-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

সত্য-শান্তির মতবাদকে, মিথ্যা প্রচারে নামতে হয় না।

ধর্মের প্রথম স্তম্ভই হল সত্য। তাই ধর্ম এবং সত্য অবিচ্ছেদ্যভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। ধর্ম থেকে কখনই সত্যকে পরিত্যাগ করা যায় না।বিপরীতক্রমে সত্যহীন ধর্ম অধর্মে পর্যবসিত হয়। বৈদিক শাস্ত্রে নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী সর্বদা সত্যকে অনুসরণ করে, সর্বদা সত্যের নির্দেশ অনুসারে ধর্মের আচরণ করতে বলা হয়েছে। সত্যের আকর বেদকে সর্বক্ষেত্রে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। তাই সত্যরূপ বেদ অধ্যয়নে অবহেলা করতে সম্পূর্ণভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সত্যাসত্য বিচারেরই মানবের ধর্মাধর্ম নির্ণীত হয়। সেই নির্ণীত ধর্মাধর্মই কর্তব্যকর্মের জ্ঞানোদয় ঘটায়। সত্যং বদ।ধর্মং চর।স্বাধ্যায়ান্মা প্রমদঃ। সত্যান্ন প্রমদিতব্যম্।ধর্মান্ন প্রমদিতব্যম্। কুশলান্ন প্রমদিতব্যম্।ভূত্যৈ ন প্রমদিতব্যম্।।  (তৈত্তিরীয়োপনিষদ্ ১.১১.১) "সর্বদা সত্যকথা বলবে। ধর্মের আচরণ করবে। বেদ অধ্যয়নে কখনো ও অবহেলা করবে না।সত্য থেকে কখনো বিচ্যুত হবে না।ধর্ম থেকে কখনো বিচ্যুত হবে না। মানুষের কল্যাণকর কাজ থেকে কখনো বিচ্যুত হবে না। আত্মরক্ষা এবং নিজের উন্নতিসাধনে কখনো বিচ্যুত হবে না।" সত্যকে বারবার চিৎকার করে বলতে হয় না যে আমি সত্য। সত্য, শিব এবং সুন্দর একে অন্যের পরিপূরক। কিন্তু মিথ্যাকে বারবার তার নিজের ঢাক নিজেই বাজিয়ে মানুষকে বিশ্বাস করাতে হয়। কথার চমৎকারিত্বে মানুষকে আকৃষ্ট করতে হয়। বারবার বলতে বলতে মিথ্যা অনেক সময়েই সত্যের মতই শোনায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'কণিকা' কাব্যগ্রন্থে 'সন্দেহের কারণ' কবিতায় রসিকতা করে নকল হীরার আত্মপ্রচার প্রসঙ্গে বলেছেন।নকল হীরাই বারেবারে বলে বেড়ায় দেখ আমি খাটি। পক্ষান্তরে আসল হীরাকে কখনও এমন অপ্রয়োজনীয় আত্মপ্রচারে নামতে হয় না বা তার এ অহেতুক আত্মপ্রচারের প্রয়োজনও নেই। তার নিজের সম্পর্কে তার যথেষ্ট ধারণা আছে। "কত বড়ো আমি, কহে নকল হীরাটি। তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি।" এ নকল হীরার মতই বর্তমানকালে জগতে শান্তির মতবাদ বলে অনেক মতাদর্শ প্রচলিত রয়েছে। শান্তির নামে এরা 'গুলিস্তান মার্কেটিং' করে চলছে। এ গুলিস্তান মার্কেটিং করতে করতে অনেক সময়েই তারা বিষয়টিকে সম্পূর্ণ  হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ সকলই বুঝতে পারে, হয়ত  মুখ ফুটে বলে না পারিপার্শ্বিকতার কারণে। ঢাকা শহরের গুলিস্তানে অবস্থিত হকাররা রোগ শতভাগ সেরে যাওয়ার প্রচারণা করে বিভিন্ন প্রকারের ঔষধ বিক্রি করে।এ ঔষধগুলো বিক্রির সময়ে সে ঔষধের গুণাবলি যখন তারা বর্ণনা করে তা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে জোরগলায় বলে।