-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

একাদশী পালনের শাস্ত্রীয় বিধি।

একাদশীর কথা বেদের কোথাও না থাকলেও বিভিন্ন পুরাণে এর সম্পর্কে বলা আছে। শাক্ত,শৈব,বৈষ্ণব মোটামুটি প্রায় সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই একাদশী পালনের রীতি দেখা যায়। শুক্ল-কৃষ্ণ প্রতি পক্ষের একাদশী তিথিতে অনুষ্ঠিত একাদশী একটি পবিত্র ব্রত। শাস্ত্রে বিভিন্ন প্রকার ব্রতের কথা আছে, এর মধ্যে একাদশী অন্যতম। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে একাদশীর প্রচলন সর্বাধিক। শ্রাদ্ধে যেমন মুখ্যকর্ম হল দান, তেমনি একাদশী ব্রতে মুখ্যকর্মই হল উপবাস এবং সংযম। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে একাদশী পালনের বিধিনিষেধ। অবশ্য ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ বঙ্গের বৈষ্ণবদের খুব আদরণীয় গ্রন্থ হলেও, বর্তমানে এ পুরাণে বর্ণিত একাদশী বিধির সম্পূর্ণ বিষয়গুলো খুব কমই বঙ্গদেশে অনুসরণ করতে দেখা যায়। একাদশী বিধি সম্পর্কে সেখানে বলা আছে:

কৃত্বা হবিষ্যং পূর্ব্বাহ্ণে ন চ ভুঙেক্ত পুনর্জ্জলম্।
একাকী কুশশয্যায়াং নক্তং শয়নমাচরেৎ।।
ব্রাহ্ম্যে মুহূর্ত্ত উত্থায় প্রাতঃকৃত্যং বিধায় চ।
নিত্যকৃত্যং বিধায়াথ ততঃ স্নানং সমাচরেৎ।।
ব্রতোপবাসসঙ্কল্পং শ্রীকৃষ্ণপ্রীতিপূর্বকম্।
কৃত্বা সন্ধ্যাতপর্ণঞ্চ বিধায়াহ্নিকমাচরেৎ।।
নিত্যপূজাং দিনে কৃত্বা ব্রতদ্রব্যং সমাহরেৎ।
দ্রব্যং ষোড়শোপচারং প্রকৃষ্টং বিধিবোধিতম্।।
আসনং বসনং পাদ্যমর্ঘ্যং পুষ্পানুলেপনম্।
ধূপদীপঞ্চ নৈবেদ্যং যজ্ঞসূত্রঞ্চ ভূষণম্।।
গন্ধস্নানীয়তাম্বূলং মধুপর্কঃ পুনর্জলম্।
ত্রতান্যাহৃত্য দিবসে ব্রতং নক্তং সমাচরেৎ।।
উপবিশ্যাসনে পূতো ধৃত্বা ধৌতে চ বাসসী।
আচম্য শ্রীহরিং স্মৃত্বা স্বস্তিবাচনমাচরেৎ।।
আরোপ্য মঙ্গলঘটং ধান্যধারে শুভক্ষণে।
ফলশাখাচন্দনাক্তং বেদোক্তং মুনিভির্মুদা।।
দেবষট্ কং সমাবাহ্য পৃথগদ্ধ্যানৈঃ সমর্চ্চয়েৎ।
পূজাং পঞ্চোপচারেণ প্রকৃষ্টেন বিচক্ষণঃ।।
গণেশ্বরং দিনকরং বহ্নিং বিষ্ণু শিবং শিবাম্।
সম্পূজ্য তান্ প্রণম্যাথ ব্রতং কুর্য্যাদ্ধরিং স্মরণ্।।
নারাধ্য দেবষট্ কঞ্চ যদি কর্ম সমাচরেৎ।
নিত্যং নৈমিত্তিকং বাপি তং সর্বং নিষ্ফলং ভবেৎ।।
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ :শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড,২৬ অধ্যায়, ৪১-৫১)
