-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

"মহাজনাে যেন গতঃ সঃ পন্থাঃ"; মহাজনদের পথই, আমাদের পথ।

জগতের মানুষ সাধারণত দুইপ্রকারের। প্রথমত পনেরো আনা মানুষ এবং এর বিপরীতে অবশিষ্ট এক আনা মানুষ। এই দুইপ্রকারের মানুষ নিয়েই জগতের ষোলআনা মানুষ। এক আনা মানুষেরা সকল কিছুই সৃষ্টি করে, আবিষ্কার করে, সংস্কার করে এবং নতুনত্বের স্বপ্ন দেখে এবং অন্যকে স্বপ্ন দেখায়। বিপরীতে পনেরো আনা মানুষ বা বৃত্তেবদ্ধ সাধারণ খেয়েপড়ে বেঁচে থাকা মানুষ, গড্ডালিকা প্রবাহে বুঝে হোক বা না বুঝে এক আনা সৃষ্টিশীল মানুষকে অনুসরণ করে। মানুষের স্বভাব শ্রেষ্ঠ মহাজনদের অনুসরণ। জগতের প্রত্যেকটি মানুষই ভ্রম, প্রমাদ, করণাপাটব এবং বিপ্রলিপ্সা এ চার প্রকারের ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা দ্বারা আচ্ছন্ন। এর থেকে কেউ মুক্ত নয়। তবে শ্রেষ্ঠ বরণ্যে ব্যক্তিদের মধ্যে এ ত্রুটির আধিক্য কম। তারা সর্বদা যুক্তি এবং বিচারের আলোকেই সকল তত্ত্ব গ্রহণ করে অগ্রহণযোগ্য যুক্তিহীনতাকে বর্জন করেন। তাই চোখের সামনে দৃষ্টান্ত স্বরূপ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সর্বদা অনুসরণ করতে হয়। শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর এবং শ্রেষ্ঠতমদের বরেণ্যদের বাক্য অনুসরণ করার বিষয়টি বৈদিক সমাবর্তন ভাষণে বলা হয়েছে। তেমনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদগীতার মধ্যেও বলেছেন, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং তাঁদের আচরণকেই সর্বদা অনুসরণ করতে। এ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের বাক্যকে শাস্ত্রে 'আর্ষবাক্য' নামে অবিহিত করা হয়েছে।
যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ৷
স যৎপ্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৩.২১)
"শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যে ভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষেরাও তার অনুকরণ করেন। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন অন্য ব্যক্তিরা তারই অনুসরণ করে চলে।"
মহাভারতের বনপর্বে বিখ্যাত যক্ষ-যুধিষ্ঠির কথোপকথনে মহাজ্ঞানী মহাজনদের পথে চলতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।পরমেশ্বরের বাণী বেদে বিভিন্ন তত্ত্ব বলা হয়েছে, যা অধিকারী না হলে সকলেই বুঝতে পারে না। বেদের সাথে সাথে অত্রি, মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, পরাশর, বেদব্যাস সহ বিভিন্ন মুনিদের লিখিত জীবন যাপনের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনামূলক স্মৃতিগ্রন্থ রয়েছে। ঋষিমুনিদের প্রণীত গ্রন্থে মানব জীবনকে সুন্দর করে পরিচালিত করতে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় নির্দেশনা দেয়া আছে। বেদকে অনুসরণ করে তাঁদের সকলের দার্শনিক মতামতই মৌলিক। তবে