কিন্তু কথাগুলো আত্মবিশ্বাসের এবং জোরগলায় বলা হলেও তাদের কথাগুলো অধিকাংশই প্রবঞ্চনাপূর্ণ মিথ্যা। হকারদের মিথ্যা কথাগুলো বলার স্টাইল এবং কথার চমৎকারিত্বে অনেকেই সেই ওষুধ কিনে, পরবর্তীতে সেই ক্রয়কৃত ওষুধ ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ হয়। ছাত্রজীবনে আমরাও চলাফেরায় পথে গুলিস্তানের এই হকারদের গুলিস্তান মার্কেটিং করে বিভিন্ন প্রকারের ঔষধ এবং মলম বিক্রি করতে দেখতাম। দেখতাম অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষিত ছেলেরাও হকারদের কথাগুলো পাশে দাঁড়িয়ে গোগ্রাসে গিলছে। আমরাও জানতাম যে তাদের কথাগুলো সত্য নয়।এরপরেও কথাগুলো শুনতে ভালো লাগতো।কারণ কথাগুলোর মধ্যে অনেক প্রকারের সুরসুরি থাকতো। অবশ্য আমি পছন্দ না করলেও, এই সুরসুরিযুক্ত কথাগুলো অল্প বয়সের অনেক ছেলেমেয়েরাই পছন্দ করতো।তাদের কথাতে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস থাকায়, আমাদের  বন্ধুদের দুই-একজন ওষুধগুলো কিনে নিয়ে হলে যেত। পরবর্তীতে সেই বন্ধুদেরই বলতে শুনতাম, "ধ্যাৎ! শুধু শুধুই টাকাটা নষ্ট হল, এই গুলিস্তানি মলম না কিনে টাকাটা গরীব কাউকে দিলে বা কিছু একটা কিনে খেলেও টাকাটা কাজে লাগতো"।গুলিস্তানের ওষুধে এভাবে অধিকাংশই মানুষই প্রতারিত হয় বলে অভিযোগ। সেই হকারদের কথা শুনলে মনে হবে, তারা তাদের এই গুলিস্থানী ওষুধ দিয়ে জগতের সকল রোগই সারাতে পারে। কিন্তু আদতে সেই ওষুধে কোন রোগই সারে না; উল্টো আরও বিভিন্ন প্রকারের পার্শপ্রতিক্রিয়া হয়। এভাবেই মিথ্যার কথার চমৎকারিত্বে দিনশেষে সহজ সরল সাধারণ মানুষ বারেবারেই প্রতারিত হয়।  বর্তমানে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকারের যে শান্তির অনুসারী পাওয়া যায়। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ বাস্তব জীবনে সারা দিনরাত্রি চিৎকার করে নিজেকে শান্তির অনুসারী দাবি করে থাকে। এদের মধ্যে অনেকেই শান্তির দূতের প্রচারণা করে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পুরষ্কার পর্যন্ত পেয়ে যায়। কারণ তারা সংঘবদ্ধ একটি বৈশ্বিক গোষ্ঠী। সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের অবস্থান। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে জগত বর্তমানে একটি খোলা খাতার মত। জগতের সকলেই আন্তর্জালিক (Internet) বেষ্ঠনে জড়িয়ে একে অন্যের আজ কাছাকাছি। কারো চোখকে ফাঁকি দেয়ার আজ সুযোগ নেই। যে কেউ চাইলে যে কোন তথ্য-উপাত্ত জানতে পারে। স্বদিচ্ছা সময় থাকলে গবেষণাও করতে পারে। তাই কে বা কারা শান্তির দূত, আর কে বা কারা অশান্তির দূত তা জগতের কাছে দৃশ্যমান। তাই অহেতুক অপ্রয়োজনীয় "গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল" স্টাইলে নিজেকেই নিজে শান্তিপ্রিয় শান্তির দূত বলে প্রচারণা করার বিষয়টি অত্যন্ত হাস্যকর। এর সামান্যতম প্রয়োজন নেই। বিষয়গুলো নিয়ে সাধারণ মানুষ হয়ত কেউ সচরাচর মুখ খোলে না। তবে এ কথাও ইতিহাস সাক্ষী যে, লোভ, ভয় এবং রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় কোন নৃশংস বা অমানবিক মতবাদকে বেশীদিন রক্ষা করা যায় নি, আর কোনদিন যাবেও না।