-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

জামাই আদর বলে কথা!

কন্যার স্বামীকে জামাই বলা হয়। এ জামাই নিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিতে আলোচনার অন্ত নেই। কেউ যদি কোথাও বেশ আদর আপ্যায়নে থাকে, তবে আমরা আজও বলি, "লোকটা জামাই আদরে আছে"। জামাই শব্দটির সাথে আদর শব্দটি যেন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে। আজও বাঙালি পরিবারে ঘরে জামাই আসলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন আদর আপ্যায়ন করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়। কি থেকে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। জামাইয়ের সাথে ঘর শব্দ যুক্ত হয়ে ঘরজামাই শব্দে রূপান্তরিত হলে শব্দটি অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। জামাই আদরণীয় শব্দ হলেও, ঘর জামাই শব্দটি একটি তুচ্ছতাচ্ছিল্যবাচক শব্দ। যারা ঘর জামাই, তারা অনেক আদরে থাকলেও তাদের নিয়ে আশেপাশের মানুষ হাসিঠাট্টা করে। অবশ্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গারোদের মত মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থায় বিষয়টি ব্যতিক্রম। মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থায় সকল ছেলেদেরই বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বসবাস করতে হয়। বাঙালিদের একটি প্রবাদ আছে যে, "যম, জামাই ভাগ্নে কেউ নয় আপনা"। এ প্রবাদটি বহুল জনপ্রিয় হলেও, এ প্রবাদটির তাৎপর্য সুস্পষ্ট নয়। যম মানুষের আত্মাকে হরণ করে মৃত্যু ঘটায়, এ কারণে যম কখনো আপন হয় না। যমের এ বিষয়টি না হয় বোঝা গেলো। কিন্তু জামাই এবং ভাগ্নে কি দোষ করলো তা প্রবাদবাক্যটি যারা রচনা করেছেন, তারাই বলতে পারবেন। ভাগ্নে কৃষ্ণের হাতে যেহেতু মামা কংশের মৃত্যু হয়েছে, তাই হয়তো ভাগ্নেদের থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। অনেক জামাই শ্বশুরবাড়ির আদরের আতিশয্যে শ্বশুরবাড়ি নিজের রাজত্ব শুরু করে দেন। এদের শুধু জামাই নয়, জামাই রাজা বলা যায়।  বাঙালি সংস্কৃতিতে জামাইদের নিয়ে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় আনন্দঘন উৎসব রয়েছে। এ উৎসবটির নাম 'জামাই ষষ্ঠী'। জ্যেষ্ঠমাসে এ উৎসবটি প্রায় বাঙালি হিন্দু পরিবারে অনুষ্ঠিত হয়। নানা নিয়ম এবং পূজা-অর্চনার মাধ্যমে জামাই ষষ্ঠীর ব্রত পালন করা হয়। জামাই ষষ্ঠীর দিন এমন কিছু নিয়ম রয়েছে যা পালন করতে পারলে মেয়ে এবং তার স্বামী দু’জনেরই পরবর্তী জীবন অত্যন্ত সুখের হয়।