-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

"উত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ"; গীতায় বর্ণিত ধর্মযুদ্ধের স্বরূপ

শ্রীমদ্ভগবদগীতা, শ্রীমদ্ভগবদগীতা কি, শ্রীকৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ


শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ধর্মযুদ্ধের প্রসঙ্গে অনেকেই না বুঝে বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্য করে বসেন। তারা বলেন, শ্রীমদ্ভগবদগীতা যদি বৈশ্বিক শান্তির গ্রন্থ হয় তবে অর্জুন বারবার যুদ্ধ করতে অপারগতা জানানোর পরেও কেন শ্রীকৃষ্ণ বিভিন্ন ভাবে তাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে বলেছেন? কথাটি যৌক্তিক হলেও, শ্রীমদ্ভগবদগীতার প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে বালখিল্য কথা। এ ধর্মযুদ্ধ শব্দটি আলোচনার আগে আমাদের জানা প্রয়োজন ধর্ম কাকে বলে। শাস্ত্রে বিভিন্ন স্থানে ধর্মের সংজ্ঞা দেয়া আছে। মহাভারতেই অর্জুন জগতে ধর্ম কি ; তা জানতে শ্রীকৃষ্ণের কাছে জানতে চেয়েছিলেন।উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন :
ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহু ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ।
যৎস্যাদ্ধারণ সংযুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ।।
(মহাভারত : কর্ণপর্ব, ৬৯. ৫৮)
"সমাজকে, জনসাধারণকে যা ধারণ করে রাখে, তাই ধর্ম। তাই কিসে জনসাধারণের, সমাজের সমৃদ্ধি এবং কল্যাণ হয়, তার সাথে যুক্ত হওয়াই ধর্ম ; এ কথা নিশ্চিতরূপে যেন।"
ধর্ম হল সর্বজনীন কল্যাণের একটি সত্ত্বা।যা সমাজ এবং সমাজের সকল মানবকে কল্যাণের পথে ঋদ্ধির পথে ধারণ করে রাখে, তাই ধর্ম।তাই ঋদ্ধি কল্যাণের পথে যুক্ত হওয়াকেই ধর্ম বলে। সনাতন ধর্ম চেতনায় কোন জাতিবাচকতা নেই। এ ধর্মে শুধুই স্রষ্টা এবং সৃষ্টির সম্পর্কই মুখ্য। সর্বজনীন কল্যাণের জন্যে স্রষ্টা তাঁর বাণী প্রকাশ করেছেন। এ বাণীতে নেই কোন জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ ; কোন ভাষাভাষির প্রতি বিদ্বেষ। শুধুই দুটি পথ ধর্ম এবং অধর্মের। এ অধর্ম যদি রক্তের সম্পর্কে নিজ পরিবারেও উৎপন্ন হয়, তবে তাকেও বিনাশ করতে হবে। দুর্যোধনাদি শতভাই এবং পঞ্চপাণ্ডব সকলেই রক্তের সম্পর্কের ভাই। এরপরেও তাদের মাঝে যুদ্ধ হয়েছে, শুধুই ধর্মের কারণে।
শ্রীমদ্ভগবদগীতা যদি ভাল-মন্দ যাই হোক জগতের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতি যুদ্ধ ঘোষণা করত; সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাড়া অন্যদের বিধর্মী ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে অকারণ যুদ্ধ ঘোষণা করে তাকে ধর্মযুক্ত নামে নামকরণ করত; তবে বিষয়টি মানবতার নিরিখে প্রশ্নবিদ্ধ হত। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় উক্ত যুদ্ধ শুধুই ধর্ম অধর্মের যুদ্ধ; সাধুজনদের রক্ষা এবং অসাধু দুর্জনদের বিনাশের যুদ্ধ। গীতার শুরুতেই এ কারণেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে একজন ক্ষত্রিয় যোদ্ধা হিসেবে স্বীয়কীর্তি থেকে ভ্রষ্ট হতে নিষেধ করেছেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এতে তার পাপ হবে। মানুষ তার অকীর্তি গাইবে, ভীতু বলে তুচ্ছজ্ঞান করবে।
যা একজন মর্যাদাবান মহারথীর অপেক্ষা মৃত্যুও অধিক শ্রেয়স্কর। ধর্ম এবং অধর্মের যুদ্ধে ভয় পেয়ে অথবা মোহ-মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করা যাবে না।
অথ চেত্ত্বমিমং ধর্ম্যং সংগ্রামং ন করিষ্যসি৷
ততঃ স্বধর্মং কীর্তিং চ হিত্বা পাপমবাপ্স্যসি৷৷
অকীর্তিঞ্চাপি ভূতানি কথয়িষ্যন্তি তেঽব্যয়াম্৷
সংভাবিতস্য চাকীর্তির্মরণাদতিরিচ্যতে৷৷
ভয়াদ্রণাদুপরতং মংস্যন্তে ত্বাং মহারথাঃ৷
যেষাঞ্চ ত্বং বহুমতো ভূত্বা যাস্যসি লাঘবম্৷৷
অবাচ্যবাদাংশ্চ বহূন্ বদিষ্যন্তি তবাহিতাঃ৷
নিন্দন্তস্তব সামর্থ্যং ততো দুঃখতরং নু কিম্৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:২.৩৩-৩৬)
"আর তুমি যদি এই ধর্মযুদ্ধ না কর তা হলে তোমার স্বীয়কীর্তি থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পাপ ভোগ করবে।
আরও দেখ, সমস্ত লোক তোমার কীর্তিহীনতার কথা বলবে। যে কোন মর্যাদাবান লোকের পক্ষে অকীর্তি অপেক্ষা মৃত্যুও অধিক শ্রেয়স্কর।
সমস্ত মহারথীরা মনে করবেন, যে তুমি দয়াবশত নয়, ভয় পেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করেছ। তখন তুমি যাদের কাছে সম্মানীত ছিলে তারা তোমাকে ভীতু বলে তুচ্ছজ্ঞান করবে।
তোমার শত্রুরা তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করে বহু অকথ্য কথা বলবে। এর চেয়ে অধিক দুঃখজনক তোমার পক্ষে আর কি হতে পারে?"
এ সর্বজনীন কল্যাণের ধর্মযুদ্ধ করতে যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনকে উত্থিত হতে বলেছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনি অর্জুনকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যে এ যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হলে সে অক্ষয় স্বর্গলাভ করে মহিমান্বিত হবে। পক্ষান্তরে জয়লাভ করলে পৃথিবীর ঐশ্বর্য ভোগ করবে। এ পৃথিবী, বীরভোগ্যা। বীরেরাই পৃথিবীকে অধর্ম থেকে রক্ষা করে। অধর্মের ধারক দুর্যোধনাদি ভাইদের সাথে সন্ধিচুক্তি সহ সাম-দানের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পরেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধটি অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও, এর থেকে পরিত্রাণের উপায় ছিল না। তাই মহারথী অর্জুনকে উত্থিত হয়ে ধর্মযুদ্ধে নির্ভীকচিত্তের অবতীর্ণ হতে বলেছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্৷
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:২.৩৭)
"'হে কুন্তীপুত্র, এই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হলে তুমি স্বর্গলাভ করবে এবং জয়লাভ করলে পৃথিবী ভোগ করবে ; অতএব যুদ্ধের জন্য দৃঢ় সংকল্প হয়ে উত্থিত হও।"
পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময়েও এমনি ধর্মযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। তখন এদেশীয় বিপ্লবী স্বদেশীরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বর্ণিত আত্মতত্ত্ব এবং ক্লীবত্ব পরিত্যাগ করে ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করাকেই তাদের প্রধান সম্বল করে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে নির্ভীকচিত্তে সাধ্যমত লড়াই করেছেন। অনেকেই হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ আত্মাহুতি দিয়েছেন। সে সময়ে