-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

ডুবে শ্যামা যমুনাতে, খেলব খেলা শ্যামের সাথে।

এ জগতের সিংহভাগই অন্ধকার। আলো খুবই কম। জগত অন্ধকারের খেলাঘর। তাইতো জগতের পিতা-মাতা কালোরূপেই কল্পনা করা হয়েছে। আদিপুরুষ গোবিন্দ কালো এবং মহাকালের শক্তি জগন্মাতা কালীও কালো।অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাংলা কবি এবং মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীর পরে যিনি আধুনিক বাংলা গানের অন্যতম প্রর্বত্তক শ্রীরামপ্রসাদ সেন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান তিন উপাসনার ধারা শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব এ তিনমতের সমন্বয়ের অন্যতম অগ্রনায়ক ছিলেন। কৃষ্ণ কালীকে তিনি একসাথেই উপাসনা করেছেন। তাঁর কাছে কৃষ্ণ এবং কালী ছিলো একই ব্রহ্মের পুরুষ ও প্রকৃতির অভেদ রূপ। শ্রীমদ্ভাগবতের পঞ্চম স্কন্ধেও কৃষ্ণ-কালীর অভেদ বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর করে বর্ণনা করা আছে-  ন বা এতদ্বিষ্ণুদত্ত মহদদ্ভুতং যদসম্ভ্রমঃ  স্বশিরশ্চ্ছেদন আপতিতেঽপি বিমুক্ত- দেহাদ্যাত্মভাবসুদৃঢ়হৃদয়গ্রন্থীনাং সর্বসত্ত্ব- সুহৃদাত্মনাং নির্বৈরাণাং সাক্ষাদ্ভগবতা- নিমিষারিবরায়ুধেনাপ্রমত্তেন তৈস্তৈর্ভাবৈঃ  পরিরক্ষ্যমাণানাং তৎপাদমূলমকুতশ্চি- দ্ভয়মুপসৃতানাং ভাগবতপরমহংসানাম্ ॥ (শ্রীমদ্ভাগবত : ৫.৯.২০)  "ভগবান স্বয়ং ভদ্রকালী প্রভৃতি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে এসে সাধুদের রক্ষা করেন। যার দেহাভিমানরূপ হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে গেছে, যিনি সমস্ত প্রাণীজগতের সুহৃৎ, যিনি কারাের প্রতি বৈরী ভাব পােষণ করেন না, তাদের স্বয়ং ভগবান বিভিন্ন রূপ ধারণ করে রক্ষা করেন ; তাই ভগবানের শরণাগত নির্ভয় ভগবদ্ভক্ত পরমহংসগণ নিজের শিরচ্ছেদনের সময়েও বিচলিত হবেন না, এটাই স্বাভাবিক।" সমস্যা বাধে তখনই , যখন আমরা যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে যে যে মতাবলম্বী সবাইকে সেই সেই মতাবলম্বী বানাতে চাই। আমরা ভুলে যাই বেদান্ত দর্শনের চার নং সূত্র-তত্তু সমন্বয়াৎ।। (১.১.৪) এই সূত্রকে। এই সূত্রেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে বিভিন্ন মত-পথ নির্বিশেষে সকল মত-পথই ব্রহ্ম লাভ এবং উপলব্ধির এক একটি পন্থা।বাঙালি হিন্দুরা প্রধানত আমরা শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণবের মিশ্র উপাসক। আমাদের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা এবং প্রধান তিথিকৃত্য জন্মাষ্টমী ও শিবচতুর্দশী। একই মন্দিরে আমাদের কৃষ্ণ থাকে, কালী থাকে, দুর্গা থাকে এবং শিবসহ আমাদের পঞ্চমতের সকল উপাস্য থাকে। এই সমন্বয় এবং সমন্বয়ে আবহে উৎপাদিত সংগীত-নৃত্যকলা সহ সকল শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতাই আমাদের বাঙালি জীবনের অক্ষয় ভাব সম্পদ। সেই সমন্বয়ের ভাবসম্পদের রত্নভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন শ্রীরামপ্রসাদ সেন। তাঁর সেই সৃষ্টির রত্নভাণ্ডারে সনাতন বিভিন্ন মত-পথকে সমন্বয় করে বেশ কয়েকটি সংগীত পাওয়া যায়।