-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

"কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্"; জগতের স্রষ্টাই পরম গুরু।

"কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্";  জগতের স্রষ্টাই পরম গুরু শাস্ত্রে গুরু নিয়ে যেমন অনেক কথা বলা হয়েছে, তেমনি গুরু নিয়ে শাস্ত্রে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। যিনি এ জগত সৃষ্টি করেছেন, তিনিই গুরু।আমাদের বিভিন্ন শাস্ত্রে পরমেশ্বরকে গুরুরূপে অভিহিত করার পরেও, আমরা অনেকে গুরু নিয়ে সন্দিগ্ধ হয়ে যাই। অর্থাৎ মনুষ্য গুরু নিয়ে আমরা এত বেশি সন্দিগ্ধ হয়ে যাই যে, পরমেশ্বরকে আর গুরু বলে অনুভব করতে পারি না। এ প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর 'কথামৃত' গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন:  "মানুষের কী সাধ্য অপরকে সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত করে। যাঁর এই ভুবনমোহিনী মায়া, তিনিই সেই মায়া থেকে মুক্ত করতে পারেন। সচ্চিদানন্দগুরু বই আর গতি নাই। যারা ঈশ্বর লাভ করে নাই, যারা তাঁর আদেশ পায় নাই, যারা ঈশ্বরের শক্তিতে শক্তিমান হয় নাই, তাদের কী সাধ্য জীবের ভববন্ধন মোচন করে।" (শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত: ৪র্থ খণ্ড, ৫ম পরিচ্ছেদ) গুরু এক সচ্চিদানন্দ। তিনিই শিক্ষা দিবেন।  ...আদেশ না থাকলে 'আমি লােক শিক্ষা দিচ্ছি' এই অহংকার হয়। অহংকার হয় অজ্ঞানে । অজ্ঞানে বােধ হয়, আমি কর্তা। ঈশ্বর কর্তা, ঈশ্বরই সব করছেন, আমি কিছু করছি না, এ বােধ হলে তাে সে জীবন্মুক্ত। 'আমি কর্তা’, 'আমি কর্তা' এই বােধ থেকেই যত দুঃখ, অশান্তি।" (শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত: ২য় খণ্ড, ৮ম পরিচ্ছেদ) মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্রের সমাধিপাদে জগতের সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বরকেই গুরু বলে অবিহিত করে বলা হয়েছে, তিনিই সর্বজ্ঞবীজ; তিনিই কালের দ্বারা অবিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব পূর্ববর্তী অনাদিকাল থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গুরু। প্রণবকে অবলম্বন করে তাঁকে জানা যায়। তত্র নিরতিশয়ং সর্বজ্ঞবীজম্। স পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেন অনবচ্ছেদাৎ। তস্য বাচকঃ প্রণবঃ।  (যোগসূত্র : ১.২৫-২৭) "ঈশ্বরই নিরতিশয়ত্ব প্রাপ্ত সর্বজ্ঞবীজ।তিনি কালের দ্বারা অবিচ্ছিন্ন পূর্ব পূর্ববর্তী অনাদিকাল থেকেই গুরু। প্রণব বা ওঁকারই তাঁর বাচক।" যোগদর্শনের মত বেদাদি শাস্ত্রের বহুস্থানেই ভগবানকে গুরু বা জগদগুরু বলা হয়েছে, কারণ সকল জ্ঞানের উৎস তিনি। জীবকে সৃষ্টি করেছেন তিনি, সকল জ্ঞানের উৎসও তিনি, তাই তাকে জগদগুরু বলা হয়।মহাভারতের আদিপর্বে বলা হয়েছে: মঙ্গল্যং মঙ্গলং বিষ্ণুং বরেণ্যমনঘং শুচিম্ ।  নমস্কৃত্য হৃষীকেশং চরাচরগুরুং হরিম্ ॥ (মহাভারত: আদিপর্ব, ১.২৪) "যিনি মঙ্গলজনক ও মঙ্গলময় বিষ্ণু, ভোগ ও মুক্তিপ্রার্থীদের আদরণীয়, নিষ্পাপ, পবিত্র, মায়ার নিয়ন্তা ও জগতের গুরু; সেই নারায়ণকে নমস্কার।" মহাভারতের শান্তিপর্বে মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, সর্বদাই পুরুষোত্তম ভাগবান নারায়ণের পূজা করতে। কারণ, তিনি সমগ্র জগতের মাতা, পিতা এবং গুরু। ত্বয়াপি সততং রজন্নভ্যর্চ্চঃ পুরুষোত্তমঃ ।  সহি মাতা পিতা চৈব কৃৎস্নন্য জগতো গুরুঃ ॥  (মহাভারত:শান্তিপর্ব, ৩২৫.১২৬) " হে রাজা যুধিষ্ঠির! তুমিও সর্বদাই পুরুষোত্তম নারায়ণের পূজা করবে। কারণ, তিনি সমগ্র জগদ্বাসীর মাতা, পিতা ও গুরু।" শ্রীমদ্ভাগবত সহ বিভিন্ন পুরাণ এবং দর্শনে ভগবানকে বারবার গুরু বা জগদগুরু বলে অবিহিত হতে দেখা যায়। শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধে কুন্তীদেবী ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে বলেন: বিপদঃ সন্তু নঃ শশ্বত্তত্র তত্র জগদ্গুরো।  ভবতো দর্শনং যৎ স্যাদপুনর্ভবদর্শনম্৷৷ (শ্রীমদ্ভাগবত:১.৮.২৫) "হে জগদ্‌গুরু ! আমাদের জীবনে পদে পদে বিপদ আসুক ; কারণ বিপদের মধ্যেই নিশ্চিতভাবে আপনার দর্শনলাভ হয় এবং আপনার দর্শনলাভ হলে আর জন্মমৃত্যুর চক্রে পড়তে হয় না৷" শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের ভক্ত প্রহ্লাদ কর্তৃক নৃসিংহদেবের স্তোত্রেও ভগবানকে অখিল জগতের গুরু বা জগদ্‌গুরু বলে অবিহিত করা হয়েছে: কো ন্বত্র তেহখিলগুরো ভগবন্ প্রয়াস  উত্তারণেঽস্য ভবসম্ভবলোপহেতোঃ। মূঢ়েষু বৈ মহদনুগ্রহঃ আর্তবন্ধো কিং তেন তে প্রিয়জনাননুসেবতাং নঃ৷৷ (শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ:৭.৯.৪২) "হে জগদ্‌গুরু, আপনি সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের কর্তা, এ সংসার নদী থেকে জীবকে পার করার আপনি কী উপায় ভেবেছেন ? হে দীননাথ ! সাংসারিক বুদ্ধিহীন সরল ব্যক্তিই মহান পুরুষের বিশেষ অনুগ্রহভাজন হয়। কিন্তু আমি তা নই। আমার তার প্রয়োজনও নেই কারণ আমি আপনার প্রিয়জনের সেবাদাস, তাই সংসার সাগর পার হওয়ার কোনো ভাবনাই আমার নেই।" জগদগুরু শব্দটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নামের পূর্বে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের মত শ্রীমদ্ভগবদগীতার মঙ্গলাচরণ ধ্যানেও বলা হয়েছে। সেখানে জগদগুরুরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা করা হয়েছে।  সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ। পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ ৷৷  বসুদেবসুতং দেবং কংসচাণূরমর্দনম্। দেবকীপরমানন্দং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্ ৷৷  (গীতাধ্যান:৪-৫) "উপনিষদসমূহ গাভী, গোপালনন্দন শ্রীকৃষ্ণ সেই গাভীর দোহনকর্তা, অর্জুন গো-বৎস, এই মহৎ গীতামৃতস্বরূপ বাণী সেই গাভীর দুগ্ধ এবং শুদ্ধ-বুদ্ধিসম্পন্ন সুধীজন তার ভোক্তা।  কংস ও চাণূর নামক দ্বৈত্যদ্বয়-বিনাশী, জননী দেবকীর পরমানন্দদায়ক, বসুদেবপুত্র জগদ্গুরু ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আমি বন্দনা করি।" শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর রচিত কৃষ্ণাষ্টক নামক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে সমর্পিত স্তোত্রটি শুরুই করেছেন বেদের একমাত্র প্রতিপাদ্য, বুদ্ধির সাক্ষীরূপ সর্বান্তর্যামী, অসুর বিনাশক চরাচর সকলের গুরুরূপ পরমেশ্বরকে স্মরণ করেছেন। শ্রিয়াশ্লিষ্টো বিষ্ণুঃ স্থিরচরগুরুর্বেদবিষয়ো ধিয়াং সাক্ষী শুদ্ধো হরিরসুরহন্তাব্জনয়নঃ । গদী শঙ্খী চক্রী বিমলবনমালী স্থিররুচিঃ শরণ্যো লোকেশো মম ভবতু কৃষ্ণোঽক্ষিবিষয়ঃ॥  "শক্তি স্বরূপা শ্রীকে আলিঙ্গিত করে অভেদমূর্তিতে আছেন যে বিষ্ণু, যিনি চরাচর সকলের গুরু, বেদের যিনিই একমাত্র প্রতিপাদ্য বিষয়, যিনি বুদ্ধির সাক্ষীরূপ সর্বান্তর্যামী, যিনি অসুর বিনাশক, পদ্মকমলের ন্যার রক্তিম যাঁর নয়ন। যিনি শঙ্খ,চক্র ও গদা ও বিমল বনমালা ধারণকারী। যাঁর দেহের উজ্জল দীপ্তি সর্বদা বিরাজমান।যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র শরণ্য ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণচন্দ্র দয়া করে আমার নয়নগোচর হোন।" শ্রীশঙ্করাচার্যের রচিত অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের একটি প্রকরণগ্রন্থ হল 'বিবেকচূড়ামণি'। এ গ্রন্থের মঙ্গলাচরণ শ্লোকেই তিনি, বাক্যমনের অতীত পরমানন্দস্বরূপ গোবিন্দকে সদ্গুরুরূপে প্রণাম করেছেন। যে পরমেশ্বর গোবিন্দকে সর্ববেদান্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জানা যায়। এই মঙ্গলাচরণ শ্লোকে শ্রীশঙ্করাচার্য দ্ব্যর্থবোধক শব্দে বাক্যমনের অতীত পরমেশ্বর গোবিন্দ এবং এবং তাঁর নিজগুরু শ্রীগোবিন্দপাদকে প্রণাম করেছেন। সর্ববেদান্তসিদ্ধান্তগোচরং তমগোচরম্ । গোবিন্দং পরমানন্দং সদ্গুরুং প্রণতোঽস্ম্যহম্ ॥ (বিবেকচূড়ামণি:১) "সর্ববেদান্ত সিদ্ধান্তে যাঁর কথা বলা হয়েছে, যিনি বাক্যমনের অতীত পরমানন্দস্বরূপ সদ্ গুরু; সেই গোবিন্দকে আমি প্রণাম করি।" শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের চতুর্থ স্কন্ধে জগৎস্রষ্টা ব্রহ্মাকেও জগদগুরু নামে অবিহিত করা হয়েছে: ব্রহ্মা জগদ্গুরুর্দেবৈঃ সহাসৃত্য সুরেশ্বরৈঃ। বৈন্যস্য দক্ষিণে হস্তে দৃষ্ট্বা চিহ্নং গদাভৃতঃ৷৷  পাদয়োররবিন্দঞ্চ তং বৈ মেনে হরেঃ কলাম্।  