দেশের মন্ত্রীরা যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে শপথ নেয়, তখন তারা তাদের পদের শপথের সাথে সাথে গোপনীয়তারও শপথ নেন। পদ এবং গোপনীয়তার জন্যে দুইবার করে শপথ নিতে হয় তাদের। একটি রাষ্ট্রের অসংখ্য গোপনীয় দিক থাকে, যা প্রকাশিত হলে রাষ্ট্রটি জাতিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। একটি রাষ্ট্রের যেমন গোপনীয়তা থাকে তেমনি, একটি সমাজ, একটি পরিবার সহ সর্বোপরি ব্যক্তিরও গোপনীয়তা থাকে। এ গোপনীয়তা ভঙ্গে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, ব্যক্তি সহ সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সম্পূর্ণ গোপনীয় বিষয় যেমন কখনই বলা উচিত না ;তেমনি অসচেতনভাবে কারো গোপনীয় বিষয় জেনে তা প্রকাশিত করাও উচিত নয়। এ প্রসঙ্গে গরুড়পুরাণের পূর্বখণ্ডে বলা হয়েছে:
নাত্মচ্ছিদ্রং পরে দদ্যাদ্বিদ্যাচ্ছিদ্রং পরস্য চ।
গৃহেৎ কুৰ্ম ইবাঙ্গানি পরভাবঞ্চ লক্ষয়েৎ ॥
(গরুড়পুরাণ :পূর্বখণ্ড, ১১৪.১৫)
"অপরের নিকট কখনো নিজের আত্মচ্ছিদ্র বা দুর্বলতা প্রকাশ করবে না। কিন্তু বিদ্যাচ্ছিদ্র বা নিজের বিদ্যার সীমাবদ্ধতা অপরকে জানাবে। কচ্ছপ যেমন নিজের শরীর গোপন করে রাখে, সেইরূপ আত্মপরাভব যথাসম্ভব গোপন করে রাখবে।"
তবে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদারের রথটি বরাবরই অন্যদের থেকে কিছুটা উল্টোপথে চলে। তাদের নিজ ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে যদি নেতিবাচক বিষয় থাকে, তারা সবার আগেই তা প্রকাশ করে নিজের স্বতন্ত্রতা জানাতে চায়। অথচ হিন্দুবিহীন বাঙালি অন্যদের মধ্যে সামাজিক সংস্কার বা তাদের সম্প্রদায়ের অমানবিক বিষয় নিয়ে কথা বলা হয় খুবই সীমিত পরিসরে। রাস্তায় অবস্থানকারী হতদরিদ্র একজন মানুষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ; সংস্কার প্রসঙ্গে সকলের মনোভাব এবং কথাই একইপ্রকারের।চাণক্যও তাঁর সূত্রগ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, স্বীয় ছিদ্র বা গোপনীয়তা কখনও প্রকাশ করা উচিত নয়।
আত্মচ্ছিদ্রং ন প্রকাশয়েৎ।
(চাণক্যসূত্র: ২.৯৬)
"নিজের ছিদ্র বা গোপনীয়তা কখনও প্রকাশ করবে না।"
মানবজীবনে গোপনীয়তা থাকবেই, প্রত্যেকের জীবনেই কোন কোন না কোন গোপনীয়তা আছে। যতই প্রিয় হোক বা যতই কাছের হোক জীবনের সম্পূর্ণ গোপনীয়তা কাউকেই বলা উচিত নয়।এ প্রসঙ্গে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছেন, "যত গুপ্ত তত পোক্ত; যত ব্যক্ত তত ত্যক্ত"। জীবনে যে কখন কোন বন্ধু-আপনজন শত্রুরূপে আবির্ভূত হবে তা কেউ নির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না।কচ্ছপ যেমন নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে সংকুচিত করে রাখে, তেমনি নিজের বা সম্প্রদায়ের গোপনীয় বিষয় যথাসম্ভব পোক্ত করে রাখা উচিত।কিছু লোক আছে যারা, নিজের কিছু সাময়িক লাভের আশায় স্বজাতীয় গোপনীয়তা ভঙ্গ করে। পরিণামে স্বজাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরা অনেকটা শিকারীর পোষা পাখির মত। যে পোষাপাখির সুমিষ্ট সুরের আহ্বানে অন্য পাখিরা আকৃষ্ট হয়। পোষাপাখিকে ব্যবহার করে শিকারী ফাঁদে ফেলে
স্বজাতীয় অন্য পাখিদের খাঁচায় আবদ্ধ করে।দুর্বল মুহূর্তে আমরা নিজেদের গোপনীয়তা বন্ধুবান্ধবদের কাছে অধিকাংশ সময়ে অবচেতনভাবে প্রকাশিত করে দেই। পরবর্তীতে দেখা যায় দুর্বল সময়ে বলা মনের একান্ত কথাই পরে কাছের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায় বুমেরাং হয়ে ফিরে এসে জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। গোপনীয় বিষয় যদি কিছুটা প্রকাশিত করতে হয়, তবে তা এমন ব্যক্তিদের কাছেই প্রকাশিত করা উচিত যাদের থেকে একটি সমাধানের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু যাদের দ্বারা সামান্যতম সমাধানের সম্ভাবনা নেই, তাদের কাছে বিষয়টি বৃথাই ফলহীন অরণ্যরোদন। নিজের সমপর্যায়ের বন্ধুদের কাছে গোপনীয় বিষয় না বলাই উত্তম। এতে সমস্যা আরোও বৃদ্ধি পেতে পারে।কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতায় বলেছেন, কেউ বিপদে না পরা পর্যন্ত অন্য সমপর্যায়ের বন্ধুদের বিপদ উপলব্ধি করতে পারে না। তখন বিপদগ্রস্থের বিপদের ভয়াবহতা বোঝা দূরে থাক; সে বিপদগ্রস্ত মানুষটাকে নিয়ে পর্যন্ত পরিহাস করে।
"যতদিন ভবে, না হবে না হবে,
তোমার অবস্থা আমার সম।
ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।"
শ্রীমদ্ভগবদগীতাতেও গোপনীয়তা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, "মৌনং চৈবাস্মি গুহ্যানাং(১০.৩৮)"। এ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, গোপনীয়তার মধ্যে মৌন। ধ্যান, জপাদি আধ্যাত্মিক কর্মেও গোপনীয়তা প্রয়োজনীয়। এককথায় বলতে গেলে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক সহ সকল ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনে গোপনীয়তা অত্যাবশ্যকীয়।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।