ঋগ্বেদ সংহিতার প্রথম মণ্ডলের শুরুতেই জ্ঞানসমুদ্ররূপা দেবী সরস্বতীর স্তোত্র করতে গিয়ে ঋষি বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুচ্ছন্দা ঋষি চব্বিশ অক্ষরের গায়ত্রী ছন্দে দেবীকে মঙ্গলজনক সত্য ও প্রিয়বাণীর প্রেরণাদাত্রী এবং সৎবুদ্ধির চেতনাদাত্রী বলে আহ্বান করেছেন। অর্থাৎ মানবজীবনে চেতনার সুবুদ্ধি লাভের চিন্তা-চেতনা বৈদিককাল থেকেই বহমান।
"মঙ্গলজনক সত্য ও প্রিয়বাণীর প্রেরণাদাত্রী এবং সৎবুদ্ধির চেতনাদাত্রী মাতা সরস্বতী শুভকর্মকে ধারণ করে আছেন।জ্ঞানদাত্রী মাতা সরস্বতী প্রজ্ঞাশক্তি দ্বারা মহান জ্ঞানসমুদ্রকে প্রকাশ করে বুদ্ধিকে প্রদীপ্ত করেন।"
বৈদিক এ চেতনার সুবুদ্ধি লাভের কথা উনবিংশ শতাব্দীতে এসে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কণ্ঠেও অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ধ্বনিত হয়েছে ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রথম কল্পতরু উৎসবের দিনটিতে। দিনটি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও তাঁর অনুসারীদের জীবনে ছিল এক অনন্য তাৎপর্যপূর্ণ দিন এবং ঘটনা। সেই সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দুরারোগ্য গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর শারীরিক অবস্থারও দিনে দিনে যথেষ্ট অবনতি হয়ে যাচ্ছিলো । তাই তাঁকে সুচিকিৎসার জন্যে উত্তর কলকাতার কাশীপুর এলাকার একটি বাগানবাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল। ১ জানুয়ারি গোধূলিবেলায় ঠাকুর একটু সুস্থ বোধ করায় তিনি বাগানে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর ভক্ত নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ সহ অন্যদের তাঁর সকল ভালবাসা উজাড় করে দিয়ে আশীর্বাদ করেন এবং বলেন,“আমি আর কি বলব? তোমাদের চৈতন্য হোক।” এরপর তিনি সমাধিস্থ হয়ে তাঁর প্রত্যেক শিষ্যকে স্পর্শ করেন। রামকৃষ্ণ-অনুগামীদের মতে, তাঁর স্পর্শে সেদিন প্রত্যেক ভক্তের অদ্ভুত এক দৈব আধ্যাত্মিক অনুভূতি হয়েছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অন্যতম শিষ্য রামচন্দ্র দত্ত কল্পতরু সম্পর্কে বলেছিলেন, সেই দিন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব পুরাণে বর্ণিত কল্পতরুতে পরিণত হয়েছিলেন। কল্পতরু হলো এমন একটি স্বর্গীয় বৃক্ষ, তার কাছে যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়। শ্রীরামকৃষ্ণও সেই দিনে তাঁর সকল ভক্তের মনের কামনা পূর্ণ করেছিলেন। তাই শিষ্য রামচন্দ্র দত্তই এই দিনটিকে "কল্পতরু দিবস" নাম দিয়েছিলেন, যা পরে কল্পতরু উৎসব নামে পরিণত হয়ে যায়। উল্লেখ্য, এই দিন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের গৃহস্থ ভক্ত-শিষ্যরাই তাঁর কাছে উপস্থিত ছিলেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ১৮৮৬ সালে আমাদের চৈতন্য হবার জন্যে আশীর্বাদ করে গিয়েছেন, সেই আমাদের বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের এত বছরেও কতটুকু চৈতন্য হয়েছে ; তা আমি ঠিক জানি না। দিব্যজ্ঞানের সাথে সাথে যে একটু কাণ্ডজ্ঞানেরও প্রয়োজন আছে সেই জ্ঞানের চৈতন্যটুকু কে দিবে?
