-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

মানুষ দিনশেষে একা, এবং নিজেকেই শুধু ভালবাসে

মানব; মানব ছবি; ছায়া; মানুষ; সমুদ্র;


 মানুষ সামাজিক জীব। সে কারো সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া একা কোনভাবেই বাঁচতে পারে না। মানুষ কারো সঙ্গ ছাড়া যেমন বেঁচে থাকতে পারে না, একথাটি যেমনি সত্য; তেমনি মুদ্রার উল্টোদিকে আরেকটি নির্মম সত্য রয়েছে। মাতৃগর্ভ থেকে অন্তেষ্টিক্রিয়ায় শ্মশান, মানুষ সর্বত্রই একা। 

মাতৃগর্ভ এবং শ্মশানের মাঝখানে বাকিটা সময় শুধুই একলা না থাকার জন্যে আমরা আশ্রয় খুঁজে বেড়াই , ভালবাসা খুঁজে বেড়াই এবং অবলম্বন খুঁজে বেড়াই। এ হল রূঢ় বাস্তব সত্যকথা।যে সত্যকথা আমরা সাধারণত প্রকাশ্য বলি না, অথবা বলতে হয় না। কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিরা সত্যটি জীবনে চরমভাবে উপলব্ধি করে জীবনকে বৈরাগ্যময় করতে পেরেছেন। মহাভারতের যুগেও  মিথিলার রাজা রাজর্ষি জনকের মুখেও মমতা, ভালবাসা না পাওয়ার বেদনা শোনা যায়। তিনি মিথিলা সহ সারা পৃথিবী যথাসম্ভব হন্যে হয়ে ঘুরেও মমতা রূপ ভালবাসাকে পাননি।


পিতৃপৈতামহে রাজ্যে বশ্যে জনপদে সতি।
বিষয়ং নাধিগচ্ছামি বিচিন্তন্ পৃথিবীসহম্।।
নাধ্যগচ্ছং যদা পৃথ্ব্যাং মিথিলা মার্গিতা ময়া।
নাধ্যগচ্ছং যদা তস্যাং স্বপ্রজা মার্গিতা ময়া।।
নাধ্যগচ্ছং যদা তস্যাং তদা মে কশ্মলোঽভবৎ।
ততো মে কশ্মলস্যান্তে মতিঃ পুনরুপস্থিতা।।

(মহাভারত : আশ্বমেধিক পর্ব, ৩৭.৮-১০)


"রাজা জনক বললেন, এ রাজ্যটি আমার পিতৃপিতামহক্রমে এসেছে এবং সমগ্র দেশটাও আমার বশীভূত রয়েছে; তথাপি আমি সমগ্র পৃথিবী অন্বেষণ করেও মমত্বাস্পদীভূত বস্তু পেলাম না। যখন পৃথিবীতে মমতার বস্তু পেলাম না, তখন মিথিলাতে খুঁজলাম, যখন মিথিলাতেও মমতার বস্তু পেলাম না ; তখন নিজের প্রজাদের মাঝে মমতাকে খুঁজলাম। যখন প্রজাদের মধ্যেও মমতার বস্তু পেলাম না, তখন আমার মোহ উপস্থিত হল; মোহ পরবর্তীতে চলে গেলে আমার প্রকৃত বুদ্ধির উদয় হল।"

জীবনে সকল রূঢ় বাস্তবতা যুক্ত সত্যকথা বলতে নেই। আমাদের এই সুন্দর শরীরের অভ্যন্তরে রক্তমাংস এবং একটি নরকঙ্কাল রয়েছে। বিষয়টি আমাদের কখনও মনেও থাকেনা। শরীরের অভ্যন্তরের রক্তমাংস যুক্ত নরকঙ্কালটি যদি একবার বাইরে চলে আসে। আমরা ভয় পেয়ে যাব।তেমনি সুন্দর এ সমাজ সভ্যতার অভ্যন্তরে একটি প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক আত্মপ্রীতিময় সত্ত্বা রয়েছে। যে সত্ত্বা শুধু নিজেকেই ভালবাসে এবং নিজের ভাললাগার জন্যেই অন্যের সাথে ভালবাসার বন্ধন তৈরি করে।এ অত্যন্ত রূঢ় বাস্তব সত্যকথাটি কোন নতুন কথা নয়; বহুপূর্বে বেদেই বলা আছে:


স হােবাচ ন বা অরে পত্যুঃ কামায় পতিঃ প্রিয়াে ভবত্যাত্মনস্তু কামায় পতিঃ প্রিয়াে ভবতি। ন বা অরে জায়ায়ৈ কামায় জায়া প্রিয়া ভবত্যাত্মনস্তু কামায় জায়া প্রিয়া ভবতি । ন বা অবে পুতাণাং কামায় পুত্রঃ প্রিয়া ভবন্ত্যাত্মনস্তু কামায় পুত্রাঃ প্রিয়া ভবন্তি। না বা অরে বিত্তস্য কামায় বিত্তং প্রিয়ং ভবত্যাত্মনস্তু কামায় বিত্তং প্রিয়ং ভবতি। 

(বৃহদারণ্যক উপনিষদ : ২.৪.৫)


"পতির প্রতি প্রীতির জন্য পতি প্রিয় হয় না, আত্মপ্রীতির জন্যই পতি প্রিয় হয়। স্ত্রীর প্রতি প্রীতির জন্য স্ত্রী প্রিয় হয় না, আত্মপ্রীতির জন্যই স্ত্রী প্রিয় হয়। পুত্রগণের প্রতি প্রীতির জন্য পুত্রগণ প্রিয় হয় না, আত্মপ্রীতির জন্যই পুত্রগণ প্রিয় হয়। অর্থ-বিত্তের প্রতি প্রীতির জন্য অর্থ- বিত্ত প্রিয় হয় না, আত্মপ্রীতির জন্যই বিত্ত প্রিয় হয়। অর্থাৎ জগতের সকল কিছুই মানুষের নিজের জন্যে, নিজের ভাললাগার জন্যে অর্থাৎ আত্মপ্রীতির জন্যে।"

মানুষ নিজেকেই সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। নিজেকে ভালবাসতে গিয়েই অন্যের সাথে ভালবাসা নামক লুকোচুরি খেলায় সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে জড়িয়ে যায়। কখনও সে ভালবাসায় আনে মুক্তি , অথবা কখনও ভালবাসা নিয়ে আসে অন্ধত্ব বা বন্ধ্যাত্ব।মাঝগঙ্গায় কারো যদি সপরিবারে নৌকাডুবি হয়। তবে কর্তাব্যক্তিটি হতবিহ্বল হয়ে যায়। সর্বপ্রথম সে স্ত্রীসন্তান সহ পরিবারের সবাইকেই বাঁচাতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা করে। কিন্তু পরবর্তীতে সে যখন দেখে, সবাইকে  বাঁচানো সম্ভব না; তখন সে স্বার্থপর হতে শুরু করে। গঙ্গার তীব্রস্রোত থেকে সর্বপ্রথম স্ত্রীকে ছেড়ে সন্তানদের বাঁচাতে চেষ্টা করে। এরপরে যদি সে দেখে সকল সন্তানকেও বাঁচানো সম্ভব না, তবে মেয়ে সন্তানটিকে ছেড়ে, ছেলে সন্তানটিকে বাঁচাতে চেষ্টা করে। কারণ তার কাছে  ছেলেটি বংশের ভবিষ্যৎ।  এতেও যদি সে অসমর্থ হয়, তবে স্ত্রীসন্তান সকলকেই ছেড়ে সে নিজেই বাঁচতে আপ্রাণ প্রয়াস শুরু করে। এরই নাম নির্মম সত্য। অবশ্য ঘটনাটি কাল্পনিক ; তাই ঘটনাটি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে হয়ত সত্য নয়।

মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