এ বেদানুগত স্বতন্ত্র নির্দেশনা আপাদৃষ্টিতে পরস্পর বিরোধী বলে বোধ হলেও, সকল ঋষিমুনি মহাজনদের মতাদর্শের মধ্যে একটি সাধারণ ঐক্যবদ্ধতা আছে। এ ঐক্যবদ্ধতা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারে না। ধর্মের নিগূঢ়তম তত্ত্ব সকলেই বুঝতে পারে না। যেহেতু বুঝতে পারে না, তাই ধারণও করতে পারে না। এরজন্যে চোখের সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে যারা আছেন, সেই মহৎপ্রাণ মহাজন ব্যক্তিদের সর্বদা অনুসরণ করা কর্তব্য।সেই মহাজনেরা যে পথে গিয়েছেন, তাই সকল পথই অত্যন্ত মঙ্গলের পথ।
বেদা বিভিন্নাঃ স্মৃতয়ো বিভিন্না
নাসৌ মুনির্যস্য মতং ন ভিন্নম্।
ধর্ম্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং
মহাজনাে যেন গতঃ সঃ পন্থাঃ।
(মহাভারত: বনপর্ব, ২৬৭.৮৪ )
"বেদ বিভিন্ন, স্মৃতি বিভিন্ন। এমন কোন মুনি নেই, যাঁর মতের ভিন্নতা নেই বা স্বতন্ত্রতা নেই। ধর্মের তত্ত্ব নিগূঢ়তম অজ্ঞেয়স্থানে রক্ষিত; সুতরাং মহাজন ব্যক্তিরা যে পথে গিয়েছেন, তাই একমাত্র পথ।"
মহাভারতের বনপর্বের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে, গরুড় পুরাণের পূর্বখণ্ডের 'নীতিসার' প্রসঙ্গে।
তর্কোঽপ্রতিষ্ঠঃ শ্রুতয়ো বিভিন্নাঃ
নাসাবৃষির্যস্য মতং ন ভিন্নম্।
ধর্ম্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং
মহাজনাে যেন গতঃ স পন্থাঃ।
(গরুড়পুরাণ: পূর্বখণ্ড,১০৯.৫১)
"ধর্ম নির্ণয়ে অনন্তকাল ধরে তর্ক চলছে এবং শ্রুতিতে এ সকল মতপথেরই সমর্থন রয়েছে। তিনি ঋষিই নন, যার মতের স্বতন্ত্রতা নেই।ধর্মের তত্ত্ব নিগূঢ়তম অজ্ঞেয়স্থানে রক্ষিত; সুতরাং মহাজন ব্যক্তিরা যে পথে গিয়েছেন, তাই একমাত্র পথ।"
বিভিন্ন মুনি-ঋষিদের তপস্যার গভীরে অথবা ভগবান যখন অবতাররূপে আসেন তখন তিনি জগতের কল্যাণে জীবের প্রয়োজন অনুসারে কিছুটা জানিয়ে দেন। ধর্ম স্বয়ং সাক্ষাৎ ভগবান কর্তৃক প্রবর্তিত। ধর্মের প্রকৃততত্ত্ব একমাত্র তিনিই জানেন। সৃষ্টিকর্তা ভগবান ছাড়া ধর্মের স্বরূপ ঋষি, দেবতা বা সিদ্ধগণ কেউ সম্যকরূপে জানতে পারে না। অতএব মানুষ, বিদ্যাধর, চারণ বা অসুরদের তো জানার প্রশ্নই উঠে না। লবনের পুতুল যেমন সমুদ্রের গভীরতা মাপতে গিয়ে নিজেই সমুদ্রে মিশে একাকার হয়ে সমুদ্র হয়ে যায়; তেমনি শুদ্ধ ও গুহ্য শাশ্বত ধর্মের জ্ঞান হলে সাধক ব্রহ্মের সাথে একাকার হয়ে হয়ে যায়। ব্রহ্মের উপলব্ধির বোধ ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। শুধুই অনুভব করতে হয়। কোন বাকশক্তি রহিত বোবাকে যদি কোন সুস্বাদু রসগোল্লা খাইয়ে, সেই রসগোল্লার স্বাদ জিজ্ঞাসা করা হয় সে কখনই সেই স্বাদের কথা বর্ণনা করতে পারবে না। আকার ইঙ্গিতে কিছুটা বলার চেষ্টা করা হলেও, সম্পূর্ণ রসগোল্লার স্বাদটি কখনই বলা সম্ভব নয়। তাই নিগূঢ়তম ধর্ম অত্যন্ত গোপনীয়, সেই ধর্মরহস্য যারা কিছুটা জানেন তাঁরা ভগবৎসারূপ্য লাভ করেন। এ গোপনীয় ধর্মরহস্য যাঁরা জানেন তাদের শাস্ত্রে দ্বাদশ মহাজন বলে। এ ধর্মরহস্য জ্ঞাত হওয়া দ্বাদশ মহাজন হলেন: ব্রহ্মা, দেবর্ষি নারদ, শম্ভু, সনৎকুমার, কপিলদেব, স্বায়ম্ভুব মনু, প্রহ্লাদ, জনক, ভীষ্মপিতামহ, বলিরাজ, শুকদেব এবং ধর্মরাজ যম।
