জগতে ধর্ম কি?এর উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মহাভারতের কর্ণপর্বে ধর্মের স্বরূপ সম্পর্কে বিস্তৃত বলেছিলেন :
ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহু ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ।যৎস্যাদ্ধারণ সংযুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ।।
(মহাভারত : কর্ণপর্ব, ৬৯. ৫৮)
"সমাজকে, জনসাধারণকে যা ধারণ করে রাখে, তাই ধর্ম। তাই কিসে জনসাধারণের, সমাজের সমৃদ্ধি এবং কল্যাণ হয়, তার সাথে যুক্ত হওয়াই ধর্ম ; এ কথা নিশ্চিতরূপে জানবে।"
ধর্মের গতি নিগূঢ়তম, তাই অনেকেই সবসময়ে ধর্মকে সম্যক বুঝতে পারেন না। মানবতা মনুষ্যত্বের প্রয়োজনে ধর্মের রূপ পরিবর্তিত হতে পারে। যে বিষয়টিতে আপাতদৃষ্টিতে ধর্ম মনে হয়ে, তখন দেখা যায় সেটি করলেই অধর্ম হয়। তাই মহাভারতের বনপর্বে বলা হয়েছে, আপৎকালীন প্রাণ রক্ষার্থে এবং বিবাহের প্রয়োজনে মিথ্যা বলা যায়। একে আপদধর্ম বলে। এ
আপদধর্ম সূক্ষ্ম শ্বাশত ধর্মেরই সাময়িক কল্যাণকর রূপ।
প্রাণান্তিকে বিবাহে চ বক্তব্যমনৃতং ভবেৎ।অনৃতেন ভবেৎ সত্যং সত্যেনৈবানৃতং ভবেৎ।।যদ্ভূতহিতমত্যন্তং তৎ সত্যমিতি ধারণা।বিপর্য্যয়কৃতো ধর্ম্মঃ পশ্য ধর্ম্মস্য সূক্ষ্মতাম্।।
( মহাভারত : বনপর্ব, ১৭৭ অধ্যায়, ৩-৪)
"প্রাণনাশের সম্ভাবনাস্থলে এবং বিবাহে মিথ্যা বলা যায়। কেননা, সে সকল ক্ষেত্রে প্রয়োজনে মিথ্যাতেই সত্য এবং সত্যতেই মিথ্যা হয়।
এখানে সত্য এবং মিথ্যা শব্দের এমন অর্থ ধরতে হবে যে, যা প্রাণীগণের অত্যন্ত হিতকর, তাই সত্য। এবং বিপরীতে যা প্রাণীগণের অত্যন্ত অহিতকর তাই মিথ্যা। উক্তস্থলে উল্টো করায় ধর্ম হয়, সুতরাং ধর্মের সূক্ষ্মতা দেখুন।"
প্রাণকে রক্ষা করাও ধর্ম। তাই নিজের বা অপরের প্রাণনাশের সম্ভাবনা দেখা দিলে সর্বপ্রথমে তারই সমাধান করতে হবে। পথে যদি কোন ছিনতাইকারী বা আততায়ী কোন ব্যক্তির পিছে ধাওয়া করে তখন সে ব্যক্তি যদি প্রাণ রক্ষার্থে কোথায় লুকিয়ে থাকে। ব্যক্তির পিছে ধাওয়া করা দুষ্কৃতকারীরা যদি ব্যক্তিটিকে খুঁজে না পেয়ে। সামনে পথচারীদের জিজ্ঞেস করে, সে কোথায় পালিয়ে আছে? তখন পথচারীরা যদি সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হয়ে পলাতক ব্যক্তিকে দেখিয়ে দেয় এবং দুষ্কৃতকারীরা যদি তাকে খুঁজে পেয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তবে যে পাপ হত্যাকারীদের হয়েছে, একই পাপ জীবন রক্ষার্থে পলাতক ব্যক্তিকে যারা দেখিয়ে দিয়েছে সেসকল ব্যক্তিদেরও হয়েছে। কারো জীবন রক্ষার্থে মিথ্যা কথা বললে, সে প্রয়োজনীয় মিথ্যায় কোন পাপ তো স্পর্শ করেই না, উল্টো একজনের জীবন রক্ষার পুণ্যলাভ হয়।
তাহলে প্রশ্ন হতে পারে যে, যার জীবন রক্ষার্থে মিথ্যা কথা বা মিথ্যা আচরণ করতে হবে; তিনি যদি পাপী, দুরাচারী, নৃশংস সন্ত্রাসী হয় তবেও কি তার জীবন রক্ষা করতে হবে? এ প্রশ্নেরও অত্যন্ত যৌক্তিক উত্তর আছে মহাভারতের বনপর্বের ১৭৭.৪ শ্লোকে। সেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, "যা প্রাণীগণের অত্যন্ত হীতকর, তাই সত্যি এবং বিপরীতে যা প্রাণীগণের অত্যন্ত অহীতকর তাই মিথ্যা।" এ সকলই নির্ভর করবে প্রাণীগণের হীত এবং অহীতের উপরে। জগতে এমন অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি আছেন, যাদের পেশা হয়ত ডাকাতি হলেও, সে ডাকাতির উপার্জিত অর্থে তারা সাধারণ মানুষের কল্যাণ করেছেন। অকাতরে দান করে বিলিয়ে দিয়েছেন সকল সম্পদ।
এর জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ অষ্টাদশ শতাব্দীর রংপুরের কীর্তিমতী নারী দেবী চৌধুরাণী। সেময়ে রাজস্ব আদায়ে ইংরেজদের বাড়বাড়ন্ত অত্যাচারে এদেশের সাধারণ কৃষকদের সাথে সাথে জমিদাররাও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বৃহত্তর রংপুর জুড়ে ইংরেজ নীলকরদের অত্যাচার বেড়ে যায়। তারা জোরপূর্বক উর্বর জমিতে কৃষকদের নীলচাষ করতে বাধ্য করতে শুরু করে। এরই ফলশ্রুতিতে দেবী চৌধুরাণী ভবানী পাঠকের নেতৃত্বে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাদের তীব্র রোষানলে পড়ে। দেবী চৌধুরাণীর সাথে থাকে দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া অঞ্চলের হাজার হাজার সাধারণ কৃষক। কারণ দেবী চৌধুরাণী ইউরোপের রবিন হুডের মত বড়লোকদের থেকে ধনসম্পদ নিয়ে এ গরীব অসহায় কৃষকদের অকাতরে দান করেছিলেন।
প্রাণীকুলের হীতকর ব্যক্তির জীবন রক্ষার্থে মিথ্যা বললে পাপ স্পর্শ করে না, একে আপদধর্ম বলে। এ অবস্থায় ধর্মের রূপ কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়। আমাদের চতুরাশ্রম ব্যবস্থায় দ্বিতীয় আশ্রম বিবাহ।"ব্রহ্মচর্যাশ্রম" অর্থাৎ পড়াশোনা শেষ করে এ আশ্রমে প্রবেশ করতে হয়। বিবাহ একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বৈদিক সংস্কার, এর মাধ্যমে বংশরক্ষা হয়। বৈদিক যুগ থেকে রামায়ণ মহাভারত বাহিত হয়ে বিবাহ করে প্রিয়জনকে কাছে পেতে অসংখ্য ঘটনার ঘনঘটা এ ভূখণ্ড সহ সারা পৃথিবীজুড়ে ঘটেছে। প্রিয়জনকে বিবাহ করে স্থায়ীভাবে পেতে কতপুরুষ কত নারীকে জগতে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে এর হিসেব নেই। আজও এমন কোন দিন নেই যে, পৃথিবীর কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ প্রিয়জনকে কাছে না পেয়ে, বিবাহ করতে না পেরে আত্মাহুতি দিয়ে জীবনপ্রবাহ শেষ করে দিচ্ছে। তবে সত্যিকারের ভালবাসা থাকলে, একটা প্রচণ্ড দৈবী প্রেরণায় সকল বাঁধা অতিক্রম করে মানুষ তার প্রিয়জনকে কাছে পায়। তবে একথাও সত্যি মানুষ সর্বদাই তার ভালবাসার মানুষকে কাছে পায় না। কথাটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর শ্রীকান্ত উপন্যাসে বলেছেন, "বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না—ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে। ছোটখাটো প্রেমের সাধ্যও ছিল না—এই সুখৈশ্বর্য-পরিপূর্ণ স্নেহ-স্বর্গ হইতে মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য আমাকে আজ একপদও নড়াইতে পারিত।"
সত্যিকারের কাউকে ভালবাসলে, সেই ভালবাসার মানুষকে কাছে পেতে আপাত মিথ্যার আশ্রয় নেয়া যায়, যেহেতু উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু ভালবাসার মধ্যে যদি স্বার্থ লুকিয়ে থাকে তবে এটি পাপকর্ম। ইদানীং আমরা দেখি, ভালবাসার মানুষকে আমরা যতটা ভালবাসি তার থেকে তার পরিবার পরিজন এবং বাবার অর্থবিত্তকে ভালবাসি। ভালবাসার নামে থাকে, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, দৈহিক স্বার্থ। অধুনা যুক্ত হয়েছে, ধর্মীয় স্বার্থ। এর অভিঘাতে পড়ছে বাংলাদেশের অসংখ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণী। তারা না বুঝেই এ ভালবাসা নামক বিষপান করতে গিয়ে পরিবার পরিজন হারা হয়ে ধর্মান্তরিত হচ্ছে।
পরবর্তীতে যখন বুঝতে পারছে তখন হয়ত জল অনেক দূর গড়িয়ে সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। পিতামাতা পরিবার পরিজনকে পরিত্যাগ করে, তথাকথিত বিবাহের ফলে অনেকে জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকে, আবার কেউ কেউ হয় আত্মঘাতী। প্রদীপ নেভার আগে বুঝতে পারে, এটা ভালবাসা ছিল না,নতুন স্বপ্ন ছিল না, বিবাহ ছিল না, এটা ছিল একটি গোষ্ঠীবদ্ধ ধর্মান্তরের ফাঁদ। শাক্তকবি রামপ্রসাদ সেনের ভাষায় বলতে হয়:
"কেবল আসার আশা, ভবে আসা, আসা মাত্র হল ।যেমন চিত্রের পদ্মেতে পড়ে, ভ্রমর ভুলে রল ॥মা নিম খাওয়ালে , চিনি বলে, কথায় করে ছল ।ওমা ! মিঠার লোভে,তিত মুখে সারা দিনটা গেল ॥"
এ শাক্তপদাবলীর মত, আমরা অনেকেই জীবনে ভ্রমর হয়ে পদ্মের ছবিকে দেখে পদ্ম মনে করে মধুপান করতে গিয়ে প্রতারিত হই। চিনি মনে করে খাওয়ার পরে টের পাই, এটা চিনি নয় ছলনা করে নিমতিতা খাইয়ে দিয়েছে। মিষ্টির লোভে তখন সারাদিন তেতোমুখেই থাকতে হয়।
তবে নিস্পাপ ভালবাসা অত্যন্ত পবিত্র, আমাদের অবতার পুরুষরাও একে অস্বীকার করেননি। আমরা তাঁদের জীবনেও এর শুদ্ধ প্রকাশ দেখি।ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনেও দেখা যায়, তিনিও বৈদর্ভ রাজকন্যা রুক্মিণীর শুদ্ধ ভালবাসাকে বিবাহে রূপ দিতে গিয়ে সামান্য ছলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। যে ছলে মানুষের কল্যাণ হয়, সুখ লাভ হয়; তা ছল নয়, তা আপদধর্ম। বিদর্ভের অধিপতি রাজা ভীষ্মকের কন্যা রুক্মিণী। অনন্য রূপবতী, ধীময়ী, উদারচেতা ও সুশীলা। অপরূপা রুক্মিণী মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন দ্বারকাপতি শ্রীকৃষ্ণকে। কিন্তু রুক্মিণীর বিয়ে ঠিক হয়েছে চেদিরাজ শিশুপালের সঙ্গে। বিয়ে ঠিক করেছেন রুক্মিণীর বড় ভাই রুক্মী কুমার। রুক্মিণী তাঁর না-দেখা, শুধু কানে বীরত্বের গাথা শোনা নায়ক শ্রীকৃষ্ণকে একটি আবেগঘন প্রেমপত্র লিখে তাঁকে নিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। সুনন্দ নামে এক বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণ দূতের মাধ্যমে প্রেমপত্রটি প্রেরণ করলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে। সেই প্রেমপূর্ণপত্রে রুক্মিণী লিখলেন:
"হে প্রভু, তোমাকে আমি আমার দেহ মন প্রাণ সমর্পণ করেছি। তুমিই আমার পরমপুরুষ। আমাকে তুমি তোমার পত্নীরূপে গ্রহণ কর। শিশুপালাদি যেন আমাকে স্পর্শ করতে না পারে। তাই তুমি অতিদ্রুত এসে আমার পাণিগ্রহণ কর।"
পত্রটিতে রুক্মিণীহরণের যাবতীয় কলাকৌশল স্বয়ং রুক্মিণীই বলে দেন শ্রীকৃষ্ণকে। বিনা রক্তপাতে সে অনুসারে বড় ভাই বলরামের সহযোগিতায় বসন্তকালে রুক্মিণীকে হরণ করে, দ্বারকায় নিয়ে এসে বিবাহ করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।বিবাহের পরে রুক্মিণী হন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রধান মহিষী।
রুক্মিণীর মত যদি তীব্রতর ভালবাসা কারো হৃদয়ে থাকে, তবে তাকে পেতে মিথ্যার আশ্রয়ে কোন পাপ স্পর্শ করে না। কিন্তু বর্তমানের ভালবাসা সাময়িক ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময়ে তা হচ্ছে শুধুই সময় অতিক্রম করা। কিছুদিন পরেই ভালবাসার মানুষদের ভেতরের স্বরূপ বের হয়ে যাচ্ছে। মানুষ বেশীক্ষণ অভিনয় করতে পারে না।ভালবাসার মানুষকে বিবাহের আগে সম্ভব হলে পরীক্ষা করে নিতে হয়। বিয়ে করার আগে হবু বরের সাথে রৌদ্রের মধ্যে রাস্তায় দুইঘন্টা জ্যামে বসে থাকবেন। আগামীতে তার ধৈর্য এবং মানসিকতা এমনিতেই টের পেয়ে যাবেন, কাউকে কিছু বলতে হবে না।বিপরীতে হবু কনেকে দামী শপিংমলে নিয়ে যাবেন বা দুইঘন্টা কোন রান্নাঘরে বসে গল্প করার চেষ্টা করবেন। দুজন দুজনের প্রকৃতি এমনিতেই বুঝে যাবেন, আর কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।