-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

মানুষ স্বেচ্ছায় স্বনির্মিত, আশাপাশের শৃঙ্খলে বদ্ধ ।

মানুষ স্বেচ্ছায় স্বনির্মিত,   আশাপাশের শৃঙ্খলে বদ্ধ  মানুষ এবং মানবসভ্যতা জ্ঞানত অথবা অজ্ঞানত বিভিন্ন শৃঙখলে আবব্ধ। এ শৃঙ্খলের কিছু থাকে দৃশ্যমান, অধিকাংশই থাকে অদৃশ্য হয়ে মানুষের অভ্যন্তরে। এ অনন্ত শৃঙখল এবং বন্ধনের মধ্যে কিছু শৃঙ্খল মানুষের স্বনির্মিত। মানুষ নিজেই স্বেচ্ছায় নিজেকে বন্দী করে রাখে মোহান্ধ হয়ে। ঋগ্বেদে সেই সহস্র শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্যে অগ্নিরূপ পরমেশ্বরের কাছে বারেবারেই প্রার্থনা করা হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রে। শুনশ্চিচ্ছেপং নিদিতং সহস্রাদ্যু- পাদমুঞ্চো অশমিষ্ট হি যঃ। এবাম্মদগ্নে বি মুমুগ্ধি পাশান্  হােতশ্চিকিত্ব ইহ তূ নিষদ্য।।  (ঋগ্বেদ সংহিতা:৫.২.৭) "হে অগ্নি! তুমি সম্পূর্ণরূপে বদ্ধ শুনঃশেপ ঋষিকে সহস্র যুপ হতে মুক্ত করেছ, কারণ তিনি স্তব করেছিলেন। হে হােতা বিদ্বান অগ্নি ! তুমি এ বেদিতে উপবেশন করে, আমাদের সকল পাশবন্ধন থেকে মুক্ত কর।" এ বিবিধ পাশের মধ্যে আশাপাশ বড় ভয়ংকর। এ আশাপাশ মানুষকে অত্যন্ত ভোগের জগতে নিয়ে বিধ্বস্ত করে দেয়। মানুষের স্বভাব সে শুধুই চায়। সে কোন ঘরের বাইরে থাকলে ঘরে প্রবেশ করতে চায়। একবার প্রবেশ করলে, সে ঘরের ভেতরের কক্ষে যেতে চায়। ভেতরের কক্ষে দাঁড়িয়ে থাকলে সে বসতে চায়। বসতে দিলে সে শুতে চায়। শুতে দিলে সে ঘুমাতে চায়। ঘুমাতে সুযোগ দিলে সে খেতে চায়। খেতে দিলে সে ঘরে মনমত বাস করতে চায়। মনমত বাস করার সুযোগ দিলে সে, সর্বদাই থাকতে। সর্বদা থাকার সুযোগ দিলে সে ঘরটিকেই নিজের করে নিতে চায়। ঘরটিতে তাকে যদি নিজের করে নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়, তবে সে গৃহস্বামীকেই বিতারিত করে গৃহটি সম্পূর্ণভাবে করায়ত্ব করতে চায়। এটাই কলিযুগের অধিকাংশ মানুষের স্বভাব। আসুরি প্রকৃতির ভোগী মানুষেরা মৃত্যুকাল পর্যন্ত বিষয় ভোগের চিন্তায় রত থাকে। কি করে তার সুখের তৃষ্ণা শেষ হয় না। বিষয়ভোগও শেষ হয় না। ভোগকেই সকল সুখ মনে করে তারা অসংখ্য আশাপাশে জড়িয়ে যায়। যেই আশপাশের কামনার জাল থেকে এরা আর চাইলেও উত্তরণ ঘটাতে পারে না। এই আশাপাশে আবদ্ধ থেকে কামনা চরিতার্থ করার জন্য সৎ-অসৎ সকল প্রক্রিয়ায় অবলম্বন করে। কাম ও ক্রোধের বশিভূত হয়ে বিষয়ভোগের জন্য, অন্যায়ভাবে বিবেক বর্জন করে হলেও অর্থ সংগ্রহ করে নিজের ভোগকে চরিতার্থ করে। এই দুষ্কর্মের জন্য অন্যের ক্ষতি হলেও, এতে তাদের বিবেকের সামান্যতম দংশন হয় না। চিন্তামপরিমেয়াঞ্চ প্রলয়ান্তামুপাশ্রিতাঃ। কামোপভোগপরমা এতাবদিতি নিশ্চিতাঃ৷৷ আশাপাশশতৈর্বদ্ধাঃ কামক্রোধপরায়ণাঃ ৷ ঈহন্তে কামভোগার্থমন্যায়েনার্থসঞ্চয়ান্৷৷ (শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১৬.