"ব্রতী পূর্বাহ্ণে হবিষ্য করে, সেদিন আর জল পর্যন্তও পান করবে না; এরপরে রাত্রে একাকী কুশশয্যায় শয়ন করবে।পরদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যা হতে উত্থান করে প্রাতঃকৃত্য সমাপন করে, নিত্যকৃত্য সম্পাদনপূর্বক স্নান করবে। ব্রতী, ব্রত ও উপবাসের সংকল্প ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রীতির উদ্দেশ্যে করে, এরপরে সন্ধ্যা-তর্পণাদি সম্পাদন করে আহ্নিক করবে।নিত্যপূজা সম্পাদন করে দিনের মধ্যেই ব্রতদ্রব্য আহরণ করবে ; এতে ষোড়শোপচার দ্রব্যই প্রকৃত বিধিনির্দিষ্ট। আসন,বস্ত্র, পাদ্য,অর্ঘ্য, পুষ্প, অনুলেপন, ধূপ,দীপ,নৈবেদ্য,যজ্ঞসূত্র, ভূষণ,গন্ধ, স্নানীয়, তাম্বূল, মধুপর্ক এবং আচমনীয় ; ব্রতী এ ষোড়শোপচারের দ্রব্য সকল দিবসে আহরণ করে রাত্রিতে ব্রত করবে।এরপরে ব্রতী ধৌত পরিষ্কার বস্ত্রযুগল পরিধান করে পবিত্রভাবে আসনে উপবেশন করে আচমনপূর্বক শ্রীহরিস্মরণ ও স্বস্তিবাচন করবে।তৎপরে শুভক্ষণে ধ্যানাধারে মুনিগণ দ্বারা বেদোক্ত মঙ্গলঘট স্থাপন করে তাতে ফল,শাখা ও চন্দন প্রদান করবে।সেই ঘটে পৃথক পৃথক ধ্যান ও আবাহনে ছয় দেবতাকে পূজা করবে।ছয় দেবতারা হলেন: গণেশ, সূর্য,বহ্নি, বিষ্ণু,শিব ও শিবা। এ ছয়দেবতাকে পূজা করে প্রণামপূর্বক হরি স্মরণ করে ব্রত করবে; যদি কেহ এ ছয়দেবতাকে আরাধনা না করে ব্রতকর্ম করে, তা হলে তার নিত্য নৈমিত্তিকাদি সমস্ত কর্মই নিষ্ফল হয়।"
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে একাদশী ব্রতের শুরু হয়, একাদশীর পূর্বদিন দশমী তিথি থেকে। সেদিন পূর্বাহ্নে আমিষ বর্জিত ঘৃতযুক্ত আতপ চালের অন্ন একবেলা খেতে হয়। এরপরে আর কিছুই খাওয়া যাবে না। এমনকি জলও না।
সেদিন স্ত্রীসহ শয়ন করা যাবে না, খাটেও শয়ন করা যাবে না; কুশশয্যায় একাকী শয়ন করতে হবে।
একাদশীর দিনে সূর্যোদয়ের দুইদণ্ড পূর্বে (৪৮ মিনিট), ব্রাহ্মমুহূর্তে কুশশয্যা থেকে উঠে প্রতিদিনের প্রাতঃকৃত্য নিত্যকৃত্য শেষ করে স্নান করতে হবে।
আমরা অনেকেই জানি না যে, পূজা ব্রত এবং যজ্ঞের পূর্বে সংকল্প করতে হয়। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হয়, হে ভগবান আমি যেন ব্রতটি সম্পূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পারি। ব্রতভ্রষ্ট যেন না হই। শ্রীকৃষ্ণের প্রীতির জন্যে ব্রতী, একাদশী ব্রত ও উপবাসের সংকল্প করবে।
এরপরে বৈদিক গায়ত্রী সন্ধ্যা-তর্পণাদি সম্পাদন করে আহ্নিক করতে হবে। সাথে গৃহের দেববিগ্রহের নিত্যপূজা নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করতে হবে।