এ দিন একটি সাদা সুতায় পাঁচ বা সাত পাক করে নিয়ে তাতে হলুদ মাখিয়ে মা ষষ্ঠীর কাছে পূজা দিয়ে জামাইয়ের হাতে বেঁধে দেয়া হয়। কোন কোন স্থানে পরিবারের সকলেই সেই সূত্রটি হাতে বন্ধন করেন। দেবী ষষ্ঠীর পূজা করা হয়। দেবী ষষ্ঠী হলেন সন্তান-সন্ততির কল্যাণ এবং রক্ষাকর্ত্রী। বিড়াল যেহেতু সারাবছর প্রচুরসংখ্যক সন্তান প্রসব করে, তাই দেবী ষষ্ঠীর বাহন হলো বিড়াল। জামাই ষষ্ঠীর দিনে জামাইদের সাথে সাথে ঘরের পোষ্য বিড়ালকেও ব্যাপক আদর আপ্যায়ন করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই সংস্কৃত এবং লোকায়ত সাহিত্যে জামাইদের নিয়ে অনেক গল্পগাথা প্রচলিত রয়েছে। জামাইদের দিনের পরে দিন শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করা প্রসঙ্গে বিষ্ণু শর্মার রচিত 'পঞ্চতন্ত্রে' একটি মজার গল্প রয়েছে। সেই গল্পটি হল:    বিকণ্টক নামক নগরে এক মহাধনী বণিক বাস করতেন। তার নাম ঈশ্বর। তার আদরের চার মেয়ের চার জামাই অবন্তীপীঠ নামক নগর থেকে বিকণ্টকে তার গৃহে এসে অতিথি হয়। জামাইদের পেয়ে বণিকও বেশ খুশি। তিনি তাদের যথাসাধ্য আদর আপ্যায়ন করলেন।জামাইদের জন্য বিভিন্ন প্রকারের খাওয়া-দাওয়া এবং বিবিধ প্রকারের পোষাকের ব্যবস্থা করলেন। বণিকের অতি-সমাদর এবং আপ্যায়নে জামাইরা তাদের নিজেদের বাড়িকে একপ্রকার ভুলেও গেলো। শ্বশুরবাড়িতে জামাই আদরে এভাবে ছয়মাস তারা রয়ে গেলো। ছয়মাস পরে একদিন ঈশ্বর বণিক তার স্ত্রীকে বললেন, "দেখো, জামাইরা এত বেশি আদর যত্নের টানে আর বাড়ি ফিরতে চাইছে না। তাদের আদর যত্ন কমিয়ে না দিলে তারা নিজের বাড়ি হয়ত ভুলে গিয়ে এ বাড়িতেই থাকা শুরু করবে। তাই এক কাজ করো, আজ খাবার দেয়ার সময় হাত-পা ধোওয়ার জল দিও না। তবে তাদের কিছুটা অপমান বোধ হতে পারে। সেই অপমান বোধ অনুভব করে তারা শ্বশুরবাড়ির জামাই আদর আপাতত পরিত্যাগ করে নিজের বাড়িতে চলে যাবে।" বণিকের কথামত তার স্ত্রী তাই করলেন। হাত-পা ধোওয়ার জল না দেওয়ায় অত্যন্ত অপমান বোধ করে বড় জামাই গর্গ তার নিজের বাড়িতে চলে গেলো। বণিকের তত্ত্বে কাজ হলো। বড় জামাই গর্গ চলে গেলেও রয়ে গেলো অন্য তিন জামাই। তারা নিশ্চিন্তমনে শ্বশুরবাড়ির জামাই আদর উপভোগ করতে লাগলো। সময় চলে যাচ্ছে, অন্য তিন জামাই যেহেতু তাদের নিজেদের বাড়িতে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে না। তখন ঈশ্বর বণিক আবার তার স্ত্রীকে খাবার দেয়ার সময় হাত-পা ধোওয়ার জল না দেওয়ার সাথে সাথে;  তাদের খেতে বসার সময়ে অনাদরে তুচ্ছতার সাথে আসন দিতে বললেন। প্রথমে হাত-পা ধোওয়ার জল, পরবর্তীতে খেতে বসার জন্যে যথাযোগ্য আসন না দেওয়ায় দ্বিতীয় জামাই সোম রাগ করে শ্বশুরবাড়ি পরিত্যাগ করলো। কিন্তু এরপরেও আরও দুই জামাই শ্বশুরবাড়ি যথারীতি রয়েই গেলো। তাদের যাওয়ার কোন লক্ষণ না দেখে, ঈশ্বর বণিক তার স্ত্রীকে এবার আরও কঠোর হতে বললেন। তিনি নিম্নমানের সাধারণ খাবার জামাইদের দিতে বললেন।