১১-১২) "আসুরি প্রকৃতির ভোগী মানুষেরা মৃত্যুকাল পর্যন্ত বিষয় ভোগের অসংখ্য চিন্তা এবং বিষয়ভোগে রত থাকে। তারা এই ভোগকেই সকল সুখ মনে করে।  তারা অসংখ্য আশাপাশে অর্থাৎ কামনার জালে আবদ্ধ থাকে। তারা কাম ও ক্রোধপরায়ণ হয়ে বিষয়ভোগের জন্য অন্যায়ভাবে অর্থ সংগ্রহে সর্বদা রত থাকে।" আশার প্রয়োজন আছে যদি তা ঈশ্বরকে লাভের আশা হয়, দৈব্যকর্মের আশা হয় অথবা লোককল্যাণের আশা হয়। কিন্তু আশা যদি হয় শুধুই নিজের ভোগের জন্য, তবে সেই আশাই আশাপাশে রূপান্তরিত হয়ে মানুষকে আবদ্ধ করে।আত্মভোগের আশা পূর্ণ না হলে, মানুষ হতাশ হয়ে যায়। সেই হতাশা থেকে পর্যায়ক্রমে দেহে ক্রোধ চলে আসে। বর্তমান নাগরিক জীবনের অধিকাংশ আশাই চাওয়া-পাওয়ার অলীক আশা। এ অলীক আশা অধিকাংশই জীবনে পুরোপুরি ফলপ্রসূ হয় না। তখনই চলে আসে জীবনে একরাশ হতাশা। মধ্যযুগের কবি রামপ্রসাদ সেনের এ প্রসঙ্গে একটি গান রয়েছে। একটি ভ্রমর সকাল থেকেই একটি পদ্মের উপরে বসে আছে, সে পদ্মের মধু পান করবে। কিন্তু সারাদিন বসে থেকেও সে মুখে একফোঁটা মধুও পায় না। ভ্রমরটি জানে না যে, পদ্মে সে মধুপানের আশায় বসে আছে, সেই পদ্মটি আসল পদ্ম নয়; চিত্রে আঁকা নকল পদ্ম। বোকা ভ্রমর জানে না যে চিত্রে আঁকা নকল পদ্মে কখনো মধু থাকে না। মধু থাকে আসল পদ্মে। এমনি করে মনুষ্য আসল পদ্ম পরমেশ্বরকে ভুলে নকল পদ্মরূপ এ জাগতিক আভ্যুদয়িক বিষয় নিয়ে দিবারাত্রি ভুলে আছে। তাই সে আশাপাশে আবদ্ধ হয়ে কষ্ট পাচ্ছে। কবি রামপ্রসাদ সেনের ভাষায় : "কেবল আসার আশা, ভবে আসা, আসা মাত্র হল । যেমন চিত্রের পদ্মেতে পড়ে, ভ্রমর ভুলে রল॥ মা নিম খাওয়ালে , চিনি বলে, কথায় করে ছল । ওমা ! মিঠার লোভে, তিত মুখে সারা দিনটা গেল ॥" দিন-রাত্রি, সন্ধ্যা-সকাল, শীত-বসন্ত কতবার আসে কতবার চলে যায়, সময়ের এই খেলা দেখতে দেখতে আয়ু শেষ হয়ে যায় কিন্তু তবুও এই বায়ুর মত অফুরন্ত আশা মানুষের আর ফুরায় না। মানুষ বৃদ্ধ হয়ে দেহের সকল অঙ্গ নরম হয়ে গেল। দেখে মনে হয় যেন, দেহ গলে গলে পড়ছে, মাথার সকল চুল পেঁকে সাদা হয়ে যাচ্ছে। সব চুল মাথা থেকে উঠে মাথায় একটি বৃহৎ টাক পরে যাচ্ছে।