কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি, যোগ এবং তন্ত্র - এ পাঁচটি সাধন মার্গের যেকোন একটি মার্গে ভগবানের পথে অগ্রসর হওয়া যায়। এই অগ্রসর হওয়া পুণ্যবানদের মধ্যে কদাচিৎ কোন সুকৃতিবান ব্যক্তি ভগবানকে দর্শন করতে পারেন। মনুষ্যের স্বাভাবিক চর্মচক্ষুতে ভগবানকে দর্শন করা যায় না। কারণ তিনি ইন্দ্রিয়াতীত। ধ্যানের গভীরে তাঁকে দর্শন করতে হয়। এ কারণে অর্জুনকেও যখন ভগবান তাঁর বিশ্বরূপের দর্শন দিয়েছিলেন
ইহৈকস্থং জগৎ কৃৎস্নং পশ্যাদ্য সচরাচরম্।
মম দেহে গুড়াকেশ যচ্চান্যদ্ দ্রষ্টুমিচ্ছসি ৷৷
ন তু মাং শক্যসে দ্রষ্টুমনেনৈব স্বচক্ষুষা।
দিব্যং দদামি তে চক্ষুঃ পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১১.৭-৮)
"হে অর্জুন ! আমার এই বিরাট শরীরে একস্থানে অবস্থিত চরাচরসহ সমগ্র জগৎ অবলোকন করো এবং আরও যা কিছু তোমার দেখবার ইচ্ছা তা-ও দেখো।
কিন্তু তুমি তোমার নিজ চর্মচক্ষুর দ্বারা আমার এই বিশ্বরূপ দেখতে সমর্থ হবে না। তাই আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু প্রদান করছি, সেই চক্ষু দ্বারা তুমি আমার ঐশ্বরিক যোগশক্তি দর্শন করো।"
ভগবান জীবের সকল ইন্দ্রিয়ের স্বামী হয়ে তিনি নিজে স্বয়ং ইন্দ্রিয়াতীত। সকল ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে তুরীয় অবস্থায় তাঁকে দর্শন করা যায়। সেই দর্শন হয় দিব্যচক্ষু দ্বারা। সাধক সাধনার গভীরে তাঁকে উপলব্ধি করতে পারে। সেই আনন্দরূপ ব্রহ্মের আনন্দকে আস্বাদ করতে পারে। কিন্তু কখনো সেই আনন্দ এবং সেই রূপ সম্পূর্ণভাবে ব্যক্ত করতে পারে না। শতভাগের একভাগও হয়তো পারে না। লালন সাঁইয়ের ভাষায় সাধক তখন বোবা হয়ে যায়। একজন বোবা যেমন রসালো রসগোল্লা খেয়ে, সেই রসগোল্লার অতুলনীয় স্বাদ শতচেষ্টা করে কখনই বর্ণনা করতে পারে না। সাধকেরও সাধনার গভীরে যখন দৈবদর্শন হয়, তখন তারও একই অবস্থা হয়।
"কানায় কানায় উলামিলা
বোবাতে খায় রসগোল্লা।
লালন তেমনি মদনা কানা
ঘুমের ঘোরে দেয় বাহার।।"
নিরবচ্ছিন্ন তপস্যা এবং সাধনার ফলে সাধকের হৃদয় আস্তে আস্তে উদ্ধগামী হয়। তার হৃদয়ের বিভিন্ন বাহ্যিক কামনা এবং বাসনার আবরণ উন্মোচিত হতে থাকে। তাঁর ইন্দ্রিয়গুলো দিব্য সত্ত্বার সাথে সংযুক্ত হয়। সাধক ধীরেধীরে পর্যায়ক্রমে চর্মচক্ষুকে অতিক্রম করে দিব্যচক্ষু লাভ করেন। সেই শুদ্ধ দিব্যচক্ষু দ্বারাই তিনি নিজ আজ্ঞাচক্রে ভগবান বিষ্ণুর শ্রীপাদপদ্ম দর্শন করেন।ফলে সাধক সকল বন্ধন অতিক্রম করে মুক্ত হয়ে যান।
তদবিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ।
দিবীব চক্ষুরাততম্।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা:১.২২.২০)
“ তপস্যা এবং যোগের ফলে সাধকগণ দিব্যচক্ষু লাভ করেন, সেই শুদ্ধ দিব্যচক্ষু দ্বারাই তাঁরা সর্বদা ভগবান বিষ্ণুর শ্রীপাদপদ্ম দর্শন করেন।"
এ অবস্থায় সাধকের ভগবানের সাথে এক একত্ববোধ জন্মে। সাধক সর্বদা উপলব্ধি করতে পারেন তাঁর মধ্যে অনন্তের প্রকাশ। এই ব্রহ্মের সাথে একত্ববোধই সাধককে মুক্তির পথে নিয়ে যায়।ঋগ্বেদ সংহিতার অষ্টম মণ্ডলেও বিষয়টি বলা হয়েছে :
যদগ্নে স্যামহং ত্বং ত্বং বা ঘাস্যা অহম্।
স্যুষ্টে সত্যা ইহাশিষঃ।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা:৮.৪৪.২৩)
"হে প্রকাশ স্বরূপ অগ্নি, যখন আমি তুমি হয়ে যাই এবং তুমি আমি হয়ে যাও; তখনই সংসারে তোমার আশীর্বাদ সার্থক হয়।"
মুক্ত পুরুষেরা নিজেরা ভবসমুদ্র পাড়ি দিয়ে মুক্ত হয়ে ঈশ্বরের পথে চলার সকল পদ্ধতি শিষ্য পরম্পরায় নির্দেশনা দিয়ে যান এ তত্ত্বটি শ্রীদ্ভাগবতেও বলা হয়েছে। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই ঈশ্বরকে পাওয়ার তাঁদের অনুসৃত সাধন পদ্ধতি তাঁরা বর্ণনা করে যান। যেন সাধারণ মানুষ মুক্তপুরুষের সে পথে চলে সহজেই ঈশ্বরকে পেতে পারেন। এ পরম্পরায়গত জ্ঞানের পথে সহজেই মুক্তিলাভ করা যায়।
স্বয়ং সমুত্তীর্য সদুস্তরং দ্যুমন্
ভবার্ণবং ভীমমদভ্রসৌহৃদাঃ।
ভবৎ পদাম্ভোরুহনাবমত্র তে
নিধায় যাতাঃ সদনুগ্রহো ভবান্।।
(শ্রীমদ্ভাগবত:১০.২.৩১)
"হে স্বপ্রকাশ! আপনার ভক্তবৃন্দ তাে নিখিল জগতের অকপট পরম বান্ধব, যথার্থ হিতৈষী ; এইজন্যই তাঁরা স্বয়ং এই ভয়ংকর দুস্তর সংসার নামক সমুদ্র পাড়ি দিলেও অন্যদের কথা বিস্মৃত হয়ে যান না। তাঁরা নিজেরা সংসার সমুদ্র অতিক্রম করে অন্যদের কল্যাণের জন্য আপনার অনুগ্রহে আপনার শ্রীপাদপদ্মরূপ তরী জগতে স্থাপিত করে যান।"
বেদের মধ্যেই আমরা সুস্পষ্টভাবে শ্রীভগবানের পাদপদ্ম (পরমং পদং) দর্শনের কথা রয়েছে। এই অচিন্ত্য পাদপদ্মের ধ্যানেই যুগে যুগে ঋষি মুনিরা তাঁর সম্পূর্ণ জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। পাদপদ্ম শব্দের সাথে সাথেই ঈশ্বরের সাকার রূপের প্রসঙ্গ চলে আসে। ঈশ্বর কখনো সাকার, কখনো নিরাকার আবার কখনো সাকার নিরাকারের অতীত। তিনি সীমিত করা যায় না। অনন্ত তাঁর প্রকাশ। ভগবানের পাদপদ্মরূপ তরী সকল জীবের আশ্রয়। সেই পাদপদ্ম