-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

জগন্নাথঃ স্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে (পঞ্চমতের একত্বের প্রতীক জগন্নাথদেব)।

জগন্নাথ অর্থাৎ জগতের নাথ। পরমেশ্বর ভগবানের করুণাঘন এক অপূর্ব রূপ। জগন্নাথধাম হিন্দুজাতির চার ধামের এক ধাম। দেবীর একান্নপীঠের এক পীঠ। জগন্নাথদেবের বিগ্রহ দৃশ্যত অসম্পূর্ণ,কিন্তু তাঁর দৃশ্যমান হস্ত,পদ না থাকা সত্ত্বেও তিনি হস্ত-পদময়। কারণ , এ জগতে এবং সকল জীবের মাঝেই তাঁর প্রকাশ। আবার তিনি এ জগতের পারে, সকল ইন্দ্রিয়ের পারে, ইন্দ্রিয়, বাক্য, মনের অগোচর হয়ে সদা বিরাজিত হয়ে আছেন ।সারা ভারতবর্ষে যতো প্রাচীন মন্দির আছে তার প্রত্যেকটি মন্দিরে বিগ্রহেরই কিছু স্বতন্ত্রতা আছে। তেমনি স্বতন্ত্রতা জগন্নাথ বিগ্রহের। অপরূপ করূণাঘন চখা-চখা চোখে তাকিয়ে আছেন ভগবান ভক্তের পানে। স্কন্ধপুরাণের বিষ্ণুখণ্ডের পুরুষোত্তমক্ষেত্রমাহাত্ম্যের এক থেকে সাতান্নটি অধ্যায়ে জগন্নাথদেবের এমন রূপের কারণ দেয়া আছে অত্যন্ত সুন্দর করে।সেই মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন, রাণী গুণ্ডিচা এবং বৃদ্ধ কারিগরের এ ঘটনাটা আমরা সকলেই মোটামুটি জানি। তাই সেদিকে আর আমি যাচ্ছি না। জগন্নাথদেব সনাতন হিন্দুর শাক্ত, শৈব,গাণপত্য, সৌর এবং বৈষ্ণব এ পঞ্চ মতেরই একত্বের প্রতীক। বলদেব শিবের, শুভদ্রা শক্তির, জগন্নাথ বিষ্ণু, আর সুদর্শন সূর্যের প্রতীক বলে উপাসনা করা হয়। পঞ্চমতের মধ্যে বাকি রইল একটি গাণপত্য। তাই স্নানযাত্রার দিনে জগন্নাথদেবকে গণেশরূপে উপাসনা করা হয়। আবার জগন্নাথদেবের যেহেতু দৃশ্যমান হস্ত-পদ নেই, তাই তিনি হস্ত-পদের পারে ব্রহ্মস্বরূপ। এবং তাঁর বিগ্রহকে বলা হয় দারুব্রহ্ম।তান্ত্রিকমতে জগন্নাথকে শক্তিপীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিমলার ভৈরব হিসেবে পূজা করা হয়। বৈদিক, তান্ত্রিক সকল মতেই জগন্নাথদেবকে পূজা করা হয়।  জগন্নাথদেবের মন্দির শুধুমাত্র হিন্দুদের সকল মত-পথের একতার প্রতীকই নয় ; হিন্দু জাতির একতা গঠনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। জগন্নাথদেবের গর্ভগৃহে সকল হিন্দুদের সহ ভারতে উৎপন্ন বৌদ্ধ, জৈন,শিখসহ সকল ধর্মাবলম্বীদেরই প্রবেশের অধিকার। শুধুমাত্র সেমেটিক ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশাধিকার নেই, কারণ তারা সুযোগের অসৎ ব্যবহার করে প্রচুর অসভ্যতা করেছে। বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে এ বিষয়ে।জগন্নাথদেবের প্রসাদ ব্রাহ্মণ-শূদ্র নিবির্শেষে সকলে এক সাথে, এক পাতে বসে গ্রহণ করে।যেখানে জগন্নাথদেবের প্রসাদ পাওয়া যায়, সেই স্থানের নাম আনন্দবাজার। অপূর্ব নামকরণ! এ যেন একতার আনন্দবাজার। এ যেন জাত-পাতের রাজনীতিকে একপাশ রেখে হিন্দুত্বের মিলনের আনন্দবাজার। জগন্নাথদেবের পূজা হয় দ্বৈতভাবে, ব্রাহ্মণ পাণ্ডাদের রীতিতে এবং শূদ্র শবরদের রীতিতে। সকলেই সমান সমান অংশগ্রহণকারী জগন্নাথদেবের উপাসনায়। জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রার পরের ১৫ দিনকে বলা হয় অনসর-পিড়ি ; এ সময়ে শবর বিশ্বাবসুর বংশধর শূদ্র দয়িতাপতিরাই জগন্নাথদেবকে পূজা করেন। সাধারণত দেবতা থাকে মন্দিরে আর ভক্তরা এসে বিগ্রহকে প্রণাম করে, উপাসনা করে। কিন্তু জগন্নাথদেব এর ব্যতিক্রম, তিঁনি সাধারণজনের মাঝে সাধারণজন হয়ে রাজপথে নেমে এসেছেন। তিঁনি তো রাজাধিরাজ তিঁনিই যখন নেমে এসেছেন রাজপথে, তখন দেশের রাজার তো সাধ্য নেই রাজসিংহাসনে বসে থাকার। তিনিও চলে এসেছেন রাজপথে সাধারণদের কাছে। হাতে ঝাড়ু নিয়ে হয়েছেন জগন্নাথদেবের পথের ঝাড়ুদার। পুরীর গজপতি রাজা স্বয়ং শোভাযাত্রা সহকারে জগন্নাথদেবের রথের চলার পথকে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করার পরেই তিনটি রথ চলতে শুরু করে। এ প্রথা রাজা অনঙ্গভীমদেবের সময় ( ১১৭৫-১২০২ খ্রিস্টাব্দ) থেকেই চলে আসছে। রাজা- প্রজা সকলেই আজ একাকার, সবারই পরিচয় তারা জগন্নাথদেবের সেবক ; অপূর্ব সাম্যবাদের শিক্ষা দেয়ার জন্যেই এ প্রথার আয়োজন।  বর্তমানে আমাদের যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে যাচ্ছে, পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে অশান্তি ঝগড়াঝাটি চলে আসছে, ভাইবোনের মধ্যে স্বার্থের বিরোধে কোর্টকাছারি পর্যন্ত যেতে হচ্ছে। কিন্তু একবার আমরা ভেবে দেখেছি কি, পুরীর জগন্নাথ মন্দির ভাইবোনের সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। জগন্নাথদেব শ্রীকৃষ্ণ, বড়ভাই বলরাম এবং আদরের ছোটবোন সুভদ্রা এ তিনভাইবোনকে একসাথে বসিয়ে সেখানে পূজা করা হচ্ছে। আরেকটি বিষয় খুবই লক্ষ্যনীয়, রথযাত্রার সময়ে আগে বড়ভাই বলরামের রথ যায়, এরপরে ছোটবোন সুভদ্রার রথ এবং পরিশেষে যায়  জগন্নাথদেবের রথ। আমাদের সংস্কৃতি অনুসারে  জ্যেষ্ঠভাইকে আগে যেতে দিতে হয়। জ্যেষ্ঠকে অগ্রগামী করে,আদরের ছোটবোনের যাত্রা নির্বিঘ্ন করে, তবেই অবশেষে জগন্নাথদেবের রথ রাজপথে অগ্রসর হয়।৪৫ ফুট উচ্চতার জগন্নাথদেবের রথের নাম নন্দীঘোষ, এর আরও কয়েকটি নাম আছে গরুড়ধ্বজ, চক্রধ্বজ এবং কপিধ্বজ। একইভাবে ৪৪ ফুট উচ্চতার বলভদ্রের রথের নাম তালধ্বজ এবং ৪৩ ফুট উচ্চতার সুভদ্রাদেবীর রথের নাম দর্পদলন। শ্রীশঙ্করাচার্য, শ্রীরামানুজাচার্য,শ্রীচৈতন্যদেব তুলসীদাস সহ আমাদের প্রায় সকল আচার্যবৃন্দেরই উপাসনার, সাধনার স্থান ছিলো জগন্নাথ ধাম। তাই আমাদের প্রায় সকল আচার্যবৃন্দই শ্রীক্ষেত্র, পুরুষোত্তম ক্ষেত্র, শঙ্খক্ষেত্র, নীলাচল ক্ষেত্র, মুক্তিক্ষেত্র ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত জগন্নাথধামের মাহাত্ম্যকথা প্রচার করেছেন এবং জগন্নাথদেবের মাহাত্ম্যযুক্ত স্তোত্র রচনা করেছেন। মধ্যযুগে উত্তর ভারতে ভক্তি আন্দোলনের যিনি পুরোধাপুরুষ শ্রীরামচরিতমানসের রচয়িতা তুলসীদাস গোস্বামীও পুরিতে এসে জগন্নাথদেবকে রঘুপতি রামরূপে উপাসনা করেছিলেন। কালান্তরে জগন্নাথ ধামে কালযবনের অত্যাচারকালে মন্দিরের সেবায়েত পাণ্ডাগণ জগন্নাথ বিগ্রহের উদর প্রদেশ স্থিত রত্নপেটিকা চিল্কা হ্রদের তীরে ভূগর্ভে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় কালক্রমে উক্ত স্থানের লোকেরা ভুলে যান রত্নপেটিকা রাখার স্থানটিকে। শ্রীশঙ্করাচার্য যোগবলে জগন্নাথের রত্নপেটিকা রাখার স্থানটিকে নির্ধারণ করে দেন এবং জগন্নাথকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। বদরিকাশ্রমে নারায়ণ বিগ্রহও তিনি অনুরূপভাবে প্রকাশিত করেন।উল্লেখ্য যে, আচার্যের জীবনের একটি প্রধান কীর্তিই হল শ্রেষ্ঠ পবিত্র মন্দিরগুলোতে ভগবদ্বিগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা। যখন আচার্য শ্রীশঙ্কর যোগবলে জগন্নাথের রত্নপেটিকা রাখার স্থানটিকে নির্ধারণ করে দেন তখন ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি জগন্নাথদেবের উদ্দেশ্যে অসাধারণ একটা সংস্কৃত স্তোত্র তৈরি করেন। এ স্তোত্রটি আজও প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হয় এবং জগন্নাথদেবকে নিয়ে স্তোত্রের মধ্যে এ স্তোত্রটিকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়। শ্রীশঙ্করাচার্যের ভাষায়: মহাম্ভোধেস্তীরে কনকরুচিরে নীলশিখরে, বসন্ প্রাসাদান্তে সহযবলভদ্রেণ বলিনা। সুভদ্রামধ্যস্থঃ সকলসুরসেবাবসরদো, জগন্নাথঃ স্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে।। "যিনি মহাসমুদ্রের তীরে স্বর্ণময় নীলশিখর-প্রাসাদে মহাবলশালী বড়ভাই বলরাম এবং ভগ্নী সুভদ্রাদেবীকে নিয়ে অবস্থান করে, সকল দেবতাদেরই সেবা করার সুযোগ প্রদান করছেন; সেই জগন্নাথদেব তুমি আমার নয়নপথে আসো।" জগন্নাথদেবের দৃশ্যমান হাত নেই, কিন্তু তিনি সকল দ্রব্যই গ্রহণ করেন। তাঁর দৃশ্যমান পা নেই, কিন্তু তিনি সর্বত্রই বিরাজমান।তিনি জগতের আদিপুরুষ। তিনিই বিশ্বাত্মা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তাঁর রূপ নেই, আকার নেই। তিনি চিন্তার অতীত। বাক্য মনের অতীত। তিনি অচিন্ত্য, তাই তাঁর সম্পূর্ণ বিগ্রহ তৈরি করা আদৌ সম্ভব নয়, শুধু ভক্ত আকাঙ্ক্ষায় অসম্পূর্ণ দারুব্রহ্ম প্রতীকে তিনি প্রকাশিত।জগন্নাথদেবের কৃপাঘন, গোলাকার চখা-চখা কমল নয়ন এবং অসম্পূর্ণ বিগ্রহ দেখে, আমরা না বুঝে বলে ফেলি; জগন্নাথের হাত-পা নেই, তাই সে ঠুটোঁ জগন্নাথ। কথাটি বলতে বলতে আমরা তা বাংলা প্রবাদবাক্যই বানিয়ে ফেলেছি। জগন্নাথের প্রতি না বুঝে তুচ্ছার্থে প্রতিনিয়ত ব্যবহারও করে ফেলি কথাবার্তায়।হয়ত আমরা একবার ভেবেও দেখিনি বাক্যটির অর্থ কি হতে পারে। যিনি সর্বব্যাপী পরমেশ্বর তাকেই বলছি ঠুটোঁ! বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আমাদের প্রচলিত ঠুটোঁ জগন্নাথ বাক্যের স্থানে ব্যবহার করা উচিৎ, সর্বব্যাপী জগন্নাথ। তাহলেই ভাবটি শুদ্ধ হয়, সুন্দর হয়। শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।

জগন্নাথ অর্থাৎ জগতের নাথ। পরমেশ্বর ভগবানের করুণাঘন এক অপূর্ব রূপ। জগন্নাথধাম হিন্দুজাতির চার ধামের এক ধাম। দেবীর একান্নপীঠের এক পীঠ। জগন্নাথদেবের বিগ্রহ দৃশ্যত অসম্পূর্ণ,কিন্তু তাঁর দৃশ্যমান হস্ত,পদ না থাকা সত্ত্বেও তিনি হস্ত-পদময়। কারণ , এ জগতে এবং সকল জীবের মাঝেই তাঁর প্রকাশ। আবার তিনি এ জগতের পারে, সকল ইন্দ্রিয়ের পারে, ইন্দ্রিয়, বাক্য, মনের অগোচর হয়ে সদা বিরাজিত হয়ে আছেন ।সারা ভারতবর্ষে যতো প্রাচীন মন্দির আছে তার প্রত্যেকটি মন্দিরে বিগ্রহেরই কিছু স্বতন্ত্রতা আছে। তেমনি স্বতন্ত্রতা জগন্নাথ বিগ্রহের। অপরূপ করূণাঘন চখা-চখা চোখে তাকিয়ে আছেন ভগবান ভক্তের পানে। স্কন্ধপুরাণের বিষ্ণুখণ্ডের পুরুষোত্তমক্ষেত্রমাহাত্ম্যের এক থেকে সাতান্নটি অধ্যায়ে জগন্নাথদেবের এমন রূপের কারণ দেয়া আছে অত্যন্ত সুন্দর করে।সেই মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন, রাণী গুণ্ডিচা এবং বৃদ্ধ কারিগরের এ ঘটনাটা আমরা সকলেই মোটামুটি জানি। তাই সেদিকে আর আমি যাচ্ছি না। জগন্নাথদেব সনাতন হিন্দুর শাক্ত, শৈব,গাণপত্য, সৌর এবং বৈষ্ণব এ পঞ্চ মতেরই একত্বের প্রতীক। বলদেব শিবের, শুভদ্রা শক্তির, জগন্নাথ বিষ্ণু, আর সুদর্শন সূর্যের প্রতীক বলে উপাসনা করা হয়। পঞ্চমতের মধ্যে বাকি রইল একটি গাণপত্য। তাই স্নানযাত্রার দিনে জগন্নাথদেবকে গণেশরূপে উপাসনা করা হয়। আবার জগন্নাথদেবের যেহেতু দৃশ্যমান হস্ত-পদ নেই, তাই তিনি হস্ত-পদের পারে ব্রহ্মস্বরূপ। এবং তাঁর বিগ্রহকে বলা হয় দারুব্রহ্ম।তান্ত্রিকমতে জগন্নাথকে শক্তিপীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিমলার ভৈরব হিসেবে পূজা করা হয়। বৈদিক, তান্ত্রিক সকল মতেই জগন্নাথদেবকে পূজা করা হয়। জগন্নাথদেবের মন্দির শুধুমাত্র হিন্দুদের সকল মত-পথের একতার প্রতীকই নয় ; হিন্দু জাতির একতা গঠনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। জগন্নাথদেবের গর্ভগৃহে সকল হিন্দুদের সহ ভারতে উৎপন্ন বৌদ্ধ, জৈন,শিখসহ সকল ধর্মাবলম্বীদেরই প্রবেশের অধিকার। শুধুমাত্র সেমেটিক ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশাধিকার নেই, কারণ তারা সুযোগের অসৎ ব্যবহার করে প্রচুর অসভ্যতা করেছে। বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে এ বিষয়ে।জগন্নাথদেবের প্রসাদ ব্রাহ্মণ-শূদ্র নিবির্শেষে সকলে এক সাথে, এক পাতে বসে গ্রহণ করে।