একটা প্রবাদ আছে, "আপনা হাত জগন্নাথ।" মানুষ তার নিজের শক্তিতেই শক্তিমান। জীবন চলার পথে কেউ উৎসাহিত করতে পারে, প্রেরণাপ্রদীপ্ত করতে পারে কিন্তু দিনশেষে নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয় এবং সে কাজের ভাল মন্দ কর্মফল নিজেকেই ভোগ করতে হয়।জীবনে আত্মবিশ্বাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ আত্মবিশ্বাস এবং প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি মানুষের জীবনের অনেক অসাধ্যকে সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসে। আমাদের প্রত্যেকের দেহের মধ্যে স্রষ্টা জীবাত্মা রূপে বিরাজিত। এটা আমাদের মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে নির্ভীক হতে হবে। লক্ষ্যটা অনেক বড় হতে হবে, হিমালয়ের মত বৃহৎ হতে হবে। জগতের সকল মানবের মধ্যেই অনন্ত শক্তি আছে, কেউ সে শক্তিকে জাগরিত করতে পারে কেউ হয়ত পারে না। তাই নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কখনো হীনমন্য হতে নেই। অনেক বড় বড় সফল ব্যক্তির জীবনে দেখা যায় তাদের জীবনের সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা এবং প্রতিবন্ধকতাই তাদের সফল করেছে স্বাতন্ত্র্য করেছে; শুধু ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা তাদের তীব্রতর ছিল। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন:
"তুমি যাহা চিন্তা করিবে, তাহাই হইয়া যাইবে। যদি তুমি নিজেকে দুর্বল ভাব, তবে দুর্বল হইবে। তেজস্বী ভাবিলে তেজস্বী হইবে।"(স্বামী বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা :৫,২৭)
আত্মবিশ্বাসের কথাগুলো আমরা প্রতিনিয়ত শুনি, তবে খুব একটা বিশ্বাস করিনা। বিষয়টি নিয়ে অন্যকে উপদেশ দিতে গিয়ে জ্ঞানের প্রয়োগ করি সত্য। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ঘটনাগুলো যখন নিজের জীবনে ঘটে, তখন আমরা হতবিহ্বল বা শোকবিহ্বল হয়ে যাই। অনুপ্রেরণার গ্রন্থগত কথাগুলো সময়কালে কাজে লাগে না। কারণ, আমরা কথাগুলোকে গভীর থেকে গ্রহণ করে আমাদের ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগ করিনা। ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগে উপলব্ধি করতে পারব, আত্মবিশ্বাসের অন্তর্নিহিত শক্তি। আমরা হয়ত অনেকেই জানি না আমাদের সকলের মধ্যে এক একটা ঘুমন্ত সিংহ আছে, কেউ তাকে জাগিয়ে তুলতে পারি, কেউ হয়ত পারিনা। সিংহ ক্ষুধার্ত থাকলেও কারো কাছে খাবার প্রার্থনা করে না, তেমনি উত্তম ব্যক্তিও ধনহীন থাকলেও অন্যায় করেন না। তার ব্যক্তিগত পারিবারিক সংস্কারে বাঁধে। তার ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলেন না।সাময়িক তার বিপদ হলেও এ বিপদ তার নিমেষেই কেটে যায় ফুটবলের মত। উপর থেকে ফুটবলকে নিক্ষিপ্ত করা হলে, ফুটবল লাফিয়ে লাফিয়ে যেখান থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে সেখানে চলে যায়। কিন্তু দুর্জনের ক্ষেত্রে হয় লোহার গোলকের মত উল্টো। লোহার গোলক একবার মাটিতে নিক্ষিপ্ত হলে আর নিজে নিজে উঠতে পারে না। অন্যদের গোলকটিকে টেনে তুলতে হয়। বিষয়টি গরুড়পুরাণে অত্যন্ত সুন্দর করে বলা আছে:
বনেঽপি সিংহা ন নমন্তি কর্ণংবুভুক্ষিতা মাংসনিরীক্ষণঞ্চ।ধনৈবিহীনাঃ সুকুলেষু জাতান নীচকর্মাণি সমারভন্তি।।(গরুড়পুরাণ: পূর্বখণ্ড, ১১৫ অধ্যায়, ১৪)
"বনবাসী সিংহ ক্ষুধার্ত হয়ে কখনও কারো কাছে মাথা নত করে খাদ্য প্রার্থনা করে না, কিংবা ক্ষুধার্ত অবস্থায় মাথা অবনত করে আপন বাহুমূল সারাক্ষণ নিরীক্ষণ করে না। তেমনি উত্তম ব্যক্তি ধনহীন হলেও, তার ব্যক্তিত্বের কারণে কখনও নীচ কর্মে প্রবৃত্ত হয় না।"
জগতে ক্ষমতা কেউ কাউকে এমনি দেয় না, নিজের অর্জন করে নিতে হয়। এ কারণেই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকে এখনও অনেক রাজ পরিবারেই দেখা যায়, ক্ষমতার জন্যে ভাইয়ে ভাইয়ে, বাবা সন্তানের দ্বন্দ্ব। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং তার পিতা শাহজাহান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বনের সিংহকে কেউ অভিষেক সংস্কার করে দেয় না, তার স্বোপার্জিত ক্ষমতাই তাকে বনের রাজা করে । ছত্রপতি শিবাজি কোন বৃহৎ সাম্রাজ্যের রাজা ছিলেন না, তার সাহস যোগ্যতা এবং আত্মবিশ্বাস তাকে বৃহৎ মারাঠা সাম্রাজ্যের রাজা করে তুলেছিল। আমরা হাজার পাওয়ারের লাইটের আলোর মত রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী কাউকে দেখলে মনে করি আমার তো হাজার পাওয়ারের হওয়া সম্ভব নয়, অথবা তার কাছাকাছিও হওয়া সম্ভব নয়; তাহলে আমার দ্বারা বোধহয় আর কিছুই করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এ হাজার পাওয়ারের শক্তিশালী মানুষটির আশেপাশে থেকেও আমার ক্ষুদ্র সার্মথ্য অনুসারে আমার শক্তির অস্তিত্বের জানান দিতে পারি, যদি মনে আত্মবিশ্বাস থাকে। হাজার পাওয়ারের লাইটের পাশে যদি আমি লাল নীল রঙিন লাইট হয়ে জ্বলজ্বল করতে পারি, তবে আমি ৫০ ওয়ার্টের লাইট হলেও আমার দিকে সবার দৃষ্টি পড়বে। অথবা লাইটটি যদি একবার জ্বলছে, আবার নিভে যাচ্ছে ; আবার জ্বলছে এমন হয় তবে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ হবেই হবে। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিংহের মত স্বাতন্ত্র্যবোধ দিয়ে যদি নিজের চলার পথকে আত্মবিশ্বাস দিয়ে পূর্ণ করতে পারি তবে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে আমরা এগিয়ে যাবই যাব। হতাশ হওয়ার কিছুই নেই। গরুড় পুরাণে প্রাসঙ্গিক অনন্য সুন্দর একটি শ্লোক আছে:
নাভিষেকো ন সংস্কারঃ সিংহস্য ক্রিয়তে বনে।নিত্যমূজ্জিতসত্ত্বস্য স্বয়মেব মৃগেন্দ্রতা।।(গরুড়পুরাণ: পূর্বখণ্ড, ১১৫ অধ্যায়,১৫)
"সিংহ বনে বাস করে। বনে তাকে কোন আনুষ্ঠানিক অভিষেক বা সংস্কার না করলেও সে তার আপন শক্তিবলেই বনের রাজা।"
আমরা পথ চলতে হতাশ হয়ে যাই, ভাবি এইবুঝি আমার সব শেষ হয়ে গেল। আমাকে দিয়ে আর কিছুই হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এটা বুঝি না, জীবন নাট্যমঞ্চের চলার পথটি পুষ্পসজ্জিত নয়, বিভিন্ন স্থানেই আছে কণ্টকাকীর্ণ বাঁক। এ বাঁকগুলিকে সফলভাবে আত্মশক্তিকে সহায় করেই পারি দেয়াই জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। প্রবাদ আছে যে হাতি যেন নিজের দেহ নিজে ঠিকমত দেখতে না পারে, তাই তার কুলার মত বৃহৎ কান। হাতি যদি নিজের দেহ নিজে দেখতো তাহলে তাকে আর পোষ মানানো সম্ভব ছিল না। সে বেপরোয়া হয়ে যেত। আমরাও আমাদের ভেতরের অন্তঃস্থিত শক্তিকে দেখি না, উপলব্ধি করি না; জানতেও পারি না, জানার চেষ্টাও করি না। তাই অধিকাংশ সময়ে হতাশ হয়ে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই। এক্ষেত্রে জীবনে নিজের প্রতি বিশ্বাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ্যে বাধা যতই কঠিন হোক, হ্যাঁ আমি বাঁধা অতিক্রম করতে পারব -এ তীব্র আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে, তবেই বাঁধা অতিক্রম করতে পারব।স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন :
"যে নিজেকে বিশ্বাস করে না, সে-ই নাস্তিক। প্রাচীন ধর্ম বলিতঃ যে ঈশ্বর বিশ্বাস করে না, সে নাস্তিক। নূতন ধর্ম বলিতেছেঃ যে নিজেকে বিশ্বাস করে না, সে-ই নাস্তিক।" ( স্বামী বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা:২,২৩০)
সর্বদা নিজের মধ্যে,"স্বয়মেব মৃগেন্দ্রতা" ধারণ করতে হবে। তবেই আমি সমাজ সংসারে প্রতিষ্ঠিত হতে পারব। পথে বাঁধা থাকবে, দুঃখ বেদনা থাকবে, আবার সে সকল অতিক্রমও করতে হবে। থেমে গেলে চলবে না।আমরা বাঙালিরা যখন অতিথিকে খাবার পরিবেশন করি, আমাদের খাবার পাতে প্রথমে থাকে করলা ভাজা, এর পরে মাছ, মাংস, ডাল ইত্যাদি । কিন্তু প্রথমেই যদি তিতা করলা দেখে হতাশ হয়ে কেউ খাবার ছেড়ে উঠে যায়, সে হয়ত জানতেও পারবে না যে খাবারের শেষপাতে টকচাটনি, দই-মিষ্টি বা রসগোল্লা আছে। শেষপাত পর্যন্ত যারা অপেক্ষা করেছে, তারা সকলেই সুস্বাদু রসগোল্লা পেয়েছে। তেমনি ভগবান প্রত্যেকটি মানুষের জন্যেই শেষপাতে রসগোল্লা রেখেছেন, এ বিশ্বাসটি রেখে নিষ্কামভাবে নিজের নিদিষ্ট করনীয় দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। তবেই আমাদের ভেতরের অন্তঃস্থিত আত্মশক্তির সিংহ জেগে উঠে হুংকার দিয়ে নিজের অনন্যতা জগতকে জানাবে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।