মানুষের পেশা মানুষের ব্যক্তিজীবনের উপরে ব্যপকভাবে প্রভাব সৃষ্টি করে। এই পেশাকে কেন্দ্র করে মানুষের যাপিত জীবনের ভাষা পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়ে যায়। বাঙালির একটি প্রবাদ রয়েছে, "ছাগল চড়াতে চড়াতে ছাগল হয়ে যায়"। ছাগলেরা কখনো ভেড়ার মত গড্ডলিকাপ্রবাহে একই সরল রেখায় পূর্ববর্তীকে অনুসরণ করে চলে না। তারা তিড়িংতিড়িং করে পথ থেকে এদিক ওদিক ছুটে বিপথে চলে যায়। সেই ছাগল চড়ানো ব্যক্তির কাছে যদি আমি রবীন্দ্র সুভাষণ আশা করি, তবে বুঝতে হবে আমি বোকার স্বর্গে বসবাস করছি। তাই জগতের সকলের সাথে একই ভাষায় যোগাযোগ করা যায় না। সুন্দর প্রমিত রাবিন্দ্রীক ভাষা সকলেই বুঝতে পারে না। যারা বুঝতে পারে না, তাদের জন্যে যে ভাষায় তারা বোঝে, সেই ভাষাতেই তাদের বোঝাতে হয়। এতেই তাদের কল্যাণ হয়।সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছে যারা গালি না দিয়ে কথা বলতে পারে না। তাদের হাজারবার নিষেধ করলেও, তারা গালি দিবে। তাদের যদি কেউ সুন্দর করে বোঝাতে যায়, তবেও তারা সহজাত স্বভাবে গালি দিয়ে কথার প্রতুত্তর করবে। কিন্তু এদের ক্ষেত্রে একটি মহৌষধী সমাধান রয়েছে। তা হল, এই সকল ব্যক্তিরা যে ভাষায় বা যে মাত্রায় অকারণে অপরকে গালি দেয়; তাদের গালির প্রতুত্তরে যদি তাদের মাত্রাকেও পিছে ফেলে দিয়ে সমান জবাব দেয়া যায়, তবেই এরা সুবোধ বালকের মত হয়ে যায়। তখন পোশা বিড়ালের মত মিউমিউ করে। পরবর্তীতে ভাবটা এমন করবে যেন, কিছুই হয়নি বা অশ্লীল গালি কি জিনিস তা সে জানেই না। যার স্বভাব গাধার মত, তাকে শত প্রচেষ্টা করেও ঘোড়া বানানো সম্ভব নয়। তেমনি হায়েনা হিংস্র হতে পারে, কিন্তু কখনো সিংহের গৌরব লাভ করতে পারে না।
বাঙালি সমাজে বিভিন্ন পেশার পেশাজীবী ব্যক্তিরা পরিবারের কিভাবে কথা বলে তার কয়েকটি কাল্পনিক দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। বাঙালি চলচ্চিত্র এবং নাটকের মত এখানেও সতর্কবাণী এই যে- সকল চরিত্র সকল ব্যক্তি কাল্পনিক। অর্থাৎ সব চরিত্র কাল্পনিক, এর সাথে বাস্তবতার কোন মিল থাকলেও মিল নেই বলে ধরে নিতে হবে। এরপরেও যদি অকারণে কারো জীবনের সাথে মিলে যায় তবে লেখক দায়ি নয়। এ পারিবারিক আলাপ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে সুকুমার রায়ের 'আবোলতাবোল' গ্রন্থের প্যাঁচা আর প্যাঁচানি' নামক একটি কবিতার কথা। কবিতায় প্যাঁচানির ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্ চ্যাঁচানি শুনে অন্যদের পিলে চমকে উঠলেও; প্যাঁচার হৃদয় আনমনা হয়ে নেচে ওঠে। জগতের সব কিছুই ভুলে প্যাঁচানির চাঁদমুখের মিষ্টি সংগীতে (প্যাঁচার দৃষ্টিতে) প্যাঁচার দুচোখে অশ্রু ঝরে।
"প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি,
খাসা তোর চ্যাঁচানি !
