কবি নজরুল এবং গুরু বরদাচরণ
মানুষের জীবনের কোন একটি ঘটনা অথবা কোন প্রিয়জনের মৃত্যু তাকে সম্পূর্ণভাবে অন্য মানুষে পরিণত করে তোলে। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কবি কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত আদরের শিশুপুত্র বুলবুলের দুরারোগ্য বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে
মৃত্যু হয়। বুলবুলের বয়স তখন মাত্র চার বছর। তার জন্ম হয় ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। বুলবুলের পুরো নাম ছিলো অরিন্দম খালেদ। কবি নজরুল আদর করে ডাকতেন বুলবুল। শিশুপুত্র বুলবুলের মৃত্যু তাঁকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়ে যায়। বিষয়টি তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টিতেও পাওয়া যায়:
"ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।
করুণ চোখে চেয়ে আছে সাঝের ঝরা ফুলগুলি।।
ফুল ফুটিয়ে ভোর বেলা কে গান গেয়ে,
নীরব হ’ল কোন নিষাদের বান খেয়ে,
বনের কোলে বিলাপ করে সন্ধ্যারাণী চুল খুলি।।
কাল হতে আর ফুটবে না হায়, লতার বুকে মঞ্জরী
উঠছে পাতায় পাতায় কাহার করুণ নিশাস মর্মরী।
গানের পাখি গেছে উড়ে শূণ্য নীড়,
কন্ঠে আমার নেই যে আগের কথার ভিড়,
আলেয়ার এই আলোতে আর আসবে না কেউ কুল ভুলি।।"
বসন্ত রোগে আক্রান্ত শিশু বুলবুল যখন মৃত্যু সজ্জায় সে সময়ে কবি নজরুল ইসলাম পারস্যের কবি হাফিজের ' রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ' কাব্যটি অনুবাদ করে কাব্যটি তাঁর মৃত্যু পথযাত্রী আদরের পুত্রকে উৎসর্গ করেন। এ উৎসর্গপত্রে তিনি বুলবুলকে উদ্দেশ্য করে যা লিখেন, এতে কবির তৎকালীন মানসিক অবস্থা সহজেই ধরা পড়ে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পরবর্তীতে বিদ্রোহী মনোভাবের চঞ্চল স্বভাবের কবি ধীরেধীরে শান্ত স্বভাবের হয়ে যেতে থাকেন। বহির্জগত থেকে তিনি ধীরেধীরে অন্তর্মুখী হয়ে যেতে থাকেন। অশান্ত কবি নজরুল ইসলাম এক আধ্যাত্মিক শান্তির খোঁজ করছিলেন।
"কিছুদিন পরে যখন আমি আমার পথ খুঁজিতেছি, তখন আমার প্রিয়তম পুত্রটি সেই পথের ইঙ্গিত দেখাইয়া আমার হাত পিছলাইয়া মৃত্যুর সাগরে হারাইয়া গেল। মৃত্যু এই প্রথম আমায় ধর্মরাজ রূপে দেখা দিলেন। সেই মৃত্যুর পশ্চাতে আমার অন্তরাত্মা নিশিদিন ঘুরিয়া ফিরিতে লাগিল। ধর্মরাজ আমার হাত ধরিয়া তাঁহারই কাছে লইয়া গেলেন, যাঁহাকে নিমতিতা গ্রামে বিবাহসভায় দেখিয়াছিলাম, ধ্যানে বসিয়া আবিষ্টের মতো তাঁহাকে বাইশবার প্রদক্ষিণ করিলাম। ধর্মরাজ আমার পুত্রকে শেষবার দেখাইয়া হাসিয়া চলিয়া গেলেন। তাঁহারই চরণতলে বসিয়া যিনি আমার চিরকালের ধ্যেয় তাঁহার জ্যোতিরূপ দেখিলাম। তিনি আমার হাতে দিলেন যে অনির্বাণ দীপ-শিখা, সেই দীপ-শিখা হাতে লইয়া আজ বারো বৎসর ধরিয়া পথ চলিতেছি— আর অগ্রে চলিতেছেন তিনি পার্থসারথিরূপে।"