ধর্মং তু সাক্ষাদ্ভগবৎ প্রণীতং
ন বৈ বিদুঃ ঋষয়ো নাপি দেবাঃ।
ন সিদ্ধমুখ্যা অসুরা মনুষ্যাঃ
কুতশ্চ বিদ্যাধরচারণাদয়ঃ।।
স্বয়ম্ভুর্নারদঃ শম্ভূঃ কুমারঃ কপিলাে মনুঃ।
প্রহ্লাদো জনকো ভীষ্মাে বলির্বৈয়াসকির্বয়ম্।।
দ্বাদশৈতে বিজানীমাে ধর্মং ভাগবতং ভটাঃ।
গুহ্যং বিশুদ্ধং দুর্বোধং যং জ্ঞাত্বামৃতমশ্নুতে।।
(শ্রীমদ্ভাগবত:০৬.০৩.১৯-২১)
"ধর্ম স্বয়ং সাক্ষাৎ ভগবান কর্তৃক প্রবর্তিত। তাই ভগবান ছাড়া ধর্মের স্বরূপ ঋষি, দেবতা বা সিদ্ধগণ কেউ সম্যকরূপে জানেন না। অতএব মানুষ, বিদ্যাধর, চারণ বা অসুরদের তো জানার প্রশ্নই উঠে না।
ভগবানের দ্বারা রচিত ভাগবতধর্ম পরম শুদ্ধ ও গুহ্য, তা জানা অতীব কঠিন , যে সেই ধর্ম জানতে পারে সে ভগবৎসারূপ্য লাভ করে। হে দূতগণ! ভাগবত- ধর্মরহস্য ব্রহ্মা, দেবর্ষি নারদ, শম্ভু, সনৎকুমার, কপিলদেব, স্বায়ম্ভুব মনু, প্রহ্লাদ, জনক, ভীষ্মপিতামহ, বলিরাজ, শুকদেব এবং আমি (ধর্মরাজ যম) এ বারােজনই মাত্র জানি।"
ভগবানের বিভূতি স্বরূপ দ্বাদশ মহাজন এবং পরবর্তীতে তাঁদের ভাবদর্শনের অনুগত শ্রেষ্ঠ আচার্যবৃন্দরা যুগে যুগে নিজেরা আচরণ করে ধর্মের শিক্ষা প্রদান করেছেন। তাই আমাদের শাস্ত্রে উক্ত দ্বাদশ মহাজন এবং পরবর্তীকালের শ্রীশঙ্করাচার্য সহ আচার্যবৃন্দ যাঁরা মহাজন পদবাচ্য। এই আচার্যদের সকলের অনুসরণ করা উচিত। ভারতবর্ষে পূর্বে যতগুলি মত-পথ এবং দার্শনিক সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে তার প্রত্যেকটি বেদান্তদর্শনের ভাষ্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। প্রত্যেক আচার্য তাঁদের মতকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, বেদান্তসূত্রের উপরে তাঁদের এক একটি স্বতন্ত্র ভাষ্য রচনা করে। আচার্যদের মধ্যে দার্শনিক চিন্তার সামান্যতম মতভিন্নতা থাকলেও, এদের সকলের দার্শনিক মতের মধ্যে বেশ কিছু সাধারণ ঐক্য ছিলো। এ ঐক্যের ভিত্তি সনাতন পরম্পরায় লব্ধ সাধারণ বিশ্বাস। এ সাধারণ ঐক্যের বিষয়গুলো মহাজন এবং আচার্যবৃন্দ সকলই নিজের মত করে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মহাজনবৃন্দের স্বীকৃতির ফলে, জন্মান্তরবাদ, কর্মফল, সাকার উপাসনা, অবতারবাদ, স্বর্গ-নরকের অস্তিত্ব, মন্দিরে দেবতা উপাসনা ইত্যাদি সাধারণ ঐক্যের বিষয়গুলো আজ সনাতন ধর্ম বিশ্বাসের মূলধারায় পরিণত হয়েছে।এ স্বীকৃত সাধারণ ঐক্যগুলো হলো:
১.বেদ পরমেশ্বর কর্তৃক প্রকাশিত মানব জাতির পূর্ণাঙ্গ সংবিধান। অপৌরুষেয় সত্যবিদ্যাময় এ গ্রন্থই সনাতন ধর্মের একমাত্র ভিত্তিস্বরূপ। সকল মহাজনেরা পরমেশ্বরের বাণী বেদকে প্রমাণ বলে গ্রহণ করে, বেদের সহায়ক হিসেবে তাঁরা পুরাণ এবং স্মৃতিশাস্ত্রকেও স্বীকৃতি দিয়েছেন।
