শ্রাবণীপূর্ণিমায় শ্রীকৃষ্ণের ঝুলনযাত্রা আয়োজিত হয়। এ দিনে বৈশ্বিক সৌভ্রাতৃত্বের পবিত্র উৎসব রক্ষাবন্ধন বা রাখিবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। দিনটিকে বিশ্ব সংস্কৃত দিবস হিসেবেও পালন করা হয়। প্রাচীনকাল থেকে এ শ্রাবণী পূর্ণিমাতিথি থেকেই বেদাদি শ্রাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ শুরু হত; সেই বিষয়কে স্মরণে নিয়ে ১৯৬৯ সাল থেকেই এ দিনটি বিশ্ব সংস্কৃত দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
শ্রাবণী পূর্ণিমায় শিবলিঙ্গে স্বয়ং বিষ্ণু মিলিত হয়ে একইদেহে হরিহর বা শিব-বিষ্ণু যুগ্মমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই এ দিনে শিবের মাথায় জল ঢাললে, শিবপূজা করলে, শিবের সাথে হরিরও পূজা হয়। দক্ষিণ ভারত সহ ভারতের অনেক শিবমন্দিরে এদিনে হরিহরের পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শ্রাবণ মাস এমনিতেই শিবভক্তদের কাছে পবিত্র মাস, সেই শ্রাবণের পূর্ণিমা আরো মাহাত্ম্যপূর্ণ। শিবকে এদিনে ডাবের জল এবং দুধ দিয়ে স্নান করানো হয় ; নতুন যজ্ঞোপবীত দান করতে হয়। এ দিনে ভগবান শিবকে যজ্ঞোপবীত দান করলে মানুষের সমস্ত পাপ নাশ হয়। কাশ্মীরীয় শৈব পণ্ডিত অভিনব গুপ্ত তাঁর ‘শৈবদর্শন’ গ্রন্থে শ্রাবণীপূর্ণিমা মাহাত্ম্য উল্লেখ করেছেন।
রক্ষাবন্ধন সাধারণত উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণ ভারতেই পালিত হয়। বাঙালিরা সাধারণত ভাইবোনের পবিত্র এ উৎসবটি পালন করে কালীপূজার দুইদিন পরে ভাইফোঁটার দিনে।ভারতবর্ষীয় হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং শিখ সহ সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্ষাবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।ভাইয়ের মঙ্গল কামনায়, তার হাতে রক্ষাবন্ধন সূত্র রাখিসূত্র বেঁধে দেয় বোন। ভাই বোনকে বিভিন্ন উপহার দিয়ে, বোনকে সর্বদা রক্ষার সংকল্পবদ্ধ হয়।রক্ষাবন্ধনের সময় একটি পবিত্র সংস্কৃত শ্লোক বলেই তবে রক্ষাবন্ধনের সূত্রটি বাঁধতে হয়। এ পবিত্র শ্লোকটি হল:
যেন বদ্ধো বলী রাজা দানবেন্দ্রো মহাবলঃ।
তেন ত্বামভিবধ্নামি রক্ষে মা চল মা চল।
"যে রক্ষাবন্ধন দিয়ে মহাশক্তিশালী দানবেন্দ্র মহারাজা বলীকে বাঁধা হয়েছে, সেই পবিত্র রক্ষাবন্ধন সূত্র দিয়ে আমি তোমাকে বেঁধেছি ; যা সর্বদা তোমাকে রক্ষা করবে।"
বঙ্গভঙ্গের পরে সকলকেই এক করার জন্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম এ দিনটিকে ভাইবোনের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের উৎসবে পরিণত করে তোলে। সে থেকেই দিনটি বাঙালির জীবনের এক গুরুত্ববহ অচ্ছেদ্য হয়ে আছে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকার ১৯০৫ সালের ২০ জুলাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে এবং সে বছরের ১৬ অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার ঘোষণা দেয়া হয়। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে সরব হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ কোলকাতা কেন্দ্রিক প্রায় সকল বুদ্ধিজীবী। বাংলাকে ভাগ করার চক্রান্তের প্রতিবাদে ১৬ অক্টোবর, ৩০ আশ্বিন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার দিনে সকল বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে এক সর্বজনীন রাখিবন্ধনের ডাক দেয়া হয়।
সকলে মিলে গঙ্গায় স্নান করে শুরু হয় রাখিবন্ধন উৎসব। সকল বাঙালি সম্প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ একে অন্যের হাতে বেধে দেন রাখিবন্ধনের হলুদ, রঙিন সুতা। রাখিবন্ধনকে উপলক্ষ করে বাঙালির ঐক্য, বাঙালির সাধনা, বাঙালির সংস্কৃতি, বাঙালির আশা আকাঙক্ষা চিত্রিত করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন একাধিক অনন্য স্বদেশী গান। যা চিরকালের জন্যে বাঙালির অক্ষয় সম্পদে পরিনত হয়েছে। এ ঐক্যের স্বদেশী গানগুলি রাজধানী কলকাতা ছাপিয়ে সারা বাংলা জুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরেছিল।এর মধ্যে একটি গান জনপ্রিয়তায় সকলকেই ছাপিয়ে গিয়ে সবার কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে:
"বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক,
পুণ্য হউক হে ভগবান॥
........
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন,
বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন-
এক হউক, এক হউক,
এক হউক হে ভগবান॥"
এ বঙ্গভঙ্গের রেশ বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক পর্যন্ত সক্রিয় ছিল, যার প্রভাব বাংলার হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে অনেকের জীবনেই ছিল।সে সকল স্বদেশী বিপ্লবীরা বঙ্গভঙ্গের অভিঘাতে উৎপন্ন, তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশীয় আন্দোলনে আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন।