বর্তমানে অনেকের মধ্যে এমন ভাব প্রকাশ করতে দেখা যায় যে তারা ব্রহ্মকে জেনে ফেলেছেন। তিনি কেমন এবং কোথায় থাকেন? এদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি মনে করে ব্রহ্ম সাকার এবং পক্ষান্তরে অন্য কিছু ব্যক্তি মনে করে তিনি নিরাকার। কিন্তু তারা জানে না যে, ব্রহ্ম বা পরমাত্মা সাকার নিরাকার কোনটিই নন তিনি চিন্তার অতীত একটি সত্ত্বা। তাই কেন উপনিষদে বলা হয়েছে, কেউ যদি মনে করেন যে, তিনি ব্রহ্মকে ভালমতো জানতে পেরেছেন, তবে একথা নিশ্চিত যে, তিনি ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না। জানেননা বলেই তিনি তার ক্ষুদ্র চিন্তায় সীমাবদ্ধ করতে চাচ্ছেন।
যদি মন্যসে সুবেদেতি দভ্রমেবাপি
নূনং ত্বং বেথ ব্ৰহ্মণো রূপম্ ।
যদস্য ত্বং যদস্য দেবেষ্বথ নু
মীমাংস্যমেব তে মন্যে বিদিতম্ ৷৷
(কেন উপনিষদ: ২.১)
"যদি কেউ মনে করেন যে, আমি ব্রহ্মকে ভালমতো জেনে ফেলেছি, তবে একথা নিশ্চিত যে, তিনি ব্রহ্মের স্বরূপ সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানেন না। তিনি জীবাত্মা, দেবতাদের ও দৃশ্যমান জগতে ব্রহ্মের প্রকাশকেই কেবল জেনেছেন৷ সুতরাং ব্রহ্ম সম্বন্ধে আরও গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন। (শিষ্য): আমার মনে হয়, আমি (ব্রহ্মকে) জানি ।"
পরমেশ্বরকে ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। এরপরেও আমরা তাঁকে যথাসম্ভব ভাষায় বর্ণনা করার প্রচেষ্টা করি। কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ নিস্ফল। তিনি সর্বব্যাপী হয়ে সকল জীবের মাঝেই বিরাজ করেন। তিনি অনন্ত জ্যোতির্ময়, কোটি কোটি চন্দ্র সূর্য তাঁর জ্যোতিকে ম্লান করতে পারে না। বরং চন্দ্র সূর্য তার শক্তিতেই জ্যোতির্ময়। তিনি নিরবয়ব, অর্থাৎ তার কোন প্রাকৃত মূর্তি নেই। তিনি অচিন্ত্য হলেও সাধকের মনজগতের কল্পনাতে অরূপ থেকে জ্যোতির্ময় স্বরূপে ধরা দেন। তিনি নিষ্কলুষ অক্ষত। তিনি অচ্যুত, তিনি দোষরহিত শুদ্ধ নির্মল। তিনি সর্বজ্ঞ হয়ে জীবের মনের নিয়ন্তা।তিনি সকলের শ্রেষ্ঠ সর্বোত্তম।তিনি স্বয়ম্ভূ এবং চিরন্তন। তিনিই জীবের কর্মফল প্রদান করেন।
স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণ-
মম্নাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্ ।
কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূ-
যার্থাতথ্যতোঽর্থান্ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ ॥
(ঈশ উপনিষদ:৮)
"পরমেশ্বর সর্বব্যাপী, জ্যোতির্ময়, রূপহীন (চিন্তার অতীত তাঁর রূপ), অক্ষত, স্নায়ুহীন ( সুনির্দিষ্ট দেহ নেই, বিশ্বই তাঁর রূপের প্রকাশ), শুদ্ধ, দোষরহিত, সর্বজ্ঞ, নিজ মনের নিয়ন্তা, সর্বোত্তম, স্বয়ম্ভূ (নিজের ইচ্ছাতেই নিজেকে প্রকাশ করেন)। তিনি শ্বাশতকাল থেকেই কর্মফল এবং উপাসনা অনুসারে প্রত্যেকটি জীবের যথাকর্তব্য বিধান করেন।"
ঈশ উপনিষদে যে ব্রহ্মের বৈশিষ্ট্য হিসেবে "অকায়মব্রণমম্নাবিরং" বলা হয়েছে। এ বিষয়টিতে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ঈশ্বর দৃশ্যমান বা মূর্তিমান হতে পারেন না। কিন্তু বিষয়টি তা নয়। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ব্রহ্মের হাত না থাকলেও, তিনি সবকিছুই ধারণ করেন। তাঁর পা না থাকলেও, তিনি সর্বত্র যেতে পারেন। তাঁর চোখ নেই, তবু তিনি জগতের সকল কিছুই দেখতে পান। তাঁর কান নেই, তবু তিনি সব শুনতে পান। যা কিছু জানবার, তা তিনি জানেন যদিও তাঁকে কেউ জানে না।
অপাণিপাদো জবনো গ্রহীতা
পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্ণঃ।
স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা
তমাহুরগ্রং পুরুষং মহান্তম্ ॥
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ:৩.১৯)
"তাঁর হাত নেই, তবু তিনি সবকিছু ধারণ করেন; তাঁর পা নেই, তবু তিনি দূরে যেতে পারেন। তাঁর চোখ নেই, তবু তিনি সব দেখতে পান। তাঁর কান নেই, তবু তিনি সব শুনতে পান। যা কিছু জানবার, তা তিনি জানেন যদিও তাঁকে কেউ জানে না। যাঁরা পরমাত্মাকে জানেন, তাঁরা বলেন—তিনিই সকলের অগ্রণী এবং তিনি সর্বব্যাপী।"
অচিন্ত্য সর্বজ্ঞ পরমেশ্বর সকলকে জানলেও তাঁকে কেউ সম্যকরূপে জানে না। সেই অচিন্ত্যকে জানতেই কেউ হয়ত নিরাকার ওঙ্কাররূপে উপাসনা করে; আবার কেউ বিভিন্ন প্রতিমায় তাঁকে উপাসনা করেন। কারণ, তিনি সকলের অগ্রণী এবং তিনি সর্বব্যাপী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়:
"নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে॥
বাসনার বশে মন অবিরত ধায় দশ দিশে পাগলের মতো,
স্থির-আঁখি তুমি মরমে সতত জাগিছ শয়নে স্বপনে॥"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।