যেদিন রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে না, সেদিন সেই মতবাদ ভেঙে খানখান হয়ে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে । এ কথা সত্য যে, যদি রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা কোন দার্শনিক মতবাদকে সর্বদা রক্ষা করতে হয়, সেই দার্শনিক মতবাদের মত দুর্বল মতবাদ জগতে আর নেই।পৃথিবীর ইতিহাসে এর অন্যতম উদাহরণ এডলফ হিটলার। তিনি রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে ইহুদিদের প্রতি যে গণহত্যা সংগঠিত করেছেন, তা আজও ঘৃণিত মানবতার বিরুদ্ধে  অপরাধ। প্রকৃতি একদিন না একদিন জগতে সংগঠিত সকল অন্যায় মানবতাহীন নৃশংস কর্মেরই প্রতিশোধ নেয়। অনেক সময়েই প্রকৃতির প্রতিশোধ অত্যন্ত ভয়ংকর হয়। ছদ্মবেশী বিনয়ের অভিনয় মানুষ বেশীক্ষণ করতে পারে না, টাকাপয়সা এবং অন্যান্য সুরসুরিতে আসল স্বরূপ বের হয়ে যায়। তেমনি অসত্য, অশান্তি এবং নৃশংসতা যতই সত্য শান্তির আধুনিক মুখোশ পরে থাকুক না কেন ;তাদের মিথ্যার মুখোশ খুলে যাবেই। এ মুখোশ খুলে গেলে, প্রকৃত যৌনতা মিশ্রিত জল্লাদ স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে গেলে, মানুষের অবদমনে তাদের একমাত্র সম্বলই থাকে শুধুই  নৃশংসতা। অথর্ববেদের শৌনকীয় শাখার অন্তর্গত মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে, "সত্যমেব জয়তে"।একমাত্র সত্যই জয়লাভ করে, মিথ্যা নয়। বৈদিক হিরন্ময় এ বাক্যটি ভারতের জাতীয় প্রতীকের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।  সত্যমেব জয়তে নানৃতং  সত্যেন পন্থা বিততাে দেবযানঃ  যেনাক্ৰমন্ত্যষৃয়ো হ্যাপ্তকামা  যত্র তৎ সত্যস্য পরমং নিধানম্ ।। (মুণ্ডক উপনিষদে:০৩. ০১. ০৬) "সত্যেরই জয় হয় , অসত্যের জয় হয় না। দেবযান নামক পথটি সত্যনিষ্ঠাতেই অবিচ্ছিন্নভাবে বিস্তৃত আছে । যেখানে সত্যদ্বারা লভ্য সর্বোত্তম পুরুষার্থরুপে পরমার্থ তত্ব নিহিত রয়েছে। সে পথেই বিষয় তৃষ্ণাবিহীন পূর্ণকাম ঋষিগণ গমন করেন।" জগতে যতই অসত্যের আপাতদৃষ্টিতে আস্ফালন থাকুক না কেন, সত্যই একদিন জয় লাভ করে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, শত বাঁধা সত্ত্বে সত্যই চিরকাল জয় লাভ করেছে এবং করবে । তাই নির্ভীক চিত্তে সত্যের পথে সর্বদা চলতে হবে। এ কথাই বারবার ধ্বনিত হয়েছে বেদ-পুরাণাদি শাস্ত্রগ্রন্থে। যে সত্য এবং শান্তিকে ধরে আছে, সে ভগবানের আশ্রয়ে আছে। বেদাদি শাস্ত্রে সত্যকে স্বয়ং পরমেশ্বর এবং ধর্মের স্বরূপ বলে অভিহিত করে, সেই সত্যস্বরূপ পরমেশ্বরের শরণ নিতে বলা হয়েছে।  সত্যব্রতং সত্যপরং ত্রিসত্যং সত্যস্য যােনিং নিহিতং চ সত্যে। সত্যস্য সত্যমৃতসত্যনেত্রং সত্যাত্মকং ত্বাং শরণং প্রপন্নাঃ।।  (শ্রীমদ্ভাগবত:১০.২.২৬) "হে প্রভু ! আপনি সংকল্প সত্য, সত্যই আপনাকে লাভ করার শ্রেষ্ঠ উপায়। সৃষ্টির পূর্বাবস্থা, প্রলয়ের পরবর্তী সময় এবং সংসারের স্থিতিকাল-এই ত্রিবিধ অসত্য অবস্থার মধ্যেও আপনি সত্যরূপেই বিরাজমান। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম এ পঞ্চভূত নামক দৃশ্যমান সত্যের যোনি তথা অন্তর্যামী কারণরূপে অবস্থিতও আপনিই। আপনি এই দৃশ্যমান জগতের পরমার্থস্বরূপ। মধুর সত্য বাক্য এবং সর্বত্র সমদর্শনের প্রবর্তকও আপনি। হে সত্যস্বরূপ পরমেশ্বর, আপনার শরণ নিলাম।" সত্যকে কখনও চাপিয়ে রাখা যায় না। বহুদিন যদি সত্যকে চাপিয়ে রাখা হয়, তবে একদিন সে অগ্নুৎপাতের গলিত লাভা হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পরে নিজের স্বরূপ দেখিয়ে দেয়। সত্য প্রসঙ্গে রামায়ণে  ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বলেন: উদ্বিজন্তে যথা সর্পান্নরাদনৃতবাদিনঃ। ধর্মঃ সত্যপরো লোকে মূলং সর্বস্য চোচ্যতে।। "সত্যমেবেশ্বরাে লােকে সত্যেধর্মঃ সদাশ্রিতঃ। সত্যমূলানি সর্বানি সত্যান্নাস্তি পরমং পদম্।। ( রামায়ণ: অযোধ্যা, ১০৯.১২-১৩) " সাপ হতে যেমন উদ্বেগ জন্মে, মিথ্যাবাদী ব্যক্তি হতেও তেমনি ভয়ের উৎপত্তি ঘটে।সত্যপরায়ণ ধর্মই সংসারে সকলের মূল। এই সংসারে সত্যই ঈশ্বর, সত্যই ধর্ম, ধর্ম সর্বদা সত্যেই আশ্রিত থাকে। সত্যই জগৎপ্রভৃতি সকল পদার্থের মূল। তাই সত্য থেকে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নেই। " শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ধর্মের প্রথম স্তম্ভই হল সত্য। তাই ধর্ম এবং সত্য অবিচ্ছেদ্যভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। ধর্ম থেকে কখনই সত্যকে পরিত্যাগ করা যায় না।বিপরীতক্রমে সত্যহীন ধর্ম অধর্মে পর্যবসিত হয়। বৈদিক শাস্ত্রে নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী সর্বদা সত্যকে অনুসরণ করে, সর্বদা সত্যের নির্দেশ অনুসারে ধর্মের আচরণ করতে বলা হয়েছে। সত্যের আকর বেদকে সর্বক্ষেত্রে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। তাই সত্যরূপ বেদ অধ্যয়নে অবহেলা করতে সম্পূর্ণভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সত্যাসত্য বিচারেরই মানবের ধর্মাধর্ম নির্ণীত হয়। সেই নির্ণীত ধর্মাধর্মই কর্তব্যকর্মের জ্ঞানোদয় ঘটায়।
সত্যং বদ।ধর্মং চর।স্বাধ্যায়ান্মা প্রমদঃ।
সত্যান্ন প্রমদিতব্যম্।ধর্মান্ন প্রমদিতব্যম্।
কুশলান্ন প্রমদিতব্যম্।ভূত্যৈ ন প্রমদিতব্যম্।।
(তৈত্তিরীয়োপনিষদ্ ১.১১.১)
"সর্বদা সত্যকথা বলবে। ধর্মের আচরণ করবে। বেদ অধ্যয়নে কখনো ও অবহেলা করবে না।সত্য থেকে কখনো বিচ্যুত হবে না।ধর্ম থেকে কখনো বিচ্যুত হবে না। মানুষের কল্যাণকর কাজ থেকে কখনো বিচ্যুত হবে না। আত্মরক্ষা এবং নিজের উন্নতিসাধনে কখনো বিচ্যুত হবে না।"
সত্যকে বারবার চিৎকার করে বলতে হয় না যে আমি সত্য। সত্য, শিব এবং সুন্দর একে অন্যের পরিপূরক। কিন্তু মিথ্যাকে বারবার তার নিজের ঢাক নিজেই বাজিয়ে মানুষকে বিশ্বাস করাতে হয়। কথার চমৎকারিত্বে মানুষকে আকৃষ্ট করতে হয়। বারবার বলতে বলতে মিথ্যা অনেক সময়েই সত্যের মতই শোনায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'কণিকা' কাব্যগ্রন্থে 'সন্দেহের কারণ' কবিতায় রসিকতা করে নকল হীরার আত্মপ্রচার প্রসঙ্গে বলেছেন।নকল হীরাই বারেবারে বলে বেড়ায় দেখ আমি খাটি। পক্ষান্তরে আসল হীরাকে কখনও এমন অপ্রয়োজনীয় আত্মপ্রচারে নামতে হয় না বা তার এ অহেতুক আত্মপ্রচারের প্রয়োজনও নেই। তার নিজের সম্পর্কে তার যথেষ্ট ধারণা আছে।
"কত বড়ো আমি, কহে নকল হীরাটি।
তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি।"
এ নকল হীরার মতই বর্তমানকালে জগতে শান্তির মতবাদ বলে অনেক মতাদর্শ প্রচলিত রয়েছে। শান্তির নামে এরা 'গুলিস্তান মার্কেটিং' করে চলছে। এ গুলিস্তান মার্কেটিং করতে করতে অনেক সময়েই তারা বিষয়টিকে সম্পূর্ণ হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ সকলই বুঝতে পারে, হয়ত মুখ ফুটে বলে না পারিপার্শ্বিকতার কারণে। ঢাকা শহরের গুলিস্তানে অবস্থিত হকাররা রোগ শতভাগ সেরে যাওয়ার প্রচারণা করে বিভিন্ন প্রকারের ঔষধ বিক্রি করে।এ ঔষধগুলো বিক্রির সময়ে সে ঔষধের গুণাবলি যখন তারা বর্ণনা করে তা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে জোরগলায় বলে।কিন্তু কথাগুলো আত্মবিশ্বাসের এবং জোরগলায় বলা হলেও তাদের কথাগুলো অধিকাংশই প্রবঞ্চনাপূর্ণ মিথ্যা। হকারদের মিথ্যা কথাগুলো বলার স্টাইল এবং কথার চমৎকারিত্বে অনেকেই সেই ওষুধ কিনে, পরবর্তীতে সেই ক্রয়কৃত ওষুধ ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ হয়। ছাত্রজীবনে আমরাও চলাফেরায় পথে গুলিস্তানের এই হকারদের গুলিস্তান মার্কেটিং করে বিভিন্ন প্রকারের ঔষধ এবং মলম বিক্রি করতে দেখতাম। দেখতাম অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষিত ছেলেরাও হকারদের কথাগুলো পাশে দাঁড়িয়ে গোগ্রাসে গিলছে। আমরাও জানতাম যে তাদের কথাগুলো সত্য নয়।এরপরেও কথাগুলো শুনতে ভালো লাগতো।কারণ কথাগুলোর মধ্যে অনেক প্রকারের সুরসুরি থাকতো। অবশ্য আমি পছন্দ না করলেও, এই সুরসুরিযুক্ত কথাগুলো অল্প বয়সের অনেক ছেলেমেয়েরাই পছন্দ করতো।তাদের কথাতে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস থাকায়, আমাদের বন্ধুদের দুই-একজন ওষুধগুলো কিনে নিয়ে হলে যেত। পরবর্তীতে সেই বন্ধুদেরই বলতে শুনতাম, "ধ্যাৎ! শুধু শুধুই টাকাটা নষ্ট হল, এই গুলিস্তানি মলম না কিনে টাকাটা গরীব কাউকে দিলে বা কিছু একটা কিনে খেলেও টাকাটা কাজে লাগতো"।গুলিস্তানের ওষুধে এভাবে অধিকাংশই মানুষই প্রতারিত হয় বলে অভিযোগ। সেই হকারদের কথা শুনলে মনে হবে, তারা তাদের এই গুলিস্থানী ওষুধ দিয়ে জগতের সকল রোগই সারাতে পারে। কিন্তু আদতে সেই ওষুধে কোন রোগই সারে না; উল্টো আরও বিভিন্ন প্রকারের পার্শপ্রতিক্রিয়া হয়। এভাবেই মিথ্যার কথার চমৎকারিত্বে দিনশেষে সহজ সরল সাধারণ মানুষ বারেবারেই প্রতারিত হয়।
বর্তমানে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকারের যে শান্তির অনুসারী পাওয়া যায়। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ বাস্তব জীবনে সারা দিনরাত্রি চিৎকার করে নিজেকে শান্তির অনুসারী দাবি করে থাকে। এদের মধ্যে অনেকেই শান্তির দূতের প্রচারণা করে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পুরষ্কার পর্যন্ত পেয়ে যায়। কারণ তারা সংঘবদ্ধ একটি বৈশ্বিক গোষ্ঠী। সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের অবস্থান। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে জগত বর্তমানে একটি খোলা খাতার মত। জগতের সকলেই আন্তর্জালিক (Internet) বেষ্ঠনে জড়িয়ে একে অন্যের আজ কাছাকাছি। কারো চোখকে ফাঁকি দেয়ার আজ সুযোগ নেই। যে কেউ চাইলে যে কোন তথ্য-উপাত্ত জানতে পারে। স্বদিচ্ছা সময় থাকলে গবেষণাও করতে পারে। তাই কে বা কারা শান্তির দূত, আর কে বা কারা অশান্তির দূত তা জগতের কাছে দৃশ্যমান। তাই অহেতুক অপ্রয়োজনীয় "গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল" স্টাইলে নিজেকেই নিজে শান্তিপ্রিয় শান্তির দূত বলে প্রচারণা করার বিষয়টি অত্যন্ত হাস্যকর। এর সামান্যতম প্রয়োজন নেই। বিষয়গুলো নিয়ে সাধারণ মানুষ হয়ত কেউ সচরাচর মুখ খোলে না। তবে এ কথাও ইতিহাস সাক্ষী যে, লোভ, ভয় এবং রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় কোন নৃশংস বা অমানবিক মতবাদকে বেশীদিন রক্ষা করা যায় নি, আর কোনদিন যাবেও না।যেদিন রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে না, সেদিন সেই মতবাদ ভেঙে খানখান হয়ে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে । এ কথা সত্য যে, যদি রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা কোন দার্শনিক মতবাদকে সর্বদা রক্ষা করতে হয়, সেই দার্শনিক মতবাদের মত দুর্বল মতবাদ জগতে আর নেই।পৃথিবীর ইতিহাসে এর অন্যতম উদাহরণ এডলফ হিটলার। তিনি রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে ইহুদিদের প্রতি যে গণহত্যা সংগঠিত করেছেন, তা আজও ঘৃণিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। প্রকৃতি একদিন না একদিন জগতে সংগঠিত সকল অন্যায় মানবতাহীন নৃশংস কর্মেরই প্রতিশোধ নেয়। অনেক সময়েই প্রকৃতির প্রতিশোধ অত্যন্ত ভয়ংকর হয়।
ছদ্মবেশী বিনয়ের অভিনয় মানুষ বেশীক্ষণ করতে পারে না, টাকাপয়সা এবং অন্যান্য সুরসুরিতে আসল স্বরূপ বের হয়ে যায়। তেমনি অসত্য, অশান্তি এবং নৃশংসতা যতই সত্য শান্তির আধুনিক মুখোশ পরে থাকুক না কেন ;তাদের মিথ্যার মুখোশ খুলে যাবেই। এ মুখোশ খুলে গেলে, প্রকৃত যৌনতা মিশ্রিত জল্লাদ স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে গেলে, মানুষের অবদমনে তাদের একমাত্র সম্বলই থাকে শুধুই নৃশংসতা। অথর্ববেদের শৌনকীয় শাখার অন্তর্গত মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে, "সত্যমেব জয়তে"।একমাত্র সত্যই জয়লাভ করে, মিথ্যা নয়। বৈদিক হিরন্ময় এ বাক্যটি ভারতের জাতীয় প্রতীকের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সত্যমেব জয়তে নানৃতং