এর মধ্যে একটি সমন্বয় সংগীত হল,"মন করোনা দ্বেষাদ্বেষি"। সংগীতটি বাংলা ভাষায় এক অক্ষয় রত্নতুল্য। "মন করোনা দ্বেষাদ্বেষি। যদি হবিরে বৈকুণ্ঠবাসী।। আমি বেদাগম পুরাণে, করিলাম কত খোঁজ- তালাসি। ঐ যে কালী,কৃষ্ণ, শিব, রাম, সকল আমার এলোকেশী।। শিবরূপে ধর শিঙ্গা, কৃষ্ণরূপে বাজাও বাঁশী। ওমা রামরূপে ধর ধনু, কালীরূপে করে অসী।। দিগম্বরী দিগম্বর, পীতাম্বর চিরবিলাসী। শ্মশানবাসিনী বাসী, অযোধ্যা গোকুলনিবাসী।। ভৈরবী ভৈরব সঙ্গে, শিশু সঙ্গে এক বয়সী। যেমন অনুজ ধানুকী সঙ্গে জানকী পরম রুপসী।। প্রসাদ বলে ব্রহ্ম নিরুপণের কথা দেঁতোর হাসি। আমার ব্রহ্মময়ী সর্বঘটে, পদে গঙ্গা গয়া কাশী।।" কিন্তু কয়েকটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব সংগঠনের প্রচারণা অত্যন্ত দুঃখজনক। তারা যেভাবে বিভেদ সৃষ্টিকারী দাস-দাসী তত্ব নিয়ে সদা ব্যস্ত, এতে তাদের কতোটুকু লাভ হয় তা আমাদের বোধগম্য নয়। কিন্তু এতে করে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনৈক্যের জাল, বিদ্বেষের জাল দিনেদিনে আরও সুদৃঢ় হচ্ছে। দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা আসলেই তারা তাদের হাস্যকর দাস-দাসী তত্ব নিয়ে এসে হাজির হয় এবং বিভেদ সৃষ্টি করে তোলে।এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর লেখা "জগজ্জননী কালীমাতার তত্ত্ব" নামক একটি ছোট্ট বইতে ব্রহ্মচারীজী শাক্ত বৈষ্ণব মিলনের একটি অসাধারণ রেফারেন্স দিয়েছেন বৈষ্ণব শিরোমণি ষড় গোস্বামীর অন্যতম শ্রীজীব গোস্বামীর লেখা থেকে (পৃষ্ঠা -১১)। যঃ কৃষ্ণঃ সৈব দুর্গা স্যাৎ যা দুর্গা কৃষ্ণ এব সঃ। "যে কৃষ্ণ, সেই দুর্গা এবং যিনি দুর্গা তিনিই কৃষ্ণ।" যেই শ্যাম, সেই শ্যামা। যেই ব্রহ্ম, সেই শক্তি; যেই লক্ষ্মী, সেই নারায়ণ ; যেই শিব, সেই শক্তি ; যেই রাধা, সেই কৃষ্ণ। একই সত্ত্বার শুধুমাত্র প্রকাশ বিভিন্ন। আর আমরা এই দৃশ্যমান বিভিন্নতায় মায়ার প্রভাবে বিভ্রান্ত হয়ে যাই।ব্রহ্ম এবং তাঁর শক্তি অভেদ-এ তত্ত্বটি বোঝাতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর শ্রীম লিখিত কথামৃতে বলেছেন: ''ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ, এককে মানলেই আর-একটিকে মানতে হয়। যেমন অগ্নি আর তার দাহিকাশক্তি; ... অগ্নি মানলেই দাহিকাশক্তি মানতে হয়, দাহিকাশক্তি ছাড়া অগ্নি ভাবা যায় না; আবার অগ্নিকে বাদ দিয়ে দাহিকাশক্তি ভাবা যায় না। সূর্যকে বাদ দিয়ে সূর্যের রশ্মি ভাবা যায় না।" "আদ্যাশক্তি লীলাময়ী; সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম কালী। কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী! একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয় - সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কোন কাজ করছেন না -এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এই সব কার্য করেন, তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি নাম-রূপভেদ। ''  ব্রহ্ম ও শক্তি এবং শ্যাম ও শ্যামা বা কালী-কৃষ্ণের অভেদ তত্ত্বকেই কবি নজরুল ইসলাম তার অনন্য অসাধারণ একটি সংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। কোন প্রকার বিভেদের জালে না জড়িয়ে প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জীবনে চলে আসছে শ্যাম ও শ্যামার যুগ্ম আরাধনা। যেখানেই কালী মন্দির, সেখানেই কৃষ্ণ মন্দির। ব্রহ্ম ও তাঁর শক্তি এবং কালী-কৃষ্ণের অভেদ তত্ত্বকে নিয়ে মধ্যযুগের কবি রামপ্রসাদ সেন সহ অনেকেই বিভিন্ন  মর্মস্পর্শী  সংগীত  লিখেছেন। আধুনিক যুগে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়েও,শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণব মিলনের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সংগীত লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। এ অনন্য অসাধারণ সংগীতটিতে কবি, শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে শ্যামের নাম জপ করতে চেয়েছেন। তিনি শ্যামা নামের যমুনাতে ডুবে, শ্যামের সাথে খেলা করতে চেয়েছেন।সংগীতটির প্রত্যেকটি বাক্যে শ্বাশত সম্প্রীতির ভাব প্রকাশ পেয়েছে। "শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম। মা হলেন মোর মন্ত্রগুরু ঠাকুর হলেন রাধাশ্যাম॥ ডুবে শ্যামা-যমুনাতে খেলব খেলা শ্যামের সাথে শ্যাম যবে মোর হানবে হেলা মা পুরাবেন মনস্কাম॥ আমার মনের দো-তারাতে শ্যামা ও শ্যামা দুটি তার, সেই দো-তারায় ঝংকার দেয় ওঙ্কার রব অনিবার॥ মহামায়ার মায়ার ডোরে আনবে বেঁধে শ্যাম কিশোরে, কৈলাসে তাই মাকে ডাকি দেখব সেথায় ব্রজধাম॥" ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের লক্ষ্যে শ্যাম ও শ্যামার যুগ্ম আরাধনায় সকল বাঙালি উজ্জীবিত এবং জাগরিত হয়ে উঠুক এই প্রার্থনা এবং প্রচেষ্টায় সকলের অংশগ্রহণ করা উচিত। শ্যাম-শ্যামার অভেদ ব্রহ্মচিন্তায় আমাদের ভুলে যেতে হবে, সকল প্রকার বিদ্বেষ এবং বিদ্বেষপূর্ণ দাসদাসীতত্ত্ব। সাধারণত গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণই এ দাসদাসী তত্ত্বের ব্যবহার বেশী করেন। কিন্তু তারা হয়তো অনেকেই জানেন না, তাঁদের অন্যতম পবিত্র গ্রন্থ  'শ্রীচৈতন্যভাগবত' গ্রন্থে অত্যন্ত সুন্দর করে ব্রহ্মস্বরূপা আদ্যাশক্তির স্তোত্র করা আছে। নবদ্বীপে চন্দ্রশেখরের গৃহে শ্রীচৈতন্যদেবকে উদ্দেশ্য করে নিত্যানন্দ সহ সকল পার্ষদেরা এ অনন্য আদ্যাশক্তি স্তোত্রটি করেন। "জগৎস্বরুপা তুমি তুমি সর্বশক্তি। তুমি শ্রদ্ধা দয়া লজ্জা তুমি বিষ্ণুভক্তি।। যত বিদ্যা সকল তোমার মূর্তিভেদ। সর্ব প্রকৃতির শক্তি তুমি কহে বেদ।। নিখিল ব্রহ্মাণ্ডগণের তুমি সর্বমাতা। কে তোমার স্বরূপ কহিতে পারে কথা।। তুমি ত্রিজগতহেতু গুণত্রয়ময়ী। ব্রহ্মা আদি তোমারে নাহি জানি কেহি।। সর্বাশ্রয়া তুমি সর্বজীবের বসতি। তুমি আদ্যা অবিকারা পরমপ্রকৃতি।। জগতজননী তুমি দ্বিতীয়রহিতা। মহীরূপে তুমি সর্ব জীবপাল মাতা।। জলরূপে তুমি সর্বজীবের জীবন। তোমা সঙরিলে খণ্ডে অশেষ বন্ধন।। সাধুজন-গৃহে তুমি লক্ষ্মী মূর্তিমতী। অসাধুর ঘরে তুমি