যেখানে জগন্নাথদেবের প্রসাদ পাওয়া যায়, সেই স্থানের নাম আনন্দবাজার। অপূর্ব নামকরণ! এ যেন একতার আনন্দবাজার। এ যেন জাত-পাতের রাজনীতিকে একপাশ রেখে হিন্দুত্বের মিলনের আনন্দবাজার। জগন্নাথদেবের পূজা হয় দ্বৈতভাবে, ব্রাহ্মণ পাণ্ডাদের রীতিতে এবং শূদ্র শবরদের রীতিতে। সকলেই সমান সমান অংশগ্রহণকারী জগন্নাথদেবের উপাসনায়। জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রার পরের ১৫ দিনকে বলা হয় অনসর-পিড়ি ; এ সময়ে শবর বিশ্বাবসুর বংশধর শূদ্র দয়িতাপতিরাই জগন্নাথদেবকে পূজা করেন। সাধারণত দেবতা থাকে মন্দিরে আর ভক্তরা এসে বিগ্রহকে প্রণাম করে, উপাসনা করে। কিন্তু জগন্নাথদেব এর ব্যতিক্রম, তিঁনি সাধারণজনের মাঝে সাধারণজন হয়ে রাজপথে নেমে এসেছেন। তিঁনি তো রাজাধিরাজ তিঁনিই যখন নেমে এসেছেন রাজপথে, তখন দেশের রাজার তো সাধ্য নেই রাজসিংহাসনে বসে থাকার। তিনিও চলে এসেছেন রাজপথে সাধারণদের কাছে। হাতে ঝাড়ু নিয়ে হয়েছেন জগন্নাথদেবের পথের ঝাড়ুদার। পুরীর গজপতি রাজা স্বয়ং শোভাযাত্রা সহকারে জগন্নাথদেবের রথের চলার পথকে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করার পরেই তিনটি রথ চলতে শুরু করে। এ প্রথা রাজা অনঙ্গভীমদেবের সময় ( ১১৭৫-১২০২ খ্রিস্টাব্দ) থেকেই চলে আসছে। রাজা- প্রজা সকলেই আজ একাকার, সবারই পরিচয় তারা জগন্নাথদেবের সেবক ; অপূর্ব সাম্যবাদের শিক্ষা দেয়ার জন্যেই এ প্রথার আয়োজন। বর্তমানে আমাদের যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে যাচ্ছে, পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে অশান্তি ঝগড়াঝাটি চলে আসছে, ভাইবোনের মধ্যে স্বার্থের বিরোধে কোর্টকাছারি পর্যন্ত যেতে হচ্ছে। কিন্তু একবার আমরা ভেবে দেখেছি কি, পুরীর জগন্নাথ মন্দির ভাইবোনের সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। জগন্নাথদেব শ্রীকৃষ্ণ, বড়ভাই বলরাম এবং আদরের ছোটবোন সুভদ্রা এ তিনভাইবোনকে একসাথে বসিয়ে সেখানে পূজা করা হচ্ছে। আরেকটি বিষয় খুবই লক্ষ্যনীয়, রথযাত্রার সময়ে আগে বড়ভাই বলরামের রথ যায়, এরপরে ছোটবোন সুভদ্রার রথ এবং পরিশেষে যায় জগন্নাথদেবের রথ। আমাদের সংস্কৃতি অনুসারে জ্যেষ্ঠভাইকে আগে যেতে দিতে হয়। জ্যেষ্ঠকে অগ্রগামী করে,আদরের ছোটবোনের যাত্রা নির্বিঘ্ন করে, তবেই অবশেষে জগন্নাথদেবের রথ রাজপথে অগ্রসর হয়।৪৫ ফুট উচ্চতার জগন্নাথদেবের রথের নাম নন্দীঘোষ, এর আরও কয়েকটি নাম আছে গরুড়ধ্বজ, চক্রধ্বজ এবং কপিধ্বজ। একইভাবে ৪৪ ফুট উচ্চতার বলভদ্রের রথের নাম তালধ্বজ এবং ৪৩ ফুট উচ্চতার সুভদ্রাদেবীর রথের নাম দর্পদলন। শ্রীশঙ্করাচার্য, শ্রীরামানুজাচার্য,শ্রীচৈতন্যদেব তুলসীদাস সহ আমাদের প্রায় সকল আচার্যবৃন্দেরই উপাসনার, সাধনার স্থান ছিলো জগন্নাথ ধাম। তাই আমাদের প্রায় সকল আচার্যবৃন্দই শ্রীক্ষেত্র, পুরুষোত্তম ক্ষেত্র, শঙ্খক্ষেত্র, নীলাচল ক্ষেত্র, মুক্তিক্ষেত্র ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত জগন্নাথধামের মাহাত্ম্যকথা প্রচার করেছেন এবং জগন্নাথদেবের মাহাত্ম্যযুক্ত স্তোত্র রচনা করেছেন। মধ্যযুগে উত্তর ভারতে ভক্তি আন্দোলনের যিনি পুরোধাপুরুষ শ্রীরামচরিতমানসের রচয়িতা তুলসীদাস গোস্বামীও পুরিতে এসে জগন্নাথদেবকে রঘুপতি রামরূপে উপাসনা করেছিলেন। কালান্তরে জগন্নাথ ধামে কালযবনের অত্যাচারকালে মন্দিরের