গুরুপূর্ণিমা দিনটি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা ভারতবর্ষীয় শিক্ষক দিবস। এ দিনে সকলেরই আদিগুরু,আদি শিক্ষক শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের জন্ম হয়েছে। তাই এ দিনে শিক্ষকদের সম্মান জানানো এক প্রাচীন রীতি। আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক,
ড.নারায়ণচন্দ্র বিশ্বাস বিদ্যালঙ্কার, যাঁর থেকে জীবনে চলার অথবা একাডেমিক বিষয়ে অনেক কিছুই শিখেছি এবং আজও শিখছি।
বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের অর্থ হল, বিদ্যালয়ের মধ্যে যেখানে বিশ্ব থাকে, একটা প্রচণ্ড বৈশ্বিক মনন থাকতে হয়; যা মানুষকে মনুষ্যত্বে উন্নীত করে, মানবিক করে। স্যার এবং তাঁর চিন্তাধারা ছিল এমনি। জীবনে চিন্তার বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সহ অংসখ্য মানবিক বোধ তৈরি হয়েছে স্যারের অনুপ্রেরণায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কথা মনে হলে সবার প্রথমে আমার আত্মপ্রচারবিমুখ নারায়ণ স্যারের কথাই মনে হয়। স্যারের অনন্য পাণ্ডিত্যের জন্যে ভারত থেকে তাঁকে বিদ্যালঙ্কার উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ভাবতে অবাক লাগে, সংস্কৃতের সাহিত্য, ব্যকরণ, দর্শন সহ মোটামুটি সকল বিষয়ে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী পণ্ডিত হয়েও তাঁকে অধিকাংশ মানুষই চেনে না। নারায়ণ স্যার বসতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের পিছনে লেকচার থিয়েটারের তিনতলায়। ক্লাসের বাইরে জ্ঞানপিপাসু ছাত্রছাত্রীরা ভিড় করতেন স্যারের সেই বিখ্যাত রুমে। সারা রুম ভর্তি টাল দেয়া শুধুই বই আর বই। অসংখ্য বইয়ের মাঝে স্যারের বসার শুধু একটি সাধারণ চেয়ার। পাশেই একটি পুরনো মডেলের কম্পিউটার। স্যার যে চেয়ারে বসতেন, সেই চেয়ারের কিছুটা উপরে একটি সাদা বোর্ড ছিল। সেই সাদা বোর্ডে সিগনেচার পেন দিয়ে বাংলা এবং সংস্কৃতে দুটি লেখা ছিল। একটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার 'সেঁজুতি' কাব্যগ্রন্থের 'পরিচয়' কবিতার চরণ
"মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,
আমি তোমাদেরই লোক
আর কিছু নয়,
এই হোক শেষ পরিচয়।"
এবং সাথে বৃহস্পতি আগম শাস্ত্রের সেই বিখ্যাত উক্তি,
যুক্তিহীন বিচার ধর্মের হানি ঘটায়।
যুক্তিহীনবিচারে তু ধর্মহানিঃ প্রজায়তে।
এ রবীন্দ্রনাথের কবিতার চরণটি এবং বৃহস্পতি আগম শাস্ত্রের কথাগুলো স্যারের জীবনের সাথে মিশে গিয়েছিল। তাই আজও এতবছর পরেও স্যারের কথা বিভিন্ন প্রসঙ্গে মনে পড়ে। স্যারের দার্শনিক চিন্তার সাথে আমি শতভাগ ঐকমত্য ছিলাম না। এরপরেও স্যার আমাদের মত অনেক ছাত্রছাত্রীদের ভাবনার মুক্তি ঘটিয়েছিলেন। শাস্ত্রে চিন্তা বা দর্শনের ক্ষেত্রে এমন একপেশে বিষয়গুলো নিষিদ্ধ। নারায়ণ স্যার শিখাতেন অন্ধভাবে কোন মতপথকে গ্রহণ না করতে। যথাসাধ্য চিন্তার মুক্তি ঘটাতে। মানুষ বিভিন্ন, তাই মানুষের মাঝে মতের বিভিন্নতা থাকবেই। এরপরেও সকল মতকে সম্মান করে নিজের সিদ্ধান্ত প্রতিস্থাপন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি মহাভারতের বনপর্বের উদ্ধৃতি দিতেন:
বেদা বিভিন্নাঃ স্মৃতয়ো বিভিন্না
নাসৌ মুনির্যস্য মতং ন ভিন্নম্।
ধর্ম্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং
মহাজনাে যেন গতঃ সঃ পন্থাঃ।
(মহাভারত: বনপর্ব, ২৬৭.৮৪ )
"বেদ বিভিন্ন, স্মৃতি বিভিন্ন। এমন কোন মুনি নেই, যাঁর মতের ভিন্নতা নেই বা স্বতন্ত্রতা নেই। ধর্মের তত্ত্ব নিগূঢ়তম অজ্ঞেয়স্থানে রক্ষিত; সুতরাং মহাজন ব্যক্তিরা যে পথে গিয়েছেন, তাই একমাত্র পথ।"
দেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারায়ণ স্যারদের মত কিছু শিক্ষকদের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি টিকে আছে, তা না হলে প্রতিষ্ঠানগুলি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যেত। স্যারকে প্রণাম, শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা!
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।