শুনে শুনে আন্মন
নাচে মোর প্রাণমন !
মাজা-গলা চাঁচা সুর
আহ্লাদে ভরপুর !
গলা চেরা গমকে
গাছ পালা চমকে,
সুরে সুরে কত প্যাঁচ
গিট্কিরি ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্ !
যত ভয় যত দুখ
দুরু দুরু ধুক্ ধুক্,
তোর গানে পেঁচি রে
সব ভুলে গেছি রে-
চাঁদ মুখে মিঠে গান
শুনে ঝরে দু'নয়ান।"
শিক্ষকের পরিবার : আমাকে বেশী জ্ঞান দিতে এসো না। আমি তোমার থেকে কম বুঝি না। তোমার জন্মের আগেই থেকেই আমি এ বিষয়টি জানি ইত্যাদি।
অভিনেতার পরিবার : আমার সাথে অতিরিক্ত অভিনয় করবে না। তুমি যে কি চাও আমি সব বুঝি।তুমি ভেতরে ভেতরে কি করার ধান্ধায় আছ এটা কি আমি বুঝিনা ভেবেছ? তোমার হল উপর দিয়ে ফিটফাট আর নিচ দিয়ে সদরঘাট।
তৈল ব্যবসায়ীর পরিবার: আমাকে কি তুমি চোখঢাকা কলুর বলদ পেয়েছ যে, তোমার কথামত খেয়ে না খেয়ে খালি ঘুরতেই থাকব? বাহ কি সুন্দর! তেল খাবে তুমি, আর আমাকে দিয়ে বলদের মত সারাক্ষণ ঘুরাবে, তাই না? সেই দিন শেষ। এখনো বলছি, সময় আছে তুমি তেলের হাড়ির মত একটু তেলতেলে হও। আমি তেলছাড়া নিরস মানুষদের একদম পছন্দ করি না, যাদের শরীরে একদম দয়ামায়া নেই।
পাইলটের পরিবার : দেখ, সুযোগ পেলেই বেশী উড়তে শুরু করো না। পরে আর ঠিকানায় ফিরতে পারবে না। উপর থেকে যখন প্লেনের মত বিধ্বস্ত হয়ে পড়বে, তখন বুঝবে মজা যে কত ধানে কত চাল।
ধোপার পরিবার : বেশি উল্টাপাল্টা কাজ করলে একদম ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ধুয়ে ভালো করে নিংড়ে রোদে শুকাতে দিয়ে দিব। তখন বুঝতে পারবে অবস্থা।
নাপিতের পরিবার: আমার সাথে কিন্তু বেশি লাগতে আসবে না, ঘ্যাচাং করে সব কেটে দিব; তখন বুঝতে পারবে মজা কাকে বলে? কি কেটে দিব কোথায় কেটে দিব তা জানার দরকার নেই; শুধু এতটুকু জেনে রাখ জায়গামত কেটে দিব। এখন দেখার দরকার নেই, সময় হলেই সব দেখতে পাবে।
দন্ত চিকিৎসকের পরিবার : এক থাপ্পড়ে তোমার সব দাঁত ফেলে দিব। শুধু দুইপাশের আক্কেল দাঁতদুটি রেখে দেব। তখন মাছ, মাংসও খেতে পারবে না। তবে চান্দু, বুঝবে আমার সাথে অশান্তির ফলাফল।
ব্যবসায়ীর পরিবার : আমাকে সস্তার মাল পেয়েছো? আমি এত সস্তা মাল না।আমার বাবা কেন এমন একটি বিছুটিপাতার মত মালের কাছে আমাকে গছিয়ে দিল। সবই আমার কপাল!
মাংস বিক্রেতার পরিবার: আমার কথা না শুনলে, কেটে টুকরো টুকরো করে কুকুরকে খাইয়ে দিব।কলিজায় বেশি জোর হয়ে গেছে, তাই না? ভালো কথায় তো তোমার কানে লাগে না। কলিজা ভেজে যখন মুড়মুড় করে খেয়ে ফেলব, তখন বুঝতে পারবে আমি কে এবং কত ভয়ানক!