কালরূপাকৃতি।। তুমি সে করাহ জগতের সৃষ্টি স্থিতি। তোমা না ভজিলে পায় ত্রিবিধ দুর্গতি।।" (শ্রীচৈতন্য ভাগবত, মধ্যখণ্ড,১৮শ অধ্যায়) স্তোত্রটিতে দেবীকে জগৎস্বরূপা, সর্বশক্তিস্বরূপা এবং সকল জীবের মাতা সহ ঈশ্বরের সকল বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়েছে। কোথাও একবারের জন্যেও তাঁকে কৃষ্ণের দাসি বলা হয়নি। এরপরেও আমরা দেখি কিছু বৈষ্ণবেরা দাস-দাসী তত্ত্ব তোতাপাখির মতো প্রতিনিয়ত আওড়ে যান!আমাদের স্মরণে, মননে এবং জীবনে শ্যাম-শ্যামার অভেদ তত্ত্ব প্রতিফলিত করে যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবো, তখনই হবে আমাদের সার্থক জাগরণ। বাঙালির প্রধান দুই আরাধ্য কালী এবং কৃষ্ণ যে এক। এ কথা গৌতমীয়, তন্ত্র কুব্জিকা তন্ত্র সহ বিভিন্ন তন্ত্রশাস্ত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। কলৌ কৃষ্ণত্বমাসাদ্য বৃন্দাবনবিহারিণী বংশীনাদ-বিনোদেন মোহয়ত্যখিলং জগৎ।। (কুব্জিকা তন্ত্র: ১.৩৪) "দেবী কালীই কলিযুগের প্রারম্ভে,বৃন্দাবনে কৃষ্ণরূপে নিজের বংশীধ্বনিতে ত্রিভুবন মোহিত করেছিলেন।" সকল প্রকার বিদ্বেষপূর্ণ দাসদাসীতত্ত্ব ভুলে শ্যাম শ্যামার অভেদ তত্ত্বটি স্মরণে, মননে এবং জীবনে আমাদের প্রতিফলিত করা প্রয়োজন। তবেই শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণবের নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বিদূরিত হয়ে জাতিগত ঐক্যবদ্ধতা আসবে। মনে রাখতে হবে বিভেদে বিচ্ছিন্নতা, এবং অভেদেই ঐক্যবদ্ধতা। শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।

এ জগতের সিংহভাগই অন্ধকার। আলো খুবই কম। জগত অন্ধকারের খেলাঘর। তাইতো জগতের পিতা-মাতা কালোরূপেই কল্পনা করা হয়েছে। আদিপুরুষ গোবিন্দ কালো এবং মহাকালের শক্তি জগন্মাতা কালীও কালো।অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাংলা কবি এবং মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীর পরে যিনি আধুনিক বাংলা গানের অন্যতম প্রর্বত্তক শ্রীরামপ্রসাদ সেন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান তিন উপাসনার ধারা শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব এ তিনমতের সমন্বয়ের অন্যতম অগ্রনায়ক ছিলেন। কৃষ্ণ কালীকে তিনি একসাথেই উপাসনা করেছেন। তাঁর কাছে কৃষ্ণ এবং কালী ছিলো একই ব্রহ্মের পুরুষ ও প্রকৃতির অভেদ রূপ। শ্রীমদ্ভাগবতের পঞ্চম স্কন্ধেও কৃষ্ণ-কালীর অভেদ বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর করে বর্ণনা করা আছে-

ন বা এতদ্বিষ্ণুদত্ত মহদদ্ভুতং যদসম্ভ্রমঃ
স্বশিরশ্চ্ছেদন আপতিতেঽপি বিমুক্ত-
দেহাদ্যাত্মভাবসুদৃঢ়হৃদয়গ্রন্থীনাং সর্বসত্ত্ব-
সুহৃদাত্মনাং নির্বৈরাণাং সাক্ষাদ্ভগবতা-
নিমিষারিবরায়ুধেনাপ্রমত্তেন তৈস্তৈর্ভাবৈঃ
পরিরক্ষ্যমাণানাং তৎপাদমূলমকুতশ্চি-
দ্ভয়মুপসৃতানাং ভাগবতপরমহংসানাম্ ॥
(শ্রীমদ্ভাগবত : ৫.৯.২০)
