীড়াসক্ত-স্তরুণস্তাবৎ তরুণীরক্তঃ।
বৃদ্ধস্তাবচ্চিন্তামগ্নঃ পরমে ব্রহ্মণি কোঽপি ন লগ্নঃ॥
"বালকেরা খেলায় আসক্ত, তরুণেরা তরুণীদের প্রতি আসক্ত, বৃদ্ধেরা বিষয় চিন্তায় আসক্ত থাকে, সকল বয়সের সকলেই ভোগ নিয়ে ব্যস্ত ; শুধু পরম ব্রহ্মকে জানার জন্য কারো সময় নেই।"
নারী এবং পুরুষদের এ দৈহিক মানসিক প্রকারভেদকে উপলক্ষ করে, বিখ্যাত সংস্কৃত আলঙ্কারিকরা বিশেষ করে শ্রীবিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর "সাহিত্যদর্পণ" গ্রন্থে নায়ক বা পুরুষদের ৪৮ প্রকারে এবং নায়িকা বা নারীদের ৩৮৪ প্রকারে ভাগ করেছেন।এখানে অবাক হওয়ার বিষয়, একজন নারীর মনজগতের প্রকারভেদ পুরুষের থেকে ৮ গুন বেশী। এ কারণেই নারীকে বুঝতে বহু পুরুষেরা ধোঁকা খেয়ে যায়। সৌন্দর্য দেখে এগিয়ে পরে বিপদগ্রস্ত হয়ে যায়। অনেকে কাটিয়ে উঠতে পারে আবার অনেকে ত্রিশঙ্কুর মত মধ্যগগনে ঝুলে থাকে, উপরে নিচে কোথাও যেতে পারে না। ফুলের জগতে ব্লিডিং হার্ট বা রক্তাক্ত হৃদয় নামে এমনি একটি রহস্যময় ফুল আছে। গাঢ় গোলাপি, বেগুনি বা সাদা রঙের ফুলগুলি হার্ট বা হৃদয় আকৃতির দেখতে। তাতে রক্তক্ষরণের চিহ্ন স্বরূপ দুটি পাঁপড়ি একটু বাইরে বেরোনো। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, হৃদয় থেকে রক্তপাত হচ্ছে।
শীতের শেষ এবং বসন্তের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডার সহ বেশ কয়েকটি দেশে ফুলটি দেখা যায়। ব্লিডিং হার্ট ফুলের বাগান দেখলে, দু’দণ্ড না দাঁড়িয়ে পারবেন না। এতই তার সৌন্দর্য, এতই তার আকর্ষণ।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এত সৌন্দর্য থাকার পরও ব্লিডিং হার্টের গোটা শরীর বিষে ভরা। বৃন্ত থেকে পাঁপড়ি ফুলটির সকল স্থানেই বিষে জর্জর। ফুলটি একবার মানুষের ত্বকের সংস্পর্শে এলেই শুরু হয়ে যায় বিপদ। প্রচণ্ড চুলকানি, অস্বস্তি, লাল হয়ে যাওয়া সহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। ধীরে ধীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। পরিণাম, বমি-বমি ভাব, শ্বাসকষ্ট এবং অসুস্থতা। এ অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে বহু সময় লেগে যায়, আবার অনেকে হয়ত সুস্থ নাও হতে পারেন।
আমাদের ভালবাসা যখন ব্লিডিং হার্টের মত পঞ্চেন্দ্রিয় সর্বস্ব হয়ে যায় তখন নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম প্যারাসাইটের মত আমাদের দুর্ঘটনায় প্ররোচিত করে। সৌন্দর্য দেখে আমরা অনেকেই ব্লিডিং হার্টের কাছে যাই, আর বিষগ্রস্থ হই। কেউ যদি আগে থেকে সাবধান করে আমরা তাদের শত্রুর মত মনে করি। এ সময়ে বাবা-মা আত্মীয় পরিজন সহ যারা সাবধান করে, সকলকেই তখন শত্রুর মত মনে হয়। জীবন চলার পথে কোথায় কোথায় লাগাম দিতে হয়, তা আমরা অনেকেই জানি না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর "মানসী" কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত "মেঘদূত" কবিতায় বলেছেন পূর্ণ ভালবাসা -এ এক মানসসরসীতীরের কল্পপুরী; এ কল্পপুরীতে সশরীরে কেউ আদৌও গিয়েছেন কিনা এ নিয়ে কবির সংশয় । তিনি হতাশ হৃদয়ে প্রশ্ন করেছেন, প্রকৃত প্রেম তার নিজের গন্তব্য কেন খুঁজে পায় না?
"কেন ঊর্ধ্বে চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ?
কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ?
সশরীরে কোন্ নর গেছে সেইখানে,
মানসসরসীতীরে বিরহশয়ানে,
রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে
জগতের নদী গিরি সকলের শেষে।"
মানুষের জীবনে যেখানেই ভালবাসার ফল্গুধারা থাকবে, সেখানেই থাকবে একরাশ আবেগ এবং সেখানেই অযাচিতভাবে থাকবে বাধাবিপত্তি নামক আশীবিষের দংশন। ভালবাসার যথাযথ প্রকাশ সর্বক্ষেত্রে করা যায় না; কিছু ভালবাসা শুধুই হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। নিশব্দে শুনতে হয় ভালবাসার বৃষ্টির বিরামহীন রিমঝিম নান্দনিক শব্দ।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।


মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