বিশ্ব উদ্ধারের অলিক বাস্তবতায় হুজুগে উন্মাদ হয়ে জাতিগতভাবে বাঙালি হিন্দুরা অনেক ক্ষেত্রেই আজ নিজভূমে পরবাসী। তারা যদি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের দেখানো পথে, 'ব্রহ্মচারী এবং সাপের গল্পে'র মতো ফোসফাস করতে শিখতো বা 'পাগলা হাতির গল্পের' মতো আশেপাশের পাগলা হাতিদের চিনে তাদের থেকে দূরত্বে থাকতো; তাহলে তারা জাতিগতভাবে অনেকটাই সুরক্ষিত থাকতো। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর কথামৃতে বলেছেন, "ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন। তবে ভাল লোকের সঙ্গে মাখামাখি চলে; মন্দ লোকের কাছ থেকে তফাত থাকতে হয়। বাঘের ভিতরেও নারায়ণ আছেন; তা বলে বাঘকে আলিঙ্গন করা চলে না।"
বিষয়টি আরো গভিরভাবে বুঝাতে তিনি পরপর দুটি গল্প বলেছেন। প্রথমটি 'পাগলা হাতির' এবং পরেরটি 'ব্রহ্মচারী এবং সাপের'। আমরা কথামৃত থেকে প্রথম গল্পটি উল্লেখ করছি। তাহলে সকলেই আশাকরি বুঝতে পারবেন আমাদের আশেপাশের দুর্জন পাগলা হাতিদের সম্পর্কে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মনোভাব কি ছিল। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভাষায়:
“একটা গল্প শোন্। কোন এক বনে একটি সাধু থাকেন। তাঁর অনেকগুলি শিষ্য। তিনি একদিন শিষ্যদের উপদেশ দিলেন যে, সর্বভূতে নারায়ণ আছেন, এইটি জেনে সকলকে নমস্কার করবে। একদিন একটি শিষ্য হোমের জন্য কাঠ আনতে বনে গিছল। এমন সময়ে একটা রব উঠল, ‘কে কোথায় আছ পালাও —একটা পাগলা হাতি যাচ্ছে।’ সবাই পালিয়ে গেল, কিন্তু শিষ্যটি পালাল না! সে জানে যে, হাতিও যে নারায়ণ তবে কেন পালাব? এই বলিয়া দাঁড়িয়ে রইল। নমস্কার করে স্তবস্তুতি করতে লাগল। এদিকে মাহুত চেঁচিয়ে বলছে ‘পালাও, পালাও’; শিষ্যটি তবুও নড়ল না। শেষে হাতিটা শুঁড়ে করে তুলে নিয়ে তাকে একধারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল। শিষ্য ক্ষতবিক্ষত হয়ে ও অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইল।
এই সংবাদ পেয়ে গুরু ও অন্যান্য শিষ্যেরা তাকে আশ্রমে ধরাধরি করে নিয়ে গেল। আর ঔষধ দিতে লাগল। খানিক্ষণ পরে চেতনা হলে ওকে কেউ জিজ্ঞাসা করলে, ‘তুমি হাতি আসছে শুনেও কেন চলে গেলে না?’ সে বললে, ‘গুরুদেব আমায় বলে দিয়েছিলেন যে, নারায়ণই মানুষ, জীবজন্তু সব হয়েছেন। তাই আমি হাতি নারায়ণ আসছে দেখে সেখান থেকে সরে যাই নাই।’ গুরু তখন বললেন, ‘বাবা, হাতি নারায়ণ আসছিলেন বটে, তা সত্য; কিন্তু বাবা, মাহুত নারায়ণ তো তোমায় বারণ করেছিলেন। যদি সবই নারায়ণ তবে তার কথা বিশ্বাস করলে না কেন? মাহুত নারায়ণের কথাও শুনতে হয়।’
শাস্ত্রে আছে ‘অপো নারায়ণঃ’ জল নারায়ণ। কিন্তু কোন জল ঠাকুর সেবায় চলে; আবার কোন জলে আঁচানো, বাসনমাজা, কাপড়কাচা কেবল চলে; কিন্তু খাওয়া বা ঠাকুরসেবা চলে না। তেমনি সাধু, অসাধু, ভক্ত, অভক্ত — সকলেরই হৃদয়ে নারায়ণ আছেন।
কিন্তু অসাধু, অভক্ত, দুষ্ট লোকের সঙ্গে ব্যবহার চলে না। মাখামাখি চলে না। কারও সঙ্গে কেবল মুখের আলাপ পর্যন্ত চলে, আবার কারও সঙ্গে তাও চলে না। ওইরূপ লোকের কাছ থেকে তফাতে থাকতে হয়।”