থেকে কৃপার কৃপার গঙ্গা প্রবাহিত হয়ে চলছে। সাধক ভগবানের পাদপদ্ম প্রবাহিত গঙ্গাধারায় স্নান করে শুদ্ধ হয়। আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক এবং আধিদৈবিক এ ত্রিতাপজ্বালা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ভগবানের করুণাঘন কৃপায়। তিনি সাধককে কখনো বিমুখ করেন না। এ জন্মে না হলেও জন্মজন্মান্তরে হলেও তাঁর শ্রীপাদপদ্মের দর্শন দিয়ে মুক্ত করেন। তাঁর অহৈতুকী কৃপায় জীব মুক্ত হয়। সকল তরী ডুবে গেলেও, ভগবানের পাদপদ্মরূপ তরী কখনো ডুবে না। বিপদসংকুল দুস্তর সংসার সমুদ্র অবলীলায় পাড়ি দেয়। কবি কাজী নজরুল ইসলামও ভগবান শ্রীহরির পাদপদ্মের কামনা করেছে। অসাধারণ ভাবমাধুর্যে ব্যক্ত হয়েছে তাঁর ভগবান শ্রীহরির পাদপদ্মে আশ্রয় লাভের আকুতি। কবির ভাষায়:
"হে গোবিন্দ রাখ চরণে।
মোরা তব চরণে শরণাগত আশ্রয় দাও আশ্রিত জনে হে॥
গঙ্গা ঝরে যে শ্রীচরণ বেয়ে
কেন দুখ পাই সে চরণ চেয়ে
এ ত্রিতাপ জ্বালা হর হে শ্রীহরি, চাহ করুণা সিক্ত নয়নে॥
হরি ভিক্ষা চাহিলে মানুষ নাহি ফিরায়
তোমারি দুয়ারে হাত পাতিল যে, ফিরাবে কি তুমি তায়।
হরি সব তরী ডুবে যায়
তোমার চরণ তরী ত’ ডোবে না হায়,
তব চরণ ধরিয়া ডুবে মরি যদি রবে কলঙ্ক নিখিল ভুবনে॥"
বর্তমানে অজ্ঞানতাবশত কেউ বলছি ঈশ্বর সাকার হতে পারেন না ; বিপরীতে কেউ বলছি ঈশ্বর নিরাকার হতে পারেন না। একবারও ভেবে দেখছি না যে, ঈশ্বরের সাকার নিরাকার উভয় ভাবই বেদাদি শাস্ত্রে আছে। আমরা অন্ধের হস্তিদর্শনের মত, যে যার মত করে অনন্তকে অনন্ত সমুদ্রের পাড়ে বসে দুই একটি জ্ঞানের নুড়িপাথর কুড়াচ্ছি। আর মনে মনে অহংকার করছি, সমুদ্রের জেনে গেছি। বিষয়টি হাস্যকর। কিন্তু আমরা একবারও এই মহাসমুদ্রকে পাড়ি দিয়ে, অনন্তের সংগীতের আহ্বান শুনতে হবে। হৃদয়ে যখন সেই অনন্ত সিন্ধুর মহাসংগীত ভেসে আসে, তখনই চিদাকাশে ভগবানের পরমপদের দর্শন হয়। সেই মহাসিন্ধু পাড়ে নেই কোন মৃত্যু, নেই কোন জরা ব্যাধি। শুধুই আনন্দ, শুধুই অনন্ত, শুধুই আলো, শুধুই অমৃত।কবি দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের ভাষায়:
"ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে
কে ডাকে কাতর প্রাণে, মধুর তানে
আয় চলে আয়
ওরে আয় চলে আয় আমার পাশে
মহাসিন্ধুর ওপার থেকে
কি সঙ্গীত ভেসে আসে।
বলে আয়রে ছুটে, আয়রে ত্বরা
হেথা নাইকো মৃত্যু, নাইকো জরা"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।