জগন্নাথ হল দক্ষিণ ভবনের কিছু টুকরো স্মৃতি:
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে বাবা বলেছিলেন, " তুই যেহেতু আর্টসের ছাত্র, তাই যেখানেই ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করিসনা কেন, তুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হবি।" আমার বাবাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের ছাত্র ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালের ব্যাচ ছিলেন।এ ব্যাচের অধিকাংশ ছাত্রের মত তিনিও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ছোটকাল থেকেই অনেক গল্প শুনেছি তার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের।আমার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কথা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছা এবং বাবার ইচ্ছায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে ২০০২-০৩ সেশনে ভর্তি হই।
ভর্তির কিছুদিন পরেই ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু ছাত্রদের একমাত্র হল জগন্নাথ হলে উঠি। হঠাৎ মনে হল একটা অজানা মানব সমুদ্রে এসে পড়লাম। বয়সে বড় হলেও এলাকার সম্পর্কে ভাগ্নে অমিতাভ দাস নামে মার্কেটিং বিভাগের এক পূর্ব পরিচিত ছাত্রের সহায়তায় ২৬২ নম্বর রুমে উঠি। অমিতাভ দাস ছাড়াও অন্যদুই সিটে আরও দু'জন থাকতেন এক বিকাশ সিংহ রায় নামে যশোরের এক দাদা এবং সাজু দেব রায় নামে জামালপুরের এক দাদা। সাধারণত নতুনরা হলে বা রুমে উঠলে, সিনিয়রদের মনের মাঝে হঠাৎ করে একটু কেমন যেন দাদাগিরি ভাব চলে আসে। এর জন্যে অনেকেই সিনিয়রদের দ্বারা রিগিং অথবা টুকটাক মানসিক হেরাসের স্বীকার হয়। জগন্নাথ হলে তৎকালীন জাহাঙ্গীরনগর বা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত রিগিং না থাকলেও কিছু কিছু বড়ভাইয়ের মধ্যে একআধটু দাদাগিরি ভাব ছিল। কিন্তু দুইএকটা ঘটনা ছাড়া আমি এর স্বীকার হইনি বললেই চলে। এর দুটি কারণ ছিল: এক আমার তখন হাবভাব প্রচণ্ড গুরুগম্ভীর টাইপের ছিল এবং অন্যটি হল আমার রুমের বড়ভাইদের বিশেষ করে বিকাশদার স্নেহ। হয়ত আমার একটু সিনিয়রদের মত গুরুগম্ভীর আচরণের কারণে জুনিয়র হলেও রুমের সিনিয়ররা স্নেহ সূলভ সমীহ করত। এখন অবশ্য সে কথাগুলো মনে পড়লে হাসি আসে। মানুষ মানেই পরিবর্তন অবিসংবাদিত, যত বেশী মানুষের সাথে মিশেছি তত বেশী গুরুগম্ভীর রাশভারী আচরণের বরফটা একটু একটু করে গলে গেছে। নিজেও অনেক পরিবর্তিত হয়েছি।