একাদশীর মধ্যেই ব্রতদ্রব্য সংগ্রহ করতে হবে। ষোড়শোপচারে দেবতাদের পূজা করতে ষোড়শোপচার দ্রব্যই বিধিনির্দিষ্ট হয়ে আছে। এ পবিত্র দ্রব্যগুলো হল: আসন, বস্ত্র, পাদ্য, অর্ঘ্য, পুষ্প, গায়ের সুগন্ধি অনুলেপন, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, যজ্ঞসূত্র, ভূষণ,গন্ধ,স্নানীয়, পান, মধুপর্ক(ঘি, মধু,দধি, দুধ এবং চিনি) এবং আচমনীয়। রাত্রিকালে সম্পন্ন ব্রতের জন্যে ব্রতীকে এ ষোড়শোপচারের সকল দ্রব্য দিবসেই সংগ্রহ করতে হবে।
এরপরে ব্রতী পরিষ্কার পরিছন্ন হয়ে পরিধেয় এবং উত্তরীয় এ দু'টি বস্ত্র শরীরে পরিধান করবে। শুদ্ধ পবিত্রভাবে আসনে উপবেশন করে আচমনপূর্বক শ্রীহরিস্মরণ ও বৈদিক স্বস্তিবাচন করবে।
আচমনপূর্বক শ্রীহরিস্মরণ ও বৈদিক স্বস্তিবাচনের পরে মুনিগণ দ্বারা নির্দেশিত, পরমেশ্বরকে আহ্বান করতে বেদোক্ত মঙ্গলঘট স্থাপন করে; তাতে একটি অক্ষত ফল, আমের পল্লব সহ বিভিন্ন পবিত্র বৃক্ষের শাখা ও চন্দন শ্রদ্ধার সাথে প্রদান করবে।
মঙ্গলঘটে পৃথক পৃথক ধ্যান ও আবাহনে গণেশ, সূর্য,বহ্নি, বিষ্ণু,শিব ও শিবা -এ ছয়দেবতাকে নিষ্ঠার সাথে পূজা করতে হবে। সনাতন ধর্মে অনাদি অনন্ত ব্রহ্মের উপাসনা পঞ্চমতে ও পথে বিভজিত যথা- শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য এবং বৈষ্ণব -এ পঞ্চমতের প্রধান হল এ পঞ্চদেবতা। তাঁদের একইঘটে আহ্বান করতে হবে, কারণ তাঁরা সকলেই একই পরমেশ্বরের স্বরূপ। বিভিন্ন মতপথ নির্বিশেষে আমরা যে একজনকেই উপাসনা করি, বিষয়টি বোঝাতেই আমাদের সকল পূজার আগেই পঞ্চদেবতার পূজা করা হয়। এমনকি শ্রাদ্ধ, বিবাহ, একাদশী সহ সকল ব্রতেই পঞ্চদেবতার পূজা আগে করতে হয়। যেন আমাদের মধ্যে এক ব্রহ্মের অভেদ চিন্তা আসে। যজ্ঞস্বরূপ অগ্নিকে বলা হয়েছে, সকল দেবতার মুখ। পঞ্চদেবতার সকল পূজাতেই যজ্ঞ করতে হয়। তাই পঞ্চদেবতার সাথে যজ্ঞস্বরূপ অগ্নিকে ধরে ছয়দেবতা। বর্তমান কিছু সনাতন ধর্মাবলম্বী অজ্ঞানতাবশত নিজের উপাস্য এবং নিজ সম্প্রদায়কে বড় করতে গিয়ে ঈশ্বরের পঞ্চরূপের এ পঞ্চদেবতার মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করে থাকে। তারা নিজেরাও জানে না, এ ভেদের মাধ্যমে তারা নিজের অজ্ঞাতসারে পাপে লিপ্ত হয়ে অধঃপতিত হচ্ছে। পঞ্চমতের পঞ্চদেবতাকে পূজা করে প্রণামপূর্বক শ্রীহরিকে স্মরণ করেই ব্রত আরম্ভ করতে হবে। কিন্তু কেউ যদি এ ছয়দেবতাকে আরাধনা না করে ব্রতকর্ম করে, তা হলে তার নিত্য নৈমিত্তিকাদি সমস্ত কর্মই নিষ্ফল হয়ে যায়।