সকল মানবকেই বুকে জড়িয়ে ধরতে যেয়ে আজ আমাদের নিজেদের বুকই ছারখার হয়ে যাচ্ছে । আমরা যতই শান্তির বাণী নিয়ে দস্যুদের কাছে যাচ্ছি, দস্যু প্রকৃতির আততায়ীরা ততই দস্যুতর-দস্যুতম হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সাধুসজ্জন এবং আততায়ীদের মধ্যে আকাশপাতাল ব্যবধানকে গুলিয়ে ফেলছি আমরা।শ্রীমদ্ভগবদগীতার প্রথম অধ্যায়তেইই আততায়ী শব্দটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। ধর্মশাস্ত্রে আততায়ী ঘৃণ্য এবং নৃশংস হওয়ার কারণে শাস্তির যোগ্য। স্মৃতি শাস্ত্রেও আততায়ীদের সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। তাদের প্রতিরোধ করতে বলা হয়েছে। বশিষ্ঠ সংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ে আততায়ী সম্পর্কে বলা হয়েছে:
"যে ঘরে আগুন দেয়; খাবারে বিষ প্রয়োগ করে; ধারালো অস্ত্র দ্বারা হত্যা করতে উদ্যত হয় বা করে; অন্যের ধনসম্পদ যে জোর করে অপহরণ করে; অন্যের ক্ষেতখামার বা জমিজমা যে দখল করে এবং ঘরের স্ত্রীদের অপহরণকারী; এছয় প্রকার দুষ্কৃতিকারীকে আততায়ী বলা হয়।"
আমাদের আশেপাশের নিষ্ঠুর, নৃশংস আততায়ীদের না চিনতে পেরে তাদের কাছে অহেতুক অপ্রয়োজনীয় সাম্য, মৈত্রী, প্রেম বিতরণ একটি অত্যন্ত অপরিণামদর্শীতার লক্ষণ। ফলে প্রতিনিয়তই জাতিগতভাবে প্রতারিত হচ্ছে, ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে সম্প্রদায়। এ ক্ষয়িষ্ণুতা থেকে মুক্তির জন্যে, জানিনা কবে আমাদের চৈতন্য হবে?
চোদয়িত্রী সূনৃতানাং চেতন্তী সুমতীনাং।
যজ্ঞং দধে সরস্বতী॥
মহো অর্ণঃ সরস্বতী প্রচেতয়তি কেতুনা।
ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি॥
(ঋগ্বেদ সংহিতা: ১.৩.১১-১২)
"মঙ্গলজনক সত্য ও প্রিয়বাণীর প্রেরণাদাত্রী এবং সৎবুদ্ধির চেতনাদাত্রী মাতা সরস্বতী শুভকর্মকে ধারণ করে আছেন।জ্ঞানদাত্রী মাতা সরস্বতী প্রজ্ঞাশক্তি দ্বারা মহান জ্ঞানসমুদ্রকে প্রকাশ করে বুদ্ধিকে প্রদীপ্ত করেন।"
বৈদিক এ চেতনার সুবুদ্ধি লাভের কথা উনবিংশ শতাব্দীতে এসে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কণ্ঠেও অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ধ্বনিত হয়েছে ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রথম কল্পতরু উৎসবের দিনটিতে। দিনটি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও তাঁর অনুসারীদের জীবনে ছিল এক অনন্য তাৎপর্যপূর্ণ দিন এবং ঘটনা। সেই সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দুরারোগ্য গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর শারীরিক অবস্থারও দিনে দিনে যথেষ্ট অবনতি হয়ে যাচ্ছিলো । তাই তাঁকে সুচিকিৎসার জন্যে উত্তর কলকাতার কাশীপুর এলাকার একটি বাগানবাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল। ১ জানুয়ারি গোধূলিবেলায় ঠাকুর একটু সুস্থ বোধ করায় তিনি বাগানে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর ভক্ত নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ সহ অন্যদের তাঁর সকল ভালবাসা উজাড় করে দিয়ে আশীর্বাদ করেন এবং বলেন,“আমি আর কি বলব? তোমাদের চৈতন্য হোক।” এরপর তিনি সমাধিস্থ হয়ে তাঁর প্রত্যেক শিষ্যকে স্পর্শ করেন। রামকৃষ্ণ-অনুগামীদের মতে, তাঁর স্পর্শে সেদিন প্রত্যেক ভক্তের অদ্ভুত এক দৈব আধ্যাত্মিক অনুভূতি হয়েছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অন্যতম শিষ্য রামচন্দ্র দত্ত কল্পতরু সম্পর্কে বলেছিলেন, সেই দিন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব পুরাণে বর্ণিত কল্পতরুতে পরিণত হয়েছিলেন। কল্পতরু হলো এমন একটি স্বর্গীয় বৃক্ষ, তার কাছে যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়। শ্রীরামকৃষ্ণও সেই দিনে তাঁর সকল ভক্তের মনের কামনা পূর্ণ করেছিলেন। তাই শিষ্য রামচন্দ্র দত্তই এই দিনটিকে "কল্পতরু দিবস" নাম দিয়েছিলেন, যা পরে কল্পতরু উৎসব নামে পরিণত হয়ে যায়। উল্লেখ্য, এই দিন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের গৃহস্থ ভক্ত-শিষ্যরাই তাঁর কাছে উপস্থিত ছিলেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ১৮৮৬ সালে আমাদের চৈতন্য হবার জন্যে আশীর্বাদ করে গিয়েছেন, সেই আমাদের বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের এত বছরেও কতটুকু চৈতন্য হয়েছে ; তা আমি ঠিক জানি না। দিব্যজ্ঞানের সাথে সাথে যে একটু কাণ্ডজ্ঞানেরও প্রয়োজন আছে সেই জ্ঞানের চৈতন্যটুকু কে দিবে?
বিশ্ব উদ্ধারের অলিক বাস্তবতায় হুজুগে উন্মাদ হয়ে জাতিগতভাবে বাঙালি হিন্দুরা অনেক ক্ষেত্রেই আজ নিজভূমে পরবাসী। তারা যদি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের দেখানো পথে, 'ব্রহ্মচারী এবং সাপের গল্পে'র মতো ফোসফাস করতে শিখতো বা 'পাগলা হাতির গল্পের' মতো আশেপাশের পাগলা হাতিদের চিনে তাদের থেকে দূরত্বে থাকতো; তাহলে তারা জাতিগতভাবে অনেকটাই সুরক্ষিত থাকতো। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর কথামৃতে বলেছেন, "ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন। তবে ভাল লোকের সঙ্গে মাখামাখি চলে; মন্দ লোকের কাছ থেকে তফাত থাকতে হয়। বাঘের ভিতরেও নারায়ণ আছেন; তা বলে বাঘকে আলিঙ্গন করা চলে না।"
বিষয়টি আরো গভিরভাবে বুঝাতে তিনি পরপর দুটি গল্প বলেছেন। প্রথমটি 'পাগলা হাতির' এবং পরেরটি 'ব্রহ্মচারী এবং সাপের'। আমরা কথামৃত থেকে প্রথম গল্পটি উল্লেখ করছি। তাহলে সকলেই আশাকরি বুঝতে পারবেন আমাদের আশেপাশের দুর্জন পাগলা হাতিদের সম্পর্কে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মনোভাব কি ছিল। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভাষায়:
“একটা গল্প শোন্। কোন এক বনে একটি সাধু থাকেন। তাঁর অনেকগুলি শিষ্য। তিনি একদিন শিষ্যদের উপদেশ দিলেন যে, সর্বভূতে নারায়ণ আছেন, এইটি জেনে সকলকে নমস্কার করবে। একদিন একটি শিষ্য হোমের জন্য কাঠ আনতে বনে গিছল। এমন সময়ে একটা রব উঠল, ‘কে কোথায় আছ পালাও —একটা পাগলা হাতি যাচ্ছে।’ সবাই পালিয়ে গেল, কিন্তু শিষ্যটি পালাল না! সে জানে যে, হাতিও যে নারায়ণ তবে কেন পালাব? এই বলিয়া দাঁড়িয়ে রইল। নমস্কার করে স্তবস্তুতি করতে লাগল। এদিকে মাহুত চেঁচিয়ে বলছে ‘পালাও, পালাও’; শিষ্যটি তবুও নড়ল না। শেষে হাতিটা শুঁড়ে করে তুলে নিয়ে তাকে একধারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল। শিষ্য ক্ষতবিক্ষত হয়ে ও অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইল।