বিকাশদার মধ্যে একটু 'নার্সিসিজম' ছিল, তিনি নিজেকে অনেক সুন্দর এবং স্মার্ট মনে করতেন। অবশ্য তৎকালীন সময়ে হলের সুন্দর এবং স্মার্টের তালিকায় তিনি ছিলেনও। আমাকে অনেক স্নেহ করতেন, বলতে গেলে একরকম, প্রশ্রয়ই দিতেন।তাই একেবারে জুনিয়র হয়েও আমি যখন বলতাম- রুমে পার্টি দেয়া যাবে না, এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না; তিনি সকল কথাতেই সায় দিতেন। তাই আমার কখনই খুব একটা হেপা পোহাতে হয়নি।শুরু করলাম আমার মত করে রুমকে গুছানো। একদিন আমি বল্লাম রুমের কোন নাম নেই, রুমের একটি নাম দিতে হবে। যেই কথা সেই কাজ, সিনিয়রদের গ্রিন সিগনাল পেয়ে সাথে সাথেই আমি সরস্বতী পূজাতে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের পরিত্যক্ত ককশিট থেকে অক্ষর খুঁজে খুঁজে রুমের "SANATAN" নামটা দিলাম। এ নামটি ২০০৩ সাল থেকে এখনো আছে।
আরেকজন দাদা ছিলেন অমায়িক স্বভাবের সাজুদেব রায়। তিনি সংস্কৃত বিভাগের ছাত্র ছিলেন। আমি যখন রুমে আসি তার মাস্টার্সের রেজাল্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রচণ্ড সরলতা ছিল তার আচরণে। স্মৃতিগুলি এখনও খুব মনে পরে। মণিদি নামে একজনের সাথে তার সম্পর্ক ছিল সাত-আট বছরের। কিন্তু দাদা তাকে সর্বদা আপনি করে বলতেন এবং মণিদির হাত পর্যন্ত কখনও ধরেননি। বিষয়টি নিয়ে তার বন্ধুরা সবাই মজা করত দেখতাম। তিনি ছিলেন ক্লাসিক যুগের প্রেমিকদের মত।তার ভগ্নীপতি অস্ট্রেলিয়া থাকে, তাই তাকে বলেছে ভালো করে ইংরেজি শিখতে। ইংরেজি শিখতে পারলে তবেই তার ভগ্নীপতি তাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাবে। তাই সেই সময়টাতে সে সর্বদা ইংরেজি পড়তেন। এখনো মনে পড়ে তিনি পড়বেন, "উইডো মানে বিধবা, কাফ মানে বাছুর" ইত্যাদি ইত্যাদি ; পড়ার স্টাইলটি ছিল একেবারে বাচ্চাদের মত। বিকাশদা বলতেন, "সাজু বাদ দে, বাড়া! তোকে দিয়ে আর ইংরেজি হবে না।" কোন কিছুই মনে না করে সাজুদা আরও বেশী করে পড়ায় মনযোগ দিতেন। পড়ার ফাঁকে বিকাশদাকে প্রায়ই জাকির হোসাইনের "জীবন তো আমার দুরন্ত ঢেউ, কখনো যে কূল পায়, কখনো যে হারায়।আমাকে নিয়ে, পাবেনা তো কেউ, পাবেনা তো কেউ"- গানটা গাইতে বলতেন। গানটি সম্ভবত তার খুবই প্রিয় ছিল এবং গানের কথাগুলো তার জীবনের সাথে মিল ছিল।অবশ্য শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ভাল করে ইংরেজি শিখে সাজুদা আজ অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।
আমরা রুমে ওঠার কিছুদিনের মধ্যেই প্রথমে অমিতাভ মামা উত্তর ভবনের ১৩৭ নম্বরে চলে গেল; এরপরে সাজুদা হয়ত বুঝলেন হলে তাঁর পড়াশোনা হবে না, তখন তিনি নিজেই বাড়িতেই চলে গেলেন, তার মাস্টার্সের রেজাল্ট হয়ে গিয়েছে তখন। এরপরে ২০০৪ শেষে অথবা ২০০৫ এর শুরুতে বিকাশদা বাইরে বাসা নিয়ে চলে গেলেন। এরপরে রুমে তিনবেডে রইলাম তিনজন। আমি, বিকাশদার এক বন্ধুর মাধ্যমে ওঠে অমিত ঘোষ এবং একরাত্রের জন্যে থাকতে এসে থেকে যায় চট্টগ্রামের শাওন বড়ুয়া। শাওনের যেহেতু থাকার সমস্যা ছিল, তখন আমিই উপযোগী হয়ে সিনিয়রদের বলি শাওনকে থাকতে দিতে ; এভাবেই সে থেকে যায়।
