ক্ষমতা একটি শাখের করাতের মত। দুধারেই কাটে। এর দ্বারা যেমন লোককল্যাণ করা যায়, তেমনি বিপরীতে ক্ষমতার অপপ্রয়োগে ব্যক্তি অধঃপতিত হয়। ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীতে সংস্কৃত সাহিত্যের খ্যাতিমান গদ্যকবি হলেন।বাণভট্ট। তাঁর পৃথিবী বিখ্যাত গদ্যকাব্যের নাম 'কাদম্বরী'। এই কাদম্বরী গদ্যকাব্যের শুরতে কথারম্ভতেই রয়েছে রাজপুত্র চন্দ্রাপীড়কে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করার পূর্বে মন্ত্রী শুকনাসের উপদেশ। একজন বিচক্ষণ মন্ত্রী শুকনাস ভবিষ্যৎ রাজাকে ক্ষমতা এবং ক্ষমতার অপপ্রয়োগ সম্পর্কে অবহিত করেন। অবন্তি দেশে উজ্জয়িনী নগরীতে তারাপীড় নামে মহাযশস্বী তেজস্বী প্রবলপ্রতাপ রাজা ছিলেন। তিনি অর্জ্জুনের ন্যায় নিজভুজবলে অখণ্ড ভূমণ্ডল জয় ও প্রজাগণের ক্লেশ দূর করিয়া সুখে রাজ্য ভোগ করেন। রাজার যখন বয়স হলো, তখন রাজা চিন্তা করলেন যে, তাঁর পুত্র চন্দ্রাপীড়কে যৌবরাজ্যে অভিষেক করবেন। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে মহারাজ রাজকুমার চন্দ্রাপীড় যুবরাজ হবেন, এ ঘোষণা সর্ব্বত্র প্রচার করলেন। যুবরাজের অভিষেককে কেন্দ্র করে রাজপ্রাসাদ ও নগর আনন্দকোলাহলে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। অভিষেকের সামগ্রীসম্ভার সংগ্রহের জন্যে লোক সকল দিগ্দিগন্তে গমন করল। ঠিক এমনি সময়ে রাজপুত্র চন্দ্রাপীড় মন্ত্রী শুকনাসের আশীর্বাদ এবং পরামর্শ নিতে তাঁর বাড়িতে গেলেন। মন্ত্রী শুকনাস তখন, মধুর বচনে চন্দ্রাপীড়কে ক্ষমতার প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগ সম্পর্কে যা বলেন, তা বর্তমানের জন্যেও প্রাসঙ্গিক। মন্ত্রী শুকনাস বলেন:
কুমার! তুমি সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন ও সমুদায় বিদ্যা অভ্যাস করেছ, সকল কলা আয়ত্ত করেছ, ভূমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করে জ্ঞাতব্য অধিকাংশ জ্ঞানই লব্ধ করেছ। তোমার অজ্ঞাত কিছুই নেই, তাই তোমাকে উপদেশ দেয়ারও কিছুই নেই। তুমি যুবক, মহারাজ তোমাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত ও ধনসম্পত্তির অধিকারী করতে ইচ্ছা করেছেন। যৌবন, ধনসম্পত্তি, প্রভুত্ব, এ তিনেরই তুমি অধিকারী। তবে জেনে রাখ, যৌবনের যদি যথাযথভাবে ব্যবহার না হয়, তবে তা বিষম কালস্বরূপ হয়ে ওঠে। নিয়ন্ত্রণহীন যৌবনরূপ বনে মানুষ অনেক সময়ে বন্য জন্তুর ন্যায় ব্যবহার আচরণ করে। যুবা পুরুষেরা কাম, ক্রোধ, লোভ প্রভৃতি পশুধর্মকে সুখের হেতু ও স্বর্গের সেতু জ্ঞান করে। যৌবনপ্রভাবে যৌবনকালে মনে একপ্রকার ভয়ংকর অন্ধকার উপস্থিত হয়। সহজেই সে অন্ধকার নিরস্ত হতে চায় না। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যৌবনের আরম্ভে অতি নির্মল বুদ্ধিও বর্ষাকালীন নদীর ন্যায় কলুষিতা হয়। বিষয়তৃষ্ণা ইন্দ্রিয়দিগকে আক্রমণ করে। তখন অতিগর্হিত অসৎ কর্ম্মকেও দুষ্কর্ম্ম বলে আর বোধ হয় না। তখন লোকের প্রতি অত্যাচার করে স্বার্থসম্পাদন করতেও আর লজ্জাবোধ হয় না। মদ্যপান না করলে ও চক্ষুর দোষ না থাকলেও ধনমদে একপ্রকার মত্ততা জন্মে। পরবর্তীতে সেই মত্ততা থেকে অন্ধতার আবির্ভাব ঘটে। ধনমদে উন্মত্ত হলে ব্যক্তির হিতাহিত বা ভালো মন্দ বিচার বুদ্ধি থাকে না। প্রচুর ধন থেকে মানুষের অহঙ্কারের উৎপত্তি ঘটে। অত্যন্ত অহংকারী পুরুষেরা মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে না। তারা প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক হয়ে নিজেকেই সর্বাপেক্ষা গুণবান্, বিদ্বান্, এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে। এই ক্ষমতার অহংকার তারা অন্যের নিকটেও যথাসম্ভব প্রকাশ করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা করে। অহংকারী ব্যক্তিদের স্বভাব এমন উদ্ধত যে, সে নিজের মতের বিপরীত কথা শুনিলে তৎক্ষণাৎ খড়্গহস্ত হয়ে অন্যের উপরে ঝাপিয়ে পরে। ক্ষমতার প্রভুত্বরূপ বিষের ঔষধ নেই। প্রভুজনেরা অধীন লোককে দাসের ন্যায় জ্ঞান করে ছোট করে। আপন সুখে সন্তুষ্ট থেকে পরের দুঃখ সন্তাপ কিছুই তারা তাদের চোখে দেখতে পায় না। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে তারা স্বার্থপর হয়ে অন্যের সর্বদা অনিষ্ট করার চেষ্টা করে। যৌবরাজ্যে, যৌবন, প্রভুত্ব ও অতুল ঐশ্বর্য্য, এ সকল কেবল অনর্থপরম্পরা। অসামান্যধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরাই ক্ষমতার এ তরঙ্গ হতে উত্তীর্ণ হতে পারে। তীক্ষ্ণবুদ্ধিরূপ দৃঢ় নৌকা না থাকলে, ক্ষমতার প্রবল স্রোতে নিপতিত হতে হয়। একবার নিপতিত হলে আর সেই ক্ষমতার ঘূর্ণিস্রোত থেকে উঠার সামর্থ্য থাকে না।
সদ্বংশে জন্মিলেই যে, সৎ ও বিনীত হয় না। উর্বরা ভূমিতে কাঁটাগাছের জন্ম হয়। সুগন্ধিযুক্ত চন্দনকাঠের ঘর্ষণে যে অগ্নি নির্গত হয়, সেই অগ্নির থেকে উৎপন্ন দাবানলে সম্পূর্ণ বন ভস্মীভূত হয়ে যেতে পারে। জগতে সকল ব্যক্তিরাই উপদেশের যথার্থ অধিকারী নয়। মূর্খকে উপদেশ দিলে, সেই উপদেশ কোন ফল হয় না। সূর্যের কিরণ স্ফটিকমণির ন্যায় মৃৎপিণ্ডে প্রতিফলিত হয় না।