-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

বেদজ্ঞান দান করে, সকলের প্রিয় হও।


বেদজ্ঞান দান করে,   সকলের প্রিয় হও বেদ পরমেশ্বরের বাণী, বেদের উপরেই সনাতন ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। তাই বেদবিরুদ্ধ সকল ব্যক্তিসর্বস্ব মতবাদকে পরিত্যগ করে সকলের বৈদিক রাজমার্গে আসা প্রয়োজন। বেদের জ্ঞান কোন ব্যক্তিগোষ্ঠী বিশেষের মধ্যে আবদ্ধ নয়। বেদের জ্ঞান সর্বজনীন এবং জগতের সকল মানবমাত্রেরই সংসারে চলার পাথেয়। প্রচারের মাধ্যমে বেদের জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র, মিত্র ও শত্রু, আপন - পর; জগতের কোন মানবই যেন বেদজ্ঞান থেকে বঞ্চিত না হয়।  যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ। ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্যায় চ স্বায় চারণায় চ। প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ভূয়াসময়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামূপ মাদো নমতু।। (শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা:২৬.২) "আমি যেমন এই কল্যাণকারিণী বেদবাণী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,শূদ্র, বৈশ্য নির্বিশেষে সবাইকে বেদের জ্ঞান দান করেছি, তেমনি তোমরাও তোমাদের প্রিয়জন থেকে শত্রু সবাইকেই বেদের জ্ঞান প্রদান করে দেবতা সহ সকলের প্রিয় হও এবং পরিশেষে আমাকে প্রাপ্ত হও।" শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার মন্ত্রটিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,শূদ্র, বৈশ্য বর্তমান প্রচলিত চতুর্বণের উল্লেখ দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে বেদে বর্ণবাদ স্বীকৃত বলে মনে করেন। বিষয়টি ঠিক তেমন নয়।যারা মস্তিষ্ক বা বুদ্ধি বল দ্বারা সমাজ সেবা করেন সমাজে তাদেরই ব্রাহ্মণ বলে। যারা বাহুবল দ্বারা দেশ-জাতি এবং সমাজকে রক্ষা করেন তারাই ক্ষত্রিয়। কৃষি গোরক্ষা, ব্যবসা, বানিজ্য দ্বারা সমাজের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে পুষ্টিসাধন করেন তারাই বৈশ্য। যারা সেবার মাধ্যমে সমাজের ভিত্তি বা আশ্রয় সুদৃঢ় করে তারাই শূদ্র। বিষয়টি হল সমাজের শুধুই শ্রমবিভাজন। একজন জ্ঞানের পথে, আরেকজন বীরত্বের পথে, অপরজন ব্যবসা বাণিজ্য সহ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এবং আরেকজন সেবা-পরিশ্রমে পথে।একেকজনের কর্মক্ষমতা ও আধ্যাত্মিকতা একেক রকম আর সে অনুসারে কেউ ব্রাহ্মণ,কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ বৈশ্য কেউ শূদ্র। জগতের প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই এ চতুর্বণের ভাব দেখা যায়। আবার গুণকর্ম অনুসারে যার মধ্যে যে ভাবটি প্রবল, তাকে সেই বর্ণের বলে অবিহিত করা হয়। তবে তবে একথা সত্য যে জগতে কে ব্রাহ্মণ, কে ক্ষত্রিয়, কে বৈশ্য এবং কে শূদ্র বিষয়টি নির্ধারণ করার মত অসম্ভব কিছুই আর নেই। একমাত্র ভগবানই জানেন বিষয়টি। জন্ম নয়,  কর্মগুণেই যে মানুষের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রত্ব নির্ধারিত হয়, তা শ্রীমদ্ভগবদগীতার চতুর্থ অধ্যায়ে অত্যন্ত  সুস্পষ্টভাবে আছে। বিষয়টি নিয়ে মহাভারতের বনপর্বে ধর্মব্যাধ এবং কৌশিক প্রসঙ্গে একটি সম্পূর্ণ গীতাগ্রন্থই আছে, সে গীতাগ্রন্থের নাম 'ব্যাধগীতা'। একদা কৌশিক নামে এক ব্রাহ্মণ শাস্ত্রপাঠ ও তপস্যা বলে অলৌকিক শক্তি অর্জন করে।