তখন ছাত্রদলের সময়ে হলে অনেক বহিরাগত ছিল, তাই প্রচণ্ড সিটের ক্রাইসিস ছিল। ঠিক সে সময়ে নিউ সেকেন্ড ইয়ারের তিনিটি ছেলে তিনিটি বেডে আছি এটা সে সময়ে একরকম ভাবাই যায় না। অবিশ্বাস্য ছিল বিষয়টি। বিষয়টি যখন বাইরে জানাজানি হল, এরপরে শুরু হল রুমকে রাজনৈতিকভাবে দখলের বিভিন্ন পায়তারা। আমরাও বিশেষ করে আমিও অনড় যে রুমটিকে কোনমতেই রাজনৈতিক রুম হতে দেব না। এরমধ্যে ঘটে কয়েকটি ঘটনা, সদরুদ্দিন নামে একজন শিক্ষক হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে 'বিশ্বসভ্যতা ও ধর্ম' নামে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ বিকৃতমস্তিষ্ক একটি বই লেখে। সারা বইটি হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে হালের জাকির নায়েকের স্টাইলে মিথ্যাচারে ভর্তি। এর প্রতিবাদে হলের সাধারণ ছাত্রদের এক করে একটি আন্দোলন শুরু করি, তখন এ আন্দোলনের কারণেই জগন্নাথ হলে আমার একটা পরিচিতি হয়, হলের সবাই মোটামুটি চিনে যায়।
এ ঘটনার কিছুদিন পরে অক্টোবর ভবনে তিনতলার একটি রুমে সন্ধ্যার সময়ে কয়েকটি ছেলে মদ খাচ্ছিল। রুম খোলা থাকায় আমি আমার পরিচিত একজনকে খুঁজতে গিয়ে সেই রুমে ঢুকে পড়ি। রুমে আমাকে দেখে অকস্মাৎ সেই মদ্যপ ছেলেগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠে। আমি কেন ভেতরে ঢুকলাম, এ কথাগুলো বারবার বলে আমার উপরে প্রচণ্ড চড়াও হয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় আমার সাথে অত্যন্ত খারাপ আচরণ শুরু করে দেয়। অনাকাঙ্ক্ষিত আকস্মিক এ বিষয়টিতে আমি নিজেও হতভম্ব হয়ে যাই। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়ে, আমিও কি করব ভেবে না পেয়ে অক্টোবর ভবন থেকে নেমে যেতে থাকি। নামতে নামতেই দেখলাম আমার গায়ে আঘাত করেছে বলে দলেদলে ছেলে ওই রুমের দিকে যাচ্ছে। এরপরে দেখলাম বিষয়টি এতদূর গিয়েছে যে, সাধারণ ছাত্ররা ওদের গণধোলাই দিচ্ছে। প্রথমে মদ্যপদের অসভ্যতা পরে সাধারণ ছাত্রদের রিয়াকশন, সম্পূর্ণ বিষয়টিতে আমি নিজেই হতচকিত হয়ে যাই। একজনকে দক্ষিণ ভবনের সামনে গণধোলাই দেয়ার সময়ে আমি নিজেই তাকে জড়িয়ে ধরে মারের হাত থেকে বাঁচাই। প্রথম আলো সহ প্রায় সকল পত্রিকায় এটা নিউজ হয়ে যায়। অধিকাংশ পত্রিকাই প্রকৃত ঘটনা বা আমার পক্ষে লেখে, আবার দুইএকটা পত্রিকা আমার বিপক্ষে লিখে আমাকে দলবলসমেত আক্রমণকারী বানিয়ে দেয়। জীবনে প্রথম পত্রিকায় নিউজ হয়ে উপলব্ধি করি, পত্রিকাগুলিতে ছাপানো তথ্যের সত্য-মিথ্যা। প্রভোস্ট অফিসে প্রভোস্ট ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক সহ অন্য হাউস টিউটরদের সামনে ওদের মাফ চেয়ে বিষয়টির ইতি টানা হয়।ঘটনাটা যেহেতু সবার চোখের সামনে ঘটেছে এবং প্রশাসনও বিষয়টির সত্যতা দেখেছে, তাই বিষয়টি নিয়ে কোন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি।
সদরুদ্দিন নামের ব্যক্তির বই নিয়ে আন্দোলনে সময় বিষয়টি নিয়ে হলের উপাসনালয়ে একটি বিশাল সমাবেশ হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা সবাই বক্তব্য রাখে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শ্যামল সরকার দাদার বক্তব্যটি সকলের হৃদয়ে প্রচণ্ড দাগ কাটে, তা আজও মনে আছে। আমার সাথে কথা বলতে রুমে ডিবি পুলিশ সহ অনেকেই আসে। ভয়ে রুমমেটরা আপাতত অন্যরুমে থাকা শুরু করে। কিন্তু আমার কেন যেন তখন কিছু নিয়েই কোন ভয় ছিল না, কিসের একটা সাহস পেতাম সর্বদা। মনে আছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিছুদিন পরেই ছিল দুর্গাপূজা, তৎকালীন শাসকদের মনে ছিল ১৯৯২ সালে ঘটপূজার ঘটনার কথা। তাই তারা পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দকে বিষয়টি দেখতে বল্লেন। অথবা এমন হতে পারে উদযোগী হয়ে পূজা উদযাপনের নেতারাই উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করেছেন যে আমরা বিষয়টি দেখছি বলে।আমাদের নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে দীর্ঘ আলোচনা হয়। জগন্নাথ হলের পক্ষে থেকে আমাদের একটি দাবিনামা দেয়া হয়। এ বলে সতর্কও করা হয় এটা না মানলে আমরা দুর্গাপূজাতে একটা বড় সিদ্ধান্ত নিব। এখনও মনে আছে, পূজা উদযাপন পরিষদের তৎকালীন নেতা জয়ন্ত সেন দীপুদা আমাদের বুঝিয়ে সুজিয়ে তিনিই বিষয়টি দেখার দায়িত্ব নেন। আমরাও ভাবি আমাদের চিন্তা নেই, সিনিয়ররা দেখছে। কিছুদিন পরে দুর্গাপূজার ছুটি চলে আসে এবং আমরাও সকলে যে যার বাড়ি চলে যাই। পূজার বন্ধের পরে হলে আসলে সদরুদ্দিন এবং তার বইয়ের কথা এমনিতেই সবার মাথা থেকে দেখলাম যথারীতি চলে গেছে। আমিও একটু আশাভঙ্গ হলাম।
এই ঘটনাগুলোর পরম্পরায় তৎকালীন ছাত্রদলের নেতারা ভেবে বসে, আমার নিশ্চয়ই অনেক বড় ব্যাকাপ আছে, তা না হলে জুনিয়র হয়েও এত সাহস কেন করছি বা কিভাবে করছি। তখন হলে পান থেকে চুন খসা জাতীয় কিছু হলেই অক্টোবর ভবনের টিভিরুমের সামনে, একটি অনেক বড় খালেদা জিয়ার ছবি আঁকানো ছিল, সেখান বিচার হত। অনেক সময় জুনিয়ররা সিনিয়রদের মারধর অপমানিত করত। নেতাদের মধ্যে তখন একটি কথা রটে গেল যে, আমি তৎকালীন বিনপির প্রতিমন্ত্রী