মুখ থেকে সকল দাঁত পড়ে গিয়ে মুখ বিবর চুপসে যাচ্ছে। শরীর ঠিকমত চলছে না, হাতে ধরে থাকা লাঠিটাও থর থর করে কাঁপছে। কিন্তু এরপরেও বড়ই বিচিত্র এই যে, মানুষ আশা নামক সদা অপূর্ণ ভাণ্ডটি ছাড়তে চায় না। যমরাজ না আশা পর্যন্ত এই আশাভাণ্ড আমৃত্যু আঁকড়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর জগদ্বিখ্যাত 'মোহমুদগর' গ্রন্থে বলেছেন: দিনযামিন্যৌ সায়ং প্রাতঃ  শিশিরবসন্তৌ পুনরায়াতঃ। কালঃ ক্রীড়তি গচ্ছত্যায়ুঃ  তদপি ন মুঞ্চত্যাশাবায়ুঃ॥ অঙ্গং গলিতং পলিতং মুণ্ডং দন্তবিহীনং জাতং তুণ্ডম্‌। করধৃতকম্পিতশোভিতদণ্ডং তদপি ন মুঞ্চত্যাশাভাণ্ডম্‌॥ (মোহমুদগর:৬-৭) "দিন, রাত্রি, সন্ধ্যা, প্রভাত, শিশির, বসন্ত -এ সমস্ত পুনঃ পুনঃ আসছে। কিন্তু কাল সমভাবেই ক্রীড়া করছে এগিয়ে চলছে, তার সাথে মনুষ্যের পরমায়ুও হ্রাস পাচ্ছে। অহো! তথাপি মনুষ্য আশাবায়ু পরিত্যাগ করে না। দেহ অত্যন্ত জরাগ্রস্ত , মাথা শুভ্র কেশজালে পূর্ণ ও মুখ দাঁতবিহীন, কম্পিত হাতে লাঠি; তথাপিও মনুষ্য তার আশাভাণ্ড পরিত্যাগ করে না।" মনুষ্য জীবনে পাক বা না পাক আশারূপ সোনার হরিণকে সে চায়। সে সোনার হরিণ চোখকে ধাঁধা লাগিয়ে, এই চোখের সামনে আসে আবার এই অদৃশ্য হয়ে যায়। অথচ সেই মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণকে পেতে মনুষ্যের প্রচেষ্টার কোন কমতি নেই। সে হরিণকে পাবে না জেনেও সেই আশারূপ মায়াবী হরিণের পিছনে দৌড়ে বেড়ায়। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত রসিকতা করে তাঁর 'রাজা' (১৯১০) নাটকের একটি সংগীতে বলেছেন: "তোরা  যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই। মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণ চাই॥ সে-যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা। সে-যে নাগাল পেলে পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁদা। আমি ছুটব পিছে মিছে মিছে পাই বা নাহি পাই- আামি আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই॥"  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজা নাটকটি একটি রূপক-সাংকেতিক নাটক। এ নাটকে আশা প্রসঙ্গে আরেকটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে। উক্তিটি কলিঙ্গকে উদ্দেশ্য করে কাঞ্চীর। উক্তিটি হল, "বারংবার আশাকে ত্যাগ করলেও সে প্রগল্‌ভা নারীর মতো ফিরে ফিরে আসে" ( রাজা :১৫)।