২০২৩ খ্রিস্টাব্দে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন ঘোষাল।।
স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী, একাত্তরের অসংখ্য শব্দসৈনিকের মধ্যে অন্যতম হলেন মনোরঞ্জন ঘোষাল। তৎকালীন খুলনা জেলায় তার জন্ম। বর্তমানে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার গোণালীনলতা গ্রামে ১৯৪৭ সালের ১ মে; ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের ১৭ বৈশাখ বৃহস্পতিবার তার জন্ম হয়। পিতার নাম যামিনীকান্ত ঘোষাল এবং মাতার নাম কমলা ঘোষাল। পিতা যামিনীকান্ত ঘোষাল ছিলে ইস্ট পাকিস্তান পাবলিশার্স এর প্রকাশক এবং সত্ত্বাধিকারী। 'ঘরের আলো' নামক একটি জনপ্রিয় উপন্যাসের লেখক। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক আন্দলের সাথে জড়িত হয়ে 'বিক্ষুব্ধ শিল্পী গোষ্ঠীর' সদস্য হিসাবে অন্যান্য শিল্পীদের সাথে ঢাকা শহরে পাকিস্তানি অপশাসন এবং বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচারণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।প্রায় প্রতিদিনই হারমনিয়াম গলায় নিয়ে বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে প্রেসক্লাব হয়ে পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল (বর্তমান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি) পর্যন্ত বিভিন্ন বিল্পবাত্মক এবং দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের সবাইকে প্রবুদ্ধ করতেন। উল্লেখ যে, তিনি ১৯৬৩ সাল থেকে ২৯৬৭ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজের ইন্টারমিডিয়েট এবং স্নাতক শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৭ সালে বিকম পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ তে ভর্তি হন। ঢাকা শহর ছাড়াও নরসিংদী, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে সংগীত দেশাত্মবোধক সঙ্গীত পরিবেশনের কারণে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতির শতাংশে ঘাটতি দেখা যেত। যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বছরের এমবিএ এর অধিকাংশ শিক্ষকই বিদেশি ছিলেন। তারা এই উপস্থিতির বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি।ফলশ্রুতিতে তার টিউটোরিয়াল ক্লাস এবং প্রতিদিনের পরীক্ষায় তার অনুপস্থির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তিনারায়ণ ঘোষ মনোরঞ্জন ঘোষালের বড়ভাই রতন কুমার ঘোষালকে বললেন, মনোরঞ্জন ঘোষাল যেন এমবিএ ছেড়ে কমার্সের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। সএভাবেই তিনি হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে ক্লাস করতে শুরু করেন। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক ভবনে পাঠানোর জন্য বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক শফিউল্লাহকে পাঠানোর অনুরোধ করা হয়। তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করেন।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, একবছর পার হয়ে গেলেও তিনি সেই বিভাগীয় মাইগ্রেশনের কাগজপত্র প্রশাসনিক ভবনে পাঠান নি।যআর ফলে মনোরঞ্জন ঘোষালের শিক্ষা জীবন একবছর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে বছরে তিনি পরীক্ষা দিতে পারেননি। যার ফলে তিনি ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে শিক্ষা সমাপ্তের কথা থাকলেও, তিনি ১৯৭০ থেকে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ যে তিনি ১৯৬৫ সালে রেডিও পাকিস্তান ও পাকিস্তান টেলিভিশনে নজরুল সংগীত এবং আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি পাকিস্তান টেলিভিশনে লাইভ প্রোগ্রাম করেন। বিশিষ্ট সংগীত পরিচালক এবং সুরকার সবদার আলীর পরিচালনায় একটি লোকসংগীত পরিবেশন করেন। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ অনুষ্ঠানটি কেউ দেখতে পারেননি। ঐদিন ঢাকা শহরে ব্লাক আউট ছিলো। ঐদিনই পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে সারা ঢাকা শরে কঠিন ব্লাক আউট পালিত হয়। এমনকি সেদিন মোমবাতি বা হারিকেন জ্বালনো নিষেধ ছিলো।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক পরিচয়ের সাথে তিনি একজন মৃত্যুঞ্জয়ী বীর। ভয়াবহতম নৃশংসতার সাগরকে পারি দিয়ে স্বাধীনতা নামক শব্দটি আজ আমাদের কিভাবে একান্তভাবে আপন হলো; এর বাস্তব জাজ্বল্যমান উদাহরণ হলো আমার ঘোষাল মেসো। পারিবারিকভাবে তিনি আমার মেঝমেসো।১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি সামরিক সরকার আইয়ুব খানের দুঃশাসনবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সময় যোগ দিয়েছিলেন বিক্ষুব্ধ শিল্পীগোষ্ঠীতে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মেসো এবং চট্টগ্রামে মীরেরসরাইয়ের জনপ্রতিনিধি সৈয়দ ফজলুল হক, ডাক্তার মোয়াজ্জেম হোসেন, এম এ জলিল, বাদশা মিয়া, পর্বত প্রমুখের সাথে রাত্রি ১১ টা অব্ধি গাছের গুড়ি, বড় বড় টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিরোধ করে রায়সাহেব বাজারের পুলের মোড়ে। এই অবরোধ করে প্রায় বারোটায় ৪৫, পাটুয়াটুলি ইস্টবেঙ্গল পাবলিশার্সের দোতলার বাসায় চলে আসেন।এর পরে শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ। মেসো তখন তিনতলা সাদের উপরে গিয়ে দেখেন, চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখা এবং কালো ধোয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ঢাকা শহরকে ছেয়ে ফেলেছে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংসতায় মেসোর বড় ভাই রতন কুমার ঘোষালকে শাঁখারি বাজার বাসার দরজাতেই হত্যা করে। মেসো তখন ঘরে ছিলেন না। তাই মাবার ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তাকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলেন। পরবর্তীতে ২৬ মার্চ সকালে বন্ধু কালিদাস ও শান্তিসুধা দাসের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এরপর আরও নিরাপত্তার জন্যে বন্ধু শান্তিসুধা এবং তার বড়ভাই কালিদাস মেসোকে নিয়ে ১০৪ চার নং মতিঝিল গ্লোব চেম্বারে কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলস ও নিশাত জুট মিলের অফিসে থাকা শুরু করে। তাদের পাঠান দারোয়ান তাদের আস্বস্ত করে বলে যে- "আমাকে না মেরে আপনাদের মারতে পারবে না, আপনারা এখানেই থাকুন"। ২৮ তারিখ সকালে সেই বিল্ডিং এর পাঠান দারোয়ানটি জানায়, তিনি আর রক্ষা করতে পারছেন