একদিন তিনি একটি গাছের তলে বসে একাগ্রভাবে তপস্যা করছিলেন। কিন্তু  হঠাৎ গাছের ডালে বসা একটি বকপাখি তপস্যারত কৌশিকের গায়ের উপরে মলত্যাগ করে দেয়। বকের এহেন কাণ্ডে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে যান কৌশিক।  রেগে গিয়ে রক্তিম চোখে উপরের দিকে তাকালেন। তৎক্ষনাৎ বকপাখিটি মরে পরে গেল।তাকালেই পাখি ধূলিসাৎ হয়ে যায়, নিজের এই দৈবশক্তিতে কৌশিকের মনে এক তীব্র অহংকারের উদয় হল। তপস্যা থেকে উঠে কৌশিক ভিক্ষা করতে পার্শ্ববর্তী  একটি নগরে গেলেন। তিনি একটি গৃহে প্রবেশ করে গৃহস্বামীর কাছে ভিক্ষা চাইলেন। তৎক্ষনাৎ গৃহের ভেতর থেকে একজন স্ত্রীকণ্ঠে অপেক্ষা করতে বললেন। কিছুটা সময় অতিবাহিত করে গৃহের স্ত্রী কৌশিকের সম্মুখে উপস্থিত হলেন।কিন্তু  কৌশিকের খুব রাগ হল, তাঁকে অকারণ দাড়িয়ে রেখে অবহেলা করায়। তিনি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে স্ত্রীটির দিকে থাকালেন। তখন স্ত্রীলোকটি হাসতে হাসতে  বললেন, "আমি কিন্তু সেই বক পাখিটি নই, যে ধূলিসাৎ হয়ে যাব"। পতিব্রতা স্ত্রীলোকটির কথা শুনে কৌশিক বিস্মিত হলেন।তিনি উপলব্ধি করলেন, সম্মুখস্থ স্ত্রীলোকটি কোন সাধারণ নারী নয়; নিশ্চয়ই তাঁর কোন বিশেষ অলৌকিক শক্তি রয়েছে। তা না হলে, বকপাখির ঘটনাটি তিনি জানতেন না।স্ত্রীলোকটি ছিলেন খুবই ধার্মিক।তিনি সুন্দর ভাবে তার কর্তব্যকর্ম করতেন।তাঁর সঙ্গে কৌশিকের ধর্ম এবং কর্তব্য নিয়ে কথা হল। স্ত্রীলোকটি পতিসেবার জন্য ভিক্ষাদানে বিলম্ব হয়েছে, বিষয়টি কৌশিককে বুঝিয়ে বললেন।বিস্ময়াবিষ্ট কৌশিক বুঝতে পারলেন। পতিব্রতা স্ত্রীটি তখন কৌশিককে মিথিলা নগরীতে গিয়ে ধর্মব্যাধের শরণাপন্ন হতে বললেন। ধর্মব্যাধই তাঁকে ধর্মোপদেশের সম্যক জ্ঞান দান করবেন। কৌশিক মিথিলায় গিয়ে ধর্মব্যাধকে খুঁজে পেলেন। দেখলেন ধর্মব্যাধ বিভিন্ন পশু হত্যা করে তাদের মাংস বিক্রি করছেন।ধর্মব্যাধও ব্রাহ্মণ কৌশিককে দেখতে পেয়ে তাঁর কাছে এগিয়ে এসে বললেন, "সেই ধার্মিক নারী আপনাকে আমার কাছে  পাঠিয়েছেন। আপনার আগমনের কারণ আমি জানি"। মিথিলার ধর্মব্যাধের কথা শুনে কৌশিক পুনরায় অবাক হলেন। একজন নৃশংস মাংস বিক্রেতা কি করে সকল অজানা বিষয় জানেন।মনের কথা বলতে পারেন। ধর্মব্যাধ কৌশিকের অবস্থা বুঝতে পেরে তাঁকে ধর্মাধর্ম;  মানুষের জন্ম নয় কর্মের মহত্ব সহ সকল বিষয়ে সবিস্তারে বললেন। তিনি বললেন, মাংস বিক্রয় আমাদের বংশের ধর্ম এবং পুর্বপুরুষের পেশা।প্রত্যেকেরই বংশগত ধর্ম এবং প্রথা আছে।সেই পরম্পরাগত ধর্ম পালনে কোন পাপ স্পর্শ করে না। ধর্মব্যাধ তাঁর অলৌকিক আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের কারণ হিসেবে তাঁর পিতা-মাতাকে যথাসম্ভব অকৃত্রিম সেবার কথা বললেন।পিতা-মাতাই তাঁর সাক্ষাৎ দেবতা।