মনুষ্য স্বেচ্ছায় স্বনির্মিত আশাপাশের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে আছে। তাই কেউ তাকে শৃঙ্খল ভেঙে উদ্ধার করতে পারবে না, তাকে নিজেকেই এই স্বনির্মিত শৃঙ্খল ভেঙে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। তা না হলে সে, আশাপাশের মায়াময় হরিণের পিছনে আমৃত্যু দৌড়াতে দৌড়াতে মুক্তির পথ থেকে সরে যেতে থাকবে। শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মানুষ এবং মানবসভ্যতা জ্ঞানত অথবা অজ্ঞানত বিভিন্ন শৃঙখলে আবব্ধ। এ শৃঙ্খলের কিছু থাকে দৃশ্যমান, অধিকাংশই থাকে অদৃশ্য হয়ে মানুষের অভ্যন্তরে। এ অনন্ত শৃঙখল এবং বন্ধনের মধ্যে কিছু শৃঙ্খল মানুষের স্বনির্মিত। মানুষ নিজেই স্বেচ্ছায় নিজেকে বন্দী করে রাখে মোহান্ধ হয়ে। ঋগ্বেদে সেই সহস্র শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্যে অগ্নিরূপ পরমেশ্বরের কাছে বারেবারেই প্রার্থনা করা হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রে।
শুনশ্চিচ্ছেপং নিদিতং সহস্রাদ্যু-
পাদমুঞ্চো অশমিষ্ট হি যঃ।
এবাম্মদগ্নে বি মুমুগ্ধি পাশান্
হােতশ্চিকিত্ব ইহ তূ নিষদ্য।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা:৫.২.৭)
"হে অগ্নি! তুমি সম্পূর্ণরূপে বদ্ধ শুনঃশেপ ঋষিকে সহস্র যুপ হতে মুক্ত করেছ, কারণ তিনি স্তব করেছিলেন। হে হােতা বিদ্বান অগ্নি ! তুমি এ বেদিতে উপবেশন করে, আমাদের সকল পাশবন্ধন থেকে মুক্ত কর।"
এ বিবিধ পাশের মধ্যে আশাপাশ বড় ভয়ংকর। এ আশাপাশ মানুষকে অত্যন্ত ভোগের জগতে নিয়ে বিধ্বস্ত করে দেয়। মানুষের স্বভাব সে শুধুই চায়। সে কোন ঘরের বাইরে থাকলে ঘরে প্রবেশ করতে চায়। একবার প্রবেশ করলে, সে ঘরের ভেতরের কক্ষে যেতে চায়। ভেতরের কক্ষে দাঁড়িয়ে থাকলে সে বসতে চায়। বসতে দিলে সে শুতে চায়। শুতে দিলে সে ঘুমাতে চায়। ঘুমাতে সুযোগ দিলে সে খেতে চায়। খেতে দিলে সে ঘরে মনমত বাস করতে চায়। মনমত বাস করার সুযোগ দিলে সে, সর্বদাই থাকতে। সর্বদা থাকার সুযোগ দিলে সে ঘরটিকেই নিজের করে নিতে চায়। ঘরটিতে তাকে যদি নিজের করে নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়, তবে সে গৃহস্বামীকেই বিতারিত করে গৃহটি সম্পূর্ণভাবে করায়ত্ব করতে চায়। এটাই কলিযুগের অধিকাংশ মানুষের স্বভাব। আসুরি প্রকৃতির ভোগী মানুষেরা মৃত্যুকাল পর্যন্ত বিষয় ভোগের চিন্তায় রত থাকে। কি করে তার সুখের তৃষ্ণা শেষ হয় না। বিষয়ভোগও শেষ হয় না। ভোগকেই সকল সুখ মনে করে তারা অসংখ্য আশাপাশে জড়িয়ে যায়। যেই আশপাশের কামনার জাল থেকে এরা আর চাইলেও উত্তরণ ঘটাতে পারে না। এই আশাপাশে আবদ্ধ থেকে কামনা চরিতার্থ করার জন্য সৎ-অসৎ সকল প্রক্রিয়ায় অবলম্বন করে। কাম ও ক্রোধের বশিভূত হয়ে বিষয়ভোগের জন্য, অন্যায়ভাবে বিবেক বর্জন করে হলেও অর্থ সংগ্রহ করে নিজের ভোগকে চরিতার্থ করে। এই দুষ্কর্মের জন্য অন্যের ক্ষতি হলেও, এতে তাদের বিবেকের সামান্যতম দংশন হয় না।
চিন্তামপরিমেয়াঞ্চ প্রলয়ান্তামুপাশ্রিতাঃ।
