স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুর রহিম ২৮.১০.২০২০ বুধবার, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের কর্মরত সকল মুসলিম কর্মীদের উদ্দেশ্যে এক বিতর্কিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। সে বিজ্ঞপ্তিতে তিনি ধর্মীয় পরিচয় অনুসারে কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের পরিধেয় পোশাক নির্দিষ্ট করে দেন। তিনি পুরুষ কর্মীদের টাকনুর ওপরে ও মহিলাদের হিজাবসহ টাকনুর নিচে কাপড় পরার নির্দেশনা প্রদান করেন। তার প্রকাশিত সেই বিতর্কিত নির্দেশনায় বলা হয়,"অত্র ইনস্টিটিউটের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, অফিস চলাকালীন সময়ে মোবাইল ফোন সাইল্যান্ট/বন্ধ রাখা এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য পুরুষ টাকনুর উপরে ও মহিলা হিজাবসহ টাকনুর নীচে কাপড় পরিধান করা আবশ্যক এবং পর্দা মানিয়া চলার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো ('জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নারীদের হিজাব, পুরুষদের টাকনুর ওপর কাপড় পরার নির্দেশ'; ডেইলি স্টার, ২৯.১০.২০২০)।"
আইনগতভাবে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুর রহিম কি ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে এমন নির্দেশনা প্রদান করতে পারেন? উত্তর একথায়, না। তিনি বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কোনমতেই এমন নির্দেশনা দিতে পারেন না। বিষয়টি একান্তই তার ব্যক্তিগত পাগলামি। রাষ্ট্রযন্ত্রের উচিত অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিষয়টি দেখা। পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুর রহিম তো জানতেন বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় নিউজ হবে, পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা সমালোচনা হবে, প্রতিবাদ হবে এবং পরিশেষে প্রত্যাহারও হবে। কারণ বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত সে পর্যায়ে যায়নি। কিন্তু এরপরেও কেন এ কাজটি তিনি করলেন? এর কয়েকটি কারণ হতে পারে। প্রথমত সে হয়ত একগুয়ে টাইপের, কাউকে তোয়াক্কা না করে নিজে যা ভাল মনে করেন তাই করেন। দ্বিতীয়ত তার পরিমণ্ডলের মানুষগুলো তাকে বিষয়টিতে ইন্ধন দিয়েছে। তারা হয়ত বুঝে উঠতে পারেনি যে বিষয়টি এতদূর গড়াবে। তৃতীয়ত আরেকটি বিষয় হতে পারে, একটি সক্রিয় মৌলবাদী গ্রুপের পক্ষ থেকে পরীক্ষা করে দেখা যে, এ সকল বিষয়ে মানুষের মনোভাব কেমন। যদি অধিকাংশ মানুষের মনোভাব তাদের অনুকূলে থাকে, তবে সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও বিষয়টি সাধ্যানুসারে কার্যকর করাতে প্রয়াস করা।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) পরিচালকের জারি করা পোশাক সংক্রান্ত বিষয়টি সেদিন বিকালেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয়। এ বিষয়টি দেখা মাত্রই তিনি জরুরি পদক্ষেপ নিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে তাৎক্ষণিক এক নির্দেশনা দেন।এ প্রেক্ষিতে ২৯ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুই জায়গা থেকেই এ বিষয়ে পরিচালক, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট কে কারণ দর্শানোর চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাতে হয় যে, তারা বিষয়টিতে তড়িৎগতিতে হাইকোর্টের ২০১০ সালের রায় অনুসারে ব্যবস্থা নিয়েছে।ডিজিএইচএসের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, "তিনি এটা করতে পারেন না। কোনও প্রক্রিয়া না মেনে, তিনি এ নির্দেশনা জারি করেছেন। আমরা তাকে তাৎক্ষণিকভাবে এটি প্রত্যাহার করতে বলেছি ( ডেইলি স্টার; ২৯.১০.২০২০)।"
সরকারি চাকরিবিধিতে এমন নির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ার তার রয়েছে কিনা অথবা সরকারি কোনও প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবদুর রহিম বলেন, "ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। টাকনুর ওপরে যদি পুরুষ কাপড় পড়ে তাহলে তার কোনও গুনাহ নেই, টাকনুর নিচে পরলে সে কবিরা গুনাহ করল। একইভাবে নারীদের জন্যও সেটা প্রযোজ্য, নারীরা পর্দার ভেতরেই সুন্দর। টাকনুর নিচে কাপড় পরলে তার কবিরা গুনাহ হবে না। এই জিনিসটা আমাদের দেশে উঠে গেছে।এ দেশের কয়জন ইমাম- মোয়াজ্জিন, কয়জন হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ মারা গেছেন কোভিডে? আপনাদের সাংবাদিকদের অনেকেই গেছেন, পুলিশ গেছেন, ডাক্তার গেছেন- হেন পেশা নাই যে পেশাকে করোনা আক্রমণ করেনি, কিন্তু কয়জন ইমাম-মোয়াজ্জিন মারা গেছেন?আমি আমার অফিসের জন্য নির্দেশ দিয়েছি। আমাদের দেশ মুসলিম কান্ট্রি, আমাদের দেশে, আমার অফিসে যদি এভাবে সজ্জিত হয় আমার কাছে ভালো লাগবে ( 'জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে পোশাক নিয়ে নির্দেশ দেয়ায় পরিচালক শোকজ'; সময় টিভি, ২৯.১০.২০২০)।"