"ভগবান স্বয়ং ভদ্রকালী প্রভৃতি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে এসে সাধুদের রক্ষা করেন। যার দেহাভিমানরূপ হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে গেছে, যিনি সমস্ত প্রাণীজগতের সুহৃৎ, যিনি কারাের প্রতি বৈরী ভাব পােষণ করেন না, তাদের স্বয়ং ভগবান বিভিন্ন রূপ ধারণ করে রক্ষা করেন ; তাই ভগবানের শরণাগত নির্ভয় ভগবদ্ভক্ত পরমহংসগণ নিজের শিরচ্ছেদনের সময়েও বিচলিত হবেন না, এটাই স্বাভাবিক।"
সমস্যা বাধে তখনই , যখন আমরা যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে যে যে মতাবলম্বী সবাইকে সেই সেই মতাবলম্বী বানাতে চাই। আমরা ভুলে যাই বেদান্ত দর্শনের চার নং সূত্র-তত্তু সমন্বয়াৎ।। (১.১.৪) এই সূত্রকে। এই সূত্রেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে বিভিন্ন মত-পথ নির্বিশেষে সকল মত-পথই ব্রহ্ম লাভ এবং উপলব্ধির এক একটি পন্থা।বাঙালি হিন্দুরা প্রধানত আমরা শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণবের মিশ্র উপাসক। আমাদের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা এবং প্রধান তিথিকৃত্য জন্মাষ্টমী ও শিবচতুর্দশী। একই মন্দিরে আমাদের কৃষ্ণ থাকে, কালী থাকে, দুর্গা থাকে এবং শিবসহ আমাদের পঞ্চমতের সকল উপাস্য থাকে। এই সমন্বয় এবং সমন্বয়ে আবহে উৎপাদিত সংগীত-নৃত্যকলা সহ সকল শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতাই আমাদের বাঙালি জীবনের অক্ষয় ভাব সম্পদ। সেই সমন্বয়ের ভাবসম্পদের রত্নভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন শ্রীরামপ্রসাদ সেন। তাঁর সেই সৃষ্টির রত্নভাণ্ডারে সনাতন বিভিন্ন মত-পথকে সমন্বয় করে বেশ কয়েকটি সংগীত পাওয়া যায়।এর মধ্যে একটি সমন্বয় সংগীত হল,"মন করোনা দ্বেষাদ্বেষি"। সংগীতটি বাংলা ভাষায় এক অক্ষয় রত্নতুল্য।
"মন করোনা দ্বেষাদ্বেষি।
যদি হবিরে বৈকুণ্ঠবাসী।।
আমি বেদাগম পুরাণে, করিলাম কত খোঁজ- তালাসি।
ঐ যে কালী,কৃষ্ণ, শিব, রাম, সকল আমার এলোকেশী।।
শিবরূপে ধর শিঙ্গা, কৃষ্ণরূপে বাজাও বাঁশী।
ওমা রামরূপে ধর ধনু, কালীরূপে করে অসী।।
দিগম্বরী দিগম্বর, পীতাম্বর চিরবিলাসী।
শ্মশানবাসিনী বাসী, অযোধ্যা গোকুলনিবাসী।।
ভৈরবী ভৈরব সঙ্গে, শিশু সঙ্গে এক বয়সী।
যেমন অনুজ ধানুকী সঙ্গে জানকী পরম রুপসী।।
প্রসাদ বলে ব্রহ্ম নিরুপণের কথা দেঁতোর হাসি।
আমার ব্রহ্মময়ী সর্বঘটে, পদে গঙ্গা গয়া কাশী।।"
কিন্তু কয়েকটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব সংগঠনের প্রচারণা অত্যন্ত দুঃখজনক। তারা যেভাবে বিভেদ সৃষ্টিকারী দাস-দাসী তত্ব নিয়ে সদা ব্যস্ত, এতে তাদের কতোটুকু লাভ হয় তা আমাদের বোধগম্য নয়। কিন্তু এতে করে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনৈক্যের জাল, বিদ্বেষের জাল দিনেদিনে আরও সুদৃঢ় হচ্ছে। দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা আসলেই তারা তাদের হাস্যকর দাস-দাসী তত্ব নিয়ে এসে হাজির হয় এবং বিভেদ সৃষ্টি করে তোলে।এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর লেখা "জগজ্জননী কালীমাতার তত্ত্ব" নামক একটি ছোট্ট বইতে ব্রহ্মচারীজী শাক্ত বৈষ্ণব মিলনের একটি অসাধারণ রেফারেন্স দিয়েছেন বৈষ্ণব শিরোমণি ষড় গোস্বামীর অন্যতম শ্রীজীব গোস্বামীর লেখা থেকে (পৃষ্ঠা -১১)।