গৌতম চক্রবর্ত্তীর ভাগ্নে বা আত্মীয়। সে আমার মামা বা কিছু একটা হয়। আমাকে তাদের অনেক নেতাই বিষয়টি জিজ্ঞেস করত। যখন তারা এ প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করতেন, তখন আমিও "অশ্বত্থামা হত ইতি গজ" মহাভারতের দেখানো স্টাইলে হ্যাঁ বা না এর মধ্যবর্তী ভাব করতাম। তারাও মনে করত, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। আমি রুমে এসে একা একা হাসতাম। গৌতম চক্রবর্ত্তীর ভাগ্নের পরিচয়ে হোক বা হলে অরাজনৈতিক একটা জনপ্রিয়তার কারণে হোক, অন্যদের বিরক্ত করলেও আমাকে কখনো তৎকালীন হলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিরক্ত করেনি।বরং জয়ন্ত কুণ্ড, তরুণ দে, গৌরাঙ্গ সমদ্দার সহ নেতৃবৃন্দের কাছে সম্প্রদায়ের ইস্যুতে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাদের যথাসাধ্য হেল্প করতে দেখেছি।
আমাদের রুমের অবস্থানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। রুমটি থেকে জগন্নাথ হলে দক্ষিণ গেটের মধ্যে কারা কারা যাতায়াত করছে সকলই দেখা যায়। উত্তর ভবন ছাড়া অন্য সকল ভবনের মানুষের গতিবিধি দেখা যেত। তাই ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেছে রুমটিকে তাদের রাজনৈতিক গণরুমে রুপান্তরিত করতে। দক্ষিণ ভবনের ২৬২ গঠনের অন্য যে রুমগুলো ছিল, তা সকলই রাজনৈতিক রুম হয়ে গেছিল। চেষ্টা করেছি যেন তারা কোনমতেই রুমটিকে দখল করতে না পারে। তৎকালে ঘটা হলের বিভিন্ন ঘটনাবলী আমাকে একটি অরাজনৈতিক জনপ্রিয়তা এনে দেয়। সে সময়ে আমারও ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মানসিকতা আরও বেশী করে চেপে বসে। যখন হলে উঠি তখনই কি মনে করে আমি আমি প্রথম বর্ষের সকলের ঠিকানা এবং মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে রাখি একটি খাতায়। খাতাটি এখনও আছে। বিষয়টি সবার সাথে পরিচিত হতে এবং সম্পর্ক তৈরিতে পরবর্তীতে আমাকে অনেক কাজে দিয়েছিল।
বিকাশদা যখন রুম থেকে চলে যান, হঠাৎই চলে যান। আমিই পরবর্তীতে তার বিভিন্ন জিনিসপত্র গুছিয়ে তার ফ্লাটে দিয়ে আসি। সে জিনিসপত্রের মধ্যে এমন কিছু বিষয় পাই, যা মনে পরলে এখনও আমাকে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। ঠাকুরগাঁওয়ের সোমা নামে এক মেয়ের বিকাশ দাকে লেখা শতশত চিঠি। চিঠিগুলো যেহেতু খোলা ছিল বয়সের কৌতুহলে চিঠিগুলি পড়ি। আমি বিস্মিত হয়ে যাই চিঠির ভাষায়। তাদের প্রজন্মটাই হয়ত ছিল চিঠির শেষ প্রজন্ম। এরপরে মোবাইল আসায়, ফেসবুক আসায় চিঠিকেই আমরা অর্দ্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করে দিয়েছি। আমি ঠিক জানিনা মোবাইলে এবং ফেসবুকে ভাব সম্পূর্ণভাবে ব্যক্ত করা যায় কিনা। বিকাশদার ২৫ তম জন্মদিনে তাকে লেখা একসাথে আবেগি ২৫ টা চিঠি। ঝর্ণার মত স্নিগ্ধ ভাব। এর বিপরীতে বিকাশদার চিঠিগুলি দেখার ইচ্ছা ছিল। যদি ঠিকঠাক দুপক্ষের চিঠিগুলো সংগ্রহ করা যেত তবে এগুলো বাংলা সাহিত্যে পত্র সাহিত্যের অংশ হতে পারে। ভাব, ভাষা এবং ভালবাসাতে টলমল ছিল চিঠিগুলো।