( কল্যাণী কাজী, ১৪০৫: পৃ. ৬৫-৬৬)
এ আধ্যাত্মিক খোঁজেরই পরিক্রমায় তিনি খুঁজে পান তাঁর গুরুদেব শ্রীবরদাচরণ মজুমদারকে (১৮৮৬-১৯৪০)। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের লালগোলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। শ্রীবরদাচরণ মজুমদার গৃহী হলেও, তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্চ মার্গের এক গৃহীযোগী। যিনি সংসারে থেকে গৃহতে থেকেও সকল কামনা বাসনা শূণ্য হয়ে যোগীতে পরিণত হয়েছেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কবি নজরুল ইসলাম গৃহযোগী শ্রীবরদাচরণ মজুমদারের কাছে দীক্ষিত হন। শ্রীবরদাচরণ মজুমদারের সাধনপদ্ধতি ছিলো এবং ক্রিয়াযোগ এবং তন্ত্রের সমন্বয়ে।
"সারাজীবন ধরিয়া বহু সাধু-সন্ন্যাসী, যোগী-ফকির, দরবেশ খুঁজিয়া বেড়াইয়া যাঁহাকে দেখিয়া আমার অন্তর জুড়াইয়া গেল, আলোক পাইল, তিনি আমাদের মতো গৃহী। এই গৃহে বসিয়াই তিনি মহাযোগী শিবস্বরূপ হইয়াছেন। এই গৃহের বাতায়ন দিয়াই আসিয়াছে তাঁহার মাঝে ব্রহ্মজ্যোতি। তাঁহার সেই সাধনার ইঙ্গিত এই 'পথহারার পথে' রহিয়াছে।"
( কল্যাণী কাজী, ১৪০৫: পৃ. ৬৬)
গুরু শ্রীবরদাচরণ মজুমদারকে নজরুল তাঁর জীবনের 'প্রলয়-সুন্দর সারথি' বলে অবিহিত করেছেন। শ্রীবরদাচরণ মজুমদার ছিলেন যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী পরম্পরায় একজন ক্রিয়াযোগী।কবি নজরুল গুরুদেব শ্রীবরদাচরণ মজুমদারের নির্দেশমত যোগসাধনায়, বিশেষ করে তান্ত্রিক ক্রিয়া যোগসাধনায় সক্রিয়ভাবে তৎপর ছিলেন। শ্রীবরদাচরণ মজুমদার সাধারণের জন্য যোগসাধনার উপযোগী করে যোগসাধনার কয়েকটি সহজ দিক নিয়ে 'পথহারার পথ' নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। মাত্র ৩৬ পৃষ্ঠার সেই পুস্তিকাটি ১৩৪৭ সালের বৈশাখ মাসে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে পুস্তিকাটি কলেবরে বৃদ্ধি পেয়ে একটি গ্রন্থে রূপান্তরিত হয়। গুরুদেব শ্রীবরদাচরণ মজুমদারের ‘পথহারার পথ' গ্রন্থের একটি অনন্য আবেগপূর্ণ ভূমিকা লিখে দেন নজরুল ইসলাম। সে ভূমিকায় গুরুদেব শ্রীবরদাচরণ মজুমদার সম্পর্কে কবি নজরুল ইসলাম বলেন:
"সহসা একদিন তাঁহাকে দেখিলাম। নিমতিতা গ্রামে এক বিবাহ সভায় সকলে বর দেখিতেছে, আর আমার ক্ষুধাতুর আঁখি দেখিতেছে আমার প্রলয়-সুন্দর সারথিকে। সেই বিবাহ-সভায় আমার বধূরূপিণী আত্মা তাহার চিরজীবনের সাথীকে বরণ করিল। অন্তঃপুরে মুহুর্মুহুঃ শঙ্খ ধ্বনি হইতেছে, স্রক- চন্দনের শুচি সুরভি ভাসিয়া আসিতেছে, নহবতে সানাই বাজিতেছে—এমনি শুভক্ষণে আনন্দ-বাসরে আমার সে ধ্যানের দেবতাকে পাইলাম। তিনি এই গ্রন্থ-গীতার উদ্গাতা—শ্রীশ্রীবরদাচরণ মজুমদার মহাশয়। আজ তিনি বহু সাধকের পথপ্রদর্শক। সাধন পথের প্রতিটি পথিক আজ তাঁহাকে চেনে। কিন্তু যেদিন আমি তাঁহাকে দেখি, তখনও তিনি বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যতীত অনেকের কাছেই ছিলেন অপ্রকাশ।
সেইদিন হইতে আমার বহির্মুখী চিত্ত অন্তরে যেন অভাব বোধ করিতে লাগিল। তখন ভারতে রাজনীতির ভীষণ ঝড় উঠিয়াছে। অসহযোগ আন্দোলনকে বাংলার প্রলয়ঙ্কর রুদ্রের চেলারা ভ্রূকুটি-ভঙ্গে ভয় দেখাইতেছে; আমি ধূমকেতুরূপে সেই রুদ্র-ভৈরবদের মশাল জ্বালাইয়া চলিয়াছি।"
( কল্যাণী কাজী, ১৪০৫: পৃ. ৬৫)
পূর্ব থেকেই নজরুল ইসলামের আধ্যাত্মিকতার প্রতি এক তীব্রতর আকর্ষণ ছিল। যা তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্যে সহজেই টের পাওয়া যায়। তবে শিশুপুত্র বুলবুলের মৃত্যুতে সেই আধ্যাত্মিকতা তীব্রতর হয়ে যেতে থাকে। কবি এক অন্য মানুষে পরিণত হয়ে যেতে থাকেন। কবির যোগ সাধনার দীক্ষা এবং সাধনা প্রসঙ্গে প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায় বলেন:
"১৯৩৬ সাল থেকে নজরুল মহাকালীর ভক্ত হয়ে ওঠেন ; বরদাচরণ মজুমদারের কাছ থেকে তান্ত্রিক মতে দীক্ষা নিয়ে সাধনা শুরু করেন। এ সময় তিনি ‘যোগাম্বধি’ নামে ব্যায়াম বই কিনে তা দেখে দেখে যোগব্যায়াম করতে লাগলেন। নেশার মতো তাঁকে এ কাজটি পেয়ে বসেছে।"
( প্রাণতোষ, ১৯৭৩ : পৃ. ২৬৪-২৬৬)
কবি নজরুল ইসলাম অনুভব করতে থাকেন কেউ বা কারো এক অদৃশ্যশক্তি তাঁকে চালনা করছে। কিন্তু তাঁকে তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না।সেই অদৃশ্য শক্তি অদৃশ্য সারথি হয়ে কবির লেখার মাঝে বলার মাঝে প্রেরণা শক্তি যোগাচ্ছে। কিন্তু অবচেতন ভাবে মাঝেমধ্যেই কবির সৃষ্টিতে প্রকাশিত হয়ে যেত সেই অদৃশ্য সারথির কথা। কে সেই অদেখা অদৃশ্য সারথি? কবি নজরুল বিস্মিত হয়ে ভাবতেন। সেই অদৃশ্য শক্তির দর্শনে তাঁর অশান্ত মন আরও অশান্ত হয়ে যেত।তিনি মনে ভাবতেন, আজ তাঁর দর্শন পাননি; কিন্তু তাঁর কৃপায় একদিন না একদিন তাঁর দর্শন পাবেনই। সেদিন কি তিনি তাঁর সেই প্রলয় সুন্দররূপ অদৃশ্য সারথিকে চিনতে পারবেন?