যঃ কৃষ্ণঃ সৈব দুর্গা স্যাৎ
যা দুর্গা কৃষ্ণ এব সঃ।
"যে কৃষ্ণ, সেই দুর্গা এবং যিনি দুর্গা তিনিই কৃষ্ণ।"
যেই শ্যাম, সেই শ্যামা। যেই ব্রহ্ম, সেই শক্তি; যেই লক্ষ্মী, সেই নারায়ণ ; যেই শিব, সেই শক্তি ; যেই রাধা, সেই কৃষ্ণ। একই সত্ত্বার শুধুমাত্র প্রকাশ বিভিন্ন। আর আমরা এই দৃশ্যমান বিভিন্নতায় মায়ার প্রভাবে বিভ্রান্ত হয়ে যাই।ব্রহ্ম এবং তাঁর শক্তি অভেদ-এ তত্ত্বটি বোঝাতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর শ্রীম লিখিত কথামৃতে বলেছেন:
''ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ, এককে মানলেই আর-একটিকে মানতে হয়। যেমন অগ্নি আর তার দাহিকাশক্তি; ... অগ্নি মানলেই দাহিকাশক্তি মানতে হয়, দাহিকাশক্তি ছাড়া অগ্নি ভাবা যায় না; আবার অগ্নিকে বাদ দিয়ে দাহিকাশক্তি ভাবা যায় না। সূর্যকে বাদ দিয়ে সূর্যের রশ্মি ভাবা যায় না।"
"আদ্যাশক্তি লীলাময়ী; সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম কালী। কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী! একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয় - সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কোন কাজ করছেন না -এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এই সব কার্য করেন, তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি নাম-রূপভেদ। ''
ব্রহ্ম ও শক্তি এবং শ্যাম ও শ্যামা বা কালী-কৃষ্ণের অভেদ তত্ত্বকেই কবি নজরুল ইসলাম তার অনন্য অসাধারণ একটি সংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। কোন প্রকার বিভেদের জালে না জড়িয়ে প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জীবনে চলে আসছে শ্যাম ও শ্যামার যুগ্ম আরাধনা। যেখানেই কালী মন্দির, সেখানেই কৃষ্ণ মন্দির। ব্রহ্ম ও তাঁর শক্তি এবং কালী-কৃষ্ণের অভেদ তত্ত্বকে নিয়ে মধ্যযুগের কবি রামপ্রসাদ সেন সহ অনেকেই বিভিন্ন মর্মস্পর্শী সংগীত লিখেছেন। আধুনিক যুগে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়েও,শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণব মিলনের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সংগীত লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। এ অনন্য অসাধারণ সংগীতটিতে কবি, শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে শ্যামের নাম জপ করতে চেয়েছেন। তিনি শ্যামা নামের যমুনাতে ডুবে, শ্যামের সাথে খেলা করতে চেয়েছেন।সংগীতটির প্রত্যেকটি বাক্যে শ্বাশত সম্প্রীতির ভাব প্রকাশ পেয়েছে।
"শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে
জপি আমি শ্যামের নাম।
মা হলেন মোর মন্ত্রগুরু
ঠাকুর হলেন রাধাশ্যাম॥
ডুবে শ্যামা-যমুনাতে
খেলব খেলা শ্যামের সাথে
শ্যাম যবে মোর হানবে হেলা
মা পুরাবেন মনস্কাম॥
আমার মনের দো-তারাতে
শ্যামা ও শ্যামা দুটি তার,
সেই দো-তারায় ঝংকার দেয়
ওঙ্কার রব অনিবার॥
মহামায়ার মায়ার ডোরে
আনবে বেঁধে শ্যাম কিশোরে,