কামোপভোগপরমা এতাবদিতি নিশ্চিতাঃ৷৷
আশাপাশশতৈর্বদ্ধাঃ কামক্রোধপরায়ণাঃ ৷
ঈহন্তে কামভোগার্থমন্যায়েনার্থসঞ্চয়ান্৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১৬.১১-১২)
"আসুরি প্রকৃতির ভোগী মানুষেরা মৃত্যুকাল পর্যন্ত বিষয় ভোগের অসংখ্য চিন্তা এবং বিষয়ভোগে রত থাকে। তারা এই ভোগকেই সকল সুখ মনে করে।
তারা অসংখ্য আশাপাশে অর্থাৎ কামনার জালে আবদ্ধ থাকে। তারা কাম ও ক্রোধপরায়ণ হয়ে বিষয়ভোগের জন্য অন্যায়ভাবে অর্থ সংগ্রহে সর্বদা রত থাকে।"
আশার প্রয়োজন আছে যদি তা ঈশ্বরকে লাভের আশা হয়, দৈব্যকর্মের আশা হয় অথবা লোককল্যাণের আশা হয়। কিন্তু আশা যদি হয় শুধুই নিজের ভোগের জন্য, তবে সেই আশাই আশাপাশে রূপান্তরিত হয়ে মানুষকে আবদ্ধ করে।আত্মভোগের আশা পূর্ণ না হলে, মানুষ হতাশ হয়ে যায়। সেই হতাশা থেকে পর্যায়ক্রমে দেহে ক্রোধ চলে আসে। বর্তমান নাগরিক জীবনের অধিকাংশ আশাই চাওয়া-পাওয়ার অলীক আশা। এ অলীক আশা অধিকাংশই জীবনে পুরোপুরি ফলপ্রসূ হয় না। তখনই চলে আসে জীবনে একরাশ হতাশা। মধ্যযুগের কবি রামপ্রসাদ সেনের এ প্রসঙ্গে একটি গান রয়েছে। একটি ভ্রমর সকাল থেকেই একটি পদ্মের উপরে বসে আছে, সে পদ্মের মধু পান করবে। কিন্তু সারাদিন বসে থেকেও সে মুখে একফোঁটা মধুও পায় না। ভ্রমরটি জানে না যে, পদ্মে সে মধুপানের আশায় বসে আছে, সেই পদ্মটি আসল পদ্ম নয়; চিত্রে আঁকা নকল পদ্ম। বোকা ভ্রমর জানে না যে চিত্রে আঁকা নকল পদ্মে কখনো মধু থাকে না। মধু থাকে আসল পদ্মে। এমনি করে মনুষ্য আসল পদ্ম পরমেশ্বরকে ভুলে নকল পদ্মরূপ এ জাগতিক আভ্যুদয়িক বিষয় নিয়ে দিবারাত্রি ভুলে আছে। তাই সে আশাপাশে আবদ্ধ হয়ে কষ্ট পাচ্ছে। কবি রামপ্রসাদ সেনের ভাষায় :
"কেবল আসার আশা, ভবে আসা, আসা মাত্র হল ।
যেমন চিত্রের পদ্মেতে পড়ে, ভ্রমর ভুলে রল॥
মা নিম খাওয়ালে , চিনি বলে, কথায় করে ছল ।
ওমা ! মিঠার লোভে,
তিত মুখে সারা দিনটা গেল ॥"
দিন-রাত্রি, সন্ধ্যা-সকাল, শীত-বসন্ত কতবার আসে কতবার চলে যায়, সময়ের এই খেলা দেখতে দেখতে আয়ু শেষ হয়ে যায় কিন্তু তবুও এই বায়ুর মত অফুরন্ত আশা মানুষের আর ফুরায় না। মানুষ বৃদ্ধ হয়ে দেহের সকল অঙ্গ নরম হয়ে গেল। দেখে মনে হয় যেন, দেহ গলে গলে পড়ছে, মাথার সকল চুল পেঁকে সাদা হয়ে যাচ্ছে। সব চুল মাথা থেকে উঠে মাথায় একটি বৃহৎ টাক পরে যাচ্ছে।মুখ থেকে সকল দাঁত পড়ে গিয়ে মুখ বিবর চুপসে যাচ্ছে। শরীর ঠিকমত চলছে না, হাতে ধরে থাকা লাঠিটাও থর থর করে কাঁপছে। কিন্তু এরপরেও বড়ই বিচিত্র এই যে, মানুষ আশা নামক সদা অপূর্ণ ভাণ্ডটি ছাড়তে চায় না। যমরাজ না আশা পর্যন্ত এই আশাভাণ্ড আমৃত্যু আঁকড়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর জগদ্বিখ্যাত 'মোহমুদগর' গ্রন্থে বলেছেন:
দিনযামিন্যৌ সায়ং প্রাতঃ
শিশিরবসন্তৌ পুনরায়াতঃ।
কালঃ ক্রীড়তি গচ্ছত্যায়ুঃ
তদপি ন মুঞ্চত্যাশাবায়ুঃ॥
অঙ্গং গলিতং পলিতং মুণ্ডং
দন্তবিহীনং জাতং তুণ্ডম্‌।
করধৃতকম্পিতশোভিতদণ্ডং
তদপি ন মুঞ্চত্যাশাভাণ্ডম্‌॥
(মোহমুদগর:৬-৭)
"দিন, রাত্রি, সন্ধ্যা, প্রভাত, শিশির, বসন্ত -এ সমস্ত পুনঃ পুনঃ আসছে। কিন্তু কাল সমভাবেই ক্রীড়া করছে এগিয়ে চলছে, তার সাথে মনুষ্যের পরমায়ুও হ্রাস পাচ্ছে। অহো! তথাপি মনুষ্য আশাবায়ু পরিত্যাগ করে না।
দেহ অত্যন্ত জরাগ্রস্ত , মাথা শুভ্র কেশজালে পূর্ণ ও মুখ দাঁতবিহীন, কম্পিত হাতে লাঠি; তথাপিও মনুষ্য তার আশাভাণ্ড পরিত্যাগ করে না।"
মনুষ্য জীবনে পাক বা না পাক আশারূপ সোনার হরিণকে সে চায়। সে সোনার হরিণ চোখকে ধাঁধা লাগিয়ে, এই চোখের সামনে আসে আবার এই অদৃশ্য হয়ে যায়। অথচ সেই মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণকে পেতে মনুষ্যের প্রচেষ্টার কোন কমতি নেই। সে হরিণকে পাবে না জেনেও সেই আশারূপ মায়াবী হরিণের পিছনে দৌড়ে বেড়ায়। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত রসিকতা করে তাঁর 'রাজা' (১৯১০) নাটকের একটি সংগীতে বলেছেন:
"তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।
মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণ চাই॥
সে-যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা।
সে-যে নাগাল পেলে পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁদা।
আমি ছুটব পিছে মিছে মিছে পাই বা নাহি পাই-
আামি আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই॥"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজা নাটকটি একটি রূপক-সাংকেতিক নাটক। এ নাটকে আশা প্রসঙ্গে আরেকটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে। উক্তিটি কলিঙ্গকে উদ্দেশ্য করে কাঞ্চীর। উক্তিটি হল, "বারংবার আশাকে ত্যাগ করলেও সে প্রগল্‌ভা নারীর মতো ফিরে ফিরে আসে" ( রাজা :১৫)।মনুষ্য স্বেচ্ছায় স্বনির্মিত আশাপাশের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে আছে। তাই কেউ তাকে শৃঙ্খল ভেঙে উদ্ধার করতে পারবে না, তাকে নিজেকেই এই স্বনির্মিত শৃঙ্খল ভেঙে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। তা না হলে সে, আশাপাশের মায়াময় হরিণের পিছনে আমৃত্যু দৌড়াতে দৌড়াতে মুক্তির পথ থেকে সরে যেতে থাকবে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