"বহু বৎসর আগেকার কথা। বাংলার সাহিত্য-আকাশে আমার উদয় তখন ধূমকেতুর মতো ভীতি ও কৌতূহল জাগাইয়া তুলিয়াছে, গত মহাসমরের রক্তস্নাত রুদ্রের তাণ্ডব নৃত্য আমার রক্তধারায় ছন্দহিল্লোল তুলিয়াছে। আমি তখন আবিষ্টের মতো লিখিতেছি, বলিতেছি; তাহার কোন অর্থ হয় কি না জানিতাম না, কিন্তু মনে হইতেছে তাহার প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন সাধিত হইতেছিল যাঁহার ইচ্ছায়, সেদিন তিনি আমায় এমনি গ্রাস করিয়াছিলেন যে তাঁহাকে জানিবার ইচ্ছাটুকু পর্যন্ত অবশিষ্ট রাখেন নাই। এক সাথে যশের সিংহাসন, গালির গালিটা, ফুলের মালা, কাঁটার জ্বালা—আনন্দ আঘাত পাইতে লাগিলাম। কিন্তু যিনি চালাইতেছিলেন, সেই অদৃশ্য সারথি আমায় চলিতে দিলেন না। লেখার মাঝে বলার মাঝে সহসা প্রকাশিত হইয়া পড়িত সেই অদৃশ্য সারথির কথা। নিজেই বিস্মিত হইয়া ভাবিতাম। মনে হইত তাঁহাকে আজও দেখি নাই, কিন্তু দেখিলে চিনিতে পারিব। এই কথা বহুবার লিখিয়াছি ও বহু সভায় বলিয়াছি।"
( কল্যাণী কাজী, ১৪০৫: পৃ. ৬৫)
কবি নজরুল তাঁর প্রলয় সুন্দররূপ অদৃশ্য সারথির দর্শন পেয়েছিলেন এবং চিনতেও পেরেছিলেন। গুরুর সান্নিধ্যে এসে কবি নজরুল উপলব্ধি করলেন তাঁর ব্রহ্মজ্ঞানের ক্ষুধার আগুন, যা এতকাল ধরে দাউদাউ করে তাঁর অন্তস্থলে জ্বলে যাচ্ছিল; সেই ব্রহ্মজ্ঞানের ক্ষুধার আগুন তাঁর সহজেই মিটবে। একটু একটু করে ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী হয়ে তিনি সে পথে অগ্রসর হচ্ছেন।সাধন জগতে ধীরেধীরে অগ্রসর হতে হতে তিনি যেন তাঁর রসঘন আনন্দময় স্বরূপকে দেখতে পাচ্ছেন।
যদ্বৈ তৎ সুকৃতম্। রসো বৈ সঃ।
রসং হোবায়ং লব্ধাঽঽনন্দী ভবতি।
কো হ্যেবান্যাৎকঃ প্ৰাণ্যাৎ।
যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ।
এষ হ্যেবাঽঽনন্দয়াতি।
যদা হোবৈষ এতস্মিন্নদৃশ্যেঽনাত্ম্যেঽনিরুক্তেঽনিলয়নেঽভয়ং প্রতিষ্ঠাং বিন্দতে।
অথ সোঽভয়ং গতো ভবতি।
যদা হোবৈষ এতস্মিন্নুদরমন্তরং কুরুতে।
অথ তস্য ভয়ং ভবতি।
তত্ত্বের ভয়ং বিদুষোঽমন্বানস্য।
( তৈত্তিরীয় উপনিষদ: ২.৭.১)
"সুন্দর সৃষ্টি বা স্বয়ম্ভু রূপে পরমেশ্বর 'সুকৃত’ নামে অভিহিত। তিনিই পরম আনন্দময়স্বরূপ। এ আনন্দস্বরূপকে যিনি লাভ করেন, একমাত্র তিনিই সুখী। আমাদের প্রত্যেকের অন্তরস্থ আত্মাই সকল আনন্দের উৎস। এই আনন্দ না থাকলে কেউ বাঁচতে বা জীবন ধারণের ক্লেশ সহ্য করতো? একটি নিঃশ্বাসও কি কেউ গ্রহণ করত? আত্মা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন। তিনি স্বাধীন, ত্রিগুণাতীত। যে ব্যক্তি নির্ভয়ে এই আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হন, তিনি আর কোন কিছুকে ভয় করেন না। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি পরমাত্মার সঙ্গে নিজের সামান্যতম পার্থক্যও অনুভব করেন ততক্ষণ তিনি ভয়মুক্ত নন। একজন ব্যক্তি পণ্ডিত হতে পারেন, কিন্তু তিনি যদি ব্রহ্ম থেকে নিজেকে পৃথক বলে মনে করেন তাহলে স্বয়ং ব্রহ্মই তাঁর ভীতির কারণ হয়ে ওঠেন। পক্ষান্তরে ব্রহ্মজ্ঞান মানুষকে সকল ভয়ের পারে নিয়ে যায়।"