তিনি আগে বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা করেন; এরপরে সকল কর্ম করেন। এভাবে পর্যায়ক্রমে ধর্মব্যাধ একজন মাংসবিক্রেতা হয়েও ব্রাহ্মণ কৌশিককে ধর্মাধর্মের সকল আধ্যাত্মিক জ্ঞান দান করেন। জ্ঞানার্জনে সকলরই যে সমান অধিকার; জন্ম নয় কর্মেই যে মানুষ মহান হয় এবং প্রত্যেকের থেকেই যে জ্ঞান লাভ করা যায় -বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দরভাবে মহাভারতের বনপর্বের অন্তর্ভুক্ত 'ব্যাধগীতা' গ্রন্থে বলা হয়েছে।  হিন্দুসম্প্রদায় তাদের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থাদি ভাল করে চর্চা করে না এবং অধিকাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় চর্চা ব্যক্তিগত আত্ম-উদবোধনের ; গোষ্ঠীবদ্ধ নয়।বেদের কোন স্থানেই জাতপাতে বিভক্ত করে কাউকেই বৈদিক জ্ঞান থেকে বিচ্যুত করা হয়নি।কিন্তু দুঃখজনকভাবে সমাজে এ অবৈদিক অসাম্যের কথাগুলো বিক্ষিপ্তভাবে কিছুকিছু স্থানে আছে। কয়েকটি পুরাণগ্রন্থে আছে এবং গুটিকয়েক ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্মৃতিশাস্ত্রে আছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সনাতন ধর্মে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতিগ্রন্থ বৈদিক জ্ঞানলাভের সহায়ক মাত্র। তাই বৈদিক সর্বজনীন সাম্যবাদী ঐক্যের চিন্তার বিপরীতে বেদবিরুদ্ধ সাংঘর্ষিক, যেসকল কথা পুরাণে এবং স্মৃতিতে থাকবে ; তা সকলই নির্দয়ভাবে পরিত্যাজ্য।  কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী  সহকারী অধ্যাপক,  সংস্কৃত বিভাগ,  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বেদ পরমেশ্বরের বাণী, বেদের উপরেই সনাতন ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। তাই বেদবিরুদ্ধ সকল ব্যক্তিসর্বস্ব মতবাদকে পরিত্যগ করে সকলের বৈদিক রাজমার্গে আসা প্রয়োজন। বেদের জ্ঞান কোন ব্যক্তিগোষ্ঠী বিশেষের মধ্যে আবদ্ধ নয়। বেদের জ্ঞান সর্বজনীন এবং জগতের সকল মানবমাত্রেরই সংসারে চলার পাথেয়। প্রচারের মাধ্যমে বেদের জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র, মিত্র ও শত্রু, আপন - পর; জগতের কোন মানবই যেন বেদজ্ঞান থেকে বঞ্চিত না হয়।
যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ।
ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্যায় চ স্বায় চারণায় চ।
প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ
ভূয়াসময়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামূপ মাদো নমতু।।
(শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা:২৬.২)
"আমি যেমন এই কল্যাণকারিণী বেদবাণী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,শূদ্র, বৈশ্য নির্বিশেষে সবাইকে বেদের জ্ঞান দান করেছি, তেমনি তোমরাও তোমাদের প্রিয়জন থেকে শত্রু সবাইকেই বেদের জ্ঞান প্রদান করে দেবতা সহ সকলের প্রিয় হও এবং পরিশেষে আমাকে প্রাপ্ত হও।"
শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার মন্ত্রটিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,শূদ্র, বৈশ্য বর্তমান প্রচলিত চতুর্বণের উল্লেখ দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে বেদে বর্ণবাদ স্বীকৃত বলে মনে করেন। বিষয়টি ঠিক তেমন নয়।যারা মস্তিষ্ক বা বুদ্ধি বল দ্বারা সমাজ সেবা করেন সমাজে তাদেরই ব্রাহ্মণ বলে। যারা বাহুবল দ্বারা দেশ-জাতি এবং সমাজকে রক্ষা করেন তারাই ক্ষত্রিয়। কৃষি গোরক্ষা, ব্যবসা, বানিজ্য দ্বারা সমাজের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে পুষ্টিসাধন করেন তারাই বৈশ্য। যারা সেবার মাধ্যমে সমাজের ভিত্তি বা আশ্রয় সুদৃঢ় করে তারাই শূদ্র। বিষয়টি হল সমাজের শুধুই শ্রমবিভাজন। একজন জ্ঞানের পথে, আরেকজন বীরত্বের পথে, অপরজন ব্যবসা বাণিজ্য সহ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এবং আরেকজন সেবা-পরিশ্রমে পথে।একেকজনের কর্মক্ষমতা ও আধ্যাত্মিকতা একেক রকম আর সে অনুসারে কেউ ব্রাহ্মণ,কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ বৈশ্য কেউ শূদ্র। জগতের প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই এ চতুর্বণের ভাব দেখা যায়। আবার গুণকর্ম অনুসারে যার মধ্যে যে ভাবটি প্রবল, তাকে সেই বর্ণের বলে অবিহিত করা হয়। তবে তবে একথা সত্য যে জগতে কে ব্রাহ্মণ, কে ক্ষত্রিয়, কে বৈশ্য এবং কে শূদ্র বিষয়টি নির্ধারণ করার মত অসম্ভব কিছুই আর নেই। একমাত্র ভগবানই জানেন বিষয়টি।
জন্ম নয়, কর্মগুণেই যে মানুষের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রত্ব নির্ধারিত হয়, তা শ্রীমদ্ভগবদগীতার চতুর্থ অধ্যায়ে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে আছে। বিষয়টি নিয়ে মহাভারতের বনপর্বে ধর্মব্যাধ এবং কৌশিক প্রসঙ্গে একটি সম্পূর্ণ গীতাগ্রন্থই আছে, সে গীতাগ্রন্থের নাম 'ব্যাধগীতা'। একদা কৌশিক নামে এক ব্রাহ্মণ শাস্ত্রপাঠ ও তপস্যা বলে অলৌকিক শক্তি অর্জন করে।একদিন তিনি একটি গাছের তলে বসে একাগ্রভাবে তপস্যা করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ গাছের ডালে বসা একটি বকপাখি তপস্যারত কৌশিকের গায়ের উপরে মলত্যাগ করে দেয়। বকের এহেন কাণ্ডে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে যান কৌশিক। রেগে গিয়ে রক্তিম চোখে উপরের দিকে তাকালেন। তৎক্ষনাৎ বকপাখিটি মরে পরে গেল।তাকালেই পাখি ধূলিসাৎ হয়ে যায়, নিজের এই দৈবশক্তিতে কৌশিকের মনে এক তীব্র অহংকারের উদয় হল।
তপস্যা থেকে উঠে কৌশিক ভিক্ষা করতে পার্শ্ববর্তী একটি নগরে গেলেন। তিনি একটি গৃহে প্রবেশ করে গৃহস্বামীর কাছে ভিক্ষা চাইলেন। তৎক্ষনাৎ গৃহের ভেতর থেকে একজন স্ত্রীকণ্ঠে অপেক্ষা করতে বললেন। কিছুটা সময় অতিবাহিত করে গৃহের স্ত্রী কৌশিকের সম্মুখে উপস্থিত হলেন।কিন্তু কৌশিকের খুব রাগ হল, তাঁকে অকারণ দাড়িয়ে রেখে অবহেলা করায়। তিনি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে স্ত্রীটির দিকে থাকালেন। তখন স্ত্রীলোকটি হাসতে হাসতে বললেন, "আমি কিন্তু সেই বক পাখিটি নই, যে ধূলিসাৎ হয়ে যাব"।