সেবায়েত পাণ্ডাগণ জগন্নাথ বিগ্রহের উদর প্রদেশ স্থিত রত্নপেটিকা চিল্কা হ্রদের তীরে ভূগর্ভে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় কালক্রমে উক্ত স্থানের লোকেরা ভুলে যান রত্নপেটিকা রাখার স্থানটিকে। শ্রীশঙ্করাচার্য যোগবলে জগন্নাথের রত্নপেটিকা রাখার স্থানটিকে নির্ধারণ করে দেন এবং জগন্নাথকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। বদরিকাশ্রমে নারায়ণ বিগ্রহও তিনি অনুরূপভাবে প্রকাশিত করেন।উল্লেখ্য যে, আচার্যের জীবনের একটি প্রধান কীর্তিই হল শ্রেষ্ঠ পবিত্র মন্দিরগুলোতে ভগবদ্বিগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা। যখন আচার্য শ্রীশঙ্কর যোগবলে জগন্নাথের রত্নপেটিকা রাখার স্থানটিকে নির্ধারণ করে দেন তখন ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি জগন্নাথদেবের উদ্দেশ্যে অসাধারণ একটা সংস্কৃত স্তোত্র তৈরি করেন। এ স্তোত্রটি আজও প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হয় এবং জগন্নাথদেবকে নিয়ে স্তোত্রের মধ্যে এ স্তোত্রটিকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়। শ্রীশঙ্করাচার্যের ভাষায়:
মহাম্ভোধেস্তীরে কনকরুচিরে নীলশিখরে,
বসন্ প্রাসাদান্তে সহযবলভদ্রেণ বলিনা।
সুভদ্রামধ্যস্থঃ সকলসুরসেবাবসরদো,
জগন্নাথঃ স্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে।।
"যিনি মহাসমুদ্রের তীরে স্বর্ণময় নীলশিখর-প্রাসাদে মহাবলশালী বড়ভাই বলরাম এবং ভগ্নী সুভদ্রাদেবীকে নিয়ে অবস্থান করে, সকল দেবতাদেরই সেবা করার সুযোগ প্রদান করছেন; সেই জগন্নাথদেব তুমি আমার নয়নপথে আসো।" জগন্নাথদেবের দৃশ্যমান হাত নেই, কিন্তু তিনি সকল দ্রব্যই গ্রহণ করেন। তাঁর দৃশ্যমান পা নেই, কিন্তু তিনি সর্বত্রই বিরাজমান।তিনি জগতের আদিপুরুষ। তিনিই বিশ্বাত্মা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তাঁর রূপ নেই, আকার নেই। তিনি চিন্তার অতীত। বাক্য মনের অতীত। তিনি অচিন্ত্য, তাই তাঁর সম্পূর্ণ বিগ্রহ তৈরি করা আদৌ সম্ভব নয়, শুধু ভক্ত আকাঙ্ক্ষায় অসম্পূর্ণ দারুব্রহ্ম প্রতীকে তিনি প্রকাশিত।জগন্নাথদেবের কৃপাঘন, গোলাকার চখা-চখা কমল নয়ন এবং অসম্পূর্ণ বিগ্রহ দেখে, আমরা না বুঝে বলে ফেলি; জগন্নাথের হাত-পা নেই, তাই সে ঠুটোঁ জগন্নাথ। কথাটি বলতে বলতে আমরা তা বাংলা প্রবাদবাক্যই বানিয়ে ফেলেছি। জগন্নাথের প্রতি না বুঝে তুচ্ছার্থে প্রতিনিয়ত ব্যবহারও করে ফেলি কথাবার্তায়।হয়ত আমরা একবার ভেবেও দেখিনি বাক্যটির অর্থ কি হতে পারে। যিনি সর্বব্যাপী পরমেশ্বর তাকেই বলছি ঠুটোঁ! বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আমাদের প্রচলিত ঠুটোঁ জগন্নাথ বাক্যের স্থানে ব্যবহার করা উচিৎ, সর্বব্যাপী জগন্নাথ। তাহলেই ভাবটি শুদ্ধ হয়, সুন্দর হয়।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।

মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