না। তিনি তার সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলেন। এরপরে কালিদাস ও শান্তিসুধা দাস চলে যায় তাদের ১১ নং গোবিন্দ দত্ত লেন লক্ষ্মীবাজারে তাদের বাসায়। আর মেসোও তাদের সাথে তাদের বাসায় যায়। পরবর্তীতে মেসো চলে যায় পুরাণ ঢাকার সতীশ সরকার রোডে পাকিস্তান বুক কর্পোরেশনের সত্ত্বাধিকারী আব্দুল সোবহানের বাড়িতে। মেসো জানতে পারেন যে, তার মা-বাবা, বিধবা বৌদি, তার তিনবছর ও একবছরের দুটি পুত্র সন্তান এবং ছোটবোন মনু সবাই আব্দুল সোবহানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।
২৮ মার্চ আব্দুল সোবহান, শান্তিসুধা দাশ এবং মেসো সদরঘাট টার্মিনালে যেতে মোড়ের মধ্যে পাকিস্তানি সেনা বুকের মধ্যে বন্ধুক তাক করে মেসোকে বলে- "তুম ছালে এতনা বড়া বড়া বাল কিউ রাখা? তুম সালে গুণ্ডা বদমাশ আছ।" তখন শান্তিসুধা দাস পাকিস্তানি সেনা সদস্যকে বলে, "ও গুন্ডা বদমাশ কুছ নেহি, ও ফানকার আছে।" তখন পাকিস্তানি সেনা বলে, " ও ফানকার, তুম ইহাছে ভাগ।" পরে সেখান থেকে তারা বাংলাবাজারের বইয়ের দোকান সামনে দিয়ে যেতে যেতে মেসো শান্তিসুধা দাসকে 'ফানকার' শব্দটির অর্থ জিজ্ঞাসা করে। তখন শান্তিসুধা দাস জানায়, ফানকার শব্দের অর্থ হলো গায়ক। এরপরে মেসো ঋষিকেশ দাস রোডে গিয়ে একেবারে ছোট ছোট করে চুল কেটে ফেলে বন্ধু শান্তিসুধাদের বাড়িতে চলে আসে। ২৮ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ তাদের বাসাতেই থাকে। এরপরে জানা গেলো যে সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের দ্বিতীয় তলায় নিরপেক্ষ নিরাপদ মনে করে পুরাণ ঢাকার অনেক হিন্দু আশ্রয় নিয়েছে। যার মধ্যে মেসোর বন্ধু শান্তিসুধাদের পরিবারের সকলেই ছিলো। কালীদাস এবং তার পরিবারের সদস্যসহ সব মিলিয়ে ৩৩ জন আশ্রয় নিয়েছিলেন। ৩১ মার্চ সকালে মেসো এবং কালিদাস সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে যায়। স্কুলে যাওয়ার অব্যবহিত পরেই তারা শুনতে পারে যে, পাকিস্তানি হানাদাররা সম্পূর্ণ স্কুলটিকে ঘেরাও করে। সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের সিড়িগুলো এবং বারান্দা ছিলো কাঠের। পাকিস্তানি সেনাদের বুটের আওয়াজে এক ভয়ংকর আওয়াজ হচ্ছিলো। সবাইকে ধরে নিচে নামিয়ে স্কুলের খেলার মাঠ সংলগ্ন বারান্দায় হাটুভেঙে নিল ডাউন করে বসতে বলে। তারা ৩৩ জন নিরপরাধ, নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যার উদ্দেশ্যে বন্দুকে গুলি লোড করতে থাকে। সেই সময়ে আমেরিকান বংশদ্ভূত স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলে, "This is a sacred place, you can not do any unholy works here. If you try to do so I must report to US Embassy at Adamjee Court Motijheel."