সত্যেন পন্থা বিততাে দেবযানঃ
যেনাক্ৰমন্ত্যষৃয়ো হ্যাপ্তকামা
যত্র তৎ সত্যস্য পরমং নিধানম্ ।।
(মুণ্ডক উপনিষদে:০৩. ০১. ০৬)
"সত্যেরই জয় হয় , অসত্যের জয় হয় না। দেবযান নামক পথটি সত্যনিষ্ঠাতেই অবিচ্ছিন্নভাবে বিস্তৃত আছে । যেখানে সত্যদ্বারা লভ্য সর্বোত্তম পুরুষার্থরুপে পরমার্থ তত্ব নিহিত রয়েছে। সে পথেই বিষয় তৃষ্ণাবিহীন পূর্ণকাম ঋষিগণ গমন করেন।"
জগতে যতই অসত্যের আপাতদৃষ্টিতে আস্ফালন থাকুক না কেন, সত্যই একদিন জয় লাভ করে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, শত বাঁধা সত্ত্বে সত্যই চিরকাল জয় লাভ করেছে এবং করবে । তাই নির্ভীক চিত্তে সত্যের পথে সর্বদা চলতে হবে। এ কথাই বারবার ধ্বনিত হয়েছে বেদ-পুরাণাদি শাস্ত্রগ্রন্থে। যে সত্য এবং শান্তিকে ধরে আছে, সে ভগবানের আশ্রয়ে আছে। বেদাদি শাস্ত্রে সত্যকে স্বয়ং পরমেশ্বর এবং ধর্মের স্বরূপ বলে অভিহিত করে, সেই সত্যস্বরূপ পরমেশ্বরের শরণ নিতে বলা হয়েছে।
সত্যব্রতং সত্যপরং ত্রিসত্যং
সত্যস্য যােনিং নিহিতং চ সত্যে।
সত্যস্য সত্যমৃতসত্যনেত্রং
সত্যাত্মকং ত্বাং শরণং প্রপন্নাঃ।।
(শ্রীমদ্ভাগবত:১০.২.২৬)
"হে প্রভু ! আপনি সংকল্প সত্য, সত্যই আপনাকে লাভ করার শ্রেষ্ঠ উপায়। সৃষ্টির পূর্বাবস্থা, প্রলয়ের পরবর্তী সময় এবং সংসারের স্থিতিকাল-এই ত্রিবিধ অসত্য অবস্থার মধ্যেও আপনি সত্যরূপেই বিরাজমান। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম এ পঞ্চভূত নামক দৃশ্যমান সত্যের যোনি তথা অন্তর্যামী কারণরূপে অবস্থিতও আপনিই। আপনি এই দৃশ্যমান জগতের পরমার্থস্বরূপ। মধুর সত্য বাক্য এবং সর্বত্র সমদর্শনের প্রবর্তকও আপনি। হে সত্যস্বরূপ পরমেশ্বর, আপনার শরণ নিলাম।"
সত্যকে কখনও চাপিয়ে রাখা যায় না। বহুদিন যদি সত্যকে চাপিয়ে রাখা হয়, তবে একদিন সে অগ্নুৎপাতের গলিত লাভা হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পরে নিজের স্বরূপ দেখিয়ে দেয়। সত্য প্রসঙ্গে রামায়ণে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বলেন:
উদ্বিজন্তে যথা সর্পান্নরাদনৃতবাদিনঃ।
ধর্মঃ সত্যপরো লোকে মূলং সর্বস্য চোচ্যতে।।
"সত্যমেবেশ্বরাে লােকে সত্যেধর্মঃ সদাশ্রিতঃ।
সত্যমূলানি সর্বানি সত্যান্নাস্তি পরমং পদম্।।
( রামায়ণ: অযোধ্যা, ১০৯.১২-১৩)
" সাপ হতে যেমন উদ্বেগ জন্মে, মিথ্যাবাদী ব্যক্তি হতেও তেমনি ভয়ের উৎপত্তি ঘটে।সত্যপরায়ণ ধর্মই সংসারে সকলের মূল।
এই সংসারে সত্যই ঈশ্বর, সত্যই ধর্ম, ধর্ম সর্বদা সত্যেই আশ্রিত থাকে। সত্যই জগৎপ্রভৃতি সকল পদার্থের মূল। তাই সত্য থেকে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নেই। "
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