আমরা অনেক সময়েই প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকার পরেও আমরা সবাইকে ভাল মন্দ বোঝাতে পারি না বা অধিকাংশ সময়ে বোঝানো যায়ও না। মানুষের সঙ্গ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গদোষে বলা হলা হয় লোহাও জলে ভাসতে পারে, সোলাও ডুবে যেতে পারে। যে যেমন সে ঠিক তেমনিই সঙ্গ বেঁছে নেই। আমরা নীতি-নৈতিকতার যতই বক্তব্য দেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা জীবনে প্রয়োগ করতে পারি না। একারণেই দেখা যায় অনেক বড় বড় ব্যক্তিদের বংশধররা বিভিন্ন অপকর্মে, সেই মহৎ ব্যক্তির নামকেই কলঙ্কিত করছে। প্রথমে প্রয়োজন তাদের সাধ্যমত বোঝানো। যদি কোনমতেই বোঝানো সম্ভব না হয়, তবে তাদের সর্বদা পরিত্যাগ করতে হবে। পানগাছের বরজে যদি একটি পানলতায় পচন ধরে তবে সেই ধীরেধীরে সকল লতাকেই আক্রান্ত করে সম্পূর্ণ পারেন বরজকেই নষ্ট করে দেয়। তাই মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যদি কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত অধর্মের সাথে যুক্ত হয়, কোনভাবেই যদি বুঝিয়ে ধর্মের পথে নিয়ে আসা সম্ভব না হয় ; তবে তাকে পরিত্যাগ করতে হবে। সে যতই প্রিয়জন হোক।বংশ রক্ষা করার জন্যে, যদি প্রয়োজন পরে তবে বংশের একজনকে ত্যাগ করবে। নিজ বংশ যদি অধর্মের দ্বারা আচ্ছন্ন হয় তবে গ্রাম রক্ষা করবার জন্যে বংশকে পরিত্যাগ করবে। দেশের কল্যাণার্থে এবং রক্ষার্থে অধর্মের সাথে যুক্ত গ্রাম পরিত্যাগ করবে। পরিশেষে সর্বোপরি যখন নিজের আত্মরক্ষার প্রশ্ন আসবে, নিজের কল্যাণের প্রশ্ন আসবে, নিজের মুক্তির প্রশ্ন আসবে; তখন যদি প্রয়োজন পরে সমগ্র পৃথিবীকেই পরিত্যাগ করবে। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে নিজেকেই রক্ষা করতে হবে। তবে মহাভারতের "সমগ্র পৃথিবীকেই পরিত্যাগ করবে" এ বাক্যটিতে আপাতদৃষ্টিতে অনেকে পৃথিবী পরিত্যাগ করে মৃত্যুবরণ করাকে যদি বুঝে থাকে ; তবে সে ভুল বুঝবে। যখন নিজের মুক্তির প্রশ্ন আসবে পৃথিবীর সকল কিছু থেকেই নিস্পৃহ, নিরাসক্তভাবে থেকে সর্বদা ঈশ্বরের স্মরণে থেকে মুক্তির পথে অগ্রসর হতে হবে।
ত্যজেৎ কুলার্থে পুরুষং গ্রামাস্যার্থে কুলং ত্যজেৎ।
গ্রামং জনপদস্যার্থে আত্মার্থে পৃথিবীং ত্যজেৎ।।
(মহাভারত:উদ্যোগ পর্ব, ১১৯.৪৯; ৩৭.১৭)
"কুল রক্ষা করার জন্যে কুলের একজনকে ত্যাগ করবে,গ্রাম রক্ষা করবার জন্যে প্রয়োজনে কুল পরিত্যাগ করবে, জনপদ রক্ষার্থে গ্রাম পরিত্যাগ করবে এবং আত্মরক্ষার্থে যদি প্রয়োজনীয় হয়, তবে সমগ্র পৃথিবীই পরিত্যাগ করবে।"
আত্মরক্ষার্থে যদি প্রয়োজনীয় হয়, তবে সমগ্র পৃথিবী পরিত্যাগ করে নিজেকে আগে রক্ষা করতে হবে মহাভারতের উদ্যোগ পর্বের এ নির্দেশনাটি গরুড় পুরাণের পূর্বখণ্ডেও কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে পাওয়া যায়। গরুড় পুরাণে বলা হয়েছে:
ত্যজেদেকং কুলস্যার্থে গ্রামস্যার্থে কুলং ত্যজেৎ।
গ্রামং জনপদস্যার্থে আত্মার্থে পৃথিবীং ত্যজেৎ।।
(গরুড়পুরাণ: পূর্বখণ্ড, ১০৯.২)
"কুলরক্ষার জন্যে প্রয়োজনে কুলের এক জনকে ত্যাগ করবে, গ্রাম রক্ষা করবার জন্যে প্রয়োজনে কুল পরিত্যাগ করবে, জনপথ রক্ষার্থে গ্রাম পরিত্যাগ করবে এবং আত্মরক্ষার্থে যদি প্রয়োজনীয় হয়, তবে সমগ্র পৃথিবীই পরিত্যাগ করবে।"
গরুড় পুরাণের এ শ্লোকটি সম্পূর্ণ পরিবর্তিতভাবে চাণক্যের রচিত চাণক্য শ্লোক সংগ্রহতেও (শ্লোক: ৪৩) পাওয়া যায়।
আপনজন পাপ করলেও, তাদের পরিত্যাগ করতে মায়া আমাদের বেঁধে রাখে। আমরা তখন তাদের পরিত্যাগ করতে পারি না। তখন সে দুর্জনরূপ, অধর্মরূপ আপনজনই তাদের নিচ প্রবৃত্তি দ্বারা আমাদের পরিবার, গ্রাম এবং জনপদকে দূষিত করে গ্রাস করে। একটি বনভূমি তৈরী বহুকাল প্রয়োজন। দীর্ঘকালব্যাপী গাছের পর গাছ জন্ম নিয়ে তবেই একটি বনাঞ্চলের উৎপত্তি হয়। এ বনাঞ্চল কখনো প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়, কখনো বা কৃত্রিমভাবে। বহু বছরের সময়সাধ্য, কষ্টসাধ্য বনাঞ্চলে একটি বৃক্ষ থেকে যদি দাবানলের উৎপত্তি হয়, তবে সেই একটি বৃক্ষ থেকে শুরু হয়ে দাবানলটি শতসহস্র বৃক্ষকে ভস্মীভূত করে ফেলে। এভাবে একদিন সম্পূর্ণ বনাঞ্চলকেই অঙ্গারে পরিণত করে। বহুবছর ধরে গড়ে ওঠা ববনাঞ্চল নিমেষে দগ্ধ হয়ে যায় একটা গাছের আগুন থেকে। ঠিক তেমনি বংশের দুর্নামের কারণ হয় কুপুত্র। বংশপরম্পরায় তিল তিল করে গড়ে ওঠা বংশমর্যাদা একটি কুপুত্রের দুরাচারের নিমেষেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
একেনাপি কুবৃক্ষেণ কোটরস্থেন বহ্নিনা।
দহতে তদ্ধনং সর্বং কুপুত্রেণ কুলং যথা ॥
(চাণক্য শ্লোক:১৭)
"কুবৃক্ষ বা নষ্ট হয়ে যাওয়া বৃক্ষের কোটরস্থ আগুনে যেমন সমগ্র বনভূমি অগ্নিদগ্ধ হয় তেমনই একজন কুপুত্রই সমগ্র বংশকে কলঙ্কিত করে।"
কুপুত্র তেমনি বংশকে কলঙ্কিত করে, তেমনি সুপুত্র যেমন বংশের গৌরবকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। সেই সুপুত্র সুগন্ধি পুষ্পিত গাছের মত বা সুগন্ধি চন্দন গাছের মত। যে গাছের সুবাসিত সৌরভে সমগ্র বনভূমি মোহিত হয়। কোন বংশে যদি কোন শ্রেষ্ঠ সন্তান জন্মগ্রহণ করেন, তবে সেই সন্তানটি সেই সময়ের নয় জাজ্জ্বল্যমান প্রদীপের শিখার মত অনন্তকাল সেই বংশকে আলোকিত করে রাখেন। সুগন্ধি চন্দন গাছের মত সুবাসিত করে রাখেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ভগবান শ্রীরামচন্দ্র হলেন, চন্দ্র এবং সূর্য বংশের এমনি আলোকিত প্রদীপ। যাঁদের আলোকচ্ছটায় চন্দ্র-সূর্য দুটি বংশ আজও আলোকিত।
একেনাপি সুবৃক্ষেণ পুষ্পিতেন সুগন্ধিনা।
বাসিতং স্যাৎ বনং সর্বং সুপুত্রেণ কুলং যথা।।
(চাণক্য শ্লোক:২০)
"সুগন্ধি পুষ্পিত বৃক্ষের সৌরভে যেমন সমগ্র বনভূমি সুবাসিত হয় তেমনই একজন সুপুত্রের গৌরবেই সমগ্র বংশ ধন্য হয়।"
মায়েদের মধ্যে জন্মগত এমন গুণ ভগবান দিয়েছেন যে, মায়েরা সন্তানের ভাল মন্দের প্রবৃত্তি সবার আগেই টের পেয়ে যায়। উপলব্ধি করতে পারে সন্তান কোন রাস্তায় চলছে, এর গন্তব্য কোথায়। এরপরেও অধিকাংশ মায়েরা সন্তানের অনৈতিক কর্ম এবং আচরণ পরিবার পরিজন সহ অন্যরা যেন জানতে না পারে সেভাবে চেপে রাখে। এতে বিপদ আরও বেড়ে যায়। যখন বিষয়টি নাগালের মধ্য থেকে চলে যায়, তখন উপলব্ধি করতে পারে। বুঝতে পার, হায় আমি কি করলাম! তখন আর কিছুই করার থাকে না। সন্তানের বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে সেই মা-বাবাকে ক্ষমতাবানদের পিছে পিছে দৌড়াতে হয়। কোর্টের বারান্দায় বারান্দায় আইনজীবীদের কাছে যেতে যেতে পায়ের জুতার শুকতলা ক্ষয় করে ফেলতে হয়। পুলিশ এবং প্রশাসনের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিতে হয়। এরপরেও দিনশেষে কোন সমাধান হয় না। এরপরেও মমতায় আচ্ছন্ন হয়ে অধর্মের সাথে যুক্ত হওয়া সন্তানকে মা-বাবা পরিত্যাগ করতে পারে না। পাপিষ্ঠ সন্তানটি বাবামায়ের স্নেহের দুর্বলতার সুযোগ গলিয়ে সে পরিবারের অন্যদের দূষিত করতে থাকে। লোকবল ভারি করতে থাকে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সম্পূর্ণ পরিবারকেই সে বিষাক্ত করে দূষিত করে দেয়। তাই সন্তান হোক বা পরিবার পরিজন যেই হোক যে ধর্ম পরিত্যাগ করে অধর্মের সাথে যুক্ত হবে, তাকে প্রথমে সাধ্যমত বোঝাতে হবে, যদি তাকে বোঝানো সম্ভব না হয়, তবে তাকে নির্মমভাবে পরিত্যাগ করে সকল সম্পর্ক ছেদ করে দিতে হিবে। অন্যথায় সে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দূষিত করবে।
শরীরের কোন অঙ্গে যদি পচন ধরে, তবে সম্পূর্ণ শরীরকে রক্ষা করার জন্যে প্রয়োজনে সেই পচনশীল অঙ্গকে অপারেশনের মাধ্যমে নির্মমভাবে কেটে বাদ দিয়ে দিতে হয়। তেমনিভাবে পরিবার পরিজনের মধ্যে কেউ যদি এমন কাজ করে যাতে বংশ কলঙ্কিত হয়; তবে বংশের রক্ষার্থে সেই কুলাঙ্গারকে পরিত্যাগ করতে হবে। প্রথমে তাকে যথাসম্ভব বুঝাতে হবে।যদি পরিত্যাগ করা না হয়, তবে সেই কুলাঙ্গার বংশের অন্যদের তার পৈশাচিক কর্মকাণ্ড দ্বারা দুষিত করবে। শাস্ত্রে কলঙ্কিত কুসন্তানের বড় দৃষ্টান্ত দ্বাপরযুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মামা কংশ। তিনি তার শশুর জরাসন্ধের সহায়তায় বৃদ্ধ পিতা রাজা উগ্রসেনকে বন্দি করে মথুরার রাজা হয়ে প্রজাদের উপরে ভয়ংকর নিপিড়ন শুরু করেন। ধর্ম রক্ষার্থে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম সম্মিলিতভাবে কংশকে বধ করে তার পিতা উগ্রসেনকে পুনরায় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। শ্রীকৃষ্ণ কংশের সম্পর্ককে স্মরণ করে 'কংশমামা' আজও একটি নেতিবাচক শব্দ হিসেবে সমাজে প্রচলিত। মাতৃপক্ষের কুলের রক্ষার্থে সম্পর্কে মামা হলেও, কংশকে বধ করে কুলের রক্ষা করেছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।