কৈলাসে তাই মাকে ডাকি
দেখব সেথায় ব্রজধাম॥"
ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের লক্ষ্যে শ্যাম ও শ্যামার যুগ্ম আরাধনায় সকল বাঙালি উজ্জীবিত এবং জাগরিত হয়ে উঠুক এই প্রার্থনা এবং প্রচেষ্টায় সকলের অংশগ্রহণ করা উচিত। শ্যাম-শ্যামার অভেদ ব্রহ্মচিন্তায় আমাদের ভুলে যেতে হবে, সকল প্রকার বিদ্বেষ এবং বিদ্বেষপূর্ণ দাসদাসীতত্ত্ব। সাধারণত গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণই এ দাসদাসী তত্ত্বের ব্যবহার বেশী করেন। কিন্তু তারা হয়তো অনেকেই জানেন না, তাঁদের অন্যতম পবিত্র গ্রন্থ
'শ্রীচৈতন্যভাগবত' গ্রন্থে অত্যন্ত সুন্দর করে ব্রহ্মস্বরূপা আদ্যাশক্তির স্তোত্র করা আছে। নবদ্বীপে চন্দ্রশেখরের গৃহে শ্রীচৈতন্যদেবকে উদ্দেশ্য করে নিত্যানন্দ সহ সকল পার্ষদেরা এ অনন্য আদ্যাশক্তি স্তোত্রটি করেন।
"জগৎস্বরুপা তুমি তুমি সর্বশক্তি।
তুমি শ্রদ্ধা দয়া লজ্জা তুমি বিষ্ণুভক্তি।।
যত বিদ্যা সকল তোমার মূর্তিভেদ।
সর্ব প্রকৃতির শক্তি তুমি কহে বেদ।।
নিখিল ব্রহ্মাণ্ডগণের তুমি সর্বমাতা।
কে তোমার স্বরূপ কহিতে পারে কথা।।
তুমি ত্রিজগতহেতু গুণত্রয়ময়ী।
ব্রহ্মা আদি তোমারে নাহি জানি কেহি।।
সর্বাশ্রয়া তুমি সর্বজীবের বসতি।
তুমি আদ্যা অবিকারা পরমপ্রকৃতি।।
জগতজননী তুমি দ্বিতীয়রহিতা।
মহীরূপে তুমি সর্ব জীবপাল মাতা।।
জলরূপে তুমি সর্বজীবের জীবন।
তোমা সঙরিলে খণ্ডে অশেষ বন্ধন।।
সাধুজন-গৃহে তুমি লক্ষ্মী মূর্তিমতী।
অসাধুর ঘরে তুমি কালরূপাকৃতি।।
তুমি সে করাহ জগতের সৃষ্টি স্থিতি।
তোমা না ভজিলে পায় ত্রিবিধ দুর্গতি।।"
(শ্রীচৈতন্য ভাগবত, মধ্যখণ্ড,১৮শ অধ্যায়)
স্তোত্রটিতে দেবীকে জগৎস্বরূপা, সর্বশক্তিস্বরূপা এবং সকল জীবের মাতা সহ ঈশ্বরের সকল বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়েছে। কোথাও একবারের জন্যেও তাঁকে কৃষ্ণের দাসি বলা হয়নি। এরপরেও আমরা দেখি কিছু বৈষ্ণবেরা দাস-দাসী তত্ত্ব তোতাপাখির মতো প্রতিনিয়ত আওড়ে যান!আমাদের স্মরণে, মননে এবং জীবনে শ্যাম-শ্যামার অভেদ তত্ত্ব প্রতিফলিত করে যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবো, তখনই হবে আমাদের সার্থক জাগরণ। বাঙালির প্রধান দুই আরাধ্য কালী এবং কৃষ্ণ যে এক। এ কথা গৌতমীয়, তন্ত্র কুব্জিকা তন্ত্র সহ বিভিন্ন তন্ত্রশাস্ত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে।
কলৌ কৃষ্ণত্বমাসাদ্য বৃন্দাবনবিহারিণী
বংশীনাদ-বিনোদেন মোহয়ত্যখিলং জগৎ।।
(কুব্জিকা তন্ত্র: ১.৩৪)
"দেবী কালীই কলিযুগের প্রারম্ভে,বৃন্দাবনে কৃষ্ণরূপে নিজের বংশীধ্বনিতে ত্রিভুবন মোহিত করেছিলেন।"
সকল প্রকার বিদ্বেষপূর্ণ দাসদাসীতত্ত্ব ভুলে শ্যাম শ্যামার অভেদ তত্ত্বটি স্মরণে, মননে এবং জীবনে আমাদের প্রতিফলিত করা প্রয়োজন। তবেই শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণবের নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বিদূরিত হয়ে জাতিগত ঐক্যবদ্ধতা আসবে। মনে রাখতে হবে বিভেদে বিচ্ছিন্নতা, এবং অভেদেই ঐক্যবদ্ধতা।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