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডে ছাব্বিশ অধ্যায়ে আমরা সুস্পষ্টভাবে দেখলাম একাদশীর সম্পূর্ণ বিধি দেয়া, কিভাবে একাদশী ব্রত করতে হবে।ছাব্বিশ অধ্যায়ে ব্রতের নির্দেশনার ঠিক পূর্বেই বলা আছে, "ব্রতের মধ্যে একাদশী শ্রেষ্ঠ।" ব্রতের মধ্যে যেহেতু একাদশী শ্রেষ্ঠ, তাই তাকে পালন করতে হবে শাস্ত্রের আলোকে কোন মনগড়া পরিকল্পনায় নয়। যেখানেই একাদশীর কথা আছে, প্রায় প্রত্যেকটি স্থানেই উপবাসের কথা আছে, নিরাহারের কথা আছে, নিরম্বু অর্থাৎ জল পর্যন্ত খাওয়া যাবে না, সে সকল কথা আছে। আমরা শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্দে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পিতা নন্দরাজের একাদশী ব্রত অনুষ্ঠানের কথা দেখতে পাই। সেখানে সুস্পষ্টভাবে,"একাদশ্যাং নিরাহারঃ" অর্থাৎ একাদশীতে আহার বিহীন থাকার কথা আছে।নন্দ মহারাজ উপবাস থেকেই একাদশী পালন করেছিলেন।
একাদশ্যাং নিরাহারঃ সমভ্যর্চ্য জনার্দনম্।
স্নাতুং নন্দস্তু কালিন্দ্যা দ্বাদশ্যাং জলমাবিশৎ।।
(শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ : ১০.২৮.০১)
"শুকদেব বললেন মহারাজ পরীক্ষিৎ, নন্দ মহারাজ একাদশীতে উপবাসী থেকে ভগবান জনার্দনের পূজা করেছিলেন। এবং সেদিন রাত্রে দ্বাদশী তিথিতে স্নানের জন্য যমুনার জলে প্রবেশ করেছিলেন।"
একাদশীতে সম্পূর্ণ উপবাস থাকতে হবে।সেদিন অন্ন ভোজন করলে, ঐ সমস্ত পাপে লিপ্ত হতে হয়ে ইহলোকে অতিপাতকীয় পরিগনিত হয়ে ; মৃত্যু পরবর্তীতে নরকগামী হয়, কথাটি ব্রহ্মবৈবর্ত সহ বিভিন্ন পুরাণে আছে। একাদশী একটি নৈষ্ঠিক উপবাস ব্রত। কিন্তু এ পবিত্র ব্রতকে বর্তমানে অধুনা বঙ্গের কিছু মানুষ, সেদিন খাবারের উৎসব বানিয়ে ফেলেছে। যা সম্পূর্ণভাবে অশাস্ত্রীয়, বিধিবহির্ভূত। একাদশী যেহেতু মাহাত্ম্যপূর্ণ ব্রত, পৌরাণিক শাস্ত্রানুসারে তার ফল যেহেতু মহত্তর, তাই একে পালনও করতে হবে শাস্ত্র নির্দেশিত পথে নিষ্ঠার সাথে। বর্তমানে একাদশী তিথি পালন নিয়ে বাড়বাড়ন্ত করা ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীদের একাদশী পালনের রীতিটি পর্যবেক্ষণ করবেন। তবে দেখতে পাবেন, ব্রহ্মবৈবর্ত সহ বিবিধ পুরাণে বর্ণিত একাদশীর পালনের রীতির সাথে তাদের সামঞ্জস্য কতটা এবং অন্যকে জোরজবরদস্তি করে একাদশী পালন করানো মানুষগুলো কতটা শাস্ত্র বর্ণিত একাদশী বিধিকে অনুসরণ করে চলে।
সত্যং সর্বাণি পাপানি ব্রহ্মহত্যাদিকানি চ।
সত্ত্বেবৌদনমাশ্রিত্য শ্রীকৃষ্ণব্রতবাসরে।।
ভুঙেক্ত তানি চ সর্বাণি যো ভুঙেক্ত তত্র মন্দধীঃ।
