জগন্নাথ হলে বৃহৎ আকৃতির তেলসুর গাছ সহ অকারণে বিভিন্ন শতবর্ষী গাছ কাটার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদের পক্ষ থেকে তীব্রতর প্রতিবাদ হয়েছে। বারেবারে হল প্রশাসনের অহেতুক গাছ কাটার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আমিও সক্রিয় ছিলাম। হলে বিভিন্ন ইতিহাসের সাক্ষী শতবর্ষী তেলসুর গাছগুলোতে অসংখ্য ভুবন চিল বাস করত।বাংলা ভুবন চিল, বাদামি চিল, গোদা চিল, ডোম চিল বিভিন্ন নামে পরিচিত। সাঁওতালি ভাষায় ভুবন চিলের নাম কুরিত; শ্রীলঙ্কার সিংহলি ভাষাতে রাজালিয়া; এবং আসামের ভাষায় চিলানা ও মুগাচারানি নামে পরিচিত।ভুবন চিলের বৈজ্ঞানিক নাম: 'Milvus migrans' এববং ইংরেজিতে 'Black Kite' নামে অবিহিত।
ভুবন চিলের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ হল পরিযায়ী চিল । গ্রিক শব্দ 'Milvus' অর্থ হল চিল পাখি এবং 'Migrans' অর্থ পরিযায়ন। অর্থাৎ যে ক্রমাগত ভ্রমনশীল।বড় বড় গাছে এরা দলবদ্ধভাবে রাত কাটায়। ভোরে সূর্য উঠলে এরা দল বেঁধে আকাশে ওড়ে আর অনেক্ষণ ঝাঁক বেঁধে চক্রাকারে উড়ে বেড়ায়। তারপর খাদ্যের সন্ধানে বিভক্ত হয়ে যায়। সন্ধ্যা বেলায় এরা তাদের আবাসে ফিরে আসে এবং পুনরায় ভোর বেলার মত চক্রাকারে কিছুক্ষণ ওড়ে। তারপর গাছে এসে বসে পড়ে।ভুবন চিল লম্বা চেরা লেজওয়ালা কালচে-বাদামি মাঝারি আকারের শিকারী পাখি। এর দৈর্ঘ্য কমবেশি ৬১ সেন্টিমিটার। লিঙ্গভেদে এদের সকলের চেহারা একই। তবে স্ত্রী পাখি পুরুষ পাখির তুলনায় একটু বড় হয়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহ স্পষ্ট গাঢ় লালচে-বাদামি।
শীতকালে এরা শীতপ্রধান অঞ্চল থেকে অসংখ্য ভুবন চিল পরিযায়ী হয়ে বাংলাদেশে সাময়িক আবাস গড়ে। দেশের স্থানীয় পাখির দলে যোগ দেয়।খাদ্যের সন্ধানে এরা আকাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অলস ভঙ্গিমায় চক্কর কেটে বেড়ায়। এরা খুব কমই ডানা ঝাপটায়।ভুবন চিলের খাদ্যতালিকা বেশ বিশাল। এর খাদ্যতালিকা স্থানীয় খাদ্যের উপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল। মাছ এদের অত্যন্ত প্রিয়। তাই জলাশয়ের আশেপাশে তারা আবাস গড়ে তোলে। অনেকসময় এরা মৃত বা রুগ্ন মাছও খায়। আহত, মৃত বা অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি, স্তন্যপায়ী, ব্যাঙ, সরিসৃপ ও পোকামাকড়ও খায়। উঁচু গাছে কাঠি, ডালপালা ও কাঠি দিয়ে এলোমেলো মাচার মত বাসা বানায়। বড় গাছে, উঁচু দালানে, জলের ট্যাঙ্কে সাধারণত বাসা করে তারা।নষ্ট কাগজ, অন্যান্য পাখির পালক, ছেঁড়া কাপড়, শুকনো গোবর, কাদা, উজ্জ্বল প্লাস্টিকের বস্তু দিয়ে বাসা তৈরি করে।সারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে বিতাড়িত হয়ে, অসহায় পাখিগুলো অবশেষে জগন্নাথ হলের শতবর্ষী গাছগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভুবন চিলের কাঁপা কাঁপা সুরে শিস দিয়ে "কিউইইইইইইই-উয়ি -উয়ি- উয়ি-উই-উ" ডাক আমাকে মুগ্ধ করত। ডাকটি কোকিলের মত মিষ্টি না হলেও ভালো লাগত।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই গাছগুলো বিভিন্ন অজুহাতে হল প্রশাসন পক্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে কেটে ফেলা হচ্ছিল। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে জগন্নাথ হল উত্তর ভবনের পিছনে একটি গাছ কাটার পরে আমরা অনেকেই তীব্র প্রতিবাদ করি। সাময়িক কাছ কাটা বন্ধ হয়। সেই সময়ে এক একটি গাছ কাটা হচ্ছিল এবং সে গাছে বসবাস করা অসহায় ভুবন চিলগুলো বাস্তুহারা হয়ে আকাশে এদিক ওদিক গন্তব্যহীনভাবে উড়ে বেড়াচ্ছিল। প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলাম চোখের সামনে অসহায় পাখিগুলোকে বাস্তুহারা হতে দেখে। ঠিক সে সময়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে 'তেলসুর গাছের ভুবন চিল' শিরোনামে একটি কবিতাটি লিখি। কবিতাটি হল:
অনেক কষ্টে পেয়েছ আশ্রয়,
শহর নামক ইট-বালুর জঙ্গলে;
অস্তিত্বের প্রয়োজনে
এক অসম লড়াই মানবের সাথে।
মায়ের মত আঁকড়ে ধরে আছে,
জগন্নাথ হলের শতবর্ষী তেলসুর গাছটি
ভালবাসায় যেন কত মাখামাখি।
মানবের লোভে স্বার্থপরতায়,
অভাগা শতবর্ষী তেলসুরের
জীবনপ্রদীপের তেল নিঃশেষ প্রায়।
ওগো, নিষ্পাপ ভুবন চিল!
এরপর, কোথায় যাবে তোমরা?
নগরায়ণের নামে,
অজানা উল্টারথে চলছি আমরা,
গন্তব্য যার ধ্বংস রুদ্রের আসন।
প্রলয়ের রথে চলছি অবুঝ শিশু হয়ে
আমাদের সাথে যাবে?
তোমাদের সাথি করে নিতে চাই,
যেতে না চাইলেও
তোমাদের যেতে হবে, আমাদের সাথে।
ধ্বংসের নিষ্ঠুর শোভাযাত্রায়।
মুক্ত নীলিমায় সবুজ অরণ্যে
জলের ভালবাসায় অনেক সিক্ত হয়েছ,
এবার যেতে হবে আমাদের গন্তব্যে
নিরবচ্ছিন্ন বৃক্ষ নিধন করে,
স্বোপার্জিত আত্মহননের পথে;
নগর নামক কংক্রিটের জঙ্গলে।
আমাদের সাথে
তোমাদেরও সাথি হতে হবে;
আমাদের যাত্রা প্রস্তুত,
শুধু তোমাদেরই অপেক্ষা।
জানতে পারলাম আজ হয়ত সেই পুরনো গাছগুলো নেই। বিভিন্ন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে গাছগুলো কেঁটে ফেলা হয়েছে। সেই ভুবন চিলগুলোও আগের মত আর জগন্নাথ হলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাস করে। বুঝতে যে দিনেদিনে আমরা শহর নামক ইট-বালুর জঙ্গলে আমাদের চিরপরিচিত প্রকৃতি এবং হারিয়ে ফেলছি। অবশ্য এ নিয়ে কারই ভ্রুক্ষেপ নেই। শুধু বিশ্ব পরিবেশ দিবস অথবা বিশ্ব পশুপাখি দিবসের মত দিনগুলো আসলে আমাদের কিছুটা লোকদেখানো বোধদয় হয়। আমরা সেই সকল সভা, সমিতিতে লাঞ্চের প্যাকেট এবং বক্তব্যের জন্য সম্মানী প্যাকেট প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত প্রকৃতি পরিবেশকে রক্ষা নিয়ে অগ্নি ঝরানো বক্তব্যের কোন কমতি রাখি না। যার অধিকাংশই নিজেদের জীবনে বিশ্বাস করি না। বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিজনের সাথে চর্চাও করি না। অর্থাৎ দুঃখজনক হলেও সত্য, সভা সমিতি এবং সেই সভা সমিতির উপলক্ষে সম্মানী প্রাক্তির পূর্ব পর্যন্তই আমাদের পরিবেশ প্রেম। অধিকাংশই ভেতর থেকে একটুখানি উপলব্ধি করি না যে, এ পরিবেশকে যদি রক্ষা না করি, তবে আমার অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে যাবে। এই পরিবেশে নিজেরাই নিজদের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব স্বীকৃতি দিয়ে আমার যেমন বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে; তেমনি অধিকার রয়েছে নামগোত্রহীন পথের কুকুরটির, তেমনি অধিকার রয়েছে ভুবন চিলের।
২০০৭ সালে বঙ্গোপসাগরে এলাকায় সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় 'সিডর' হয়। এর অভিঘাতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ বিধ্বস্ত হয়। সেই সেই ভয়ংকর রাত্রিতে ভুবন চিলসহ প্রচুর পাখি নিহত হয় আহত হয়। জগন্নাথ হল সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন স্থানে পাখিগুলোকে ইতস্ততভাবে মাটিয়ে ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পাখিগুলোর এই অসহায় দশা দেখে প্রচণ্ড কষ্ট হয় তখন। যারা মরে গেছে, তাদের নিয়ে তো কিছুই কথার ছিল না। কিন্তু আমার চোখের সামনে যে কয়েকটি পাখিকে জীবন্মৃত অবস্থায় পেয়েছিলাম, তাদের কয়েকজনে মিলে যথাসাধ্য সেবাশুশ্রূষা করেছিলাম।তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে, এত নিহত, আহত পাখির ভিরে এ সেবাটি অত্যন্ত অপ্রতুল ছিল। কিন্তু সে সময়ে কিছুই তেমন করার ছিল না। এই পাখিদের নিয়ে আরেকটি স্মৃতি মনে পড়ে, একবার কয়েকটি বখাটে টাইপের ছেলে রাবারের গুলির বন্দুক নিয়ে এই পাখিগুলো শিকার করতে এসেছিল। আমি তখন বন্ধুদের সাথে ক্লাস শেষ করে শামসুন্নাহার হল অতিক্রম করে জগন্নাথ হলে উত্তর গেটের দিকে যাচ্ছি। আমি ওদের জিজ্ঞাসা করলাম এই তোমরা কি করছ?ছেলেগুলো প্রতুত্তরে জানাল যে তারা পাখি শিকার করতে এসেছে। এই ভুবন চিল পাখি তো কেই পোশ মানায় না বা খায় না; তবে শুধু শুধু এই পাখিগুলোকে গুলি মেরে আহত নিহত করবে কেন? খুব সাবলীলভাবে জানায়, "ভাইয়া নিশানা প্রাকটিস করছি"। ওদের কথা শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে বলালাম, ও অন্যকে মেরে হাতের নিশানা প্রাকটিস করছ তাই না?তোমাকে মেরে যদি নিশানা প্রাকটিস করে, তবে কি করবে? তোমরা এখান থেকে যাবে না প্রশাসনকে দিয়ে তোমাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করব? ছেলেগুলো আমার কথায় ঘাবড়ে গিয়ে বন্ধুকের গুলি ফেলে দিয়েই হুড়মুড় করে দৌড়ে পালাল। আমি পেছন থেকে বললাম, এই বন্ধুকের গুলি ফেলে গেছ, নিয়ে যাও; এ গুলি দিয়ে আমি কি করব? ছেলেগুলো গুলির মায়া ত্যাগ করে আরও দ্রুত গতিতে পালাতে লাগলো।
আজ হয়ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের তেলসুর গাছের সেই ভুবন চিলগুলো নেই বা তাদের সংখ্যা তলানিতে এসে থেমেছে। কিন্তু তাদের স্মৃতিগুলো সজীব হয়ে রয়েছে। ছাত্রাবস্থায় মাঝেমধ্যে তাদের আচরণে বিরক্ত হত অনেক বন্ধুরাই। দেখা গেল কোন ছাত্র সকালে ক্লাসে রওয়ানা দিয়েছে অথবা বিকালবেলা ফিটফাট হয়ে টিউশনি করতে যাবে, হলের উত্তরের গেটে এসে আবার তাকে নিজের রুমে পুনরায় ফেরত যেতে হত। কারণ, পাখিগুলো তাদের উপরে প্রাকৃতিক কর্ম সেরে দিয়েছে। মাঝেমধ্যে ভাবতাম যে, এই ভুবন চিলসহ পাখিগুলোর সুনির্দিষ্ট হয় কি করে? পুরাতন গাছগুলোতে বসবাস করা ভুবন চিলসহ পাখিদের এই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদের কারণে বহু ছাত্রই পাখিগুলোর প্রতি বিরক্ত ছিল। এ ঘটনাটা অনেকের সাথে একাধিকবার হলেও, আমার সাথে কেন যেন কখনো হয়নি। কি জানি! আমি যে ওদের অনেক ভালোবাসতাম, এটা ওরা জানতে পেরেছিল বোধহয়। জগন্নাথ হলের তেলসুরসহ পুরনো গাছগুলোতে ভুবনচিলসহ অনেক পাখিই বাস করত। এটা বুঝতে পারতাম নিত্য নতুন বিভিন্ন রঙের পাখির পালক নিচে পড়া দেখতা। কিছু কিছু পাখির পালক এত অপূর্ব যে, শুধু চেয়ে থাকতাম। ক্লাসে যাওয়ার পথে এবং ক্লাস থেকে ফিরার পথে হলের উত্তরের গেটের আশেপাশে বড় বড় গাছগুলোতে পাখিগুলোকে দেখতে দেখতে যেতাম। এদের অনেক রঙবেরঙের পালকই সংগ্রহ করে আজও রেখেছি। এই পালকগুলোকে বইয়ের বুকমার্ক হিসেবে ব্যবহার করতাম। আজও যখন সেই বইয়ের মধ্যে সেই ছাত্রাবস্থায় রাখা রঙিন পাখির পালকগুলো দেখি, মনটা তখন হলের জীবনে চলে যায়।শুধু মনে মনে ভাবি, পাখিটি হয়ত অনেক দূরে আছে; অথবা বেঁচে নেই। কিন্তু তার রঙিন পালকটি আভিজাত্যপূর্ণ ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছে। এটাই হয়ত জীবন! খাঁচার বদ্ধ পাখি দিনশেষে অজানা গন্তব্যে উড়ে যায়। শুধু রয়ে যার তার রঙবেরঙের রঙিন পালক।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।