আদ্যাশক্তি মহামায়ার
(১)সগুণাবস্থায় সাত্ত্বিকী শক্তি সরস্বতী,
(২)রাজসী শক্তি মহালক্ষ্মী এবং
(৩)তামসী শক্তি মহাকালী।
তাই মহাদেবী আদ্যাশক্তির প্রধান রূপ তিনটি।
নির্গুণা যা সদা নিত্যা ব্যাপিকা বিকৃতা শিবা।
যোগগম্যা অখিলাধারা তুরীয়া যা চ সংস্থিতা।।
তস্যাস্তু সাত্ত্বিকী শক্তী রাজসী তামসী তথা।
মহালক্ষ্মীঃ সরস্বতী মহাকালীতি তাঃ স্ত্রিয়ঃ।।
(দেবীভাগবত: ১.২.১৯-২০)
" গুণাতীত নিত্য মঙ্গলময়ী শক্তি সর্ব্বদা সকল স্থানেই অখণ্ড অবিকৃতরূপে বিরাজমান আছেন ; যোগেন্দ্র পুরুষগণ যাঁকে সমাধিকালে নিজ আত্মমন্দিরে তুরীয় চৈতন্যরূপে লাভ করেন। তাঁরই সগুণাবস্থায় সাত্ত্বিকী শক্তি সরস্বতী, রাজসী শক্তি মহালক্ষ্মী এবং তামসী শক্তি মহাকালী; এই তিনটি অসীমশ্চৈর্য্যশালিনী অনুপম রমণীমূর্ত্তির প্রকাশ।"
দেবীভাগবতের মত মহাভাগবত পুরাণেও দেবী ভগবতীর লীলা বিষয়ে এ সরস্বতী, লক্ষ্মী এবং কালী এ ত্রিরূপে অবতীর্ণের কথা বলা হয়েছে। সেখানে দেবর্ষি নারদ , আদ্যাশক্তি মহামায়া সম্পর্কে জানতে চান ভগবান শিবের কাছে। ভগবান শিব তখন বিস্তৃতভাবে নারদের প্রশ্নের উত্তরে দেবীমাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন।
যা মূলপ্রকৃতিঃ সূক্ষ্মা জগদাদ্যা সনাতনী ।
সৈব সাক্ষাৎ পরং ব্রহ্ম সাস্মাকং দেবতাপি চ ।।
অয়মেকো যথা ব্রহ্মা তথা চায়ং জনার্দনঃ ।
যথা মহেশ্বরশ্চাহং সৃষ্টিস্থিত্যন্তকারিণঃ।।
এবং হি কোটিকোটীনাং নানাব্রহ্মাণ্ডবাসিনাম্ ।
সৃষ্টিস্থিতিবিনাশানাং বিধাত্রী সা মহেশ্বরী ।।
অরূপা সা মহাদেবী লীলয়া দেহধারিণী ।
তয়ৈতৎ সূয়তে বিশ্বং তয়ৈব পরিপাল্যতে ।।
বিনাশ্যতে তয়ৈবান্তে মোহ্যতে চ তয়া জগৎ।
সৈব স্বলীলয়া পূর্ণা দক্ষকন্যাভবৎ পুরা ।।
তথা হিমবতঃ পুত্রী তথা লক্ষ্মী সরস্বতী ।
অংশেন বিষ্ণোর্বনিতা সাবিত্রী ব্রহ্মণস্তথা ।।
( মহাভাগবত পুরাণ:৩য় অধ্যায়,১-৬ )
"যিনি সূক্ষ্ম , শাশ্বত আর মূলপ্রকৃতিরূপিণী জগদম্বা, তিনিই সাক্ষাৎ পরব্রহ্ম এবং ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এ ত্রিদেবের ঈশ্বরী। যেমন ত্রিদেব সৃষ্টি- স্থিতি- লয় করেন তেমনি সেই ভগবতী তাঁর অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে নিবাসী প্রানীর সৃষ্টি- স্থিতি- লয়ের বিধানকারিণী মহেশ্বরী। সেই মহাদেবীর কোন রূপ নেই; নিরাকার হয়েও এই দেবী লীলার জন্য দেহ ধারণ করেন । তাঁর দ্বারাই এ বিশ্ব সৃষ্টি, পালন এবং লয় হয়। তিনিই জগতকে মোহিত করে রেখেছেন।প্রাচীন কালে তিনিই স্বীয় লীলাবশে দক্ষপুত্রী সতী এবং হিমালয় কন্যা উমা নামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এই দেবীই অংশে বিষ্ণুভার্যা লক্ষ্মীদেবী ও ব্রহ্মার ভার্যা সাবিত্রী রূপে প্রকট হয়েছিলেন।"
দেবীর তিনটি প্রধানতম রূপের অন্যতম হল দেবী লক্ষ্মী। তিনি বিষ্ণুর পত্নী বা শক্তি ; তাই তাঁর নাম বৈষ্ণবীশক্তি। জগতের পালিত হয় তাঁরই ইচ্ছায়। সেই মহাদেবী লক্ষ্মীকে আমরা ধনসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবেও পূজা করি। তিনি আদিশক্তি মহামায়ার রাজসিক স্বরূপ । তিনি শ্রীস্বরূপা। তাই ঋগ্বেদের শ্রীসূক্তে বিস্তারিত তার বর্ণনা করা হয়েছে। ধনসম্পদ, আধ্যাত্মিক সম্পদ, সৌভাগ্য সম্পদ, আরোগ্য সম্পদ, সৌন্দর্য সম্পদ সহ সকল সম্পদের তিনিই দাত্রী । ঋগ্বদের শাকল শাখার অন্তর্ভুক্ত দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূক্তটি বৈদিক 'শ্রীসূক্ত'।
ওঁ হিরণ্যবর্ণাং হরিণীং সুবর্ণরজতস্রজাম্ ।
চন্দ্রাং হিরণ্ময়ীং লক্ষ্মীং জাতবেদো ম আবহ ॥
তাং ম আবহ জাতবেদো লক্ষ্মীমনপগামিনীম্ ।
যস্যাং হিরণ্যং বিন্দেয়ং গামশ্বং পুরুষানহম্ ॥
অশ্বপূর্বাং রথমধ্যাং হস্তিনাদপ্রবোধিনীম্ ।
শ্রিয়ং দেবীমুপহ্বয়ে শ্রীর্মাদেবীর্জুষতাম্ ॥
কাং সোস্মিতাং হিরণ্যপ্রাকারামার্দ্রাং জ্বলন্তীং তৃপ্তাং তর্পয়ন্তীম্ ।
পদ্মে স্থিতাং পদ্মবর্ণাং তামিহোপহ্বয়ে শ্রিয়ম্॥
চন্দ্রাং প্রভাসাং যশসা জ্বলন্তীং শ্রিয়ং লোকে দেবজুষ্টামুদারাম্ ।
তাং পদ্মিনীমীং শরণমহং প্রপদ্যেঽলক্ষ্মীর্মে নশ্যতাং ত্বাং বৃণে॥
"হে জাতবেদ অগ্নিদেব! সুবর্ণবর্ণা, হরিণীর মত চঞ্চল, সোনা এবং রূপার বিবিধ মালায় বিভূষিত ; পূর্ণিমার চন্দ্রের মত প্রকাশমানা, হিরণ্ময়ী লক্ষ্মীকে আমার জন্য আহ্বান করুন।
হে জাতবেদ অগ্নিদেব! নিম্নগমনরোধকারী সেই লক্ষ্মীকে আমার জন্য আহ্বান করুন। যিনি আহূতা হলে আমি স্বর্ণ, গো, অশ্ব, পুত্র মিত্রাদি প্রাপ্ত হব।
অশ্ব যাঁর পুরােভাগে, রথাসীনা হস্তীর বৃংহণ নাদ দ্বারা যিনি প্রকৃষ্টরূপে জ্ঞাপিকা; সেই শ্রীদেবীকে আমার নিকট আহ্বান করুন, তিনিই আমাকে কৃপা অনুগ্রহ করবেন।
ব্রহ্মারূপা, স্মিতহাস্যকারিনী, সুবর্ণাদির দ্বারা পরিবেশিষ্টা, আর্দ্রা, প্ৰকাশমানা, প্রসন্নবদনা, ভক্তের মনােবাঞ্ছাপূর্ণকারিণী, পদ্মাসীনা, পদ্মবর্ণা সেই শ্রীদেবীকে আহ্বান করি।
চন্দ্রের ন্যায় প্রভাসম প্রকাশমানা, নিজ যশে প্রজ্জ্বলিত, জগতের শ্রীস্বরূপা, ইন্দ্রাদিদেবসেবিতা, পদ্মিনীর শরণ গ্রহণ করছি। হে শ্রীদেবি! আমার দুর্ভাগ্যসূচক অলক্ষ্মী বিনষ্ট হােক, আমি তোমার শরণ নিলাম।"
বৈদিকযুগ থেকে শ্রীস্বরূপা মহালক্ষ্মী দেবী পূজনীয় এবং বন্দনীয়। বৃহৎবঙ্গে ঘরের মেয়ে হয়ে পূজিত হন। একারণে এখনো বঙ্গে গৃহের কোন মেয়ে যদি অত্যন্ত গুণবতী হয়, তবে জাতিধর্মনির্বিশেষে আমরা সকলেই তাকে লক্ষ্মীমেয়ে বলে সম্বোধন করি। দেবী ভাগবত মতে, স্বর্গে তিনিই স্বর্গলক্ষ্মী , রাজগৃহে তিনি রাজলক্ষ্মী , গৃহে তিনি গৃহলক্ষ্মী । তিনি শান্তা , দান্তা , সুশীলা , সর্ব মঙ্গলা , ষড়রিপু বর্জিতা । অগ্নি পুরাণ মতে শ্রী বা লক্ষ্মী হলেন যজ্ঞবিদ্যা , তিনিই আত্ম্যবিদ্যা , যাবতীয় গুহ্যবিদ্যা ও মহাবিদ্যাও তিনি। তিনিই সকল বিদ্যার বিমুক্তিফলদায়িনী।
‘যজ্ঞবিদ্যা মহাবিদ্যা গুহ্যবিদ্যা চ শোভনা।
আত্ম্যবিদ্যা চ দেবি বিমুক্তিফলদায়িনী ।।’
রত্ন হল ধন , যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন লক্ষ্মী । এই হল দেবী লক্ষ্মীর সামগ্রিক স্বরূপ।দশমহাবিদ্যার দশম মহাবিদ্যা কমলা দেবী হলেন দেবী লক্ষ্মী। হস্তিদ্বারা পরিব্যাপ্ত হওয়ায় তাঁকে গজলক্ষ্মীও বলা হয়। কোলাসুর নামক এক অসুরকে বধ করার জন্যই দেবী কমলার আবির্ভাব। তাই মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে কোলাবিধ্বসীরূপে মহালক্ষ্মী দেবী বিরাজিতা। বারাহীতন্ত্র মতে পুরাকালে প্রজাপতি ব্রহ্মা, ভগবান বিষ্ণু, ভগবান শিব এই কমলা দেবীকে পূজা করেন বলে কমলা মায়ের এক নাম ‘ত্রিপুরা’ ।
মহাদেবী লক্ষ্মী পদ্মের আসনে উপবিষ্ঠা।পদ্ম হল সর্বাত্মক মুক্তির প্রতীক, ষটচক্রের উর্ধ্বে সহস্রারের প্রতীক। সাধকের মূলাধার থেকে উউত্থিত শক্তি সহস্রারে এসে গন্তব্য পায়। পদ্মা নদী রূপে বঙ্গদেশে দেবী লক্ষ্মী প্রবাহিতা। পদ্মার জলের স্রোতধারায় উর্বরা এবং শস্য শ্যামলা হল বঙ্গদেশ।তিনিই কৃষকের হাসি স্বরূপা, কৃষি লক্ষ্মী। তিনিই বণিকের বানিজ্য লক্ষ্মী; তাই আজও বণিকের গৃহে তিনি গন্ধেশ্বরীরূপে পূজিতা। বাংলায় বছরের শুরুতেই নববর্ষে ব্যবসায়ীগণ সিদ্ধিদাতা গণেশের সাথে দেবী লক্ষ্মীর উপাসনা করেন ।
দেবী লক্ষ্মী দূরসমুদ্রে বৃহৎতরী নিয়ে বাণিজ্যের প্রেরণাদাত্রী। তাই আজও বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, "বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী"। চঞ্চলা লক্ষ্মীর বাণিজ্যেই নিবাস। তবে সেই চঞ্চলা লক্ষ্মীকে স্থীরভাবে ধরে রাখা কষ্টকর। অনেক সময় অসাধ্যও বটে। বাঙালি জাতি যেন সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করে সমৃদ্ধশালী হয় ; এ কামনায় পূর্ববঙ্গে লক্ষ্মীপূজাতে লক্ষ্মীদেবী নৌকার উপরে বসিয়ে পূজা করা হয়। কলা কাছের খোলা দিয়ে এ বাণিজ্য নৌকা তৈরি করা হয়। দেবীকে সেই কলার খোলার নৌকায় অধিষ্ঠিত করে পূজা করা হয়। "ওঁ শ্রীং লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ" এ মন্ত্রে দেবীর পূজা করা হয়। দেবী লক্ষ্মীর পূজায় দেবীর একটি গায়ত্রী মন্ত্র ব্যবহৃত হয়। লক্ষ্মী গায়ত্রী মন্ত্রটি শ্রীসূক্তের শেষের দিকের একটি মন্ত্র। শ্রীসূক্তের ২৬ নং মন্ত্রে গায়ত্রী মন্ত্রটি আছে। মন্ত্রটিতে বলা হয়েছে, মহাদেবী লক্ষ্মী ঋষি-মুনিদের ধ্যানের ধ্যেয়বস্তু। তিনিই ভগবান বিষ্ণুর পত্নীরূপা বৈষ্ণবী শক্তি। জীবের জাগতিক সম্পদ সহ মুক্তির তিনিই অধিষ্ঠাত্রী। সেই জগজ্জননী লক্ষ্মীর আমাদের কল্যাণের পথে প্রেরণ করুক। আমরা যেন সর্বদাই তাঁর পথে চলতে পারি।
মহাদেব্যৈ চ বিদ্মহে বিষ্ণুপত্নী চ ধীমহি।
তন্নো লক্ষ্মীঃ প্রচোদয়াৎ।।
দেবীর ধ্যানমন্ত্রের বর্ণনা অনুসারে বাংলায় দেবীর প্রতিমা তৈরি করা হয় না। বাংলায় লক্ষ্মীমূর্তিকে দেখলে ঘরের মেয়ে বলেই বোধ হয়। বাংলায় বর্তমানে লক্ষ্মী প্রতিমা দ্বিভুজা। পূর্বে বাংলায় লক্ষ্মী প্রতিমা দ্বিভুজা ছিল না। বঙ্গে অবস্থিত বিভিন্ন সংগ্রহশালায় যত প্রাচীন লক্ষ্মীমূর্তি আছে তা সকলই চতুর্ভুজা। সম্ভবত মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যের জনপ্রিয়তার যুগে লক্ষ্মী মূর্তি চতুর্ভুজা থেকে দ্বিভুজা হয়ে যায়। শ্রীচণ্ডী সহ বিবিধ শাস্ত্রে আমরা দেখি, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কালী সকল রূপই এক আদ্যাশক্তি মহামায়ার রূপ। অর্থাৎ যিনি দুর্গা; তিনিই লক্ষ্মী,তিনিই সরস্বতী এবং তিনিই কালী। কিন্তু মঙ্গলকাব্যে আমরা দেখি, লক্ষ্মী এবং সরস্বতী দেবী দুর্গার দুই মেয়ে। মঙ্গলকাব্যের লোকায়িত সংস্কৃতির মাধ্যমে, বাংলা ভাষা বিকশিত হয়েছে; লোকসংস্কৃতি, লোকসংগীত বিকশিত হয়েছে। কিন্তু এ মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যগুলো সমৃদ্ধ সাহিত্য হিসেবে গণ্য হলেও, ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মান্য নয়। মধ্যযুগ থেকেই দেবী লক্ষ্মীকে ঘরের আদরের মেয়ের মত করে উপাসনা প্রচলিত হয়। সেভাবেই বাংলার ঘরে ঘরে শুরু হয় দ্বিভুজা শান্তস্বরূপা দেবীর আরাধনা। ধনী হোক অথবা গরিব, তাতে কিছুই যায় আসে না ; প্রতিটি বাঙালির ঘরে আজও কিছু থাক বা না থাক ছোট্ট একটি লক্ষ্মীর আসন থাকবেই। প্রতি বৃহস্পতিবার মায়েরা বোনেরা সে আসনে নিজেদের মত করে ভক্তিযুক্ত হৃদয়ে উপাসনা করে দেবীর। শ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত অষ্টাদশভুজা সেই ভয়ংকরী যুদ্ধংদেহী রূপ হারিয়ে গেছে বাঙালির ঘরে ঘরে কন্যারূপে উপাসিতা স্নিগ্ধ, কোমলা দ্বিভুজা লক্ষ্মীরূপের কাছে।
ওঁ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ-সৃণিভির্যাম্যসৌম্যয়োঃ।
পদ্মাসনাস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্।।
গৌরবর্ণাং সুরূপাঞ্চ সর্বলঙ্কারভূষিতাম্।
রৌক্মপদ্মব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।
"দক্ষিণহস্তে পাশ, অক্ষমালা, এবং বামহস্তে পদ্ম ও অঙ্কুশধারিণী, পদ্মাসনে উপবিষ্টা, শ্রীরূপা, ত্রিলোকমাতা, গৌরবর্ণা, সুন্দরী, সর্বালঙ্কারভূষিতা, ব্যগ্রহস্তে সুর্ণপদ্মধারিণী এবং দক্ষিণহস্তে বরদাত্রী দেবীকে ধ্যান করি।"
বাংলায় বর্তমানে যে অর্থে লক্ষ্মী শব্দটি ব্যবহৃত হয়, সেই একই অর্থে লক্ষ্মী শব্দটির প্রয়োগ আমরা ঋগ্বেদেই দেখি।"ভদ্রৈষাং লক্ষ্মীনির্হিতাধি বাচি"- তাদের বচনে মঙ্গলময়ী লক্ষ্মী বিরাজিতা (১৯.৭১.০২)। দেবী লক্ষ্মী বৈদিকযুগ থেকে আবহমানকাল ধরে পূজিত হয়ে আসছেন। লক্ষ্মী শব্দটিও সমৃদ্ধি, সৌন্দর্য, শ্রী, শক্তি অর্থে বৈদিক ঋষিদের মত আজও আমরা ব্যবহার করছি। বৈদিক শ্রী এবং লক্ষ্মী একই অর্থে ব্যবহৃত হয়।তাই শ্রীসূক্তে অসংখ্যবার 'লক্ষ্মী' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ঋগ্বেদের একাধিক মন্ত্রে 'শ্রী' শব্দটির উল্লেখ আছে:
"সোমঃ শ্রীণন্তি পৃশ্নয়ঃ"(০১.৮৪.১১)
"শ্রীণন্তি মতিভিঃ স্ববির্দম্" (০৯.৮৪.০৫)
"শ্রীণন্তি বসূভির্ন নিক্তৈঃ" (০৯.৯৩.০৩)
কখনো ঐশ্বর্য রূপে, কখনো মানবের শ্রীরূপে, কখনো মানবের ভক্ষ অন্নরূপে, রত্নরাজিরূপে, পশুসম্পদরূপে , যজ্ঞান্তে পুরোহিতের দক্ষিণা রূপে সর্বত্রই লক্ষ্মীদেবী বিরাজিতা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এ প্রসঙ্গে হয়েছে:
স্বর্গে চ স্বর্গলক্ষ্মীশ্চ সম্পৎস্বরূপিণী ।
পাতালেষু চ মর্ত্ত্যেষু রাজলক্ষ্মীশ্চ রাজসু ।।
গৃহলক্ষ্মীর্গৃহেম্বেব গৃহিণী চ কলাংশয়া ।
সম্পৎস্বরূপা গৃহিণাং সর্ব্বমঙ্গলমঙ্গলা ।।
গবাং প্রসূঃ সা সুরভী দক্ষিণা যজ্ঞকামিনী ।
ক্ষীরোদসিন্ধুকন্যা সা শ্রীরূপা পদ্মিনীষু চ ।।
শোভারূপা চ চন্দ্রে চ সূর্য্যমণ্ডলমণ্ডিতা ।
বিভূষণেষু রত্নেষু ফলেষু চ জলেষু চ ।।
নৃপেষু নৃপপত্নীষু দিব্যস্ত্রীষু গৃহেষু চ ।
সর্ব্বশস্যেষু বস্ত্রেষু স্থানেষু সংস্কৃতেষু চ ।।
প্রতিমাষু চ দেবানাং মঙ্গলেষু ঘটেষু চ ।
বৃক্ষশাখাসু রম্যাসু নবমেঘেষু বস্তুষু ।।
( ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ:প্রকৃতিখণ্ড,৩৫.১৮-২৪)
"সেই দেবী ইন্দ্রের সম্পদরূপে স্বর্গলক্ষ্মী রূপে, পাতালে ও ভূলোকে নৃপতির গৃহে রাজলক্ষ্মী রূপে বিরাজিতা। সেই সর্বমঙ্গল- মঙ্গলা দেবীই গৃহীগণের গৃহে গৃহলক্ষ্মীরূপে , কলাংশ দ্বারা গৃহিনী রূপে বিরাজিতা । সেই দেবী গোগণের প্রসূতি সুরভি রূপে- যজ্ঞকামিনী দক্ষিণারূপে – ক্ষীরোদসাগরের দুহিতা রূপে বিরাজ করেন। পদ্মনীতে শ্রীরূপে এবং চন্দ্র ও সূর্যমণ্ডলের জ্যোতিরূপে – রত্নে- ফলে- জলে- নৃপ ও নৃপপত্নীর মধ্যে , দিব্য স্ত্রীতে , গৃহে, সমস্ত শস্যকনায় বিরাজ করেন। সেই কমলা দেবী পরিষ্কার স্থানে, দেবপ্রতিমায়, মঙ্গলঘটে, মাণিক্যে , মুক্তার মালায় , মণি- হীরকে , চন্দনে, রমণীয় বৃক্ষশাখায় ও নতুন মেঘে শোভারূপে বিরাজ করেন।"
দেবী লক্ষ্মীর উপাসনা বৈদিককাল থেকেই প্রচলিত। বৈদিক যজ্ঞে তাঁর উদ্দেশ্যে মন্ত্রের প্রয়োগ পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের শাঙখায়ন গৃ্ূহসূত্রে বৈশ্বদেবকর্মে ভদ্রকালীসহ শ্রীদেবীর ( লক্ষ্মী) উদ্দেশ্যে মন্ত্রোচ্চারণের বিধি দেয়া হয়েছে:
নমঃ শ্রীয়ৈ শয্যায়াং
শিরসি পাদতঃ ভদ্রকাল্যৈ।।
(শাঙখায়ন গৃ্ূহসূত্র:২.১৪.১৪)
ঋগ্বেদের শাঙখায়ন গৃ্ূহসূত্রে বৈশ্বদেবকর্মে শ্রীদেবী ( লক্ষ্মী) সহ ভদ্রকালীর উদ্দেশ্যে মন্ত্রোচ্চারণের বিধি মনুসংহিতাতেও পাওয়া। এতেই প্রমাণিত যে, শ্রীরূপা দেবী লক্ষ্মীর উপাসনা সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত।
উচ্ছীর্ষকে শ্রিয়ৈ কুর্য্যাদ্ভদ্রকাল্যৈ চ পাদতঃ। ব্রহ্মবাস্তোষ্পতিভ্যাক্ত বাস্তুমধ্যে বলিং হরেৎ।।
(মনুসংহিতা:৩.৮৯)
"উচ্ছীর্ষক অর্থাৎ প্রসিদ্ধ দেবগৃহের শীর্ষস্থানে বা গৃহস্থের শয়নগৃহের ঊর্দ্ধভাগে উত্তর বা পূর্বদিকে লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে ‘শ্রিয়ৈ নমঃ’ মন্ত্রোচ্চারণ পূর্বক বলি প্রদান করবে এবং ‘ভদ্রকাল্যৈ নমঃ' মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক বলি প্রদান করবে। গৃহমধ্যে ব্রহ্মার উদ্দেশ্যে ‘ব্রহ্মণে নমঃ’ ও বাস্তুদেবতার উদ্দেশ্যে ‘বাস্তোষ্পতয়ে নমঃ' মন্ত্রোচ্চারণ করে বলি প্রদান করবে।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।