২. পরমেশ্বরের সাকার এবং নিরাকার এ উভয় রূপেরই উপাসনাকে মহাজনেরা স্বীকৃতি দিয়েছেন।
৩.বৈদিক জ্ঞানের সারাংশ ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’ এবং ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ এ দুটি সপ্তশতী গ্রন্থে রয়েছে। আচার্য এবং মহাজনেরা এ দুটি গ্রন্থের স্বীকৃতি দিয়েছেন।
৪.সনাতন ধর্মে অনাদি অনন্ত ব্রহ্মের উপাসনা পঞ্চমতে ও পথে বিভজিত যথা- শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য এবং বৈষ্ণব। মহাজন এবং আচার্যবৃন্দ সকলেই সাকার পদ্ধতিতে ঈশ্বর উপাসনায় পঞ্চমতের স্বীকৃতি দিয়েছেন।
৫.জীবের চিন্তার অতীত এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মেরই ভিন্ন ভিন্ন গুণ ও শক্তির প্রতীকী প্রকাশ হলেন দেবতাগণ। এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বরই অনন্ত দেব-দেবতা রূপে বিরাজমান-এ পরমতত্ত্বটি বিশ্বাস করে মহাজন এবং আচার্যবৃন্দ সকলেই দেবতার উপাসনা করেছে। তাই সাধক ভেদে সকল দেবতার উপাসনায় শ্রদ্ধাশীল থাকা প্রয়োজন।
৬.মহাজন এবং আচার্যবৃন্দ মন্দির তৈরি করে মূর্তি পূজাকে স্বীকার করেছেন।
৭.মহাজন এবং আচার্যবৃন্দের অধিকাংশই বৈদিক ওঙ্কারের সাথে বিভিন্ন দেবতার স্বতন্ত্র বীজমন্ত্রে অথবা মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন।
৮.মহাজন এবং আচার্যবৃন্দদের সকলের মাঝেই প্রচণ্ড রকমের আধ্যাত্মিকতার উপস্থিতি ছিল।তাঁরা সকলেই প্রতিমা পূজাতে বিশ্বাসী ছিলেন।
৯. মহাজন এবং আচার্যবৃন্দ সবাই মন্ত্র সংহিতার সাথে সাথে ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদকেও শ্রুতি বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
১০. মহাজন এবং আচার্যবৃন্দদের সকলেই ভগবানের অবতারবাদকে স্বীকার করেছেন। আমাদের সকল মহাপুরুষ পরমেশ্বরের সাকাররূপে দর্শন লাভ করেছেন।
১১. জন্মান্তরবাদ এবং কর্মফলকে সকল মহাজন এবং আচার্যবৃন্দ স্বীকার করেছেন।
১২.মনুষ্যের মৃত্যু পরবর্তী মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত সাময়িক সুখ এবং দুঃখ ভোগের স্থান হিসেবে স্বর্গ ও নরকে স্বীকার করেছেন। মহাজন এবং আচার্যবৃন্দ তাঁদের জীবনে পারলৌকিক কৃত্যাদি বা শ্রাদ্ধানুষ্ঠান পালন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
১৩. তীর্থক্ষেত্রের মাহাত্ম্য এবং তীর্থক্ষেত্রে স্নানের মাহাত্ম্য স্বীকার করেছেন।
১৪. মহাজন এবং আচার্যবৃন্দ সকলেই সমাজে প্রচলিত বিবিধ সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণের প্রয়াস করেছেন।
মুক্ত পুরুষেরা নিজেরা ভবসমুদ্র পাড়ি দিয়ে মুক্ত হয়ে ঈশ্বরের পথে চলার সকল পদ্ধতি শিষ্য পরম্পরায় নির্দেশনা দিয়ে যান এ তত্ত্বটি শ্রীদ্ভাগবতেও বলা হয়েছে। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই ঈশ্বরকে পাওয়ার তাঁদের অনুসৃত সাধন পদ্ধতি তাঁরা বর্ণনা করে যান। যেন সাধারণ মানুষ মুক্তপুরুষের সে পথে চলে সহজেই ঈশ্বরকে পেতে পারেন। এ পরম্পরায়গত জ্ঞানের পথে সহজেই মুক্তিলাভ করা যায়।
