-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

হিন্দুর জ্ঞান, বৈভব সব আছে, শুধু সঙ্ঘবদ্ধ একত্বের অভাব ।

বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় বর্তমানে আপদধর্মকালীন অবস্থায়। এ অবস্থায় নিজেকে এবং নিজের পরিবার পরিজন সহ আশেপাশের সবাইকে রক্ষা করাই একমাত্র ধর্ম। সম্প্রদায়ের রক্ষার্থে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সঙ্ঘশক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে ব্যক্তি এবং সমাজকে সুরক্ষিত রাখে। বেদেও সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধতার জন্যে শাস্ত্রে সংগঠনের অত্যাবশকীয় প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে: ত্রেতায়া মন্ত্র শক্তিশ্চ জ্ঞান শক্তি কৃতোযুগে। দ্বাপরে যুদ্ধ শক্তিশ্চ সঙ্ঘশক্তি কলৌযুগে।। "ত্রেতাযুগে মন্ত্রশক্তি, সত্যযুগে জ্ঞানশক্তি, দ্বাপরযুগে যুদ্ধশক্তি ও কলিযুগে সঙ্ঘশক্তিতেই বিজয় লাভ হবে।" বর্তমানে দেশে অনেক হিন্দু সংগঠন রয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু সংগঠনগুলো সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে কিছুটা সফল হলেও, সম্পূর্ণভাবে সফলতা পাচ্ছে না। বিষয়টি অনেকটা "নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো" - এই প্রকারের।তাই সাংগঠনিক বিষয়গুলো নিয়ে দেশে প্রচলিত সংগঠনগুলোর আত্মসমীক্ষা প্রয়োজন। ব্যক্তি এবং সংগঠনের ভুল-ত্রুটিগুলো একটু পিছন ফিরে দেখা প্রয়োজন। প্রথমে আগে তাত্ত্বিকভাবে সনাতন ধর্ম-দর্শন এবং রাজনৈতিক ইতিহাস সবাইকে জানা প্রয়োজন। হিন্দু সম্প্রদায়ের মহানুভবতার সুযোগে, যে ঐতিহাসিক ভুলগুলো হয়েছে; জাতির জন্যে কাজ করতে হলে সেই ভুলগুলোকে মাথায় রেখে রাজ করা অত্যন্ত প্রয়োজন।তা না হলে সেই একই ঐতিহাসিক ভুলগুলোর বারবার পুনরাবৃত্তি হবে। জীবনে কিছু ভুল শুধু ভুল না, অমার্জনীয় অপরাধ।যেমনটি পৃথিবীরাজ চৌহান মোহাম্মদ ঘোরিকে ক্ষমা করে করেছিলেন। সাংগঠনিক দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রকৃতি আমাদের শিক্ষাগুরু হতে পারে। প্রকৃতির জীবজগত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি।সংগঠনে শৃঙ্খলা অত্যন্ত প্রয়োজন। পিঁপড়া থেকে শিক্ষালাভ করতে পারি  শৃঙ্খলার। সুশৃঙ্খলভাবে সারিবদ্ধভাবে পিঁপড়ারা একে অন্যকে সাথে নিয়ে গন্তব্যে এগিয়ে যায়। আমরা কুকুরের থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারি বিশ্বস্ততার। কুকুর কখনো অবিশ্বস্ততা, অকৃতজ্ঞতা করে না। একটি সংগঠনের কর্মী এবং সদস্যদের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পায়রার থেকে স্বচ্ছতার শিক্ষা নিতে পারি। পায়রা কখনো নোংরায় বাস করে না এবং নোংরা খবার খায় না। গাধার মধ্যে পাওয়া যায়, পরিশ্রমের শিক্ষা। সে অন্যের কল্যাণের জন্যে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দেন। উদ্যম এবং গতির শিক্ষা পাই ঘোড়ার মধ্যে। উদ্যমী ছাড়া জগতে কোন কাজই সফল হয় না।