মহাত্মা_অশ্বিনীকুমার_দত্ত বরিশালের গৌরনদীর বাটাজোর গ্রামে ১৮৫৬ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান বাঙালি রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক এবং লেখক।তার পিতা ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সাব-জজ ব্রজমোহন দত্ত। মা প্রসন্নময়ী ছিলেন বানরীপাড়ার বনেদি পরিবারের রাধাকিশোর গুহের কন্যা। তাঁর পিতামাতা উভয়ই ছিলেন সৎ, নিষ্ঠাবান এবং দেশপ্রেমিক।
আজ বরিশালে জন্ম নেয়া কিছু বংশীয় অকৃতজ্ঞদের সম্পর্কে বলতে চাই। আমারও জন্ম বরিশালে, তাই বিবেকের তাড়নায় মনে হচ্ছে আমার এ বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। যিনি আধুনিক বরিশালের রূপকার; যাঁর বাড়িটি ছিল বিপ্লবী স্বদেশীদের তীর্থভূমি; তাঁর বাড়ির তমাল গাছের তলায় বরিশালের রাজনীতি সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়েছে; সেই মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের বিরোধিতা করছে তাঁর জন্মভূমি বরিশালের উত্তরপুরুষেরা। বিষয়টি অকল্পনীয়। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী বরিশালে এসে অশ্বিনীকুমার দত্তকে অদ্বিতীয় নেতা হিসেবে, 'মহাত্মা' বলে সম্বোধন করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। অথচ তাঁর নিজভূমি বরিশালের কিছু অকৃতজ্ঞ মানুষেরাই, তাঁকে অসম্মানিত করতে তাঁর নামে কলেজের নামকরণে আপত্তি জানাচ্ছে। বিষয়টি দুঃখজনক এবং অপমানকর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়:
"হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!"
কোলকাতায় আশ্বিনীকুমার দত্তের মৃত্যুর পর তাঁর ভাইয়ের ছেলে সরল দত্ত ছোট কালীবাড়ি রোডের বাড়িতে বসবাস করতেন। বর্তমানে বাড়িটিকে সরকারি বরিশাল কলেজে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সরল দত্ত দেশ থেকে চলে যাবার সময় এই বাড়িটি ব্রজমোহন কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে দান করে যান। ১৯৬৭ পর্যন্ত বাড়িটি ব্রজমোহন কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবেই ব্যবহৃত হত। দুই তলায়ই ছাত্র থাকতো আর উপরে চিলেকোঠা সংলগ্ন কক্ষদ্বয় ব্যবহৃত হতো ছাত্রবাসের তত্বাবধায়কের আবাস হিসেবে।
১৯৬৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ব্রজমোহন (বিএম) স্কুলের একটি ভবনে বরিশাল নাইট কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ১৯৬৬ সালে ছোট কালীবাড়ি রোডে অবস্থিত অশ্বিনী কুমার দত্তের বসত বাড়িতে কলেজটি স্থানান্তরিত করা হয়। এরশাদ শাসনামলে ১৯৮৬ সালের ১৪ নভেম্বর কলেজটি জাতীয়করণ করা হয়। বরিশাল নাইট কলেজের পরিবর্তে কলেজটির নামকরণ হয়, 'সরকারি বরিশাল কলেজ।' তখন বরিশালের সর্বস্তরের মানুষ চেয়েছিলেন, মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের অধিকাংশ দানই তাঁর পিতার নামে। তাই তাঁর নিজবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত কলেজটি মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের নামেই হোক। সর্বস্তরের মানুষের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, সে সময়ে সামরিক শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কেউ তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু তখন থেকেই দাবিটি বরিশালের বিভিন্ন পর্যায়ে বারে বারে উত্থাপিত হয়ে আসছে।
বরিশালের সাংস্কৃতিক কর্মী সহ বিভিন্ন স্তরের প্রগতিশীল চিন্তার মানুষের দাবির প্রেক্ষাপটে বরিশাল জেলা প্রশাসক সরকারি বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের নামে নামকরণের করার প্রস্তাবটি গ্রহণ করে।কারণ সরকারি বরিশাল কলেজের সাথে, বরিশালের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের স্মৃতি। সারা বরিশাল জুড়েই আছে তাঁর দান।সে স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে এ উদ্যোগ নেয়া হয়।