যস্যা প্রতিহতং চক্রমংশঃ স পরমেষ্ঠিনঃ৷৷ (শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ:৪.১৫.৯-১০) "জগদগুরু ব্রহ্মা তখন দেবগণ ও দেবাধিপতিগণকে সঙ্গে নিয়ে আগমনপূর্বক পৃথুর দক্ষিণ হস্তে শ্রীহরির চক্রাকৃতি সুদর্শন চিহ্ন ও চরণদ্বয়ে পদ্মতুল্য রেখা দেখে সেই যুগলমূর্তি ভগবানেরই প্রত্যক্ষস্বরূপ বলে বুঝলেন। যাঁর হস্তের রেখায় অবিচ্ছিন্ন চক্রচিহ্ন থাকে, সে অবশ্যই ভগবানের অংশে জাত।" তন্ত্রশাস্ত্রেও পরমেশ্বর শিবকে জগদগুরু বলে অবিহিত করা হয়েছে। এর দৃষ্টান্ত বিবিধ তন্ত্রে পাওয়া যায়। এর মধ্যে কালীতন্ত্র অন্যতম। কৈলাসশিখরাসীনং দেবদেবং জগদ্গুরুম্ ।  উবাচ পার্বতী দেবী ভৈরবং পরমেশ্বরম্ ॥  (কালীতন্ত্র:১.১) "কৈলাস শিখরে উপবিষ্ট দেবদেব, জগদ্গুরু, পরমেশ্বর, ভৈরবকে পাৰ্বতী বললেন।" লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছেন, "ঈশ্বরই একমাত্র সদগুরু, আমার চরণ ধরিস না; আচরণ ধর"। বহুল প্রচলিত বাণীটিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, লোকনাথ ব্রহ্মচারী সদগুরুরূপ ঈশ্বরকেই সদা অনুসরণ করতে বলেছেন। সদগুরু ঈশ্বরের পথে সর্বদা চলা তাঁর আচরণ ধরতে বলেছেন।কিন্তু ইদানিং বিভিন্ন গুরুদের নামের সাথে জগদগুরু শব্দটি দেখা যায়। যা ঠিক নয়। যেহেতু শাস্ত্রে ভগবানকে জগদগুরু বলে অবিহিত করা হয়েছে, তাই অন্যের ক্ষেত্রে শব্দটি প্রয়োগ করা সমীচীন নয়। শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ। ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : Facebook ফেসবুক পেজ লিঙ্ক :  Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook
শাস্ত্রে গুরু নিয়ে যেমন অনেক কথা বলা হয়েছে, তেমনি গুরু নিয়ে শাস্ত্রে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। যিনি এ জগত সৃষ্টি করেছেন, তিনিই গুরু।আমাদের বিভিন্ন শাস্ত্রে পরমেশ্বরকে গুরুরূপে অভিহিত করার পরেও, আমরা অনেকে গুরু নিয়ে সন্দিগ্ধ হয়ে যাই। অর্থাৎ মনুষ্য গুরু নিয়ে আমরা এত বেশি সন্দিগ্ধ হয়ে যাই যে, পরমেশ্বরকে আর গুরু বলে অনুভব করতে পারি না। এ প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর 'কথামৃত' গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন:

"মানুষের কী সাধ্য অপরকে সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত করে। যাঁর এই ভুবনমোহিনী মায়া, তিনিই সেই মায়া থেকে মুক্ত করতে পারেন। সচ্চিদানন্দগুরু বই আর গতি নাই। যারা ঈশ্বর লাভ করে নাই, যারা তাঁর আদেশ পায় নাই, যারা ঈশ্বরের শক্তিতে শক্তিমান হয় নাই, তাদের কী সাধ্য জীবের ভববন্ধন মোচন করে।"
(শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত: ৪র্থ খণ্ড, ৫ম পরিচ্ছেদ)
গুরু এক সচ্চিদানন্দ। তিনিই শিক্ষা দিবেন।
...আদেশ না থাকলে 'আমি লােক শিক্ষা দিচ্ছি' এই অহংকার হয়। অহংকার হয় অজ্ঞানে । অজ্ঞানে বােধ হয়, আমি কর্তা। ঈশ্বর কর্তা, ঈশ্বরই সব করছেন, আমি কিছু করছি না, এ বােধ হলে তাে সে জীবন্মুক্ত। 'আমি কর্তা’, 'আমি কর্তা' এই বােধ থেকেই যত দুঃখ, অশান্তি।"
(শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত: ২য় খণ্ড, ৮ম পরিচ্ছেদ)
মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্রের সমাধিপাদে জগতের সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বরকেই গুরু বলে অবিহিত করে বলা হয়েছে, তিনিই সর্বজ্ঞবীজ; তিনিই কালের দ্বারা অবিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব পূর্ববর্তী অনাদিকাল থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গুরু। প্রণবকে অবলম্বন করে তাঁকে জানা যায়।
তত্র নিরতিশয়ং সর্বজ্ঞবীজম্।
স পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেন অনবচ্ছেদাৎ।
তস্য বাচকঃ প্রণবঃ।
(যোগসূত্র : ১.২৫-২৭)
"ঈশ্বরই নিরতিশয়ত্ব প্রাপ্ত সর্বজ্ঞবীজ।তিনি কালের দ্বারা অবিচ্ছিন্ন পূর্ব পূর্ববর্তী অনাদিকাল থেকেই গুরু। প্রণব বা ওঁকারই তাঁর বাচক।"
যোগদর্শনের মত বেদাদি শাস্ত্রের বহুস্থানেই ভগবানকে গুরু বা জগদগুরু বলা হয়েছে, কারণ সকল জ্ঞানের উৎস তিনি। জীবকে সৃষ্টি করেছেন তিনি, সকল জ্ঞানের উৎসও তিনি, তাই তাকে জগদগুরু বলা হয়।মহাভারতের আদিপর্বে বলা হয়েছে:
মঙ্গল্যং মঙ্গলং বিষ্ণুং বরেণ্যমনঘং শুচিম্ ।
নমস্কৃত্য হৃষীকেশং চরাচরগুরুং হরিম্ ॥
(মহাভারত: আদিপর্ব, ১.২৪)
"যিনি মঙ্গলজনক ও মঙ্গলময় বিষ্ণু, ভোগ ও মুক্তিপ্রার্থীদের আদরণীয়, নিষ্পাপ, পবিত্র, মায়ার নিয়ন্তা ও জগতের গুরু; সেই নারায়ণকে নমস্কার।"
মহাভারতের শান্তিপর্বে মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, সর্বদাই পুরুষোত্তম ভাগবান নারায়ণের পূজা করতে। কারণ, তিনি সমগ্র জগতের মাতা, পিতা এবং গুরু।
ত্বয়াপি সততং রজন্নভ্যর্চ্চঃ পুরুষোত্তমঃ ।
সহি মাতা পিতা চৈব কৃৎস্নন্য জগতো গুরুঃ ॥
(মহাভারত:শান্তিপর্ব, ৩২৫.১২৬)
" হে রাজা যুধিষ্ঠির! তুমিও সর্বদাই পুরুষোত্তম নারায়ণের পূজা করবে। কারণ, তিনি সমগ্র জগদ্বাসীর মাতা, পিতা ও গুরু।"
শ্রীমদ্ভাগবত সহ বিভিন্ন পুরাণ এবং দর্শনে ভগবানকে বারবার গুরু বা জগদগুরু বলে অবিহিত হতে দেখা যায়। শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধে কুন্তীদেবী ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
বিপদঃ সন্তু নঃ শশ্বত্তত্র তত্র জগদ্গুরো।
ভবতো দর্শনং যৎ স্যাদপুনর্ভবদর্শনম্৷৷
(শ্রীমদ্ভাগবত:১.৮.২৫)
"হে জগদ্‌গুরু ! আমাদের জীবনে পদে পদে বিপদ আসুক ; কারণ বিপদের মধ্যেই নিশ্চিতভাবে আপনার দর্শনলাভ হয় এবং আপনার দর্শনলাভ হলে আর জন্মমৃত্যুর চক্রে পড়তে হয় না৷"
শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের ভক্ত প্রহ্লাদ কর্তৃক নৃসিংহদেবের স্তোত্রেও ভগবানকে অখিল জগতের গুরু বা জগদ্‌গুরু বলে অবিহিত করা হয়েছে:
কো ন্বত্র তেহখিলগুরো ভগবন্ প্রয়াস
উত্তারণেঽস্য ভবসম্ভবলোপহেতোঃ।
মূঢ়েষু বৈ মহদনুগ্রহঃ আর্তবন্ধো
কিং তেন তে প্রিয়জনাননুসেবতাং নঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ:৭.৯.৪২)
"হে জগদ্‌গুরু, আপনি সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের কর্তা, এ সংসার নদী থেকে জীবকে পার করার আপনি কী উপায় ভেবেছেন ? হে দীননাথ ! সাংসারিক বুদ্ধিহীন সরল ব্যক্তিই মহান পুরুষের বিশেষ অনুগ্রহভাজন হয়। কিন্তু আমি তা নই। আমার তার প্রয়োজনও নেই কারণ আমি আপনার প্রিয়জনের সেবাদাস, তাই সংসার সাগর পার হওয়ার কোনো ভাবনাই আমার নেই।"
জগদগুরু শব্দটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নামের পূর্বে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের মত শ্রীমদ্ভগবদগীতার মঙ্গলাচরণ ধ্যানেও বলা হয়েছে। সেখানে জগদগুরুরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা করা হয়েছে
সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ।
পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ ৷৷
বসুদেবসুতং দেবং কংসচাণূরমর্দনম্।
দেবকীপরমানন্দং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্ ৷৷
(গীতাধ্যান:৪-৫)
"উপনিষদসমূহ গাভী, গোপালনন্দন শ্রীকৃষ্ণ সেই গাভীর দোহনকর্তা, অর্জুন গো-বৎস, এই মহৎ গীতামৃতস্বরূপ বাণী সেই গাভীর দুগ্ধ এবং শুদ্ধ-বুদ্ধিসম্পন্ন সুধীজন তার ভোক্তা।
কংস ও চাণূর নামক দ্বৈত্যদ্বয়-বিনাশী, জননী দেবকীর পরমানন্দদায়ক, বসুদেবপুত্র জগদ্গুরু ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আমি বন্দনা করি।"
শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর রচিত কৃষ্ণাষ্টক নামক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে সমর্পিত স্তোত্রটি শুরুই করেছেন বেদের একমাত্র প্রতিপাদ্য, বুদ্ধির সাক্ষীরূপ সর্বান্তর্যামী, অসুর বিনাশক চরাচর সকলের গুরুরূপ পরমেশ্বরকে স্মরণ করেছেন।
শ্রিয়াশ্লিষ্টো বিষ্ণুঃ স্থিরচরগুরুর্বেদবিষয়ো
ধিয়াং সাক্ষী শুদ্ধো হরিরসুরহন্তাব্জনয়নঃ ।
গদী শঙ্খী চক্রী বিমলবনমালী স্থিররুচিঃ
শরণ্যো লোকেশো মম ভবতু কৃষ্ণোঽক্ষিবিষয়ঃ॥
"শক্তি স্বরূপা শ্রীকে আলিঙ্গিত করে অভেদমূর্তিতে আছেন যে বিষ্ণু, যিনি চরাচর সকলের গুরু, বেদের যিনিই একমাত্র প্রতিপাদ্য বিষয়, যিনি বুদ্ধির সাক্ষীরূপ সর্বান্তর্যামী, যিনি অসুর বিনাশক, পদ্মকমলের ন্যার রক্তিম যাঁর নয়ন। যিনি শঙ্খ,চক্র ও গদা ও বিমল বনমালা ধারণকারী। যাঁর দেহের উজ্জল দীপ্তি সর্বদা বিরাজমান।যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র শরণ্য ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণচন্দ্র দয়া করে আমার নয়নগোচর হোন।"