ইহাতিপাতকী সোঽপি যাত্যন্তে নরকং ধ্রুবম্।।
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ: শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড, ২৬.২৩-২৪)
"শ্রীকৃষ্ণ ব্রতদিবসে ব্রহ্মহত্যাদি সমস্ত পাপই অন্নাশ্রিত থাকে। সেদিন অন্ন ভোজন করলে ঐ সমস্ত পাপে লিপ্ত হতে হয়। যে মন্দবুদ্ধি ব্যক্তি একাদশী দিনে ভোজন করে, সেই মূঢ় ঐ সমস্ত পাপপঙ্কে লিপ্ত হয়। ইহলোকে অতিপাতকীয় পরিগনিত হয়ে, অন্তে নরকগামী হয়ে থাকে।"
একই রকম কথা স্কন্দ পুরাণের বিষ্ণুখণ্ডে একাদশী প্রসঙ্গে বলা আছে, একাদশীর দিনে অন্নে পাপ আশ্রয় করে। সেদিন যারা অন্ন ভোজন করে তারা কেবল পাপই ভোজন করে। তাই সেদিন সকল প্রকারের অন্ন ভোজন নিষিদ্ধ।
সর্বদৈকাদশী পুণ্যা বিশেষাৎ কার্তিকী স্মৃতা।
যানি কানি চ পাপানি ব্রহ্মহত্যাদিকানি চ।।
অন্নমাশ্রিত্য তিষ্ঠন্তি সম্প্রাপ্তে হরিবাসরে।
স কেবলমঘং ভুঙেক্ত যো ভুঙেক্ত হরিবাসরে।।
তস্মাৎ সর্বপ্রযত্নেন কুর্য্যাদেকাদশীব্রতম্।
ন কুর্য্যাদ্ যদি মোহেন উপবাসং নরাধমঃ।।
নরকে নিয়তং বাসঃ পিতৃভি সহ তস্য বৈ।
(স্কন্দ পুরাণ, বিষ্ণুখণ্ড, কার্তিকমাসমাহাত্ম্য,
অধ্যায় ৩৩, শ্লোক ৩২-৩৫)
" একাদশী সর্বদাই পুণ্যের, বিশেষত কার্তিকের একাদশী পুণ্যতরা।ব্রহ্মহত্যাদি যত পাপ আছে তা সকলই হরিবাসরে একাদশীর দিনে অন্নে আশ্রয় করে। সেদিন যারা অন্ন ভোজন করে তারা কেবল পাপই ভোজন করে। অতএব সর্বপ্রযত্নে একাদশীব্রত করবে। যে নরাধম মোহবশতঃ একাদশীতে উপবাস না করে, পিতৃগণ সহ তার নিয়ত নরকে বাস হয়।"
যানি কানি চ পাপানি ব্রহ্মহত্যাদিকানি চ।
অন্নমাশ্রিত্য তিষ্ঠন্তি সম্প্রাপ্তে হরিাসরে।।
(বৃহন্নারদীয় পুরাণে: ২১.৮)
"ব্রহ্মহত্যা প্রভৃতি যে কোন পাপ হরিবাসর একাদশীর দিনে অন্নতে আশ্রয় করে থাকে।"
একাদশীতে খাওয়া প্রসঙ্গে বিবিধ পুরাণের সাথে সাথে গর্গসংহিতাতেও একাদশী প্রসঙ্গে বিস্তৃত বলা আছে। শ্রীকৃষ্ণের নামকরণ করেছিলেন এ গর্গমুনি। শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামে আছে, "কৃষ্ণ নাম রাখে গর্গ ধ্যানেতে জানিয়া।" যদুবংশীয় রাজা বজ্রনাভির প্রশ্নে গর্গমুনি একাদশীতে ভক্ষ্যাভক্ষ্য সম্পর্কে বলেছেন। গর্গমুনি প্রথমে সুস্পষ্টভাবে একাদশী তিথিতে ফল সহ সকল প্রকার অন্ন খেতে নিষেধ করেছেন। পরে রাজা বজ্রনাভি জিজ্ঞাসা করলেন, "যারা একাদশীতে ফলাহার করে তাদের কি হবে ?" তখন গর্গমুনি সামান্য জল-ফল খাওয়ার বিধান দেন। এবং সাথে সতর্ক করে দেন, জল-ফল খাওয়া যায়; কিন্তু এতে ব্রতীর একাদশী ব্রতের সম্পূর্ণ পুণ্য লাভ হবে না।