অজগর যা পায় তাই খায়। অজগর সাপ থেকেও অনেক শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে। অজগর নিজ খাদ্য সমাপ্ত না হলে পুনরায় খবার সংগ্রহের প্রচেষ্টা করে না। সে অনাহারে অনেকদিন কাটিয়ে দিতে পারে। সে খাবারের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে না। সংগঠনে একতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কাকের থেকে আমরা এ একতার শিক্ষা লাভ করতে পাই। একটি কাকের যদি সামান্যতম কোন ক্ষতি হয়, তবে সকল কাক একসাথে হয়ে কাকা বলে ডাকতে থাকে। কিন্তু বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টা দেখা যায়। কেউ যদি বিপদে পরে, তখন আশেপাশের অনেকেই নিখোঁজ হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রয়োজনের সময়ে তাদের আর পাওয়া যায় না। পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে, অনেকেই ছেলেমেয়ে স্ত্রীকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখে। আগুন নিভাতে নিজের পরিবার পরিজনকে আগুনের কাছে যেতে দিতে চায় না। পাছে আগুনে বিপদ হয়। পক্ষান্তরে সেই ব্যক্তির নিজের ঘরে যখন আগুন লাগে, তখন  তারই দেখানো পথ অনুসরণ করে তার বাড়িতেও আগুন নিভাতে কেউ আসে না। তখন হতাশ হয়ে সেই ব্যক্তি বলে- হিন্দু সম্প্রদায় স্বার্থপর কারো বিপদে কেউ আসে না। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। যে যেমন, সে তেমন দৃষ্টিতে জগতকে দেখে এবং তেমনিই ফলাফল উপভোগ করে। কিভাবে একতাবদ্ধ থাকতে হবে তা আমরা মৌমাছির মধ্যে দেখতে পাই। মৌমাছি একতাবদ্ধভাবে একনিষ্ঠ হয়ে দিনের পরে দিন হাজার হাজার ফুল থেকে কঠোর অধ্যবসায়ের ফলে মধুর একটি চাক তৈরি করে। তাই হিন্দু সম্প্রদায়েরও এভাবে সমন্বিত প্রয়াসে সংঘবদ্ধভাবে জাতি গঠন করা প্রয়োজন। 'গড্ডল' শব্দের অর্থ ভেড়া। এই গড্ডল বা ভেরারা সামনের ভেড়াকে অন্ধ অনুসরণ করে করে পথ অতিক্রম করে। তাই অন্ধের মত সামনের ভেরাকে অনুসরণ করে পেছনের ভেড়ার পালকে চলাকে সাহিত্যের ভাষায় বলে 'গড্ডলিকা প্রবাহ'। অর্থাৎ ভেড়ার পালের অনুসরণ সামনের ব্যক্তিকে অনুসরণ করার প্রয়োজন আছে। তবে সেই ব্যক্তিরও মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষ করে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় চলে ছাগপ্রবাহে। ছাগল কখনো সামনের ছাগলকে অনুসরণ করে না। সে তার নিজস্ব মনমত এলোমেলো পথে চলে। তাই ছাগলকে নিয়ে পথচলা অত্যন্ত কষ্টের। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং তাঁদের আচরণকেই সর্বদা অনুসরণ করতে। যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ৷ স যৎপ্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে৷৷ ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।  নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি৷৷ যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ।  মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পাৰ্থ সৰ্বশঃ৷৷ (শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৩.২১-২৩) "শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যে ভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষেরাও তার অনুকরণ করেন। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন অন্য ব্যক্তিরা তারই অনুসরণ করে চলে। হে পার্থ! ত্রিলোকে আমার কোন কর্তব্য কর্ম নেই এবং প্রাপ্তব্য কোনো বস্তু অপ্রাপ্ত নেই; তথাপি আমি সর্বদা কর্মে ব্যাপৃত থাকি, কর্মত্যাগ করি না।