২০১২ সালে তৎকালিন সংসদ সদস্য বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুস জাতীয় সংসদে সরকারি বরিশাল কলেজকে “মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত সরকারি কলেজ” নামকরণের প্রস্তাব করে। এরই ধারাবাহিকতায় বরিশালের জেলা প্রশাসক গত ২৯.০২.২০২০ তারিখে সরকারি বরিশাল কলেজকে “মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত সরকারি কলেজ” নামকরণের প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। গত ২৯.০৬.২০২০ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরিশাল শিক্ষাবোর্ডকে সরকারি বরিশাল কলেজকে “মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত সরকারি কলেজ” নামকরণের যৌক্তিকতা উল্লেখ করে সুপারিশ প্রেরণ করে। এতেই শুরু হয়ে যায় বরিশালে জন্ম নেয়া কিছু অকৃতজ্ঞের কাণ্ডজ্ঞানহীন বিরোধিতা। যার নেপথ্যে আছে, নিজস্বার্থে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইন্ধন।
যাঁর বসতবাড়ি তাঁর নামে করার প্রতিবাদে সরকারি বরিশাল কলেজের নাম অপরিবর্তন রেখে মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের নামের প্রস্তাবনা বাতিল করার দাবীতে বরিশাল নগরীতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ কিছু অকৃতজ্ঞ মৌলবাদী। লোকদেখানো প্রগতিশীল হলেও, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়; এদের অনেকেরই মননে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা আজও বাস করে। গত শনিবার (১১.০৭.২০২০) বেলা ১১টায় নগরীর অশ্বিনীকুমার টাউন হলের সামনে সরকারি বরিশাল কলেজের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এই মানববন্ধন কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়।এতে বরিশাল মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগ নেতা আসলাম তালুকদার অনিকের সভাপতিত্বে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাড. একে এম জাহাঙ্গীর হোসাইন।এসময় বক্তারা সরকারি বরিশাল কলেজ প্রতিষ্ঠায় মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের কোনো ভূমিকা নেই বলে হাস্যকর দাবি করেন। ভাবা যায় কতবড় মিথ্যাবাদী এরা? যাঁর বসতবাড়িতে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত, তাঁরই নাকি কোন ভূমিকা নেই! এ অকৃতজ্ঞরা মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের নামকরণের বিরুদ্ধে, মানববন্ধন যে স্থানে করেছে এবং বক্তব্যগুলো যে স্থানে দাড়িয়ে দিয়েছে, সেই টাউন হলটিও স্বয়ং অশ্বিনী কুমার দত্তের করা।
'হ্যালো বরিশাল ডট কম' অনলাইন নিউজ সূত্রে জানা যায়,মানববন্ধনে একাত্মতা প্রকাশ করে উপস্থিত ছিলেন, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হেমায়েত উদ্দিন সেরনিয়াবাত সুমন, মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা হাসান মাহামুদ বাবু, যুবলীগ নেতা কাউন্সিলর শেখ সাঈদ আহমেদ মান্না, জেলা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত, আতিকুল্লাহ মুনিম, সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব হোসেন খান, সরকারি বরিশাল কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রেজাউল করিম রেজা, রাসেল হোসেন, আরিয়ন হৃদয়, কিসমত শাহরিয়ার হৃদয়, আরিফুর রহমান মামুন, মহানগর ছাত্রলীগের নেতা রইজ আহমেদ মান্না, আশিক, শ্রাবণ প্রমুখ।
এ অকৃতজ্ঞদের কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানে বাংলা নাম দেখলে তাদের দিলে চোট লাগে। এ মূর্খের দলই কয়েকদশক আগে ব্রজমোহন কলেজের সামনে মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের একটি ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে ঘৃণ্য আন্দোলন করে। ওরা জানে না, এ সকল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ওরা বরিশালের শ্বাশত চিরায়ত আত্মাকেই ক্ষতবিক্ষত করেছে।প্রগতিশীল রাজনীতির ছত্রছায়ায় থেকে এভাবে একটি সাম্প্রদায়িক মনন নিয়ে যারা ঘৃণা ছড়াচ্ছে, এদের আমাদের চিনে রাখা দরকার। এ সকল অসাম্প্রদায়িক ভানধরা মৌলবাদীরা ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সহ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পরিপন্থী। সম্মিলিতভাবে এদের প্রতিরোধ করা প্রয়োজন; তা না হলে এরা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির বহু বিষয় নিজেদের বিকৃতমস্তিষ্ক চিন্তা ভাবনা দ্বারা দিনেদিনে দূষিত অপবিত্র করে দিবে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।