যে আনন্দময় স্বরূপের কথা বেদে বর্ণিত হয়েছে। বেদ পরবর্তীতে শ্রীমদ্ভাগবতসহ বিবিধ শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর গুরু বরদাচরণের আদেশ ছিলো, এ অনুভূতি সকলের কাছে প্রকাশ না করতে। এ কারণেই কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন যে, সাধন জীবনে কি দেখেছেন, কি উপলব্ধি করেছেন বা কি পেয়েছেন তা তিনি প্রকাশ করতে পারবেন না। কারণ তা আত্মপ্রচার বিমুখ তাঁর গুরুদেব তাঁকে প্রকাশ করতে আদেশ করেননি। তিনি বলেছেন যে, যদি গুরুদেব থেকে আদেশ পান, এরপরেও তিনি তা গুছিয়ে সকলকে বলতে পারবেন না। কারণ বিষয়টি সম্পূর্ণই অচিন্ত্য। ব্রহ্মের পথে সাধন জগতের অনুভূতিতে ধন্য হয়েছেন, এবং বেঁচে গেছেন।
"আজ আমার বলিতে দ্বিধা নাই, তাঁহারই পথে চলিয়া আজ আমি আমাকে চিনিয়াছি। আমার ব্রহ্ম-ক্ষুধা আজও মিটে নাই কিন্তু সে ক্ষুধা এই জীবনেই মিটিবে, সে বিশ্বাসে স্থিত হইতে পারিয়াছি। আমি আমার আনন্দ-রস-ঘন স্বরূপকে দেখিয়াছি। কি দেখিয়াছি, কি পাইয়াছি আজও তাহা বলিবার আদেশ পাই নাই। হয়তো আজ তাহা গুছাইয়া বলিতেও পারিব না, তবুও কেবল মনে হইতেছে— আমি ধন্য হইলাম, আমি বাঁচিয়া গেলাম। আমি অসত্য হইতে সত্যে আসিলাম, তিমির হইতে জ্যোতিতে আসিলাম, মৃত্যু হইতে অমৃতে আসিলাম।"
( কল্যাণী কাজী, ১৪০৫: পৃ. ৬৬)
বৈদিক যোগমার্গ এবং তন্ত্রসাধনার জগতে এসে কবি নজরুল ইসলাম উপলব্ধি করলেন যে তিনি অসত্য হতে সত্যে প্রবেশ করেছেন, তিনি অন্ধকার থেকে আলোয় এসেছেন। জ্যোতিতে এসেছেন এবং মৃত্যু থেকে অমৃতে এসেছেন। কবি নজরুলের উপলব্ধি করা এ কথাগুলো বেদেও বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে প্রজ্জ্বলিত জ্ঞানময় প্রদীপের আলোয় জীবনের অন্ধকার বিদূরিত হয়ে জীবন আলোকিত হয়ে অমৃতময় হয় উঠুক:
অসতো মা সদ্গময়,
তমসো মা জ্যোতির্গময়,
মৃত্যোর্মামৃতং গময়েতি।
(বৃহদারণ্যকোপনিষদ:১.৩.২৮)
"হে প্রভু, অসৎ পথ হতে আমাকে সৎ পথে নিয়ে যাও, অন্ধকার হতে আলোতে নিয়ে যাও, মৃত্যু হতে অমৃতে নিয়ে যাও।"
মুক্তিরূপ অমৃত প্রসঙ্গে কবি নজরুল ইসলাম আরও বলেন, তিনি তাঁর গুরুদেব থেকে অমৃতের কণামাত্র পেয়ে মুক্তির পথে আজ প্রমত্ত হয়ে আছেন।অমৃত-পিয়াসী যাঁরা আছেন তাঁরা সকলেই মুক্তিরূপ অমৃতের পথে অগ্রসর হয়ে তৃপ্ত হবেন। তাদের এই সংসার সমুদ্রে অবস্থান করে মুক্তির তৃষ্ণা অনেকটা মিটিবে। তাঁরা আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হবেন।
"যে অমৃত-পারাবারের এক কণামাত্র পাইয়া আমি আজ প্রমত্ত হইয়াছি, সেই অমৃত আজ গাত্র পুরিয়া আমার অমৃত-অধিপ সকলকে পরিবেশন করিতেছেন, অমৃত-পিয়াসী যাঁহারা, তাঁহারা আমারই মতো তৃপ্ত হইবেন, তৃষ্ণা তাঁহাদের মিটিবে, তাঁহারা স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হইবেন। তাঁহার যে দীপ্ত-শিখা আমায় পথ দেখাইয়া অমৃত-সাগরের তীরে জ্যোতিলোকের দ্বারে লইয়া আসিয়াছে, সেই দীপ-শিখার প্রাণ এই গ্রন্থ। বহু পথহারা সাধক এই সাধনার দীপ-শিখার অনুবর্তী হইয়া পথ পাইয়াছেন—আজ তাঁহারা জীবন্মুক্ত হইয়া দুঃখ-শোকের অতীত অবস্থায় স্থিত। সংসারকে 'মজার কুটীর' জানিয়া তাঁহারা আজ আনন্দস্বরূপ হইয়া বসিয়া আছেন।"
( কল্যাণী কাজী, ১৪০৫: পৃ. ৬৬)
কবি নজরুল ইসলাম তাঁর সৃষ্টিশক্তির পিছনে গুরুদেব শ্রীবরদাচরণ মজুমদারের আশীর্বাদকেই প্রধান কারণ হিসেবে নির্দেশ করেছেন। তাই তিনি বলেছেন, তাঁর গুরুদেব সম্পর্কে বলা এবং তাঁকে পরিমাপের ধৃষ্টতা তাঁর নেই। সময় এখনো আসেনি, তাই তিনি গুরুদেবের আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে প্রকাশ করতে পারছেন না।কবি নজরুল ইসলাম অবলীলায় স্বীকার করেছেন যে,কাব্য, সঙ্গীত, বিবিধ সৃষ্টিশীলতাসহ তাঁর অধ্যাত্ম জীবনে,
যা কিছু শক্তির প্রকাশ ঘটেছে— এ সকল কিছুর মূলেই তাঁর গুরুদেব শ্রীবরদাচরণ মজুমদার।কবি নজরুল ইসলাম শুধু গুরুদেব শ্রীবরদাচরণ মজুমদারের অসীম দৈবশক্তি প্রকাশের সামান্য আধার মাত্র। বহুদিন বিষয়টি প্রকাশে নিষেধ ছিলো। তাই তিনি জানাতে পারেননি বা জানাননি। আজ সামান্য আদেশ হয়েছে বলে তিনি তাঁর গুরুদেব এবং তাঁর আধ্যাত্মিকতা দৈবশক্তি সম্পর্কে কিছুটা জানাচ্ছেন। গুরুদেব শ্রীবরদাচরণ মজুমদারের ‘পথহারার পথ' গ্রন্থের অনন্য আবেগপূর্ণ ভূমিকায় কবি নজরুল ইসলাম গুরুদেবের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় এখানেই দাড়ি টেনে কথার পরিসমাপ্তি টানতে পারতেন। কিন্তু তিনি এরপরে বললেন অনন্য অসাধারণ কয়েকটি কথা। তিনি বলেন, লোকসমাজ শ্রীরামচন্দ্রকেই দেখে, কিন্তু শ্রীরামচন্দ্রের পশ্চাতে রয়েছে ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ। ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের সাধনার ফলই শ্রীরামচন্দ্র। এ বিষয়টি কয়জন ভাবে? বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের দুর্দিনে এ বাংলাদেশেই যে সাম্যবাদী, নির্লোভ, নিরহঙ্কার, নিরভিমান, ব্রহ্মজ্ঞ ব্রাহ্মণযোগী শ্রীবরদাচরণ মজুমদার আত্মগোপন করে আছেন, যাঁর শক্তিতে আজ জাতিধর্ম-নির্বিশেষে শত শত বিখ্যাত বাঙালী উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণ-কল্যাণে আত্মনিয়োগ করছেন। সেই ব্রহ্মজ্ঞ ব্রাহ্মণযোগী শ্রীবরদাচরণ মজুমদারকে কয়জন চিনতে পেরেছে? কারণ তিনি প্রচার বিমুখ এক যোগী। কবি আরও বলেও স্বয়ম্প্রকাশ সূর্যোদয়ের ঠিক আগে যেমন, অকারণে পাখিরা ডেকে উঠে; গুরুদেব সম্পর্কে তাঁর কথাগুলোও ঠিক তেমনি। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন কথা সেই অরুণোদয়ের আনন্দে পাখির আকুতির মত।