তখন সেনা সদস্যরা তাক করা বন্ধুক নামিয়ে ফেলে, প্রত্যককে দুইহাত উঁচু করে নিয়ে হাটিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ৩৩ জনকে জগন্নাথ কলেজের ভেতরে নিয়ে আসে।এদের প্রায় সকলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তারা এই ৩৩ জনকে জগন্নাথ কলেজের ২৩ ও ২৪ নং রুমে রাখে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই ২৩ ও ২৪ নম্বর রুম দুটি একটি টিনের সার্টার দিয়ে পার্টিশন করা। টিনের সার্টার উঠিয়ে দিলে, একটি বড় হল রুম।যেখানে কলেজের সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিযোগিতা বিষয়ক অনুষ্ঠান হত। সে রুমে আটকে থাকা অবস্থায় মেসোর মনে হচ্ছিল, "এই ঘরেই আমি সংগীত সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছি, অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ; সেই ঘরেই আমি মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছি।" সারাদিন সবাইকে খাবার জল না দিয়ে ক্ষুধার্ত পেটে রাখে। এমনকি কোন প্রাকৃতিক কর্ম করতেও দেয়া হয়নি। পাশেই ছোট্ট একটি পাঁচিল। পাঁচিলের আড়ালে বিশাল ব্রাহ্মসমাজ মন্দির। এই ব্রাহ্ম সমাজের দুজন ব্যক্তি মনোরঞ্জন চক্রবর্ত্তী এবং হরিরঞ্জন চক্রবর্ত্তী নামক দুইভাই মেসোদের সাথেই বন্দি।মনোরঞ্জন চক্রবর্ত্তীর নিকট খাজা খয়েরুদ্দিন স্বাক্ষরিত একটি পাকিস্তানি পন্থী প্রশংসাপত্র ছিলো। তারা প্রকৃত পাকিস্তানি নাগরিক এই মর্মে প্রত্যয়ন ছিলো। সেই প্রত্যয়নপত্রে তিনজনের নাম ছিলো। এর দুইভাই ছাড়া আরও একজনের নাম ছিলো। মনোরঞ্জন চক্রবর্ত্তী মেসোকে সেই অনুপস্থিত ব্যক্তির নাম বলতে বলে। কিন্তু মেসো পাকিস্তানি প্রত্যয়নপত্র দেখিয়ে বাঁচার বিষয়টি দৃঢ়চিত্তে প্রত্যাখ্যান করে। দফায় দফায় পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা এসে প্রত্যেকের পুরুষাঙ্গ পরীক্ষা করে দেখে। সাথে তাদের কলেমা পড়তে বলে।
ধর্ম নিশ্চিত করতে মেসোকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে তিনবার প্যান্ট খুলে পুরুষাঙ্গ পরীক্ষা করে। কলেমা পড়তে বলে।
সন্ধ্যা সাতটার পরে দুই কক্ষ থেকে বের করে তদের কিছুদূর হেঁটে নিয়ে এসে লাইনে দাঁড় করানো হয়। চোখ বেঁধে ফেলা হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সকলের উপরে নৃশংসভাবে ব্রাশফায়ার করা হয়। সকলেই মৃত্যুবরণ করেন। নিহতদের প্রায় সকলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পাকিস্তানি বাহিনীর এই নৃশংস ব্রাশফায়ারে ৩৩ জনের মধ্যে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মেসো। তিনি ব্যক্তিগত পারিবারিক আলাপে আমাকে বলেছিলেন, যখন তাদের হত্যার জন্য ব্রাশফায়ার করা হচ্ছিলো তখন মাকালী তাকে মৃত্যুমুখ থেকে রক্ষা করছে এমনটি তার মনে হচ্ছলো তখন।৩৩টি মৃতদেহের মধ্য থেকে মৃত্যুঞ্জয়ীর মনোরঞ্জন ঘোষাল মেসোর রোমহর্ষক কাহিনী দেশের প্রায় সকল পত্রিকাতেই বিভিন্ন সময়ে ছাপা হয়। মৃত্যু থেকে ১ সেকেন্ড দূরে থেকে মৃত্যুর ভয়ংকরতম স্বরূপ দেখেছিলেন তিনি। তার নিজের মুখের স্মৃতিচারণে সেদিনগুলোর দুর্বিষহ স্মৃতি ধরা পরে।
"যখন প্রথম চেতনা ফিরে পেলাম, বুঝতে পারলাম শরীরের ওপর ভীষণ চাপ। পায়ের দিকে একটা গরম অনুভব। অন্ধকারেও বেশ বুঝতে পারি, আমার শরীরের ওপর আসলে পড়ে আছে একাধিক নিথর মানবদেহ। লাশের স্তূপের মধ্যে পড়ে আছি আমি। কোনোরকমে উঠে বসার চেষ্টা করি। অনেক কষ্ট করে দাঁত দিয়ে হাতের দড়ি কাটলাম। এরপর চোখের বাঁধনও খুলে ফেলি। জমাট অন্ধকারে নিজের গায়ে চিমটি কেটে বুঝতে পারি, সত্যিই বেঁচে আছি। পায়ের কাছে গরম টগবগ রক্তের ছোঁয়া ('মৃত্যুঞ্জয়ী মনোরঞ্জনের গল্প' সমকাল, ২৫ মার্চ ২০১৮)।"
মৃতদেহের স্তুপে চোখ খোলার পরে তিনি বুঝতে পারলেন, বড় একটা গর্তের মধ্যে অন্য তিনি।অনেক লাশের সঙ্গে তেকেও মৃত ভেবে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ভাগ্য ভাল যে, সেই গর্তে মাটিচাপা দেয়া হয়নি। এরপরে শুরু হয় তার গর্ত থেকে ওপরে ওঠার যুদ্ধ। জীবন রক্ষার যুদ্ধ। গর্তের দেয়ালে হাত রেখে মাটিতে ভর দিয়ে বারবার উঠতে চেষ্টা করেও অসমর্থ জীবন্মৃত শরীরে বারবার নিচে পড়ে যান তিনি। অবশেষে যখন কোনমতে গর্ত থেকে উপরে উঠতে সমর্থ হন। সেই সময়ে পাশের গির্জা থেকে ঘণ্টার আওয়াজ আসছিলো। তিনি বুঝতে পারেন, তিনি জগন্নাথ কলেজের পাশ্ববর্তী জজকোর্ট ভবনের মধ্যে আছেন। এই ঘটনাটির বর্ণনা মুক্তিযুদ্ধের উপরে বিখ্যাত গ্রন্থ '৭১ এর দশমাস' নামক গ্রন্থেও রয়েছে। গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর লেখা।
"—জগন্নাথ কলেজ সংলগ্ন পরিত্যক্ত ভবনে বাঙ্গালী, শিক্ষক, শিল্পী, ব্যরিষ্টার ও হোটেল কর্মচারী সহ ৮৮ জনকে নির্মম ভাবে পাক বাহিনী হত্যা করে। স্থানীয় বিউটি বোডিং প্যারিদাস রোড, ফরাশগঞ্জ, বাংলাবাজার ও শাখারী বাজার থেকে এসব হতভাগ্যদের ধরে আনে পাকসেনারা। জনৈক মনোরঞ্জন ঘোষাল নামে একজন অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তিনি পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেন।
—ঢাকা রেডিও ও সামরিক কর্তৃপক্ষের বরাদ দিয়ে বলা হয় সকাল ৮–১২টা পযর্ন্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করা হয়। ঢাকা শহরে কবরের নিস্তব্ধতা চলছে। ইংলিশ রোডে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আগুনে পোড়া বিকৃত শত-শত লাশ ও আগুনের ধোয়া তখন গণহত্যা ও ধ্বংসের স্বাক্ষর বহন করছিল।"
(রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, ১৯৯৭: ৮৭)
ভাবতে অবাক লাগে পাকিস্তানীরা কতটা অসভ্য যে, কোর্টের মতো স্থানেও তারা গণহত্যা করেছিল।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বড় ভাই রতন ঘোষালের পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে মৃত্যুর শোক ভুলতে না ভুলতেই, ১৬ ডিসেম্বর দেশে এসে জানতে পারেন, অসভ্য পাকিস্তানীরা তার আদরের ছোট ভাই মদন ঘোষালকেও হত্যা করেছে নির্মমভাবে।মদন ঘোষালকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার লাশ কপোতাক্ষ নদে ফেলে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানিরা এদেশের মানুষকে হত্যা করে, মৃতদেত নদীতে ফেলে দিতো। যেন কেউ সে মৃতদেহ খুঁজে না পায়।
তথ্য সহায়তা:
১. সমকাল পত্রিকা, ২৫ মার্চ ২০১৮
২. রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, '৭১ এর দশমাস', কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা: প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৭
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
৩৩ টি মৃতদেহের মধ্যে বেঁচে ওঠা মৃত্যুঞ্জয়ী বীর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী শব্দসৈনিক মনোরঞ্জন ঘোষাল মেসোর আজ জন্মদিন। জন্মদিনে মেসো তোমাকে অনেক অনেক শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা। জীবনে অনেক কিছুই শিখেছি তোমার থেকে। তুমি আমাদের প্রেরণার। তুমি শতবছর বেঁচে থাক এই শুভকামনা করি।