একজন মানুষ একটি অত্যন্ত দায়িত্বশীল পদে থেকে কতটা সাম্প্রদায়িক মনভাবাপন্ন হলে একথা বলতে পারে যে, বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসে ইমাম-মোয়াজ্জিন আক্রান্ত হয়নি।এতটা সাম্প্রদায়িক বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে কি করে স্বপদে থাকতে পারেন, তা ভাবনার বিষয়। আমি তার বক্তব্যটি নিউজে পড়ে হতভম্ব হয়েছি, ব্যথিত হয়েছি এবং শঙ্কিত হয়েছি দেশের আগামী ভবিষ্যৎ নিয়ে। এতটা সাম্প্রদায়িকতা যিনি হৃদয়ে পোষণ করেন, তিনি কি করে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের সবাইকে স্বাস্থ্যসেবা দিবেন তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে একটু ভেবে দেখা উচিত।
নগর পুড়লে দেবালয় যেমনি রক্ষা পায় না ; তেমনি মহামারী কোন জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ চেনে না। সে সম্প্রদায় নিরপেক্ষভাবে যাদের গ্রাস করার তাদের সবাইকেই গ্রাস করে চলে। করোনা ভাইরাস মহামারীতে সাধারণ মানুষ যেমন মৃত্যু বরণ করেছে; তেমনি ধর্মের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত অসংখ্য ব্যক্তিবর্গও মারা গেছে। ভয়ংকর করোনা ভাইরাস কাউকেই রেহাই দেয়নি। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুর রহিমের কথা অনুসারে করোনাতে সাধারণত কোন ইমাম-মোয়াজ্জিন মারা যায়নি। এ অসত্য বাক্যটি বলে তিনি এর সাথে হিন্দু পুরোহিত শ্রেণির সাথে একটি সাম্প্রদায়িক তুলনা টেনেছেন। কিন্তু পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুর রহিমের কথাটি যে কতটা মিথ্যা তা করোনাকালীন জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে একটু চোখ মেলে তাকালে যে কেউ বিষয়টি বুঝতে পারবে। শুধু খুলনা করোনা হাসপাতালে একাধিক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ইমামের চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে নড়াইলের একটি মসজিদের ইমাম মো. আলী মিয়া (৬০) অন্যতম ('খুলনায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মসজিদের ইমামের মৃত্যু'; সমকাল, ০৬.০৬.২০২০)। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ৩০.০৭.২০২০ করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফকিরহাট উপজেলার ঘনশ্যামপুর কচুয়া গ্রামের মসজিদের ইমাম আব্দুল গণির (৩২) মৃত্যু হয়। এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। মৃত্যু কখনই কাম্য নয়।অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে যাদের পরিবার পরিজন মৃত্যুবরণ করেন, শুধু তারাই উপলব্ধি করতে পারেন এর কষ্ট। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুকে নিয়ে, সরকারি একটি দায়িত্বশীল পদে থেকে যে ব্যক্তি ধর্মের ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে ; সেই ব্যক্তি আর যাই হোক অন্ততপক্ষে সুস্থ মস্তিষ্কের নয়, এতটুকু বলা যায়।
পরিধেয় পোশাক প্রসঙ্গে, গত ০৪.১০.২০১০ সালে বাংলাদেশ হাইকোররটের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রায় দেয়-ইচ্ছার বিরুদ্ধে বোরকা বা কোন ধর্মীয় পোশাক কাউকে পরতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। আদালত তার রায়ে বলেছে, ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের চার মূলনীতির অন্যতম হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। এটি পঞ্চদশ সংশোধনীর রায়ের মাধ্যমে পুনঃস্থাপিত হয়েছে। কাজেই কোনো ব্যক্তিকে কোনোভাবেই ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না।আদালত তার আদেশে বলেছে যে জোর করে কোন পোশাক পরানো মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। প্রত্যেক নাগরিকেরই স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন ও ধর্মীয় পোশাক পরিধানের অধিকার রয়েছে। তারা বলেন, "পোশাক নির্বাচন করা ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়। এ ব্যাপারে জোর করা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়াও বৈষম্যমূলক ( 'বোরকা পরতে বাধ্য করা নিষিদ্ধ'; বিবিসি বাংলা, ০৪.১০.২০১০)।" তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত স্বতপ্রণোদিত হয়ে রুল জারিসহ অর্ন্তবর্তীকালীন নির্দেশ দেন।সেই বছরেই ২০১০ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দেশের কোনো দপ্তরে নারীদের বোরকা পরতে বাধ্য না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।একই সঙ্গে মেয়েদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত না রাখারও নির্দেশ দেয়া হয়। হাইকোর্টের একই বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জনস্বার্থে এ আদেশ দিয়েছিলেন।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।