পতিব্রতা স্ত্রীলোকটির কথা শুনে কৌশিক বিস্মিত হলেন।তিনি উপলব্ধি করলেন, সম্মুখস্থ স্ত্রীলোকটি কোন সাধারণ নারী নয়; নিশ্চয়ই তাঁর কোন বিশেষ অলৌকিক শক্তি রয়েছে। তা না হলে, বকপাখির ঘটনাটি তিনি জানতেন না।স্ত্রীলোকটি ছিলেন খুবই ধার্মিক।তিনি সুন্দর ভাবে তার কর্তব্যকর্ম করতেন।তাঁর সঙ্গে কৌশিকের ধর্ম এবং কর্তব্য নিয়ে কথা হল। স্ত্রীলোকটি পতিসেবার জন্য ভিক্ষাদানে বিলম্ব হয়েছে, বিষয়টি কৌশিককে বুঝিয়ে বললেন।বিস্ময়াবিষ্ট কৌশিক বুঝতে পারলেন। পতিব্রতা স্ত্রীটি তখন কৌশিককে মিথিলা নগরীতে গিয়ে ধর্মব্যাধের শরণাপন্ন হতে বললেন। ধর্মব্যাধই তাঁকে ধর্মোপদেশের সম্যক জ্ঞান দান করবেন।
কৌশিক মিথিলায় গিয়ে ধর্মব্যাধকে খুঁজে পেলেন। দেখলেন ধর্মব্যাধ বিভিন্ন পশু হত্যা করে তাদের মাংস বিক্রি করছেন।ধর্মব্যাধও ব্রাহ্মণ কৌশিককে দেখতে পেয়ে তাঁর কাছে এগিয়ে এসে বললেন, "সেই ধার্মিক নারী আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। আপনার আগমনের কারণ আমি জানি"। মিথিলার ধর্মব্যাধের কথা শুনে কৌশিক পুনরায় অবাক হলেন। একজন নৃশংস মাংস বিক্রেতা কি করে সকল অজানা বিষয় জানেন।মনের কথা বলতে পারেন। ধর্মব্যাধ কৌশিকের অবস্থা বুঝতে পেরে তাঁকে ধর্মাধর্ম; মানুষের জন্ম নয় কর্মের মহত্ব সহ সকল বিষয়ে সবিস্তারে বললেন। তিনি বললেন, মাংস বিক্রয় আমাদের বংশের ধর্ম এবং পুর্বপুরুষের পেশা।প্রত্যেকেরই বংশগত ধর্ম এবং প্রথা আছে।সেই পরম্পরাগত ধর্ম পালনে কোন পাপ স্পর্শ করে না। ধর্মব্যাধ তাঁর অলৌকিক আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের কারণ হিসেবে তাঁর পিতা-মাতাকে যথাসম্ভব অকৃত্রিম সেবার কথা বললেন।পিতা-মাতাই তাঁর সাক্ষাৎ দেবতা।তিনি আগে বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা করেন; এরপরে সকল কর্ম করেন। এভাবে পর্যায়ক্রমে ধর্মব্যাধ একজন মাংসবিক্রেতা হয়েও ব্রাহ্মণ কৌশিককে ধর্মাধর্মের সকল আধ্যাত্মিক জ্ঞান দান করেন। জ্ঞানার্জনে সকলরই যে সমান অধিকার; জন্ম নয় কর্মেই যে মানুষ মহান হয় এবং প্রত্যেকের থেকেই যে জ্ঞান লাভ করা যায় -বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দরভাবে মহাভারতের বনপর্বের অন্তর্ভুক্ত 'ব্যাধগীতা' গ্রন্থে বলা হয়েছে।
হিন্দুসম্প্রদায় তাদের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থাদি ভাল করে চর্চা করে না এবং অধিকাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় চর্চা ব্যক্তিগত আত্ম-উদবোধনের ; গোষ্ঠীবদ্ধ নয়।বেদের কোন স্থানেই জাতপাতে বিভক্ত করে কাউকেই বৈদিক জ্ঞান থেকে বিচ্যুত করা হয়নি।কিন্তু দুঃখজনকভাবে সমাজে এ অবৈদিক অসাম্যের কথাগুলো বিক্ষিপ্তভাবে কিছুকিছু স্থানে আছে। কয়েকটি পুরাণগ্রন্থে আছে এবং গুটিকয়েক ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্মৃতিশাস্ত্রে আছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সনাতন ধর্মে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতিগ্রন্থ বৈদিক জ্ঞানলাভের সহায়ক মাত্র। তাই বৈদিক সর্বজনীন সাম্যবাদী ঐক্যের চিন্তার বিপরীতে বেদবিরুদ্ধ সাংঘর্ষিক, যেসকল কথা পুরাণে এবং স্মৃতিতে থাকবে ; তা সকলই নির্দয়ভাবে পরিত্যাজ্য।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