শ্রীশঙ্করাচার্যের রচিত অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের একটি প্রকরণগ্রন্থ হল 'বিবেকচূড়ামণি'। এ গ্রন্থের মঙ্গলাচরণ শ্লোকেই তিনি, বাক্যমনের অতীত পরমানন্দস্বরূপ গোবিন্দকে সদ্গুরুরূপে প্রণাম করেছেন। যে পরমেশ্বর গোবিন্দকে সর্ববেদান্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জানা যায়। এই মঙ্গলাচরণ শ্লোকে শ্রীশঙ্করাচার্য দ্ব্যর্থবোধক শব্দে বাক্যমনের অতীত পরমেশ্বর গোবিন্দ এবং এবং তাঁর নিজগুরু শ্রীগোবিন্দপাদকে প্রণাম করেছেন।
সর্ববেদান্তসিদ্ধান্তগোচরং তমগোচরম্ ।
গোবিন্দং পরমানন্দং সদ্গুরুং প্রণতোঽস্ম্যহম্ ॥
(বিবেকচূড়ামণি:১)
"সর্ববেদান্ত সিদ্ধান্তে যাঁর কথা বলা হয়েছে, যিনি বাক্যমনের অতীত পরমানন্দস্বরূপ সদ্ গুরু; সেই গোবিন্দকে আমি প্রণাম করি।"
শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের চতুর্থ স্কন্ধে জগৎস্রষ্টা ব্রহ্মাকেও জগদগুরু নামে অবিহিত করা হয়েছে:
ব্রহ্মা জগদ্গুরুর্দেবৈঃ সহাসৃত্য সুরেশ্বরৈঃ।
বৈন্যস্য দক্ষিণে হস্তে দৃষ্ট্বা চিহ্নং গদাভৃতঃ৷৷
পাদয়োররবিন্দঞ্চ তং বৈ মেনে হরেঃ কলাম্।
যস্যা প্রতিহতং চক্রমংশঃ স পরমেষ্ঠিনঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ:৪.১৫.৯-১০)
"জগদগুরু ব্রহ্মা তখন দেবগণ ও দেবাধিপতিগণকে সঙ্গে নিয়ে আগমনপূর্বক পৃথুর দক্ষিণ হস্তে শ্রীহরির চক্রাকৃতি সুদর্শন চিহ্ন ও চরণদ্বয়ে পদ্মতুল্য রেখা দেখে সেই যুগলমূর্তি ভগবানেরই প্রত্যক্ষস্বরূপ বলে বুঝলেন। যাঁর হস্তের রেখায় অবিচ্ছিন্ন চক্রচিহ্ন থাকে, সে অবশ্যই ভগবানের অংশে জাত।"
তন্ত্রশাস্ত্রেও পরমেশ্বর শিবকে জগদগুরু বলে অবিহিত করা হয়েছে। এর দৃষ্টান্ত বিবিধ তন্ত্রে পাওয়া যায়। এর মধ্যে কালীতন্ত্র অন্যতম।
কৈলাসশিখরাসীনং দেবদেবং জগদ্গুরুম্ ।
উবাচ পার্বতী দেবী ভৈরবং পরমেশ্বরম্ ॥
(কালীতন্ত্র:১.১)
"কৈলাস শিখরে উপবিষ্ট দেবদেব, জগদ্গুরু, পরমেশ্বর, ভৈরবকে পাৰ্বতী বললেন।"
লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছেন, "ঈশ্বরই একমাত্র সদগুরু, আমার চরণ ধরিস না; আচরণ ধর"। বহুল প্রচলিত বাণীটিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, লোকনাথ ব্রহ্মচারী সদগুরুরূপ ঈশ্বরকেই সদা অনুসরণ করতে বলেছেন। সদগুরু ঈশ্বরের পথে সর্বদা চলা তাঁর আচরণ ধরতে বলেছেন।কিন্তু ইদানিং বিভিন্ন গুরুদের নামের সাথে জগদগুরু শব্দটি দেখা যায়। যা ঠিক নয়। যেহেতু শাস্ত্রে ভগবানকে জগদগুরু বলে অবিহিত করা হয়েছে, তাই অন্যের ক্ষেত্রে শব্দটি প্রয়োগ করা সমীচীন নয়।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : Facebook ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