এই সংবাদ পেয়ে গুরু ও অন্যান্য শিষ্যেরা তাকে আশ্রমে ধরাধরি করে নিয়ে গেল। আর ঔষধ দিতে লাগল। খানিক্ষণ পরে চেতনা হলে ওকে কেউ জিজ্ঞাসা করলে, ‘তুমি হাতি আসছে শুনেও কেন চলে গেলে না?’ সে বললে, ‘গুরুদেব আমায় বলে দিয়েছিলেন যে, নারায়ণই মানুষ, জীবজন্তু সব হয়েছেন। তাই আমি হাতি নারায়ণ আসছে দেখে সেখান থেকে সরে যাই নাই।’ গুরু তখন বললেন, ‘বাবা, হাতি নারায়ণ আসছিলেন বটে, তা সত্য; কিন্তু বাবা, মাহুত নারায়ণ তো তোমায় বারণ করেছিলেন। যদি সবই নারায়ণ তবে তার কথা বিশ্বাস করলে না কেন? মাহুত নারায়ণের কথাও শুনতে হয়।’
শাস্ত্রে আছে ‘অপো নারায়ণঃ’ জল নারায়ণ। কিন্তু কোন জল ঠাকুর সেবায় চলে; আবার কোন জলে আঁচানো, বাসনমাজা, কাপড়কাচা কেবল চলে; কিন্তু খাওয়া বা ঠাকুরসেবা চলে না। তেমনি সাধু, অসাধু, ভক্ত, অভক্ত — সকলেরই হৃদয়ে নারায়ণ আছেন।
কিন্তু অসাধু, অভক্ত, দুষ্ট লোকের সঙ্গে ব্যবহার চলে না। মাখামাখি চলে না। কারও সঙ্গে কেবল মুখের আলাপ পর্যন্ত চলে, আবার কারও সঙ্গে তাও চলে না। ওইরূপ লোকের কাছ থেকে তফাতে থাকতে হয়।”
সকল মানবকেই বুকে জড়িয়ে ধরতে যেয়ে আজ আমাদের নিজেদের বুকই ছারখার হয়ে যাচ্ছে । আমরা যতই শান্তির বাণী নিয়ে দস্যুদের কাছে যাচ্ছি, দস্যু প্রকৃতির আততায়ীরা ততই দস্যুতর-দস্যুতম হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সাধুসজ্জন এবং আততায়ীদের মধ্যে আকাশপাতাল ব্যবধানকে গুলিয়ে ফেলছি আমরা।শ্রীমদ্ভগবদগীতার প্রথম অধ্যায়তেইই আততায়ী শব্দটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। ধর্মশাস্ত্রে আততায়ী ঘৃণ্য এবং নৃশংস হওয়ার কারণে শাস্তির যোগ্য। স্মৃতি শাস্ত্রেও আততায়ীদের সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। তাদের প্রতিরোধ করতে বলা হয়েছে। বশিষ্ঠ সংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ে আততায়ী সম্পর্কে বলা হয়েছে:
অগ্নিদো গরদশ্চৈব শস্ত্রপাণির্ধনাপহঃ।
ক্ষেত্রদারহরশ্চৈব ষড়েত আততায়িনঃ।।
"যে ঘরে আগুন দেয়; খাবারে বিষ প্রয়োগ করে; ধারালো অস্ত্র দ্বারা হত্যা করতে উদ্যত হয় বা করে; অন্যের ধনসম্পদ যে জোর করে অপহরণ করে; অন্যের ক্ষেতখামার বা জমিজমা যে দখল করে এবং ঘরের স্ত্রীদের অপহরণকারী; এছয় প্রকার দুষ্কৃতিকারীকে আততায়ী বলা হয়।"
আমাদের আশেপাশের নিষ্ঠুর, নৃশংস আততায়ীদের না চিনতে পেরে তাদের কাছে অহেতুক অপ্রয়োজনীয় সাম্য, মৈত্রী, প্রেম বিতরণ একটি অত্যন্ত অপরিণামদর্শীতার লক্ষণ। ফলে প্রতিনিয়তই জাতিগতভাবে প্রতারিত হচ্ছে, ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে সম্প্রদায়। এ ক্ষয়িষ্ণুতা থেকে মুক্তির জন্যে, জানিনা কবে আমাদের চৈতন্য হবে?