রুম থেকে যখন সিনিয়ররা চলে গেল তখন বয়সে আমাদের মধ্যে সিনিয়র হল অমিত ঘোষ, আমি তাকে মজা করে অমিত (Ghost)গোস্ট নামেই ডাকতাম। অত্যন্ত রসিক প্রেমিকপুরুষ ছিল সে। সে পালি বিভাগে পড়ত এবং বাইরে ঢাকা কলেজে একাউন্টিং নিয়ে পড়ত। এ দুইজায়গায় পড়ার কারণে, তাকে আমরা আরেকটি নাম দেই "ডাবলডেকার"। সে যত টিউশনি করত, তাদের সকলই ছিল মেয়ে। মাত্র সাত থেকে আটটি টিউশনি করত সে। টিউশনি শেষে রাত্রে রুমে এসে সে সব ছাত্রীদের এবং তাদের মা সহ গার্জিয়ানদের বিভিন্ন গল্প করত। প্রাইভেট শিক্ষকের খাবার, এটা নিয়ে যে কত রসাল গল্প থাকতে পারে তা আমি তার থেকেই প্রথম উপলব্ধি করলাম। আমরা বলতাম, এত টিউশনি করছেন আপনি নিজের পড়া পড়বেন কখন? এই ছাত্রীদের গল্প ছাড়া কি আপনার আর গল্প নেই? অমিতদার সরল উত্তর, "ঠাকুর আমি মেয়েদের না বলতে পারিনা।" কি আর করা, আমরাও যখন বুঝলাম সে না বলতে পারেন না, সারাক্ষণ এ গল্পও ছাড়তে পারবেন না; তখন আমরাও হাল ছেড়ে তাকে তার মতই থাকতে দিলাম।
হলের অসংখ্য ঘটনা আছে, যা মনে পড়লে নিজের অজান্তেই হাসি পায়। তেমনি একটি মজার ঘটনা হল, আমাদের বন্ধু সুমন বিশ্বাসকে নিয়ে।সে তার চারুকলার বড়ভাই ভোলাভালা জ্যোতি বিশ্বাসের সাথে মেয়ে সেজে মোবাইলে প্রেম শুরু করে। জ্যোতিদা অত্যন্ত সরলসোজা আবেগপ্রবণ ছিল।আমাকে খুব স্নেহ করত। আমাকে অভেদাত্মা বলে ডাকত, তার ভাষ্যানুসারে আমার আত্মা এবং তার আত্মা নাকি অভেদ। সুমন মেয়েদের কন্ঠে তার সাথে বহুদিন প্রেম করে গেছে, সেও প্রেমের যমুনার হাবুডুবু খেয়েছে। একদিন সুমন আমার সামনেই তার সাথে প্রায় ঘন্টাখানেক রসাল প্রেমালাপ করল। এর মধ্যে অনেক সময়েই পুরুষকণ্ঠ বের হয়ে গেছে, এরপরেও জ্যোতিদা বুঝতে পারে না, যে সে দিনের পর দিন তার চারুকলার এক ছোটভাইয়ের সাথে কথা বলছে। হাসিতে আমার পেট ফেটে যাওয়ার মত অবস্থা। এমনও দেখেছি জ্যোতিদার সামনে কিছু দূরে দাড়িয়ে সুমন তার সাথে মেয়ে কন্ঠে কথা বলেছে। আমি বলতাম দোস্ত বাদ দে, সরল সাদাসিদা লোকটাকে এভাবে নাচাইশ না। পরে অবশ্য জ্যোতিদা তার প্রেমিকা সাজা ছোটভাইকে খুঁজে পেয়েছিল, ফলাফলে রাগ অভিমান যা হওয়ার তা সকলই হয়েছিল।