স্বদেশীদের উৎসাহিত করতে অসংখ্য ব্যক্তি বিপ্লবী গণসংগীত লিখেছেন। এরমধ্যে কালী উপাসক চারণ কবি মুকুন্দদাস অন্যতম। তাঁর সকল সংগীত বিপ্লবীদের রক্তে অগ্নিমন্ত্রের দীক্ষা দিয়ে ; তাদের মাঝে বিদ্যুতের মত দুর্বার গতি সঞ্চার করেছিল। তাঁর রচিত সংগীতের মধ্যে, "ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে" এ সংগীতটি একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত সকল স্বদেশী বিপ্লবীর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে। এতে দেশমাতৃকা মাতঙ্গীশক্তিকে সম্বল করে, মৃত্যু ভয় বিদূরিত করে, ধর্মযুদ্ধ স্বরূপ বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ায় এক সুতীব্র আহ্বান ব্যক্ত হয়েছে।
"ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে
তা থৈ তা থৈ থৈ দিমি দিমি দ্রম দ্রম ।।
ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে ।।
ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।।
দানব দলনী হয়ে উন্মাদিনী
আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে ।।"
শাস্ত্রে বলা আছে, যদি ধর্ম এবং স্বদেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে কেউ মৃত্যুবরণ করে, তবে যোগিগণ ধ্যানের দ্বারা যে পদ লাভ করেন, তিনিও সেই পদ লাভ করে থাকেন। তাই কখনো যদি ধর্মযুদ্ধ সামনে চলে আসে, তবে কোনভাবেই সেই যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে যাওয়া যাবে না। ভয় না পেয়ে নির্ভীক চিত্তে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। পথে যদি মৃত্যুও আসে, ভয়ের কিছু নেই।আত্মা অবিনাশী, দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলা হলেও, অবিনশ্বর আত্মাকে কেউ স্পর্শ করতে পারে না। দেহের মৃত্যু হলেও আত্মার মৃত্যু নেই। মহানির্বানতন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ধর্মযুদ্ধে নির্ভীকচিত্তে যিনি মৃত্যুবরণ করেন; সেই ব্যক্তি অনন্ত পুণ্য লাভ করেন। সে পুণ্যে তিনি চাইলে ত্রিভুবনও জয় করতে পারেন।
ন বিভেতি রণাদ্ যো বৈ সংগ্রামেঽপ্যপরাঙ্মুখঃ।
ধর্মযুদ্ধে মৃতো বাপি তেন লোকত্রয়ং জিতম্।। (মহানির্বানতন্ত্র: ৮.৬৭)
“যিনি ধর্ম যুদ্ধে ভয় পান না, যিনি সংগ্রামে অপরাঙ্মুখ, যিনি ধর্মযুদ্ধে নির্ভীকচিত্তে মৃত্যুবরণ করেন; সেই ব্যক্তি পুণ্যফলে ত্রিভুবন জয় করতে পারেন।"
ইউরোপীয়দের 'ক্রুসেড', আরবীয়দের 'জেহাদ' ভারতবর্ষীয় আধুনিক পারিভাষিক শব্দে 'ধর্মযুদ্ধ' বলে অবিহিত করা হলেও; বিষয়গুলো এক নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন। এদেশীয় ধর্মযুদ্ধ কোন জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়। যে পাপি, দুরাচারী, দুষ্কৃতকারী ; শুধু তাদেরই বিরুদ্ধে। এ পাপিষ্ঠরা যদি নিজ রক্তের ভাই হয়; তবে তাকেও দণ্ড প্রয়োগে বিনাশ করতে হবে। অন্য ধর্মাবলম্বী যাকে হালের পরিভাষায় বিধর্মী বলা হয়; সেই বিধর্মী মানুষেরা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে হত্যার যোগ্য - শ্রীমদ্ভগবদগীতার ধর্মযুদ্ধের সংজ্ঞায় এমন অমানবিক কোন বিষয়ে প্রোৎসাহিত করা হয়নি। এখানে ধর্ম-অধর্ম বলতে মনুষ্যের সাত্ত্বিক এবং তামসিক ভাবকেই নিদিষ্ট করা হয়ে; এরমধ্যে কোন জাতিবাচক বৈরিতা নেই।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