জেলের পরিবার : নতুন জলের মাছের মতন বেশি লাফালাফি করবে না। কেঁটে হলুদ, লবণ মাখিয়ে রান্না করে যখন খেয়ে ফেলবো, তখন এই এই লাফালাফি, এই ছলাৎছলাৎ ভাব কোথায় চলে যাবে এর কোন ঠিক ঠিকানা নেই!
সাংবাদিকের পরিবার : তোমার খবর আছে আজ। বাশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু একাবারে হেডলাইন নিউজ করে দিব। তখন আর মুখ দেখাতে পারবে না।
রাজনীতিবিদের পরিবার: তুমি হঠাৎ আমার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে পারিবারিক ঘটনাকে জনতার মাঝে মাঠে-ময়দানে নিয়ে গিয়ে মাইক দিয়ে দিনরাত্রি প্রচার করে বেড়াচ্ছ। কে তোমার কানে এভাবে আমার প্রতি উস্কানিমূলক কথাবার্তা ছড়াচ্ছে? ও বুঝতে পেরেছি ওই পাশের বাড়ির সেই মোটকুটায়, তাই না? আমি সব বুঝি। সে হল মিনমিনে চালাকের ভুষি খাওয়ার যম। সে চায় আমার চেয়ারটি দখল করতে। আর তুমি কিনা ওর মিষ্টি কথায় সম্পূর্ণ ভুলে আমাকে ভুল বুঝছ, হায় হায় এই দুঃখ আমি রাখি কোথায়! তুমি কি ভুলে গিয়েছ, তোমাকে দেয়া নেকলেসের প্রতিশ্রুতি আমি আজ তিন-তিনটি বছর যাবৎ নবায়ন করছি। কিন্তু তোমার কথা চিন্তা করে প্রোজেক্ট বাতিল তো করিনি। তুমি একবারও বলতে পারবে যে বাতিল করেছি? না করিনি, আর করবোও না; তুমি আমার পারিবারিক নির্দিষ্ট ভোটার বলে কথা! আগামীতে বাজেট পেলে তোমার কাজটিই আগে ধরবো আশাকরি।
কাঠমিস্ত্রির পরিবার: ভালো কথা তো কানে যায় না, তাই না? পিটিয়ে একেবারে তক্তার মত বানিয়ে দেব। সেই তক্তা দিয়ে খালের উপরে ব্রিজ বানিয়ে দিব। সেই ব্রিজের উপরে যখন গরু, ছাগলসহ সবাই হেটেচলে যাবে, তখন আমার কথা মনে করবে আর কাঁন্দবে।
রাজমিস্ত্রির পরিবার : বেশি উল্টাপাল্টা বকর বকর করলে সিমেন্ট দিয়ে জীবনের মত মুখ বন্ধ করে দেব, যেন খেতেও না পার এবং উল্টাপাল্টা কথাও বলতে না পার।
স্বর্ণকারের পরিবার: আমাকে আসল-নকল, সত্য- মিথ্যার পার্থক্য চেনাতে আসবে না। চকচক করলে সোনা হয় না, কোনটা সোনা আর কোনটা লোহা আমি ভালো করেই জানি। সোনায় কি করে খাদ মিশাতে হয়, তাও জানি।
গায়কের পরিবার: আগে যদি জানতাম তুমি সংগীত বাদ দিয়ে ঘরের মধ্যে দিবারাত্রি ছিচকাঁদুনী নামক অমূল্য সংগীত পরিবেশন করে আমার কর্ণকুহরকে ঝালাপালা করবে, তবে বিয়েই করতাম না। মনে হয় আস্ত একটি লবন জলের সমুদ্র তোমার চোখের মধ্যে বাস করছে, সে সমুদ্রে কখন যে ভেসে যাই ঠিক ঠিকানা নেই।ভেবেছিলাম সকালে ঘুম ভাঙবে সুমিষ্ট রাগ ভৈরবীর সুর। হায়! হায়! আমার কপাল আমার ঘুম ভাঙে বাজখাঁই কণ্ঠের চিৎকারে।এভাবে কথায় কথায় বেসুরা বাজখাঁই কণ্ঠের নর্তনসহ কীর্তন তুমি কোথা থেকে শিখলে?