স্বয়ং সমুত্তীর্য সদুস্তরং দ্যুমন্
ভবার্ণবং ভীমমদভ্রসৌহৃদাঃ।
ভবৎ পদাম্ভোরুহনাবমত্র তে
নিধায় যাতাঃ সদনুগ্রহো ভবান্।।
(শ্রীমদ্ভাগবত:১০.২.৩১)
"হে স্বপ্রকাশ! আপনার ভক্তবৃন্দ তাে নিখিল জগতের অকপট পরম বান্ধব, যথার্থ হিতৈষী ; এইজন্যই তাঁরা স্বয়ং এই ভয়ংকর দুস্তর সংসার নামক সমুদ্র পাড়ি দিলেও অন্যদের কথা বিস্মৃত হয়ে যান না। তাঁরা নিজেরা সংসার সমুদ্র অতিক্রম করে অন্যদের কল্যাণের জন্য আপনার অনুগ্রহে আপনার শ্রীপাদপদ্মরূপ তরী জগতে স্থাপিত করে যান। "
সনাতন ধর্মের এমন আরও কিছু সাধারণ বিষয় রয়েছে, যা সকল অবতার পুরুষ, ঋষিমুনি, আচার্যগণ দ্বারা স্বীকৃত। এক পরমেশ্বরকেই আমরা নিরাকার, শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য এবং বৈষ্ণব এ বিভিন্ন মতে এবং কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি, যোগ, তন্ত্র এ বিভিন্ন পথে উপাসনা করি। রুচির ভিন্নতার কারণেই এ উপাস্য ইষ্টে বৈচিত্র্য, তবে সকল বৈচিত্র্যময়তার মধ্যেই এক নিবিড় ঐক্য রয়েছে। এ সাধারণ ঐক্যের বিষয়গুলো যারা করেননি, তাদের মতবাদ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ঋষি,মুনি এবং আচার্য মহাজনদের আদর্শ ধরে তাঁদের পথেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। মমনুসংহিতায় বলা হয়েছে:
যেনাস্য পিতরো যাতা যেন যাতাঃপিতামহাঃ।
তেন যায়াৎ সতাং মার্গং তেন গচ্ছন্ন রিষ্যতে॥
(মনুসংহিতা:৪.১৭৮)
"যে পথে পিতা পিতামহগণ গিয়েছেন, সেই সৎপথেই গমন করবে। সেই পথে অগ্রসর হলে কেউ অধর্মের দ্বারা দূষিত হবে না।"
শ্রীচৈতন্যদেব মহাজনদের পথকে সত্য মেনে, সেই পথে সবাইকে চলতে নির্দেশনা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সন্ন্যাসী শ্রীপ্রকাশানন্দ সরস্বতীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন:
"পরম-কারণ ঈশ্বরে কেহ নাহি মানে।
স্ব-স্ব মত স্থাপে পরমতের খণ্ডনে।।
তা’তে ছয় দৰ্শন হৈতে তত্ত্ব নাহি জানি।
মহাজন যেই কহে, সেই সত্য মানি।।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যবাণী অমৃতের ধার।
তিঁহো যে কহয়ে বস্তু, সেই তত্ত্ব-সার।।”
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত: মধ্য.২৫.৪৯-৫৭)
মহাজনদের পথই একমাত্র পথ। বিষয়টি স্বামী বিবেকানন্দ উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্ত্তীকে ঠিক এমনিই এক নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বলেন মহর্ষি মনু, মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি ঋষিদের বিধানে আজও আমাদের চলতে হবে। তবে যুগের প্রয়োজনে সে বিধান কিছুটা সময়োপযোগী পরিবর্তন করে নিতে হবে।
" শিষ্য। তবে মহাশয়, এখন আমাদের কি করিতে হইবে?