কথয়িষ্যাম্যহং সর্বং শৃণূষ্ব যদুনন্দন।
একাদশ্যং ন ভোক্তব্যমন্নং চৈব ফলং তথা।।
(গর্গসংহিতা: অশ্বমেধ খণ্ড,৬১ অধ্যায়,৪৬)
"আমি বলছি তা শ্রবণ কর,একাদশীতে অন্ন এমন কি ফলও ভক্ষণ করবে না। মানব সানন্দে যথাবিধানে একাদশী করবে।"
আমাদের শাস্ত্রে সকল স্থানেই একাদশীতে অন্ন না খেতে বলা হয়েছে। কিছু কিছু পুরাণের মতে সেদিন অন্নতে পাপ আশ্রয় করে বলে বলা হয়েছে। কথাগুলো বেদমন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক, বিষয়টি নিয়ে আমি আমার পূর্ববর্তী কয়েকটি লেখায় বিস্তৃত লিখেছি। অন্ন খেতে নিষেধ করা আছে, অন্ন না খাওয়া মানে কিছুই খাওয়া যাবে না। কারণ, শ্রীমদ্ভগবদগীতা অনুসারে (১৫.১৪) জগতের সকল খাবারই অন্ন। জগতের খাদ্যের কিছুই অন্নের বাইরে নয়। "পঞ্চশস্য বা পঞ্চরবিশস্য খাওয়া যাবে না"- এ জাতীয় বিধি পুরাণে কোথাও আমার এখনও চোখে পড়েনি। সকল স্থানেই আছে, একাদশীতে অন্ন ভোজন নিষিদ্ধ, অন্নে সেদিন পাপ আশ্রয় করে।
একাদশী যদি থাকতেই হয় তবে সম্পূর্ণ নিরাহার উপবাসী থেকেই থাকতে হবে। যারা একাদশী থাকেন না, তাদের নিয়ে কোন কথা নেই, এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু যারা একাদশী থাকেন এবং থাকতে উৎসাহিত করেন তাদের সম্পূর্ণভাবে বিধি অনুসরণ করে তবেই অন্য মানুষের মাঝে একাদশীর প্রচারণা করতে হবে। নিজে আগে আচার করেই তবে অন্যদের ধর্ম শিখাতে হয়। বৈষ্ণব ভিন্ন গৃহীদের জন্যে সকল একাদশী ব্রতই বাধ্যতামূলক নয়। শুক্লা একাদশীতে উপবাস করা কর্তব্য, কিন্তু গৃহীদের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী লঙ্ঘনে কোনরূপ পাপ হয় না। একজন গৃহস্থ এবং সন্ন্যাসীর সকল বিধিবিধান যদি একই হয়, তবে গৃহস্থ এবং সন্ন্যাসীর মধ্যে পার্থক্য আর রইল কোথায় ? একজন গৃহস্থকে পরিবার, পরিজন, সংসার, চাকুরি সহ গার্হস্থধর্ম নামক বিবিধ ঝামেলা পোহাতে হয়। কিন্তু একজন সন্ন্যাসীকে কিন্তু এ সকল ঝামেলাপূর্ণ কাজ করতে হয়না। ভগবানকে সর্বদা স্মরণ করতেই তিনি সন্ন্যাস নিয়েছেন। তাই তাঁকে সকল ধর্মীয় বিধিনিষেধ নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হয়। কারণ গৃহস্থদের সামনে ধর্মের আদর্শ সন্ন্যাসীরা, তাই গৃহস্থরা সাধ্যমত তাঁদের অনুসরণ করে।
শুক্লামেব তু কুর্বন্তি গৃহিণো বৈষ্ণবেতরাঃ।
ন কৃষ্ণালঙ্ঘনে দোষস্তেষাং বেদেষু নারদ।।
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ : শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড,২৬.৩৮)