"আমার যোগসাধনার গুরু যিনি তাঁহার সম্বন্ধে বলিবার ধৃষ্টতা আমার নাই। সে সময় আজও আসে নাই। আমার যাহা কিছু শক্তির প্রকাশ হইয়াছে—কাব্যে, সঙ্গীতে, অধ্যাত্ম জীবনে, তাহার মূল যিনি, আমি যাঁহার শক্তি প্রকাশের আধার মাত্র, তাঁহাকে জানাইবার আজ আদেশ হইয়াছে বলিয়াই জানাইলাম। লোকে শ্রীরামচন্দ্রকেই দেখে, তাঁহার পশ্চাতে যে ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ, যাঁহার সাধনার ফল শ্রীরামচন্দ্র, তাঁহার কথা কয়জন ভাবে? এই দুর্দিনে এই বাংলাদেশেই যে সাম্যবাদী, নির্লোভ, নিরহঙ্কার, নিরভিমান, ব্রহ্মজ্ঞ ব্রাহ্মণযোগী আত্মগোপন করিয়া আছেন, যাঁহার শক্তিতে আজ জাতিধর্ম-নির্বিশেষে শত শত বিখ্যাত বাঙালী উদ্বুদ্ধ হইয়া জনগণ-কল্যাণে আত্মনিয়োগ করিয়াছেন, তাঁহাকে প্রণাম নিবেদন করাই এই ভূমিকার উদ্দেশ্য। স্বয়ম্প্রকাশ সূর্যোদয়ের আগে যেমন অকারণ বিহগ কাকলী ধ্বনিত হইয়া উঠে, আমারও এই কয়েকটি অসম্বন্ধ কথা সেই অরুণোদয়ের আনন্দে আকুতির ক্ষীণ আভাস মাত্র। আদেশ পাইলে এই মহাযোগীর জীবন ও সাধনা সম্বন্ধে বিশেষভাবে লিখিতে ইচ্ছা রহিল।"
( কল্যাণী কাজী, ১৪০৫: পৃ. ৬৬)
মহাযোগী শ্রীবরদাচরণ মজুমদার যদি আদেশ করেন, তবে তাঁকে নিয়ে নজরুল ইসলাম সুবিস্তারে লিখবেন বলে আকাঙ্খা করেছিলেন। তাঁর জীবন ও সাধনা সম্বন্ধেও বিশেষভাবে লিখবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এমন সৃষ্টিশীল কবি আর লিখতে পারেননি তাঁর প্রলয় সুন্দররূপ গুরুকে নিয়ে। এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪২ সালে কবি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। যেন সৃষ্টির পদ্মবনের সুরের হতভাগ্য ভ্রমর এতকাল গান শুনিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গুঞ্জন ভুলে গেলো। নিরব নিস্তব্ধ হয়ে গেলো ফুলের জলসায় চিরতরে।
"ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি
ভোরের হাওয়ায় কান্না পাওয়ায় তব ম্লান ছবি
নীরব কেন কবি।।
যে বীণা তোমার কোলের কাছে
বুক ভরা সুর লয়ে জাগিয়া আছে
তোমার পরশে ছড়াক হরষে
আকাশে বাতাসে তার সুরের সুরভি
নীরব কেন কবি।।"
শ্রীবরদাচরণ মজুমদারের ক্রিয়াযোগ এবং তন্ত্রের সম্মিলিত মতাদর্শে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, নলিনীকান্ত সরকারসহ অনেকে বিপ্লবীই দীক্ষা গ্রহণ করেন। শক্তিসাধনা বিশেষ করে কালী সাধনায় রত হন।
তথ্য সহায়তা:
১. কল্যাণী কাজী সম্পাদিত, 'শতকথায় নজরুল', সাহিত্যম্, কলকাতা: প্রথম প্রকাশ ১৪০৫
২.প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়,'কাজী নজরুল ইসলাম', কলকাতা: ১৯৭৩
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : কবি নজরুল এবং গুরু বরদাচরণ।
ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook