-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

"কামস্তদগ্রে সমবৰ্তত মনসাে"; কাম জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

মানবজীবনে কাম বা যৌনতা একটি প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সবাই কাম বা যৌনতাকে চায় এবং সুযোগ বুঝে সদ্ব্যাবহার বা অসদ্ব্যবহারও করে, শুধুমাত্র মুখে প্রকাশে অস্বীকৃতি ও অস্বস্তি। দিনেরবেলা যৌনতার বিরুদ্ধে যতই বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়া হোক না কেন; রাত্রিবেলায় সেই কামই সুযোগ বুঝে হিংস্র বাঘ হয়ে ক্ষতবিক্ষত করে হৃদয়কে। শাস্ত্রে বারেবারেই ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ এ চতুর্বর্গের কথা আছে, আমরা হয়তো ভুলে যাই এ চতুর্বর্গের মধ্যে কাম অন্যতম। কাম জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, জীবনের বাইরে না। কাম থেকেই জীবের উৎপত্তি। অথর্ববেদ সংহিতায় 'কামসূক্ত' নামে একটি বিখ্যাত সূক্ত আছে। সূক্তটিতে ফলসিদ্ধির নিমিত্ত কামের স্তুতি করা হয়েছে। ঈশ্বরের জগতসৃষ্টির ইচ্ছার কামনা থেকেই বারংবার এ জগতের উৎপত্তি।  কামস্তদগ্রে সমবৰ্তত মনসাে রেতঃ প্রথমং যদাসীৎ। স কাম কামেন বৃহতা সযােনী রায়স্পােষং যজমানায় ধেহি।। (অথর্ববেদ সংহিতা:১৯.০৬.০৭.০১) "অগ্রে এই বিকারজাত সৃষ্টির প্রাক-অবস্থায় পরমেশ্বরের মনে সম্যরূপে কাম জাত হয়েছিল (সমবর্তত), অর্থাৎ সৃষ্টির ইচ্ছা সঞ্জাত হয়েছিল। (কি জন্য?—না)–তাদৃশ মনঃসম্বন্ধি রেতঃ এই কারণেই উদ্ভূত হয়েছিল যে, অতীতকল্পে সৃষ্টির বীজভূত, প্রাণীবর্গের কৃত পূণ্য ও অপূণ্যরূপ কর্মসমূহ সৃষ্টিসময়ে বর্ধিঞ্চু হওয়ার জন্য সম্যক্ প্রকাশিত হয়েছিল। অর্থাৎ পরিপক্করূপে ফলের জন্য উন্মুখ হয়েছিল। হে কাম, সর্বজগৎকে সৃষ্টির উদ্দেশে পরমেশ্বরের দ্বারা উৎপাদিত তুমি মহান দেশ-কাল-বস্তুর পরিচ্ছেদরহিত পরমেশ্বরের সমানকারণ হয়ে (সযােনিঃ), অর্থাৎ পরমেশ্বর ব্যতিরিক্ত কারণান্তররহিত হয়ে এই যজমানে ধনপ্রদাতা বা হবিঃপ্রদাতা পুরুষে ধনপুষ্টি অর্থাৎ সমৃদ্ধি স্থাপন করাে (রায়ঃ পােষম ধেহি) অর্থাৎ প্রদান করাে।" বর্তমানকালে অনেক ধর্মীয় সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময়ে ঢালাওভাবে কামের বিরুদ্ধে, প্রেমের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে বেড়ান; বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। সেই ব্যক্তিদেরকেই যদি সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরার সামনে রাখা যায় তাহলে বোঝা যাবে, তাদের প্রকাশ্যে দেয়া বক্তব্যগুলো কতটুকু যৌক্তিক? অনেকেই বলবেন যে, আমি খোলামেলা যৌনতার পক্ষে সাফাই গাচ্ছি বা প্রোমোট করছি। বিষয়টা ঠিক ওরকম না। জগতের শুরু থেকে যে কামধারা বহমান, তা প্রলয় পর্যন্ত প্রত্যেকটি জীবের মাঝেই আছে এবং সর্বদা থাকবে। একে কেউ রোধ করতে পারবে না। তবে কোন বিষয়েই অতিরিক্ত ভাল নয়। যে অতিরিক্ত করবে সেই ফাঁদে পরবে। সকল কিছুতেই মধ্যপন্থা যৌক্তিক। বিষয়টি শ্রীমদ্ভগবদগীতার ষষ্ঠ অধ্যায় ধ্যানযোগে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আমাদের কিছু কিছু সাধুরা বলে বেড়ান, দুটি সন্তান নেয়ার পরে স্বামী-স্ত্রী ভাইবোনের মত থাকতে হবে। এমনকি এদের কেউ কেউ আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, যদি দুটি সন্তান নেন, তাহলে স্ত্রীর সাথে সেই ব্যক্তি সারাজীবনে শুধুমাত্র দুইবারই মিলিত হবেন। এর বাইরে স্ত্রীর সাথে একাধিক মিলনও অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ।এ জাতীয়  হাস্যকর তত্ত্ব প্রচার করে আমাদের সমাজের তরুণ যুবকদের বিভ্রান্ত করছেন কিছু তথাকথিত ধর্মীয় প্রচারকেরা।মানবজীবনে কাম বা যৌনতা একটি প্রয়ােজনীয় শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। মহাভারত সহ একাধিক শাস্ত্রে বারেবারেই ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মােক্ষ এই চতুবর্গের সাধনের কথা বারেবারেই বলা আছে।আমরা অনেকেই দৈহিকভাবে হয়ত কামে অংশগ্রহণ করছি না। কিন্তু প্রতি দণ্ডে দণ্ডে আমরা মানসিকভাবে কামকে উপভােগ করার চেষ্টা করছি। ক্ষণকালের দৈহিককাম চরিতার্থ থেকে সার্বক্ষণিক মানসিক কামচিন্তা শরীরের জন্য ভয়াবহ।কাম জীবনের বাইরে নয়,কাম জীবনের একটা অঙ্গ। কাম দেহের ক্ষুধা, তৃষ্ণারূপ জৈবিকবৃত্তির মতই স্বাভাবিক একটি বিষয়।  সুপুষ্পিত স্যাদফলঃ ফলবান্ স্যাদ্ দুরারুহঃ। আমঃ স্যাৎ পক্কসঙ্কাশাে ন চ জীর্য্যেত কর্হিচিৎ।। ত্রিবর্গে ত্রিবিদা পীড়া হ্যনুবন্ধাস্তথৈব চ। অনুবন্ধঃ শুভা জ্ঞেয়াঃ পীড়াস্তু পরিবর্জয়েৎ ॥ ধর্মং বিচরতঃ পীড়া সাপি দ্বাভ্যাং নিযচ্ছতি। অর্থজ্ঞাপ্যর্থলুদ্ধস্য কাঞ্চাতিপ্রবর্তিনঃ।। (মহাভারত: আদি পর্ব, ১৩৫ ,৬৮-৭০) “ফুল দেখাবে, কিন্তু ফল দিবে না; ফল দিলেও দুরারোহ থাকবে এবং অপক্ক হয়েও পক্কের মত থাকবে; কিন্তু কখনও জীর্ণ হবে না। ধর্ম, অর্থ ও কাম-এই ত্রিবর্গের মধ্যে একসাথে সবগুলাের, অনুষ্ঠান করতে থাকলে প্রত্যেকটিরই অপর দুটি দ্বারা ব্যাঘাত ঘটে এবং সেই ত্রিবর্গের ফলগুলিরও তেমনি ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু পৃথক পৃথক ভাবে অনুষ্ঠান করলে সকলের ফলই ভাল হয়; অতএব একদা সবগুলাের অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করবে।অর্থ ও কাম ধার্মিকের ধর্মানুষ্ঠানে বাধা দিয়ে থাকে, ধর্ম ও কাম অর্থলােভীর অর্থকে প্রতিহত করে এবং ধর্ম ও অর্থ কামীর কামকে নিরুদ্ধ করে।"  মহাভারতে কামের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে একসাথে সবগুলাের অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে ধর্ম, অর্থ এবং কামকে পৃথক পৃথক ভাবে অনুষ্ঠান করতে বলা হয়েছে। মা বা সংস্কৃত অম্বা শব্দটা একটি পবিত্র শব্দ। জগতে পরমেশ্বরের পরেই মায়ের স্থান।তাই তৈত্তিরীয় উপনিষদে বৈদিক শিক্ষা সমাপনান্তে বৈদিক সমাবর্তন ভাষণে, পিতামাতাকে স্বয়ং মূর্তিমান দেবতা বলা হয়েছে। মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেবো ভব।(০১.১১.০২) বৈদিক সমাবর্তন ভাষণে "মাতৃদেবো ভব।" বলে জন্মদায়িনী মাকেই দেবতাস্বরূপ বলে অভিহিত করা হয়েছে।একইভাবে মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, একজন শিক্ষক থেকে জন্মদায়িনী মাতা একলক্ষ গুণে শ্রেষ্ঠ। তাই শাস্ত্রে মাতৃ শব্দটি নিয়ে যথেচ্ছাচার নিষিদ্ধ । কিন্তু ইদানিং কিছু সাধুদের  সবাইকেই মাতাজী ডাকার নির্দেশনা দিতে দেখা যায়। সাধু-সন্ত সকল নারীকেই মাতৃজ্ঞানে দেখে মাতাজী সম্বোধন করবে, এটাতে সমস্যা নেই ; বরঞ্চ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ বছরের ছেলেরা তাদের সমবয়সী মেয়েদের মাতাজী ডাকছে তখন বিষয়টি অনেকটাই অস্বাভাবিক হয়ে যায়। যাদের প্রতিনিয়ত মাতাজী ডাকছে তাদের সাথে বয়সের কারণে প্রেম করছে, বিয়ে করছে, সবকিছুই করছে। তাহলে মা বা মাতাজী শব্দটির সম্মানটা আর রইলোই বা কোথায়? সনাতন চতুরাশ্রম ব্যবস্থায় একজন সন্ন্যাসী এবং সাংসারিক মানুষের বিধিব্যবস্থা সম্পূর্ণ এক নয়। গৃহী থেকে সন্ন্যাসীর সদাচার অত্যন্ত কঠিন।শাস্ত্রে আছে কাউকে ভুলক্রমেও যদি মা বা মাতাজী সম্মোধন করা হয়, তবে তার সাথে আর প্রেম, বিয়ে বা কিছুই করা সম্ভব না। এমনকি স্বামীও যদি বউকে ভালবাসার ছলে মা বলে ডেকে ফেলে, তাহলে সেই স্ত্রীর সাথে আর স্ত্রীজনোচিত কাজ সে করতে পারবে না। মা বলে ডাকা স্ত্রীর সাথে স্ত্রীজনোচিত কাজ করতে হলে স্বামীকে আগে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, চান্দ্রায়ণ করতে হবে। কারণ মা শব্দটি অত্যন্ত পবিত্র একটি শব্দ।  আমাদের সর্বাগ্রে দরকার ঐক্যবদ্ধ জাতিগঠন। কিন্তু "ব্রহ্মচর্য ব্রহ্মচর্য" বলে চিৎকার করতে করতে আমাদের কিছু সাধুসন্তরা ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে আমাদের যুবক,তরুণ এবং কিশোরদের। যার ফলে হিন্দু তরুণীরাও হিন্দু যুবক-তরুণদের মাকাল ফল মনে করে দূরে সরে যাচ্ছে। যাদের অনেকেই পরবর্তীতে বিভ্রান্ত হয়ে, ধর্মান্তরিত হয়ে, বিধর্মীদের বিয়ে করে, ব্যক্তিজীবন এবং পারিবারিক জীবনকে অশান্ত করে তুলছে। কাউকে উপদেশ দানের আগে উপজীব্য বিষয় হল উপদেশের পাত্র নির্বাচন করা অত্যন্ত জরুরী। যারা সংসার ত্যাগ করে বাণপ্রস্থ, সন্ন্যাস গ্রহণ করেছে, তাদের জন্য স্ত্রীসঙ্গ বারণ; এক্ষেত্রে বিষয়টি যৌক্তিক। কিন্তু একজন অবিবাহিত যুবক, যুবতীকে একই উপদেশ দেয়া বা বিবাহিতদের নিজ স্ত্রীর সাথে সন্তান উৎপাদনবিহীন মিলিত হতে না দেওয়া ; বিষয়গুলো অযৌক্তিক। শুধু দৈহিক সম্পর্কতেই স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক দৃঢ় হয় না; কেবলমাত্র সন্তান জন্মদানের উদ্দেশ্যই স্বামী স্ত্রীর মিলন নয়; দৈহিক কামকে প্রেমে রূপান্তরিত করাটাও অত্যন্ত আবশ্যকীয় কর্ম। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে সারাদিন গায়ে কাঁথা পরে থাকা এবং সন্যাস জীবনের চর্যাচর্য সকল গার্হস্থ্যজীবনের মানুষকে জোরজবরদস্তি করতে বলা অনেকটা একই। ব্রহ্মচর্য বলতে লোকে সাধারণ অর্থে নারী থেকে দূরে থাকাকেই বোঝায়, যা সর্বক্ষেত্রে সঠিক নয়। নারী মানেই শুধু যৌনতার আধার নয়।বৈদিক ঋষিরা স্ত্রীর সাথে সম্মিলিতভাবে  যজ্ঞ করেছেন, সাধনা করেছেন, সন্তানধারা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন আবার ব্রহ্মচর্যও পালন করেছেন। সকল কিছুরই সমন্বয় ছিল তাঁদের জীবনে। তবে এটা সত্য যে, কামের সঙ্গে থাকে উত্তেজনা। কিন্তু শুদ্ধপ্রেমে থাকে প্রশান্তি। কাম যখন শুধুই ভোগ সর্বস্ব হয়ে যায়, তখন সে যুক্ত হয় মোহের সাথে,অজ্ঞানের সাথে, বন্ধনের সাথে, অন্ধকারের সাথে। পক্ষান্তরে যদি সেই কাম প্রেমে রূপান্তরিত হয়, তবে সে প্রেম জ্ঞানের সঙ্গে আলোর সঙ্গে সংযোগ ঘটায়। আলোতেই সকল অন্ধকার দূর হয়ে যায়। অন্ধকারেই জন্ম হয়, চিরকাল অন্ধকারে থাকার জন্য নয়; আলোর অভিমুখে যাওয়ার জন্য। আর কতকাল আমরা ভাবের ঘরে চুরি করে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখবো? এখনও কি ঝেড়ে কাশার সময় আমাদের আসেনি?ব্রহ্মচর্যের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। বেদাদিশাস্ত্রে ব্রহ্মচর্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলা হয়েছে ঠিক। কিন্তু ব্রহ্মচর্য প্রসঙ্গে স্থান, কাল এবং পাত্র অবশ্যই বিবেচ্য। তাই আমাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন, স্থান, কাল এবং পাত্র বিবেচনা না করে অপ্রয়োজনীয় ব্রহ্মচর্যের নামে হিন্দু তরুণ-যুবকদের বিভ্রান্ত না করে তাদের মাঝে পৌরুষ জাগানো, তেজদীপ্ততা জাগানো। তবেই এ জাতি জাগবে। ব্রহ্মচর্যের অবশ্যই প্রয়োজন আছে, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় ব্রহ্মচর্য জাতিকে দূর্বল করে দেয়।  যজুর্বেদীয় শতপথ ব্রাহ্মণে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বর্ণনা করা আছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তখনই থাকে যখন স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের মধ্যে একাধিক যৌনতার স্বীকৃতি থাকে। দৈহিক সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে দৃঢ় করে, তীব্র করে, আকাঙ্ক্ষিত করে এবং সর্বোপরি দীর্ঘ করে। শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।

মানবজীবনে কাম বা যৌনতা একটি প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সবাই কাম বা যৌনতাকে চায় এবং সুযোগ বুঝে সদ্ব্যাবহার বা অসদ্ব্যবহারও করে, শুধুমাত্র মুখে প্রকাশে অস্বীকৃতি ও অস্বস্তি। দিনেরবেলা যৌনতার বিরুদ্ধে যতই বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়া হোক না কেন; রাত্রিবেলায় সেই কামই সুযোগ বুঝে হিংস্র বাঘ হয়ে ক্ষতবিক্ষত করে হৃদয়কে। শাস্ত্রে বারেবারেই ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ এ চতুর্বর্গের কথা আছে, আমরা হয়তো ভুলে যাই এ চতুর্বর্গের মধ্যে কাম অন্যতম। কাম জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, জীবনের বাইরে না। কাম থেকেই জীবের উৎপত্তি। অথর্ববেদ সংহিতায় 'কামসূক্ত' নামে একটি বিখ্যাত সূক্ত আছে। সূক্তটিতে ফলসিদ্ধির নিমিত্ত কামের স্তুতি করা হয়েছে। ঈশ্বরের জগতসৃষ্টির ইচ্ছার কামনা থেকেই বারংবার এ জগতের উৎপত্তি।

কামস্তদগ্রে সমবৰ্তত মনসাে রেতঃ প্রথমং যদাসীৎ।
স কাম কামেন বৃহতা সযােনী রায়স্পােষং যজমানায় ধেহি।।
(অথর্ববেদ সংহিতা:১৯.০৬.০৭.০১)
"অগ্রে এই বিকারজাত সৃষ্টির প্রাক-অবস্থায় পরমেশ্বরের মনে সম্যরূপে কাম জাত হয়েছিল (সমবর্তত), অর্থাৎ সৃষ্টির ইচ্ছা সঞ্জাত হয়েছিল। (কি জন্য?—না)–তাদৃশ মনঃসম্বন্ধি রেতঃ এই কারণেই উদ্ভূত হয়েছিল যে, অতীতকল্পে সৃষ্টির বীজভূত, প্রাণীবর্গের কৃত পূণ্য ও অপূণ্যরূপ কর্মসমূহ সৃষ্টিসময়ে বর্ধিঞ্চু হওয়ার জন্য সম্যক্ প্রকাশিত হয়েছিল। অর্থাৎ পরিপক্করূপে ফলের জন্য উন্মুখ হয়েছিল। হে কাম, সর্বজগৎকে সৃষ্টির উদ্দেশে পরমেশ্বরের দ্বারা উৎপাদিত তুমি মহান দেশ-কাল-বস্তুর পরিচ্ছেদরহিত পরমেশ্বরের সমানকারণ হয়ে (সযােনিঃ), অর্থাৎ পরমেশ্বর ব্যতিরিক্ত কারণান্তররহিত হয়ে এই যজমানে ধনপ্রদাতা বা হবিঃপ্রদাতা পুরুষে ধনপুষ্টি অর্থাৎ সমৃদ্ধি স্থাপন করাে (রায়ঃ পােষম ধেহি) অর্থাৎ প্রদান করাে।"
বর্তমানকালে অনেক ধর্মীয় সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময়ে ঢালাওভাবে কামের বিরুদ্ধে, প্রেমের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে বেড়ান; বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। সেই ব্যক্তিদেরকেই যদি সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরার সামনে রাখা যায় তাহলে বোঝা যাবে, তাদের প্রকাশ্যে দেয়া বক্তব্যগুলো কতটুকু যৌক্তিক? অনেকেই বলবেন যে, আমি খোলামেলা যৌনতার পক্ষে সাফাই গাচ্ছি বা প্রোমোট করছি। বিষয়টা ঠিক ওরকম না। জগতের শুরু থেকে যে কামধারা বহমান, তা প্রলয় পর্যন্ত প্রত্যেকটি জীবের মাঝেই আছে এবং সর্বদা থাকবে। একে কেউ রোধ করতে পারবে না। তবে কোন বিষয়েই অতিরিক্ত ভাল নয়। যে অতিরিক্ত করবে সেই ফাঁদে পরবে। সকল কিছুতেই মধ্যপন্থা যৌক্তিক। বিষয়টি শ্রীমদ্ভগবদগীতার ষষ্ঠ অধ্যায় ধ্যানযোগে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
আমাদের কিছু কিছু সাধুরা বলে বেড়ান, দুটি সন্তান নেয়ার পরে স্বামী-স্ত্রী ভাইবোনের মত থাকতে হবে। এমনকি এদের কেউ কেউ আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, যদি দুটি সন্তান নেন, তাহলে স্ত্রীর সাথে সেই ব্যক্তি সারাজীবনে শুধুমাত্র দুইবারই মিলিত হবেন। এর বাইরে স্ত্রীর সাথে একাধিক মিলনও অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ।এ জাতীয় হাস্যকর তত্ত্ব প্রচার করে আমাদের সমাজের তরুণ যুবকদের বিভ্রান্ত করছেন কিছু তথাকথিত ধর্মীয় প্রচারকেরা।মানবজীবনে কাম বা যৌনতা একটি প্রয়ােজনীয় শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। মহাভারত সহ একাধিক শাস্ত্রে বারেবারেই ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মােক্ষ এই চতুবর্গের সাধনের কথা বারেবারেই বলা আছে।আমরা অনেকেই দৈহিকভাবে হয়ত কামে অংশগ্রহণ করছি না। কিন্তু প্রতি দণ্ডে দণ্ডে আমরা মানসিকভাবে কামকে উপভােগ করার চেষ্টা করছি। ক্ষণকালের দৈহিককাম চরিতার্থ থেকে সার্বক্ষণিক মানসিক কামচিন্তা শরীরের জন্য ভয়াবহ।কাম জীবনের বাইরে নয়,কাম জীবনের একটা অঙ্গ। কাম দেহের ক্ষুধা, তৃষ্ণারূপ জৈবিকবৃত্তির মতই স্বাভাবিক একটি বিষয়।
সুপুষ্পিত স্যাদফলঃ ফলবান্ স্যাদ্ দুরারুহঃ।
আমঃ স্যাৎ পক্কসঙ্কাশাে ন চ জীর্য্যেত কর্হিচিৎ।।
ত্রিবর্গে ত্রিবিদা পীড়া হ্যনুবন্ধাস্তথৈব চ।
অনুবন্ধঃ শুভা জ্ঞেয়াঃ পীড়াস্তু পরিবর্জয়েৎ ॥
ধর্মং বিচরতঃ পীড়া সাপি দ্বাভ্যাং নিযচ্ছতি।
অর্থজ্ঞাপ্যর্থলুদ্ধস্য কাঞ্চাতিপ্রবর্তিনঃ।।
(মহাভারত: আদি পর্ব, ১৩৫ ,৬৮-৭০)
“ফুল দেখাবে, কিন্তু ফল দিবে না; ফল দিলেও দুরারোহ থাকবে এবং অপক্ক হয়েও পক্কের মত থাকবে; কিন্তু কখনও জীর্ণ হবে না। ধর্ম, অর্থ ও কাম-এই ত্রিবর্গের মধ্যে একসাথে সবগুলাের, অনুষ্ঠান করতে থাকলে প্রত্যেকটিরই অপর দুটি দ্বারা ব্যাঘাত ঘটে এবং সেই ত্রিবর্গের ফলগুলিরও তেমনি ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু পৃথক পৃথক ভাবে অনুষ্ঠান করলে সকলের ফলই ভাল হয়; অতএব একদা সবগুলাের অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করবে।অর্থ ও কাম ধার্মিকের ধর্মানুষ্ঠানে বাধা দিয়ে থাকে, ধর্ম ও কাম অর্থলােভীর অর্থকে প্রতিহত করে এবং ধর্ম ও অর্থ কামীর কামকে নিরুদ্ধ করে।"
মহাভারতে কামের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে একসাথে সবগুলাের অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে ধর্ম, অর্থ এবং কামকে পৃথক পৃথক ভাবে অনুষ্ঠান করতে বলা হয়েছে। মা বা সংস্কৃত অম্বা শব্দটা একটি পবিত্র শব্দ। জগতে পরমেশ্বরের পরেই মায়ের স্থান।তাই তৈত্তিরীয় উপনিষদে বৈদিক শিক্ষা সমাপনান্তে বৈদিক সমাবর্তন ভাষণে, পিতামাতাকে স্বয়ং মূর্তিমান দেবতা বলা হয়েছে।
বৈদিক সমাবর্তন ভাষণে "মাতৃদেবো ভব।" বলে জন্মদায়িনী মাকেই দেবতাস্বরূপ বলে অভিহিত করা হয়েছে।একইভাবে মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, একজন শিক্ষক থেকে জন্মদায়িনী মাতা একলক্ষ গুণে শ্রেষ্ঠ। তাই শাস্ত্রে মাতৃ শব্দটি নিয়ে যথেচ্ছাচার নিষিদ্ধ । কিন্তু ইদানিং কিছু সাধুদের সবাইকেই মাতাজী ডাকার নির্দেশনা দিতে দেখা যায়। সাধু-সন্ত সকল নারীকেই মাতৃজ্ঞানে দেখে মাতাজী সম্বোধন করবে, এটাতে সমস্যা নেই ; বরঞ্চ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ বছরের ছেলেরা তাদের সমবয়সী মেয়েদের মাতাজী ডাকছে তখন বিষয়টি অনেকটাই অস্বাভাবিক হয়ে যায়। যাদের প্রতিনিয়ত মাতাজী ডাকছে তাদের সাথে বয়সের কারণে প্রেম করছে, বিয়ে করছে, সবকিছুই করছে। তাহলে মা বা মাতাজী শব্দটির সম্মানটা আর রইলোই বা কোথায়? সনাতন চতুরাশ্রম ব্যবস্থায় একজন সন্ন্যাসী এবং সাংসারিক মানুষের বিধিব্যবস্থা সম্পূর্ণ এক নয়। গৃহী থেকে সন্ন্যাসীর সদাচার অত্যন্ত কঠিন।শাস্ত্রে আছে কাউকে ভুলক্রমেও যদি মা বা মাতাজী সম্মোধন করা হয়, তবে তার সাথে আর প্রেম, বিয়ে বা কিছুই করা সম্ভব না। এমনকি স্বামীও যদি বউকে ভালবাসার ছলে মা বলে ডেকে ফেলে, তাহলে সেই স্ত্রীর সাথে আর স্ত্রীজনোচিত কাজ সে করতে পারবে না। মা বলে ডাকা স্ত্রীর সাথে স্ত্রীজনোচিত কাজ করতে হলে স্বামীকে আগে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, চান্দ্রায়ণ করতে হবে। কারণ মা শব্দটি অত্যন্ত পবিত্র একটি শব্দ।
আমাদের সর্বাগ্রে দরকার ঐক্যবদ্ধ জাতিগঠন। কিন্তু "ব্রহ্মচর্য ব্রহ্মচর্য" বলে চিৎকার করতে করতে আমাদের কিছু সাধুসন্তরা ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে আমাদের যুবক,তরুণ এবং কিশোরদের। যার ফলে হিন্দু তরুণীরাও হিন্দু যুবক-তরুণদের মাকাল ফল মনে করে দূরে সরে যাচ্ছে। যাদের অনেকেই পরবর্তীতে বিভ্রান্ত হয়ে, ধর্মান্তরিত হয়ে, বিধর্মীদের বিয়ে করে, ব্যক্তিজীবন এবং পারিবারিক জীবনকে অশান্ত করে তুলছে। কাউকে উপদেশ দানের আগে উপজীব্য বিষয় হল উপদেশের পাত্র নির্বাচন করা অত্যন্ত জরুরী। যারা সংসার ত্যাগ করে বাণপ্রস্থ, সন্ন্যাস গ্রহণ করেছে, তাদের জন্য স্ত্রীসঙ্গ বারণ; এক্ষেত্রে বিষয়টি যৌক্তিক। কিন্তু একজন অবিবাহিত যুবক, যুবতীকে একই উপদেশ দেয়া বা বিবাহিতদের নিজ স্ত্রীর সাথে সন্তান উৎপাদনবিহীন মিলিত হতে না দেওয়া ; বিষয়গুলো অযৌক্তিক।