সদুপদেশ অমূল্য ও অসমুদ্রসম্ভূত রত্ন। তা শরীরের বৈরূপ্য প্রভৃতি জরার কার্য্য প্রকাশ না করেও বৃদ্ধত্ব সম্পাদন করে। জ্ঞানবৃদ্ধত্বে বয়সের প্রয়োজন হয় না। ক্ষমতাবান ঐশ্বর্য্যশালীকে উপদেশ দেয় এমন লোক অতি বিরল। যেমন গিরিগুহার নিকটে শব্দ করলে প্রতিশব্দ হয়, সেইরূপ পার্শ্ববর্ত্তী লোকের মুখে প্রভুবাক্যের প্রতিধ্বনি হতে থাকে; অর্থাৎ প্রভু যাহা কহেন, পারিষদেরা তাই যুক্তিযুক্ত বলে স্বীকার করে নেয়। প্রভুর নিতান্ত অসঙ্গত ও অন্যায় কথাও পারিষদদিগের নিকট সুসঙ্গত ও ন্যায়ানুগত বলে বোধ হয়।এবং সেই অসঙ্গত ও অন্যায় কথা পুনঃপুনঃ উল্লেখ করে তারা প্রভুর ধারাবাহিক প্রশংসা করতে থাকে। ক্ষমতাবান ঐশ্বর্য্যশালীর কথার বিপরীত কথা বলতে কেউ সাহস হয় না। যদি কোন সাহসিক পুরুষ ভয় পরিত্যাগ করে, ক্ষমতাবান ঐশ্বর্য্যশালীকে তাদের অন্যায় ও অযুক্ত কথাকে সংশোধন করে দেন, তথাপিও তারা তা গ্রহণ করে না। ক্ষমতাশালী প্রভু সে সময় বধির হয়ে অথবা ক্রোধান্ধ হয়ে আত্মমতের বিপরীতবাদীর অপমান করেন। অর্থই অনর্থের মূল। মিথ্যা অভিমান, অকিঞ্চিৎকর অহঙ্কার ও বৃথা ঔদ্ধত্য প্রায় অর্থ হইতে উৎপন্ন হয়।
লক্ষ্মী অত্যন্ত চঞ্চলা প্রকৃতির।অতিযত্নে রক্ষিত হলেও কখন একস্থানে, সে স্থির থাকে না। রূপ, গুণ, বৈদগ্ধ, কুল, শীল কিছুই বিবেচনা করেন না। রূপবান্, গুণবান্, বিদ্বান্, সদ্বংশজাত, সুশীল ব্যক্তিকেও পরিত্যাগ করিয়া জঘন্য পুরুষাধমকেও সে আশ্রয় করতে পারে। দুরাচার অলক্ষ্মী যাকে আশ্রয় করে, সে স্বার্থনিষ্পাদনপর ও লুব্ধপ্রকৃতি হইয়া দ্যূতক্রীড়াকে বিনোদ, পশুধর্মকে রসিকতা, যথেষ্টাচারকে প্রভুত্ব ও মৃগয়াকে ব্যায়াম বলে মনে করে। মিথ্যা স্তুতিবাদ করতে না পারলে ধনিদিগের কাছে জীবিকার সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায় না। যারা অন্যকার্য্যপরাঙ্মুখ ও কার্য্যাকার্য্য বিবেকশূন্য এবং সর্বদা বদ্ধাঞ্জলি হইয়া ধনেশ্বরকে জগদীশ্বর বলিয়া বর্ণনা করে, তারাই ধনিগণের কাছে বসার সুযোগ পায় ও তাদের প্রশংসাভাজন হয়। ক্ষমতাসীন প্রভু স্তুতিবাদককে যথার্থবাদী বলিয়া জ্ঞান করেন। তার সাথে আলাপ করেন, তাহাকেই সদ্বিবেচক ও বুদ্ধিমান্ বলিয়া ভাবেন, তার পরামর্শক্রমেই সকল কাজ সম্পাদিত করেন। পক্ষান্তরে স্পষ্টবক্তা উপদেষ্টাকে নিন্দুক বলে অবজ্ঞা করেন। সেই স্পষ্টবাদীকে নিকটেও বসতে দেন না। হে চন্দ্রাপীড় তুমি, শাসনভার গ্রহণে প্রবৃত্ত হচ্ছ। তাই সাবধান, তুমি সাধুদের উপহাসাস্পদ ও চাটুকারের প্রতারণাস্পদ কখনো হবে না। চাটুকারের প্রিয় বচনে তোমার যেন ভ্রান্তি না জন্মে। যথার্থবাদীকে নিন্দুক বলে কখনো অবজ্ঞা করবে না। রাজারা আপন চক্ষে কিছুই দেখতে পান না। রাজারা এমন হতভাগ্য লোক দ্বারা পরিবৃত থাকেন, প্রতারণা করাই যাদের লক্ষ্য । তারা নিজ প্রভুকে করে আপন অভিপ্রায় চরিতার্থ করে।