"বৈষ্ণব ভিন্ন গৃহীগণের শুক্লা একাদশীতে অবশ্য উপবাস করা কর্তব্য। কারণ তাদের কৃষ্ণা একাদশী লঙ্ঘনে কোনরূপ দোষ নেই।"
একাদশী বা দ্বাদশীতে স্বাধ্যায় অর্থাৎ বেদাদি শাস্ত্র এবং ভগবানের মাহাত্ম্য যুক্ত লীলাপাঠ করতে হবে। এ দিনে ভগবান বাসুদেবের লীলা শ্রবণ করলে দীর্ঘায়ু লাভ হয়। সংযম সহকারে উপবাস করে পুরুষোত্তম ভগবানের লীলা মাহাত্ম্য পাঠ করলে পাপের নিবৃত্তি হয়। তাই একাদশীতে অলসতা নিয়ে না কাটিয়ে, নিজে শাস্ত্রাদি পাঠ করতে হয় এবং অন্যকেও শোনাতে হয়। বিষয়টি শ্রীমদ্ভাগবতের দ্বাদশ স্কন্দে অত্যন্ত সুন্দর করে বলা আছে।
দ্বাদশ্যামেকাদশ্যাং বা শৃণ্বন্নায়ুষ্যবান্ ভবেৎ।
পঠত্যনশ্নন্ প্রয়তস্ততো ভবত্যপাতকী।।
(ভাগবত: ১২.১২.৫৯)
"যে ব্যক্তি একাদশী বা দ্বাদশীর দিনে তা (ভগবান বাসুদেবের লীলা) শ্রবণ করে সে দীর্ঘায়ু হয়। এবং যে সংযম সহকারে উপবাস করে তা পাঠ করে, তার পাপের নিবৃত্তি তো হয়ই; পরে পাপের প্রবৃত্তিরও নিবৃত্তি হয়।"
একাদশীতে উপবাস, সংযম, পূজাপাঠ সহ আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ; তা হল একাদশীর রাত্রিতে না ঘুমিয়ে রাত্রিজাগরণ। সারারাত ভগবানের নাম, কীর্তন এবং ধ্যানসহ বিবিধ প্রকারে রাতটি ভগবানকে স্মরণ করে অতিবাহিত করতে হবে। পদ্মপুরাণে বলা আছে, জাগরণ বিনা একাদশী ব্রত যারা করে, এ অনিত্য জীবনে তারা আপনা হতেই বিনষ্ট হয়ে যায়। তাই একাদশীতে জাগরণ বাধ্যতামূলক।
প্রাপ্তা একাদশী যেষাং কলৌ জাগরণং বিনা।
তে বিনষ্টা ন সন্দেহো যস্মাজীবিতমধ্রুবম্।।
(পদ্মপুরাণ :উত্তরখণ্ড, ৩৭ অধ্যায়, ২৮-২৯)
"কলিতে জাগরণ বিনা যারা একাদশী ব্রত করে, তারা আপনা হতেই বিনষ্ট হয়। যেহেতু এ জীবন অনিত্য।"
একাদশী ব্রত মানে শুধু একাদশী তিথিতেই নয়, পূর্বদিন দশমী থেকে এ ব্রত শুরু হয়ে সমাপ্ত হয় দ্বাদশীতে। দশমী তিথির পূর্বাহ্নে হবিষ্যান্ন খেয়ে সারাদিন আর অন্নগ্রহণ না করে, একাদশীর দিনে সম্পূর্ণ উপবাস হেকে দ্বাদশীতে পারণ করে একাহারী থাকতে হবে। বলতে গেলে একরকম তিনদিনই উপবাস থাকার কথা শাস্ত্রে আছে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, এ বিধি তো অনেক কঠিন এবং বর্তমানে পালন করতে অনেক কষ্টকর এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসম্ভবও বটে। তবে কি করে আমরা এ কঠিন বিধি পালন করব? এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, একাদশী যেহেতু ব্রতের মধ্যে অন্যতম এবং এর দ্বারা সঞ্চিত পুণ্যও অনেক। তাই এ পুণ্যলাভের ব্রতে কষ্ট তো একটু হবেই। প্রবাদে আছে, "কষ্ট না করলে, কেষ্ট মেলে না।"