স্বামীজী। ঋষিগণের মত চালাতে হবে; মনু, যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি ঋষিদের মন্ত্রে দেশটাকে দীক্ষিত করতে হবে। তবে সময়োপযোগী কিছু কিছু পরিবর্তন করে দিতে হবে।"
(স্বামী বিবেকানন্দ বানী ও রচনা, 'স্বামী-শিষ্য- সংবাদ', নবম খণ্ড, কলকাতা: ২০১৫, পৃ.৯৭)
ভারতবর্ষে ইতিহাসের কালখণ্ডে সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে যে সকল ব্যক্তিরা তাদের নিজস্ব পরম্পরাহীন মতবাদ তৈরি করে মন্দির, মূর্তিপূজা ঈশ্বরের অবতার গ্রহণ ইত্যাদির বিরোধিতা করেছেন তারা সকলেই আজ ইতিহাসের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছেন। তাদের সম্প্রদায় হারিয়ে গেছে, কারো কারো হয়ত প্রতিষ্ঠান টিকে আছে, দার্শনিক তত্ত্ব টিকে আছে গবেষণার প্রয়োজনে। কিন্তু তাঁদের কারোই বর্তমানে চোখে পড়ার মত অনুসারী নেই। আবার অনেকে মূর্তিপূজার বিরোধিতাকারী প্রবর্তক ব্যক্তির মতবাদ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে, মূলধারার সনাতন বিশ্বাসের কাছাকাছি চলে এসেছেন। কারণ তারাও উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে মূর্তিপূজা বিরোধী, দেবতা উপাসনা বিরোধী, অবতার বিরোধী মতবাদ সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে সম্পূর্ণভাবে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ যে সকল মতবাদই সনাতন সম্প্রদায়ের মূলধারা থেকে একটু দূরে চলে গেছে সে সকল মতবাদই হারিয়ে গেছে বা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আবার হারিয়ে যদি নাও যায়, তবে প্রবর্তক ব্যক্তির মতবাদকে আমূল সংস্কার করে মতবাদটি নামেমাত্র বর্তমান রয়েছে। তাই সনাতন ধর্ম অনুসরণে মূলধারা বা মহাজনদের পথ অনুসরণ করার কোন বিকল্প নেই। শ্রীশঙ্করাচার্য, শ্রীরামানুজাচার্য, শ্রীচৈতন্য সহ আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় আচার্যদের অধিকাংশরই জীবনের দিকে তাকালে দেখলে পাওয়া যায় তাঁদের জন্ম কর্ম সকলই হয়েছে দৈবপ্রেরণায়। তাঁরা সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তাঁরা জীবনে ঈশ্বরের দৈবীদর্শন পেয়েছে। মানব সভ্যতায় বেদান্তের দান অপরিসীম। ভারতীয় দর্শনের এবং জাতীয় জীবনের মূলাধার বেদান্ত। বেদান্তের মূল তত্ত্বগুলি যেমন শ্রীশঙ্কর, শ্রীরামানুজ, শ্রীনিম্বার্ক, শ্রীবলদেবাদি আচার্যবৃন্দদের পথ। যাঁরা শাস্ত্রীয় দ্বাদশ মহাজন পরবর্তী মহাজন পদবাচ্য। এ মহাজনদের একান্তভাবে অনুসরণ করা কর্তব্য।তাঁদের সকলের দার্শনিক চিন্তার মধ্যে একটি সাধারণ যোগসূত্র রয়েছে। এ সাধারণ যোগসূত্রগুলোই আমাদের সনাতন মূলধারা।সেই মূলধারার রাজপথেই ঐক্য, সে পথেই মুক্তি এবং সে পথেই কল্যাণ। যারা সনাতন পরম্পরাগত মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী তৈরি করেছে, তারা কেউ দীর্ঘমেয়াদে সাফল্য পায়নি। গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর বর্ধমান এবং গুরু নানক আলাদা দার্শনিক মতবাদ তৈরি করলেও তারা সনাতন মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়নি। এ তিনজনের সকলেরই দার্শনিক কাঠামো সনাতন দর্শনের কাছাকাছি। একথায় বলতে হলে, শুধুই উনিশবিশ পার্থক্য মাত্র। এককথায় বলা যায়, যারা অসংখ্য মহাজনদের দেখানো সনাতন মূলধারায় আছেন, তারাই স্বমহিমায় প্রবাহমান হয়ে অস্তিত্বশীল। মূলধারার সাথে সাংঘর্ষিক অন্যান্য মতবাদ হারিয়ে গিয়েছে।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭ এপ্রিল, ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ- ১৪ মে, ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ) -এর 'জীবন সঙ্গীত' নামে একটি অনন্য কবিতা রয়েছে। সেই কবিতায় কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, আমাদের সর্বতোভাবে পূর্বতন প্রাতঃস্মরণীয় মহাজনের পথেই চলতে হবে। তাদের সেই বরণীয় পথের কীর্তিধ্বজাকে অনুসরণ করতে পারলে আমরাও জগতে বরণীয় হতে পারব এবং অমর হতে পারব।
" মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন,
হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়,
সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে
আমরাও হব বরণীয়
সমর- সাগর-তীরে, পদাঙ্ক অঙ্কিত করে,
আমরাও হব হে অমর;
সেই চিহ্ন লক্ষ্য করে, অন্য কোনো জন পরে
যশোধারে আসিবে সত্বর।
করো না মানবগণ, বৃথা ক্ষয় এ জীবন
সংসার-সমরাঙ্গন মাঝে;
সঙ্কল্প করেছ যাহা, সাধন করহ তাহা,
রত হয়ে নিজ নিজ কাজে।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