শুধু দৈহিক সম্পর্কতেই স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক দৃঢ় হয় না; কেবলমাত্র সন্তান জন্মদানের উদ্দেশ্যই স্বামী স্ত্রীর মিলন নয়; দৈহিক কামকে প্রেমে রূপান্তরিত করাটাও অত্যন্ত আবশ্যকীয় কর্ম। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে সারাদিন গায়ে কাঁথা পরে থাকা এবং সন্যাস জীবনের চর্যাচর্য সকল গার্হস্থ্যজীবনের মানুষকে জোরজবরদস্তি করতে বলা অনেকটা একই। ব্রহ্মচর্য বলতে লোকে সাধারণ অর্থে নারী থেকে দূরে থাকাকেই বোঝায়, যা সর্বক্ষেত্রে সঠিক নয়। নারী মানেই শুধু যৌনতার আধার নয়।বৈদিক ঋষিরা স্ত্রীর সাথে সম্মিলিতভাবে যজ্ঞ করেছেন, সাধনা করেছেন, সন্তানধারা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন আবার ব্রহ্মচর্যও পালন করেছেন। সকল কিছুরই সমন্বয় ছিল তাঁদের জীবনে।
তবে এটা সত্য যে, কামের সঙ্গে থাকে উত্তেজনা। কিন্তু শুদ্ধপ্রেমে থাকে প্রশান্তি। কাম যখন শুধুই ভোগ সর্বস্ব হয়ে যায়, তখন সে যুক্ত হয় মোহের সাথে,অজ্ঞানের সাথে, বন্ধনের সাথে, অন্ধকারের সাথে। পক্ষান্তরে যদি সেই কাম প্রেমে রূপান্তরিত হয়, তবে সে প্রেম জ্ঞানের সঙ্গে আলোর সঙ্গে সংযোগ ঘটায়। আলোতেই সকল অন্ধকার দূর হয়ে যায়। অন্ধকারেই জন্ম হয়, চিরকাল অন্ধকারে থাকার জন্য নয়; আলোর অভিমুখে যাওয়ার জন্য। আর কতকাল আমরা ভাবের ঘরে চুরি করে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখবো? এখনও কি ঝেড়ে কাশার সময় আমাদের আসেনি?ব্রহ্মচর্যের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। বেদাদিশাস্ত্রে ব্রহ্মচর্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলা হয়েছে ঠিক। কিন্তু ব্রহ্মচর্য প্রসঙ্গে স্থান, কাল এবং পাত্র অবশ্যই বিবেচ্য। তাই আমাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন, স্থান, কাল এবং পাত্র বিবেচনা না করে অপ্রয়োজনীয় ব্রহ্মচর্যের নামে হিন্দু তরুণ-যুবকদের বিভ্রান্ত না করে তাদের মাঝে পৌরুষ জাগানো, তেজদীপ্ততা জাগানো। তবেই এ জাতি জাগবে। ব্রহ্মচর্যের অবশ্যই প্রয়োজন আছে, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় ব্রহ্মচর্য জাতিকে দূর্বল করে দেয়।
যজুর্বেদীয় শতপথ ব্রাহ্মণে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বর্ণনা করা আছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তখনই থাকে যখন স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের মধ্যে একাধিক যৌনতার স্বীকৃতি থাকে। দৈহিক সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে দৃঢ় করে, তীব্র করে, আকাঙ্ক্ষিত করে এবং সর্বোপরি দীর্ঘ করে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