হলের দক্ষিণ ভবনের ছাদে ওঠার সিঁড়িটি হল বাথরুমের ভেতরে। জানিনা কোন মহান ব্যক্তির মাথা থেকে এমন আইডিয়াটা বের হয়েছে। আমি প্রায় সময়ই ছাদে যেতাম এবং পায়চারি করতাম।ছাদ থেকে সম্পূর্ণ জগন্নাথ হল এবং পার্শ্ববর্তী শিববাড়ি ফুলার রোডসহ অনেক অংশই খুব সুন্দর করে দেখা যেত। একদিন আমি অনেকক্ষণ ছাদে হাটাহাটি করে যেই নামতে যাচ্ছি, ওমনি দেখি নিচে বাথরুমের ভেতরে একজন স্নান করছে। সিঁড়িটা স্বাভাবিক সিঁড়ির মত না চিকন লোহার সিঁড়ি ; প্রথমে দেখতে পাইনি, সিঁড়ির মাঝামাঝি নামার পরে এ দৃশ্যটি দেখে আমি না পারছি উপরে উঠতে, না পারছি নিচে নামতে। পরে কোনমতে নেমেই দৌড় দেই। যে স্নান করছিল, সেও লজ্জায় ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এখনো ঘটনাটি মনে পড়লে নিজের অজান্তেই হাসি পায়।
২৬২ রুমের পাশের রুম ২৬৪ রুমে মনীশ দত্ত বান্টি নামে একটি ছেলে সাপ পুষতো। আদর করে সাপটির নাম দিয়েছিল মুমতাজ। সাপটিকে নিয়ে অনেক মজার ঘটনা আছে। সাপটি অবশ্য বেশী আদর যত্নে পরে মরেই গিয়েছিল। দক্ষিণ ভবনেই থাকত আমাদের বন্ধু ইংরেজি বিভাগের সুকান্ত, নিপাট ভদ্রলোক যাকে বলে। সে খুব সুন্দর করে সংস্কৃতি অপসংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা বুঝাতো সবাইকে। তার হাবভাব ছিল বুদ্ধিজীবী টাইপের। নাম সুকান্ত হওয়ায় তাকে আমরা কবি বলে ডাকতাম। দেশ, দুনিয়া, জাতি নিয়ে তার চিন্তার অন্ত ছিল না। দক্ষিণ ভবনেই ইংরেজি বিভাগের আরেকজন দাদার কথা মনে পড়ে, সে হয়ত আমাদের থেকে একাডেমিক বছর দুইয়ের সিনিয়র হবে। কিন্তু তখনই তার মেয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ত। শিক্ষার যে কোন বয়স নেই এর বাস্তব উদাহরণ সেই দাদা। অধ্যবসায়ের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত সে। তার রুমে তাদের স্বামী স্ত্রীর একটি ছবি সুন্দর করে বড় করে সাজিয়ে রাখা ছিল। ছবির ক্যাপশনে লেখা ছিল, "এ যুগের উত্তম সুচিত্রা।" হয়তো রুমমেটরাই মজা করে লিখেছে।
দক্ষিণ ভবন ছাড়ার আগে গোপালগঞ্জের একটি ছেলের অনাকাঙ্ক্ষিত কাণ্ড আমাকে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। ছেলেটা জগন্নাথ হলের ছাত্র নয়, তার ভাই জগন্নাথ হলের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিল। সে ঢাকা কলেজে পড়ত এবং ভাইয়ের কাছেই থাকত। মাসতুতো বোনের সাথে রিলেশন ছিল। এ সম্পর্ক পরিবার মেনে না নেয়াতে সবাই যখন পূজার ছুটিতে বাড়ি যায়, তখন সে ছাত্রবিহীন হলে পূজার দুইএকদিন আগে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। সকল রুমই যেহেতু বন্ধ, তাই কেউ সাথেসাথে টের পায়নি। পূজার ছুটির পরে যখন সবাই হলে ফিরতে শুরু করে তখন দেখে একটা ভিন্ন ধরণের উৎকট গন্ধ। এর উৎস খুঁজতে যেয়ে দেখা গেল দক্ষিণ ভবনের তিনতলার একেবারে পূর্বদিকের রুমটি ২৮৫ থেকে তীব্রতর গন্ধযুক্ত জলের ধারা সিঁড়ি বেয়ে নিচতলা পর্যন্ত বয়ে যাচ্ছে। পরে হল প্রশাসনের সহায়তায় দরজা ভেঙে ছেলেটির গলিত ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে বহুদিন রুমটি বন্ধ ছিল, অনেক ছাত্র ভয়ও পেয়েছিল সে সময়। সবাই মনে করেছিল, কেউ হয়ত আর কোনদিন রুমটিতে থাকবে না। ককয়েকবছর পরেই দেখা গেল ছাত্ররা থাকা শুরু করলো এবং বিষয়টিকে ভুলেও গেল। বা হয়ত অনেকে ঘটনাটা জানেই না। এটাই বোধহয় প্রকৃতির নিয়ম। এ করুণ ঘটনাটির কথা মনে পড়লে, মনে হয় এখনও বুঝি নাকে সেই গন্ধটা আসছে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ ওঠে,জীবন বোধহয় এমনিই; এর মাঝেই হাসিকান্না নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।
"তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ-
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে॥"
কত ঘটনা হলের জীবনকে ঘিরে। হয়ত সময় পেলে পর্যায়ক্রমে আমাদের সমসাময়িক কিছু কিছু বিষয়ে লিখব। জীবিত এবং সমসাময়িক ব্যক্তিদের নিয়ে লেখা একটা দূরহ কাজ, সম্পর্ক নষ্টের ভয় থাকে। কে কি মনে করবে এর একটা অজানা ভয় থাকে। এ কারণেই মানুষ যখন এ ঘটনাগুলি খেরোখাতায় লেখে, অনেক ভেবেচিন্তে লিখতে হয়। ভেবেচিন্তে লেখার কারণে সত্য ঘটনাগুলি অনেক সময়ই পালিশ করা থাকে।
জীবন বড় কঠিন, হল জীবনে যাদের ছাড়া একদণ্ডও চলত না, আজ প্রসঙ্গক্রমে ছাড়া তাদের কথা মনেও পড়ে না। তাদেরও মনে পড়েনা। যারা বলেছে সারাজীবন দাদা আপনার সাথে থাকতে চাই, তাদের আজ খুঁজেও পাওয়া যায় না। হল থেকে অনেক পেয়েছি, অনেক শিখেছি, জীবনকে উপলব্ধি করতে পেরেছি। হলের প্রায় পাঁচহাজার ছাত্র ছিল, যা সারা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি প্রতিবিম্ব। দেশের প্রত্যকটি উপজেলা থেকেই কেউ না কেউ ছিল। তারা সেই সেই এলাকার স্যাম্পল হিসেবে হলে ছিল। বিষয়টি আমাদের অনেকের মধ্যেই গভীর জীবনবোধ তৈরি করে করেছে। একস্থানে বসেই সারা বাংলাদেশের ভাষা সংস্কৃতির একটা পাঠ পেয়েছি, যার মূল্য অমূল্য। তবে যেখানেই প্রদীপ থাকবে, সেখানে অন্ধকার থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন অনেক ভালবাসা পেয়েছি, শ্রদ্ধা পেয়েছি, আন্তরিকতা পেয়েছি। সংখ্যায় খুবই কম হলেও যুগপৎ পেয়েছি বিশ্বাসহীনতা, প্রবঞ্চনা নিপাট বিশ্বাসঘাতকতা। লাখ টাকা হারালে কষ্ট নেই, কষ্ট হয় মানুষের অকৃতজ্ঞতায়, হীনমন্যতায় বিশ্বাসঘাতকতায় এবং ছদ্মবেশী প্রবঞ্চনায়।
"যেখানেই থাকে সম্ভাবনার প্রদীপ,
দিনশেষে, প্রদীপের নিচেই থাকে
বিশ্বাসঘাতকতার গুদাম।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।