তারা সর্বদা প্রতারণারই প্রচেষ্টা করে। বাহ্যভক্তি প্রদর্শন পূর্বক নিজদের দুষ্ট অভিপ্রায় গোপন করে রাখে। তবে সময় পাইলেই চাটুবচনে প্রভুকে প্রতারিত করে সকলের সর্বনাশ করে। হে চন্দ্রাপীড়, তুমি স্বভাবতঃ ধীর প্রকৃতির। তথাপি তোমাকে বারংবার উপদেশ দিতেছি, সাবধান, যেন ধন ও যৌবনমদে উন্মত্ত হয়ে নিজকর্ত্তব্য কর্মের অনুষ্ঠানে পরাঙ্মুখ ও অসদাচরণে কখনো প্রবৃত্ত হইও না। বর্তমানে মহারাজের ইচ্ছাক্রমে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হয়ে কুলক্রমাগত ভূভার বহন কর, অরাতিমণ্ডলের মস্তক অবনত কর, এবং সমুদায় দেশ জয় করে অখণ্ড ভূমণ্ডলে আপন আধিপত্য স্থাপন করে প্রজাদিগের প্রতিপালন কর।
চন্দ্রাপীড় মন্ত্রী শুকনাসের গভীর অর্থযুক্ত উপদেশবাক্য একাগ্রতায় শুনে মনে মনে সেই কথাগুলো স্মরণ করে রাজপ্রাসাদে চলে আসলেন।অভিষেকসামগ্রী সমাহৃত হলে, অমাত্য ও পুরোহিতের সাথে রাজা শুভ দিনে ও শুভ লগ্নে তীর্থ, নদী ও সাগর হতে আনীত মন্ত্রপূত বারি দ্বারা রাজকুমারের অভিষেক করলেন। লতা যেরূপ এক বৃক্ষ হইতে শাখা দ্বারা বৃক্ষান্তর আশ্রয় করে, সেরূপ রাজসংক্রান্ত রাজলক্ষ্মী যুবরাজকে অবলম্বন করলেন।রাজা তারাপীড় সুযোগ্য পুত্রকে রাজ্যভার সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত হলেন।
কোন ক্ষমতাবান ব্যক্তি যদি ক্ষমতার চেয়ারটি হারিয়ে ক্ষমতাহীন হয়ে যান, তবে তার জীবনে এর থেকে বিরম্বনার আর কিছুই নেই। ক্ষমতাহীন হয়ে ধীরেধীরে তিনি তার জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ফলশ্রুতিতে অনেকে অকস্মাৎ মৃত্যুমুখেও পতিত হয়। প্রতিদিন এত মানুষের সম্মান, খোঁজখবর নেয়া, মোবাইলে শতশত কল আসা। এ ব্যস্ত জীবনের আনন্দ এক নিমেষেই যখন ফিকে হয়ে যায়, বিবর্ণ ধুসর হয়ে যায় ; তখন ক্ষমতার হট সিটে বসা ব্যক্তিটি ক্ষমতা হারিয়ে আর সুস্থির থাকতে পারেন না। মনে পরে যায় তার সাথে সম্পর্কিত পূর্বের ব্যক্তিগুলো এবং তাদের সেই সময়ের আচরণের কথা। যে আচরণের সিংহভাগই ছিল তেলবিষয়ক। অনেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের শেষ জীবনের দিকে তাকালে আমরা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাই।জগতের কোন ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। 'সোনার তরী' কাব্যগ্রন্থের 'পুরষ্কার' কবিতায়।
"কে আছে কোথায়, কে আসে কে যায়,
নিমেষে প্রকাশে, নিমেষে মিলায়--
বালুকার 'পরে কালের বেলায়
ছায়া-আলোকের খেলা!
জগতের যত রাজা-মহারাজ
কাল ছিল যারা কোথা তারা আজ,
সকালে ফুটিছে সুখদুখলাজ--
টুটিছে সন্ধ্যাবেলা।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।