আমি যদি সাবধান হয়ে কর্মে ব্যাপৃত না থাকি, তবে জগতের ক্ষতি হবে। কারণ মানুষ সর্বভাবে আমার পথেরই অনুসরণ করে।" সংগঠনে একসাথে চলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই একসাথে সকলে চলতে পারে না বলেই নিজের কল্যাণ তো হয় না, অন্যদেরও কল্যাণ করতে পারে না।এ প্রসঙ্গে অনূকূল ঠাকুরের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছড়া রয়েছে। তিনি বলেছেন : "এক আদেশে চলে যারা তাদের নিয়ে সমাজগড়া।" সংগঠনের ক্ষেত্রে দেখা যায় কারো একটি আছে তো অন্যটি নেই।হিংসা, ঈর্ষা, ক্রোধ, লোভ, নিষ্ঠুরতা, অহঙ্কারের পাল্লায় পরে মানুষ কোন মঙ্গলময় সর্বজনীন কর্মের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। গত প্রায় একযুগের অধিক সাংগঠনিক অভিজ্ঞতায় আমার কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয় চোখে পড়েছে। এর ব্যতিক্রম হয়ত দুইচারজন আছে। কিন্তু মানুষের সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনায় আমি ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ সে যে বিভাগেই হোক -সকল বিভাগের সাংগঠনিক সদস্যদের একই আচরণ এবং পরিণতি লক্ষ্য করেছি। এই আচরণ এবং পরিণতি দেশের প্রায় সকল সংগঠনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অবশ্য বিষয়টি আমার ব্যক্তিগত মতামত। সবাই একমত নাও হতে পারেন। যাদের মেধা আছে, তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা নেই। আবার যাদের সাংগঠনিক দক্ষতা আছে, তাদের বৈদিক জ্ঞান নেই। যাদের বৈদিক জ্ঞান আছে, তাদের বিনয় নেই। যাদের বিনয় আছে, তাদের সামর্থ্য নেই। যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের আগ্রহ নেই। যাদের আগ্রহ আছে, তাদের আত্মত্যাগ নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে! দেশে হিন্দু সম্প্রদায় ভয়াবহ আপদধর্মকালীন অবস্থায় ; এরপরেও বোধনাশাদের মত তাদের আত্মঘাতী বিবিধ আচরণ। আমি মাঝেমাঝে ভাবি, পাগলেও তো নিজের ভালোমন্দ বুঝতে পারে।তাই মাঝেমধ্যে মনে হয়, দেশের হিন্দু সম্প্রদায় পাগল হলেও ভালো হতো। তবে আর যাই হোক নিজের ভালো-মন্দ অন্ততপক্ষে বুঝতে পারতো। হিন্দুর একতা এবং সাংগঠনিক সঙ্ঘশক্তি সম্পর্কে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ বলছেন: ‘‘হিন্দুর বিদ্যা আছে, বুদ্ধি আছে, অর্থ আছে, ব্যক্তিগত শক্তি-সামর্থ্যও যথেষ্ট আছে। কিন্তু নাই কেবল তাদের মধ্যে একতা, সঙ্ঘবদ্ধতা বা সংহতি শক্তি। তাদের মধ্যে এই সঙ্ঘশক্তি জাগিয়ে দিতে পারলেই হিন্দুজাতি জগতে অজেয় হয়ে দাঁড়াবে।’’  স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ চেয়েছিলেন প্রত্যকটি হিন্দু তাঁর স্বধর্মীদের রক্ষক হয়ে জাতিকে যথাসাধ্য রক্ষা করবে। সাংগঠনিক দক্ষতায় স্বধর্মীদের প্রকৃত রক্ষী হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: "অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদ ও প্রতিকারের জন্য স্থিরসঙ্কল্প যে, দেহে একবিন্দু রক্ত থাকতেও হিন্দুর ধর্ম, মান, ইজ্জত, স্বার্থ ও অধিকারে কাকেও হস্তক্ষেপ করতে দিব না—এরূপ সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা যার সেই হবে প্রকৃত রক্ষী।’’ শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় বর্তমানে আপদধর্মকালীন অবস্থায়। এ অবস্থায় নিজেকে এবং নিজের পরিবার পরিজন সহ আশেপাশের সবাইকে রক্ষা করাই একমাত্র ধর্ম। সম্প্রদায়ের রক্ষার্থে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সঙ্ঘশক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে ব্যক্তি এবং সমাজকে সুরক্ষিত রাখে। বেদেও সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধতার জন্যে শাস্ত্রে সংগঠনের অত্যাবশকীয় প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে:
ত্রেতায়া মন্ত্র শক্তিশ্চ জ্ঞান শক্তি কৃতোযুগে।
দ্বাপরে যুদ্ধ শক্তিশ্চ সঙ্ঘশক্তি কলৌযুগে।।
"ত্রেতাযুগে মন্ত্রশক্তি, সত্যযুগে জ্ঞানশক্তি, দ্বাপরযুগে যুদ্ধশক্তি ও কলিযুগে সঙ্ঘশক্তিতেই বিজয় লাভ হবে।"
বর্তমানে দেশে অনেক হিন্দু সংগঠন রয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু সংগঠনগুলো সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে কিছুটা সফল হলেও, সম্পূর্ণভাবে সফলতা পাচ্ছে না। বিষয়টি অনেকটা "নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো" - এই প্রকারের।তাই সাংগঠনিক বিষয়গুলো নিয়ে দেশে প্রচলিত সংগঠনগুলোর আত্মসমীক্ষা প্রয়োজন। ব্যক্তি এবং সংগঠনের ভুল-ত্রুটিগুলো একটু পিছন ফিরে দেখা প্রয়োজন। প্রথমে আগে তাত্ত্বিকভাবে সনাতন ধর্ম-দর্শন এবং রাজনৈতিক ইতিহাস সবাইকে জানা প্রয়োজন। হিন্দু সম্প্রদায়ের মহানুভবতার সুযোগে, যে ঐতিহাসিক ভুলগুলো হয়েছে; জাতির জন্যে কাজ করতে হলে সেই ভুলগুলোকে মাথায় রেখে রাজ করা অত্যন্ত প্রয়োজন।তা না হলে সেই একই ঐতিহাসিক ভুলগুলোর বারবার পুনরাবৃত্তি হবে। জীবনে কিছু ভুল শুধু ভুল না, অমার্জনীয় অপরাধ।যেমনটি পৃথিবীরাজ চৌহান মোহাম্মদ ঘোরিকে ক্ষমা করে করেছিলেন।
সাংগঠনিক দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রকৃতি আমাদের শিক্ষাগুরু হতে পারে। প্রকৃতির জীবজগত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি।সংগঠনে শৃঙ্খলা অত্যন্ত প্রয়োজন। পিঁপড়া থেকে শিক্ষালাভ করতে পারি শৃঙ্খলার। সুশৃঙ্খলভাবে সারিবদ্ধভাবে পিঁপড়ারা একে অন্যকে সাথে নিয়ে গন্তব্যে এগিয়ে যায়। আমরা কুকুরের থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারি বিশ্বস্ততার। কুকুর কখনো অবিশ্বস্ততা, অকৃতজ্ঞতা করে না। একটি সংগঠনের কর্মী এবং সদস্যদের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পায়রার থেকে স্বচ্ছতার শিক্ষা নিতে পারি। পায়রা কখনো নোংরায় বাস করে না এবং নোংরা খবার খায় না। গাধার মধ্যে পাওয়া যায়, পরিশ্রমের শিক্ষা। সে অন্যের কল্যাণের জন্যে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দেন। উদ্যম এবং গতির শিক্ষা পাই ঘোড়ার মধ্যে। উদ্যমী ছাড়া জগতে কোন কাজই সফল হয় না।অজগর যা পায় তাই খায়। অজগর সাপ থেকেও অনেক শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে। অজগর নিজ খাদ্য সমাপ্ত না হলে পুনরায় খবার সংগ্রহের প্রচেষ্টা করে না। সে অনাহারে অনেকদিন কাটিয়ে দিতে পারে। সে খাবারের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে না। সংগঠনে একতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কাকের থেকে আমরা এ একতার শিক্ষা লাভ করতে পাই। একটি কাকের যদি সামান্যতম কোন ক্ষতি হয়, তবে সকল কাক একসাথে হয়ে কাকা বলে ডাকতে থাকে। কিন্তু বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টা দেখা যায়। কেউ যদি বিপদে পরে, তখন আশেপাশের অনেকেই নিখোঁজ হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রয়োজনের সময়ে তাদের আর পাওয়া যায় না। পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে, অনেকেই ছেলেমেয়ে স্ত্রীকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখে। আগুন নিভাতে নিজের পরিবার পরিজনকে আগুনের কাছে যেতে দিতে চায় না। পাছে আগুনে বিপদ হয়। পক্ষান্তরে সেই ব্যক্তির নিজের ঘরে যখন আগুন লাগে, তখন তারই দেখানো পথ অনুসরণ করে তার বাড়িতেও আগুন নিভাতে কেউ আসে না। তখন হতাশ হয়ে সেই ব্যক্তি বলে- হিন্দু সম্প্রদায় স্বার্থপর কারো বিপদে কেউ আসে না। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। যে যেমন, সে তেমন দৃষ্টিতে জগতকে দেখে এবং তেমনিই ফলাফল উপভোগ করে। কিভাবে একতাবদ্ধ থাকতে হবে তা আমরা মৌমাছির মধ্যে দেখতে পাই। মৌমাছি একতাবদ্ধভাবে একনিষ্ঠ হয়ে দিনের পরে দিন হাজার হাজার ফুল থেকে কঠোর অধ্যবসায়ের ফলে মধুর একটি চাক তৈরি করে। তাই হিন্দু সম্প্রদায়েরও এভাবে সমন্বিত প্রয়াসে সংঘবদ্ধভাবে জাতি গঠন করা প্রয়োজন। 'গড্ডল' শব্দের অর্থ ভেড়া। এই গড্ডল বা ভেরারা সামনের ভেড়াকে অন্ধ অনুসরণ করে করে পথ অতিক্রম করে। তাই অন্ধের মত সামনের ভেরাকে অনুসরণ করে পেছনের ভেড়ার পালকে চলাকে সাহিত্যের ভাষায় বলে 'গড্ডলিকা প্রবাহ'। অর্থাৎ ভেড়ার পালের অনুসরণ সামনের ব্যক্তিকে অনুসরণ করার প্রয়োজন আছে। তবে সেই ব্যক্তিরও মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষ করে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় চলে ছাগপ্রবাহে। ছাগল কখনো সামনের ছাগলকে অনুসরণ করে না। সে তার নিজস্ব মনমত এলোমেলো পথে চলে। তাই ছাগলকে নিয়ে পথচলা অত্যন্ত কষ্টের। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং তাঁদের আচরণকেই সর্বদা অনুসরণ করতে।
যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ৷
স যৎপ্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে৷৷
ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি৷৷
যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পাৰ্থ সৰ্বশঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৩.২১-২৩)
"শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যে ভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষেরাও তার অনুকরণ করেন। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন অন্য ব্যক্তিরা তারই অনুসরণ করে চলে।
হে পার্থ! ত্রিলোকে আমার কোন কর্তব্য কর্ম নেই এবং প্রাপ্তব্য কোনো বস্তু অপ্রাপ্ত নেই; তথাপি আমি সর্বদা কর্মে ব্যাপৃত থাকি, কর্মত্যাগ করি না।আমি যদি সাবধান হয়ে কর্মে ব্যাপৃত না থাকি, তবে জগতের ক্ষতি হবে। কারণ মানুষ সর্বভাবে আমার পথেরই অনুসরণ করে।"
সংগঠনে একসাথে চলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই একসাথে সকলে চলতে পারে না বলেই নিজের কল্যাণ তো হয় না, অন্যদেরও কল্যাণ করতে পারে না।এ প্রসঙ্গে অনূকূল ঠাকুরের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছড়া রয়েছে। তিনি বলেছেন :
"এক আদেশে চলে যারা
তাদের নিয়ে সমাজগড়া।"
সংগঠনের ক্ষেত্রে দেখা যায় কারো একটি আছে তো অন্যটি নেই।হিংসা, ঈর্ষা, ক্রোধ, লোভ, নিষ্ঠুরতা, অহঙ্কারের পাল্লায় পরে মানুষ কোন মঙ্গলময় সর্বজনীন কর্মের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। গত প্রায় একযুগের অধিক সাংগঠনিক অভিজ্ঞতায় আমার কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয় চোখে পড়েছে। এর ব্যতিক্রম হয়ত দুইচারজন আছে। কিন্তু মানুষের সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনায় আমি ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ সে যে বিভাগেই হোক -সকল বিভাগের সাংগঠনিক সদস্যদের একই আচরণ এবং পরিণতি লক্ষ্য করেছি। এই আচরণ এবং পরিণতি দেশের প্রায় সকল সংগঠনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অবশ্য বিষয়টি আমার ব্যক্তিগত মতামত। সবাই একমত নাও হতে পারেন।
যাদের মেধা আছে, তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা নেই।
আবার যাদের সাংগঠনিক দক্ষতা আছে,
তাদের বৈদিক জ্ঞান নেই।
যাদের বৈদিক জ্ঞান আছে, তাদের বিনয় নেই।
যাদের বিনয় আছে, তাদের সামর্থ্য নেই।
যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের আগ্রহ নেই।
যাদের আগ্রহ আছে, তাদের আত্মত্যাগ নেই।
ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে!
দেশে হিন্দু সম্প্রদায় ভয়াবহ আপদধর্মকালীন অবস্থায় ; এরপরেও বোধনাশাদের মত তাদের আত্মঘাতী বিবিধ আচরণ। আমি মাঝেমাঝে ভাবি, পাগলেও তো নিজের ভালোমন্দ বুঝতে পারে।তাই মাঝেমধ্যে মনে হয়, দেশের হিন্দু সম্প্রদায় পাগল হলেও ভালো হতো। তবে আর যাই হোক নিজের ভালো-মন্দ অন্ততপক্ষে বুঝতে পারতো। হিন্দুর একতা এবং সাংগঠনিক সঙ্ঘশক্তি সম্পর্কে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ বলছেন:
‘‘হিন্দুর বিদ্যা আছে, বুদ্ধি আছে, অর্থ আছে, ব্যক্তিগত শক্তি-সামর্থ্যও যথেষ্ট আছে। কিন্তু নাই কেবল তাদের মধ্যে একতা, সঙ্ঘবদ্ধতা বা সংহতি শক্তি। তাদের মধ্যে এই সঙ্ঘশক্তি জাগিয়ে দিতে পারলেই হিন্দুজাতি জগতে অজেয় হয়ে দাঁড়াবে।’’
স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ চেয়েছিলেন প্রত্যকটি হিন্দু তাঁর স্বধর্মীদের রক্ষক হয়ে জাতিকে যথাসাধ্য রক্ষা করবে। সাংগঠনিক দক্ষতায় স্বধর্মীদের প্রকৃত রক্ষী হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
"অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদ ও প্রতিকারের জন্য স্থিরসঙ্কল্প যে, দেহে একবিন্দু রক্ত থাকতেও হিন্দুর ধর্ম, মান, ইজ্জত, স্বার্থ ও অধিকারে কাকেও হস্তক্ষেপ করতে দিব না—এরূপ সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা যার সেই হবে প্রকৃত রক্ষী।’’
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