আইনজীবী পরিবার : দেখ, আমি তোমার থেকে কম বুঝি না, আমাকে আইন শেখাতে আসবে না। এই সমস্ত আইন-কানুন কোর্ট কাছারির ধারধারি না আমি। আমার বাসায় আমি যা বলবো, তাই আইন। সেটাই মানতে হবে তোমাকে।আমার বাসায় কোন সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট নেই; শুধু একটাই কোর্ট তা আমার কথা। তোমার ভালো লাগলে নাগরিকের মত থাকবে, সকল প্রকার নাগরিকের সুবিধা পাবে। কিন্তু ভালো না লাগলে প্রবাসী হয়ে চলে যাবে, আমি বাঁধা দিব না।
পুলিশের পরিবার : দেখ অহেতুক ঝামেলা করো না। বারবার বলছি আইন নিজের হাতে তুলে নিবে না। উপরের প্রেসার আছে, চুপচাপ থাক।
কৃষকের পরিবার: আমার শুধু ভালো রূপটাই দেখেছে, কখনো অন্য রূপটা তো দেখনি। যখন দেখবে তখন বুঝতে পারবে, কত ধানে কত চাল হয়। আমাকে অতিরিক্ত রাগালে কিন্তু আমি ধান কাটার মেশিনের মত সব কেটে-কুটে ছারখার করে দেব। তখন সারাদিন হাত-পা এসে ধরলেও পার পাবে না।
প্রকৌশলীর পরিবার : তোমার স্বভাব যে তুমি সুন্দর করে কথা বললেও শুনতে চাও না; শুধুই অহেতুক ঝগড়াঝাটি কর। দেখ তোমাকে শেষবারের মত সতর্ক করছি। তুমি যদি এভাবেই আমার কথা না শোন, তবে নিচে ফাউন্ডেশন ছাড়া বিল্ডিং বানিয়ে সেই বিল্ডিংয়ের মাথায় তোমাকে বসিয়ে রাখব। সেখানে বসে একা-একা দিনরাত্রি ঝগড়া করবে। দেখব যে কত ঝগড়া করতে পার।এরপরে যখন ভূমিকম্পের সময়ে হুরমুর করে ফাউন্ডেশন ছাড়া বিল্ডিংটি ভেঙে পড়বে, তখন পরকালে বসে শুধু আমাকে খুঁজবে।
খেলোয়াড় পরিবার: দেখ, বেশি ভাব নিবে না। তোমার ভাবকে কিন্তু চিরতরে বোল্ড আউট করে দিবো। দেখ, আমি গোলপোস্ট রক্ষা করতে না পারলেও, গোল দিতে জানি। যখন গোল দিয়ে দিব না, তখন টেরও পাবে না, শুধু দর্শকেরা গ্যালারি থেকে হাততালি দিবে।তখন আর মুখ দেখাতে পারবে না!
কাঠুরিয়ার পরিবার : বয়স তো অনেক হল, এবার আপাতত তোমার এই কাঠঠোকরার মত স্বভাব বাদ দাও। আর কতকাল অহেতুক ঠোকরাঠুকরি করবে?
স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক মজার খুনসুটি পেশা ও পরিবেশ উপরে ভিত্তি করে মানুষের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। তবে বর্তমানে আর পূর্বের মত বৃত্তেবদ্ধ আচরণ কোন, পেশাজীবী পরিবারেই হয় না। সভ্যতার আধুনিকায়নের নামে, নগরায়নের নামে মানুষের মনজগতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেছে। কোনটা শিক্ষকের পরিবারের কথাবার্তা ও আচরণ; কোনটা কৃষকের পরিবারের কথাবার্তা ও আচরণ এবং কোনটা মাংস বিক্রেতার পরিবারের কথাবার্তা আচরণ - আর বর্তমানে আলাদা করা যায় না। সকল পরিবারেই সকলে রয়েছে।কারণ পরিবর্তন এবং বৈচিত্র্যেই এ জগত সংসারের নিয়ম ।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।