নিম্নমানের সাধারণ খাবার খেয়ে অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে তৃতীয় জামাই দত্ত তার নিজের বাড়িতে চলে গেল। এই ভাবে তিনজন জামাই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু চতুর্থ জামাই শ্যামলক এতকাণ্ড হওয়ার পরেও কিছুতেই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে যায় না। সে নিশ্চিন্তমনে শ্বশুরবাড়ির খাবার খেয়েই যাচ্ছে। শ্বশুর শ্বাশুড়িসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে আকারে ইঙ্গিতে নিজের বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য বলে। কিন্তু কিছুতেই সে শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় পরিজনের ঈঙ্গিতপূর্ণ ভাষা বুঝতে পারে না। তখন নিরুপায় হয়ে শ্বশুরবাড়ি আত্মীয় পরিজনেরা তাকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে অর্থাৎ গলাধাক্কা দিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে  তাড়িয়ে দেয়।  গর্গো হি পাদশৌচাল্লঘ্বাসনদানতো গতঃ সোমঃ । দত্তঃ কদশনভোজ্যাচ্ শ্যামলকশ্চার্ধচন্দ্রেণ৷৷ (পঞ্চতন্ত্র:লব্ধপ্রণাশ, ৪৭) "পাদ্যাভাবে অর্থাৎ হাত-পা ধোওয়ার জল না দেওয়ার বড় জামাই গর্গ শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে গেলো।তুচ্ছ সামান্য আসন দেওয়ায় দ্বিতীয় জামাই সোম শ্বশুরবাড়ি পরিত্যাগ করলো। নিম্নমানের সাধারণ খাবার পরিবেশন করায় তৃতীয় জামাই দত্ত শ্বশুরবাড়ি পরিত্যাগ করলো। অর্ধচন্দ্র খেয়ে শ্বশুরবাড়ি পরিত্যাগ করলো শ্যামল।" জগতের নিয়ম এমনিই, কেউ যদি ইশারা ইঙ্গিতে না বোঝে তাকে তখন বাধ্য হয়ে সরাসরি তার নিজের বোধগম্য ভাষাতে বোঝাতে হয়। তা না হলে সে বুঝতে পারে না। কারো যদি জ্ঞান নয়তে না হয়, তবে নব্বইতে গিয়েও হয় না। অর্থাৎ যার নয়তে হয় না, তার নব্বইতে হয় না। অনেক জামাইরা শ্বশুরবাড়ির খাবার খেতে খেতে সে তা নিজের অধিকার বলে অনুভব করে। এদের অনেকেরই পরবর্তীতে পঞ্চতন্ত্রের চতুর্থ জামাই শ্যামলের মত গলাধাক্কা খেয়ে শ্বশুরবাড়ি পরিত্যাগ করতে হয়। জামাদের যেমন সর্বোচ্চ আদর আপ্যায়ন করা হয়। সে আদর আপ্যায়ন রক্ষা করাটাও এক ভয়াবহ দুরূহকাজ। জীবনে সম্পর্কগুলো লেবুর মত। অতিরিক্ত কচলাকচলি করলে তেতা হয়ে যায়। তাই অতিরিক্ত কচলাতে নেই। তাই জামাইদের যেহেতু সর্বোচ্চ আদর করা হয়, তাই পরিমিতিবোধ রেখে সে আদর আপ্যায়ন উপভোগ করতে হয়। নচেৎ আম-ছালা সকল কিছুই চলে গিয়ে, কপালে লবডঙ্কা জুটতে পারে। সংস্কৃত সাহিত্যের মত বাংলা সাহিত্যেও জামাই প্রসঙ্গ নিয়ে অনেক মজার গল্প আছে। এক ব্যক্তির একজন পরিচারক ছিলো। সেই পরিচারক ছেলেটি ধনী ব্যক্তিটির গৃহের বিভিন্ন কাজ করে দিত। একদিন সেই ধনী ব্যক্তিটি ছেলেটিকে বললো,  "ও নিমাই! এদিকে একটু শুনে যা তো বাবা।" ছেলেটি আশেপাশে তাকিয়ে যখন দেখলো কেউ নেই, সে জিজ্ঞাসা করলো, "বাবু আমার নাম তো নিমাই নয়,  কৃষ্ণ।" তখন ধনী ব্যক্তিটি বললো,  "নিমাই বা কৃষ্ণ ওই একটা হলেই হলো। তুই আমাকে প্রতিদিন নিমপাতা এনে দিস তো, তাই আদর করে তোকে নিমেই বলে ডাকছি"। ছেলেটি মণিবের কথায় খুশি হয়। সে পরের দিন যথারীতি নিমপাতার সাথে জামপাতাও এনে দেয়। তখন ধনী ব্যক্তিটি জিজ্ঞাসা করে, "ও নিমাই! তোকে শুধু নিমপাতা আনতে বলেছি, তুই নিমপাতার সাথে জামপাতা শুধুশুধু আনতে গেলি কেন?" একটি হাসি দিয়ে ছেলেটি তখন বলে, "বাবু প্রতিদিন  নিমপাতা এনে দেয়ার আমাকে যেহেতু  নিমাই নামটি দিয়েছেন, তাই নিমপাতার সাথে জামপাতা নিয়ে আসলাম। যেন আমাকে নিমপাতার জন্য নিমাইয়ের সাথে সাথে, জামপাতার জন্য জামাই বলে ডাকতে পারেন।" ধনী ব্যক্তিটি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললেন, " থাক বাবা! তোকে আমার নিমাই বলে ডাকার সাধ মিটে গেছে। তোর বাবার দেয়া আজন্মকালের কৃষ্ণ নামটিই ভালো।কৃষ্ণ বলে ডাকার সাথে সাথে ভগবানেরও নাম নেয়া হয়ে যায়। তাই অহেতুক নিমাই নামে ডাকার যেমন প্রয়োজন নেই, তেমনি জামপাতার জন্য জামাই নামেও ডাকার প্রয়োজন নেই। ক্ষান্ত দিলাম তোর নামকরণে" পরিচারক ছেলেটি ছিলো অত্যন্ত বুদ্ধিমান। সে তখন মৃদুহাসি দিয়ে বলে,"বাবু কি আর করা? সকলই জামপাতার দোষ! এই মুখপোড়া জামপাতার কারণে আমি নিত্যনতুন নাম থেকে বঞ্চিত হলাম শুধুশুধু।" কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী  সহকারী অধ্যাপক,  সংস্কৃত বিভাগ,  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
কন্যার স্বামীকে জামাই বলা হয়। এ জামাই নিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিতে আলোচনার অন্ত নেই। কেউ যদি কোথাও বেশ আদর আপ্যায়নে থাকে, তবে আমরা আজও বলি, "লোকটা জামাই আদরে আছে"। জামাই শব্দটির সাথে আদর শব্দটি যেন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে। আজও বাঙালি পরিবারে ঘরে জামাই আসলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন আদর আপ্যায়ন করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়। কি থেকে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। জামাইয়ের সাথে ঘর শব্দ যুক্ত হয়ে ঘরজামাই শব্দে রূপান্তরিত হলে শব্দটি অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। জামাই আদরণীয় শব্দ হলেও, ঘর জামাই শব্দটি একটি তুচ্ছতাচ্ছিল্যবাচক শব্দ। যারা ঘর জামাই, তারা অনেক আদরে থাকলেও তাদের নিয়ে আশেপাশের মানুষ হাসিঠাট্টা করে। অবশ্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গারোদের মত মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থায় বিষয়টি ব্যতিক্রম। মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থায় সকল ছেলেদেরই বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বসবাস করতে হয়।
বাঙালিদের একটি প্রবাদ আছে যে, "যম, জামাই ভাগ্নে কেউ নয় আপনা"। এ প্রবাদটি বহুল জনপ্রিয় হলেও, এ প্রবাদটির তাৎপর্য সুস্পষ্ট নয়। যম মানুষের আত্মাকে হরণ করে মৃত্যু ঘটায়, এ কারণে যম কখনো আপন হয় না। যমের এ বিষয়টি না হয় বোঝা গেলো। কিন্তু জামাই এবং ভাগ্নে কি দোষ করলো তা প্রবাদবাক্যটি যারা রচনা করেছেন, তারাই বলতে পারবেন। ভাগ্নে কৃষ্ণের হাতে যেহেতু মামা কংশের মৃত্যু হয়েছে, তাই হয়তো ভাগ্নেদের থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। অনেক জামাই শ্বশুরবাড়ির আদরের আতিশয্যে শ্বশুরবাড়ি নিজের রাজত্ব শুরু করে দেন। এদের শুধু জামাই নয়, জামাই রাজা বলা যায়।
বাঙালি সংস্কৃতিতে জামাইদের নিয়ে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় আনন্দঘন উৎসব রয়েছে। এ উৎসবটির নাম 'জামাই ষষ্ঠী'। জ্যেষ্ঠমাসে এ উৎসবটি প্রায় বাঙালি হিন্দু পরিবারে অনুষ্ঠিত হয়। নানা নিয়ম এবং পূজা-অর্চনার মাধ্যমে জামাই ষষ্ঠীর ব্রত পালন করা হয়। জামাই ষষ্ঠীর দিন এমন কিছু নিয়ম রয়েছে যা পালন করতে পারলে মেয়ে এবং তার স্বামী দু’জনেরই পরবর্তী জীবন অত্যন্ত সুখের হয়।এ দিন একটি সাদা সুতায় পাঁচ বা সাত পাক করে নিয়ে তাতে হলুদ মাখিয়ে মা ষষ্ঠীর কাছে পূজা দিয়ে জামাইয়ের হাতে বেঁধে দেয়া হয়। কোন কোন স্থানে পরিবারের সকলেই সেই সূত্রটি হাতে বন্ধন করেন। দেবী ষষ্ঠীর পূজা করা হয়। দেবী ষষ্ঠী হলেন সন্তান-সন্ততির কল্যাণ এবং রক্ষাকর্ত্রী। বিড়াল যেহেতু সারাবছর প্রচুরসংখ্যক সন্তান প্রসব করে, তাই দেবী ষষ্ঠীর বাহন হলো বিড়াল। জামাই ষষ্ঠীর দিনে জামাইদের সাথে সাথে ঘরের পোষ্য বিড়ালকেও ব্যাপক আদর আপ্যায়ন করা হয়।
প্রাচীনকাল থেকেই সংস্কৃত এবং লোকায়ত সাহিত্যে জামাইদের নিয়ে অনেক গল্পগাথা প্রচলিত রয়েছে। জামাইদের দিনের পরে দিন শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করা প্রসঙ্গে বিষ্ণু শর্মার রচিত 'পঞ্চতন্ত্রে' একটি মজার গল্প রয়েছে। সেই গল্পটি হল:
বিকণ্টক নামক নগরে এক মহাধনী বণিক বাস করতেন। তার নাম ঈশ্বর। তার আদরের চার মেয়ের চার জামাই অবন্তীপীঠ নামক নগর থেকে বিকণ্টকে তার গৃহে এসে অতিথি হয়। জামাইদের পেয়ে বণিকও বেশ খুশি। তিনি তাদের যথাসাধ্য আদর আপ্যায়ন করলেন।জামাইদের জন্য বিভিন্ন প্রকারের খাওয়া-দাওয়া এবং বিবিধ প্রকারের পোষাকের ব্যবস্থা করলেন। বণিকের অতি-সমাদর এবং আপ্যায়নে জামাইরা তাদের নিজেদের বাড়িকে একপ্রকার ভুলেও গেলো। শ্বশুরবাড়িতে জামাই আদরে এভাবে ছয়মাস তারা রয়ে গেলো। ছয়মাস পরে একদিন ঈশ্বর বণিক তার স্ত্রীকে বললেন, "দেখো, জামাইরা এত বেশি আদর যত্নের টানে আর বাড়ি ফিরতে চাইছে না। তাদের আদর যত্ন কমিয়ে না দিলে তারা নিজের বাড়ি হয়ত ভুলে গিয়ে এ বাড়িতেই থাকা শুরু করবে। তাই এক কাজ করো, আজ খাবার দেয়ার সময় হাত-পা ধোওয়ার জল দিও না। তবে তাদের কিছুটা অপমান বোধ হতে পারে। সেই অপমান বোধ অনুভব করে তারা শ্বশুরবাড়ির জামাই আদর আপাতত পরিত্যাগ করে নিজের বাড়িতে চলে যাবে।"
বণিকের কথামত তার স্ত্রী তাই করলেন। হাত-পা ধোওয়ার জল না দেওয়ায় অত্যন্ত অপমান বোধ করে বড় জামাই গর্গ তার নিজের বাড়িতে চলে গেলো। বণিকের তত্ত্বে কাজ হলো। বড় জামাই গর্গ চলে গেলেও রয়ে গেলো অন্য তিন জামাই। তারা নিশ্চিন্তমনে শ্বশুরবাড়ির জামাই আদর উপভোগ করতে লাগলো। সময় চলে যাচ্ছে, অন্য তিন জামাই যেহেতু তাদের নিজেদের বাড়িতে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে না। তখন ঈশ্বর বণিক আবার তার স্ত্রীকে খাবার দেয়ার সময় হাত-পা ধোওয়ার জল না দেওয়ার সাথে সাথে; তাদের খেতে বসার সময়ে অনাদরে তুচ্ছতার সাথে আসন দিতে বললেন। প্রথমে হাত-পা ধোওয়ার জল, পরবর্তীতে খেতে বসার জন্যে যথাযোগ্য আসন না দেওয়ায় দ্বিতীয় জামাই সোম রাগ করে শ্বশুরবাড়ি পরিত্যাগ করলো। কিন্তু এরপরেও আরও দুই জামাই শ্বশুরবাড়ি যথারীতি রয়েই গেলো। তাদের যাওয়ার কোন লক্ষণ না দেখে, ঈশ্বর বণিক তার স্ত্রীকে এবার আরও কঠোর হতে বললেন। তিনি নিম্নমানের সাধারণ খাবার জামাইদের দিতে বললেন।নিম্নমানের সাধারণ খাবার খেয়ে অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে তৃতীয় জামাই দত্ত তার নিজের বাড়িতে চলে গেল। এই ভাবে তিনজন জামাই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু চতুর্থ জামাই শ্যামলক এতকাণ্ড হওয়ার পরেও কিছুতেই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে যায় না। সে নিশ্চিন্তমনে শ্বশুরবাড়ির খাবার খেয়েই যাচ্ছে। শ্বশুর শ্বাশুড়িসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে আকারে ইঙ্গিতে নিজের বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য বলে। কিন্তু কিছুতেই সে শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় পরিজনের ঈঙ্গিতপূর্ণ ভাষা বুঝতে পারে না। তখন নিরুপায় হয়ে শ্বশুরবাড়ি আত্মীয় পরিজনেরা তাকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে অর্থাৎ গলাধাক্কা দিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়।
গর্গো হি পাদশৌচাল্লঘ্বাসনদানতো গতঃ সোমঃ ।
দত্তঃ কদশনভোজ্যাচ্ শ্যামলকশ্চার্ধচন্দ্রেণ৷৷
(পঞ্চতন্ত্র:লব্ধপ্রণাশ, ৪৭)
"পাদ্যাভাবে অর্থাৎ হাত-পা ধোওয়ার জল না দেওয়ার বড় জামাই গর্গ শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে গেলো।তুচ্ছ সামান্য আসন দেওয়ায় দ্বিতীয় জামাই সোম শ্বশুরবাড়ি পরিত্যাগ করলো। নিম্নমানের সাধারণ খাবার পরিবেশন করায় তৃতীয় জামাই দত্ত শ্বশুরবাড়ি পরিত্যাগ করলো। অর্ধচন্দ্র খেয়ে শ্বশুরবাড়ি পরিত্যাগ করলো শ্যামল।"
জগতের নিয়ম এমনিই, কেউ যদি ইশারা ইঙ্গিতে না বোঝে তাকে তখন বাধ্য হয়ে সরাসরি তার নিজের বোধগম্য ভাষাতে বোঝাতে হয়। তা না হলে সে বুঝতে পারে না। কারো যদি জ্ঞান নয়তে না হয়, তবে নব্বইতে গিয়েও হয় না। অর্থাৎ যার নয়তে হয় না, তার নব্বইতে হয় না। অনেক জামাইরা শ্বশুরবাড়ির খাবার খেতে খেতে সে তা নিজের অধিকার বলে অনুভব করে। এদের অনেকেরই পরবর্তীতে পঞ্চতন্ত্রের চতুর্থ জামাই শ্যামলের মত গলাধাক্কা খেয়ে শ্বশুরবাড়ি পরিত্যাগ করতে হয়। জামাদের যেমন সর্বোচ্চ আদর আপ্যায়ন করা হয়। সে আদর আপ্যায়ন রক্ষা করাটাও এক ভয়াবহ দুরূহকাজ। জীবনে সম্পর্কগুলো লেবুর মত। অতিরিক্ত কচলাকচলি করলে তেতা হয়ে যায়। তাই অতিরিক্ত কচলাতে নেই। তাই জামাইদের যেহেতু সর্বোচ্চ আদর করা হয়, তাই পরিমিতিবোধ রেখে সে আদর আপ্যায়ন উপভোগ করতে হয়। নচেৎ আম-ছালা সকল কিছুই চলে গিয়ে, কপালে লবডঙ্কা জুটতে পারে।
সংস্কৃত সাহিত্যের মত বাংলা সাহিত্যেও জামাই প্রসঙ্গ নিয়ে অনেক মজার গল্প আছে। এক ব্যক্তির একজন পরিচারক ছিলো। সেই পরিচারক ছেলেটি ধনী ব্যক্তিটির গৃহের বিভিন্ন কাজ করে দিত। একদিন সেই ধনী ব্যক্তিটি ছেলেটিকে বললো, "ও নিমাই! এদিকে একটু শুনে যা তো বাবা।" ছেলেটি আশেপাশে তাকিয়ে যখন দেখলো কেউ নেই, সে জিজ্ঞাসা করলো, "বাবু আমার নাম তো নিমাই নয়, কৃষ্ণ।" তখন ধনী ব্যক্তিটি বললো, "নিমাই বা কৃষ্ণ ওই একটা হলেই হলো। তুই আমাকে প্রতিদিন নিমপাতা এনে দিস তো, তাই আদর করে তোকে নিমেই বলে ডাকছি"। ছেলেটি মণিবের কথায় খুশি হয়। সে পরের দিন যথারীতি নিমপাতার সাথে জামপাতাও এনে দেয়। তখন ধনী ব্যক্তিটি জিজ্ঞাসা করে, "ও নিমাই! তোকে শুধু নিমপাতা আনতে বলেছি, তুই নিমপাতার সাথে জামপাতা শুধুশুধু আনতে গেলি কেন?" একটি হাসি দিয়ে ছেলেটি তখন বলে, "বাবু প্রতিদিন নিমপাতা এনে দেয়ার আমাকে যেহেতু নিমাই নামটি দিয়েছেন, তাই নিমপাতার সাথে জামপাতা নিয়ে আসলাম। যেন আমাকে নিমপাতার জন্য নিমাইয়ের সাথে সাথে, জামপাতার জন্য জামাই বলে ডাকতে পারেন।" ধনী ব্যক্তিটি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললেন, " থাক বাবা! তোকে আমার নিমাই বলে ডাকার সাধ মিটে গেছে। তোর বাবার দেয়া আজন্মকালের কৃষ্ণ নামটিই ভালো।কৃষ্ণ বলে ডাকার সাথে সাথে ভগবানেরও নাম নেয়া হয়ে যায়। তাই অহেতুক নিমাই নামে ডাকার যেমন প্রয়োজন নেই, তেমনি জামপাতার জন্য জামাই নামেও ডাকার প্রয়োজন নেই। ক্ষান্ত দিলাম তোর নামকরণে" পরিচারক ছেলেটি ছিলো অত্যন্ত বুদ্ধিমান। সে তখন মৃদুহাসি দিয়ে বলে,"বাবু কি আর করা? সকলই জামপাতার দোষ! এই মুখপোড়া জামপাতার কারণে আমি নিত্যনতুন নাম থেকে বঞ্চিত হলাম শুধুশুধু।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।

মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