অনেকে অণুকল্প ভোজনের কথা বলে একাদশীতে ফল সহ বিবিধ খাদ্যদ্রব্য খেয়ে থাকেন। কিন্তু এটি ঠিক নয়, অণুকল্প শব্দের মধ্যেই স্পষ্ট ; যে অণুকল্প বা বিকল্পে কতটুকু খাওয়া যায়। তাই অণুকল্পের নামে ভোজনের মহোৎসব করাটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। নিজে ঠিকমত শাস্ত্রীয় বিধান পালন না করেই অনেকে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে অন্যদের একাদশী পালনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমদ্ভগবদগীতার বাণীটি। সেখানে ভগবান শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে নিজ খুশীমত আচরণ করতে তীব্রভাবে নিষেধ করেছেন, ভৎসনা করেছেন।ভগবান বলছেন, এ সকল শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগকারী ব্যক্তিদের সুখও হয়না এবং মোক্ষলাভও হয়না।
যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ।
ন স সিদ্ধিম্বাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা: ১৬.২৩)
"যে ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে নিজ খুশীমত আচরণ করে, সে সিদ্ধিলাভ করতে পারেনা, তার সুখও থাকে না এবং সে জীবের পরমগতি মোক্ষলাভও করতে পারে না।"
একাদশী প্রসঙ্গে আমি আমার আলোচনায় অন্যান্য শাস্ত্র গ্রন্থাদির প্রমাণ না দিয়ে শুধু গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নিত্য ব্যবহৃত শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ (বিষ্ণু খণ্ড), বৃহন্নারদীয় পুরাণ, গর্গসংহিতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছি। আশাকরি এ শাস্ত্রাদিতে যেভাবে একাদশী পালনের বিধিনিষেধ বর্ণিত আছে, তারা সেভাবেই নিজেরা পালন করে, তবেই অন্যদের একাদশী পালনে উৎসাহিত করবে। সবকিছু শাস্ত্র অনুসারে করাই ধর্ম, নিজের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে করাটা অধর্ম। বাঙালির প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেব আমাদের শিখিয়েছেন সকল জ্ঞান এবং শিক্ষা প্রথমে নিজেকে আচরণ করেই পরে সবার মাঝে প্রচার করতে হয় ; তবেই মানুষ তা গ্রহণ করে। নিজে আচরণ না করে যে শিক্ষা সে শিক্ষা কখনো কেউ গ্রহণ করে না।
আপনি আচরি ভক্তি শিখাইমু সবারে।।
আপনি না কৈলে ধর্ম্ম শিখান না যায়।
এই ত সিদ্ধান্ত গীতা-ভাগবতে গায়।।
(চৈতন্যচরিতামৃত : আদি, তৃতীয় পরিচ্ছেদ)
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