একটু ভালবাসার প্রয়োজন।
এ জগত থেকে চলে যাওয়ার যদি পাঁচটি কারণ থাকে, তবে এ জগতে বেঁচে থাকার পাঁচকোটি কারণ আছে। এ কারণেই উপনিষদে বলা আছে, "হে মানব জীবনকে জয় করে শতবছর বাঁচ।"
দিন এবং রাত্রির মাঝে থাকে কিছু সময় যা দিন না, আবার রাত্রিও না,সে সময়টাকে বলে সন্ধ্যাকাল। এ সন্ধ্যাকাল নিয়ে অনেক কথাই আছে। ছোটবেলায় সন্ধ্যাবেলায় ভুতপ্রেত ঘোরাঘুরি করে বেড়ায়, এ কথা বলে ভয় দেখিয়ে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের আমাদের মায়েরা ঠাকুমারা খেলার মাঠ থেকে ঘরে নিয়ে আসত। বাচ্চাদের ভুতপ্রেত তুলে নিয়ে যাবে, এই ভয়ে আমরাও সুবোধ বালকের মত ঘরে চলে আসতাম। এসে হাতপা ধুয়ে পড়াশোনা করতে বসতাম।
এ সন্ধ্যাকালের মতই মানুষের জীবনে এমন কিছু সন্ধিকাল আছে, যে সময়টা সবসময়ই সুখের হয়না। অনেকে আবার উৎরেও যেতে পারে না সময়টিতে। শিশু থেকে যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হয় তখনও বয়ঃসন্ধি নামে একটি সন্ধিকাল আসে। তখন দেহের হঠাৎ পরিবর্তনের সাথে সাথে একটি মানসিক পরিবর্তনও আসে। স্মৃতিশাস্ত্রে সে সময়ে পিতামাতাকে সন্তানের বন্ধু হয়ে যেতে বলা হয়েছে। অনেক পিতামাতাই সে সময়ে সন্তানকে বুঝতে না পারায়, সন্তান অনেক সময়ই বিভিন্ন অকারণ দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। সেসময় পিতামাতা যদি তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশতে পারত, তবে হয়ত সন্তানের মনজগতের হালচাল কিছুটা বুঝত। ছেলেমেয়েদের সাধ্য না বুঝে গোল্ডেন A+ করতে করতে কত যে হীরের টুকরোরা প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে তার হয়ত সঠিক পরিসংখ্যান কেউ দিতে পারবে না। প্রত্যেক এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশের সপ্তাহেই দেখি অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যার সংবাদ।
শুধু টিনএজ বয়স নয়, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই সন্ধাকালগুলি ভয়ংকর। অনেক বড় লোকেদের জীবনেও দেখা যায়, তারাও এ সময়গুলি ঠিকঠাক পারি দিতে পারেনি। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস মানুষকে যেমন দৃঢ়চেতা করে, তেমনি বিশ্বাসভঙ্গ প্রচণ্ডভাবে মানুষকে হতাশ করে, অসহায় করে। পাহাড়ের চূড়ায় যখন ওঠে একটা আশা থাকে। কিন্তু সামান্যতম এদিক ওদিকে চূড়া থেকে কেউ যখন পাহাড়ের খাদে পরে যায়; তখন মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। জীবনের এ খাদগুলি পারি দেয়া সবার সবসময় সম্ভব হয় না।
মোবাইল বা কম্পিউটারের রিস্টার্টের মত জীবনকেও মাঝে রিস্টার্ট দিতে হয়। একটু বিশ্রাম নিয়ে পেছনফিরে দেখতে হয়। জীবনের রেসে যখন আমরা চলি, তখন ঠিক বুঝতে পারি না। মাঝেমধ্যে রেস থেকে একটু সময় বের করে গ্যালারিতে যেয়ে বসতে হয়। গ্যালারিতে বসলে যেমন রেসের সকল প্রতিযোগীদের কর্মকাণ্ড সুন্দর করে দেখা যায়। তেমনি জীবনের নাট্যমঞ্চে সর্বদা চরিত্র হয়ে না থেকে, গ্যালারিতে দর্শকসাড়িতে বসতে হয়। তখন আশেপাশের চরিত্রগুলি ভাল করে চেনা যায়। পরিস্থিতির সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
জীবনে সম্পর্ক নামক পোঁতা আলপিনগুলি চিরস্থায়ী নয়, তুলে ফেলতেই আলপিনগুলি বারবার পোঁতা হয়। বিষয়টি যাপিত জীবনে কেউ উপলব্ধি করতে পারি, কেউ হয়ত না। সম্পর্কগুলি ক্ষণিকের, এরপরেও আমরা সম্পর্কের জালগুলি তৈরি করি। মনে করি এ সম্পর্কের বন্ধন সারাজীবনের জন্যে। তাই দৃঢ়করে সম্পর্কের রশিগুলি বাঁধি। আমাদের কাণ্ডে বিধাতা হাসেন। বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর, এ বাক্যের মত একদিন সম্পর্কগুলি দুর্বল হয়ে যায়। আমরা তখন হয় মেরামত করি, নতুবা বন্ধন ছিন্ন করি। এটাই জীবন। জগতের নারীপুরুষ এভাবেই মহাকালের এক অজানা পথে প্রতিনিয়ত চলছে।
গাছকে যেমন পরিচর্যা করতে হয়। ঠিক তেমনি সম্পর্কগুলিও পরিচর্যার প্রয়োজন। এ সম্পর্কের সৌখিন গাছগুলিতে ভালবাসার জল দিয়ে সিঞ্চন করতে হয়। তা না হলে গাছটি শুকিয়ে যায়। জীবনেও কিছু ভাললাগার মানুষের সঙ্গ, স্পর্শ এবং ভালবাসা প্রয়োজন। ভালবাসা হয়ত দেখানো যায় না, অনুভব করতে হয়। কিন্তু কিছু ভালবাসা হাতির দাঁতের মত দেখাতে হয়। অবসাদের কোন স্থানকালপাত্র ভেদ নেই। সে সবার ঘারেই চাপতে পারে। যখন তখন সিন্দাবাদের ভুতের মত কাঁধে বসে যেতে পারে। এর থেকে অনেক বড় বড় পণ্ডিত, শিল্পী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, ক্ষমতাবান কেউ বাঁচতে পারেনি। যাদের অবসাদ নামক সন্ধ্যাকালটা সাময়িক, তাদেরটা হয়ত আমরা টের পাইনা। কিন্তু যাদের দীর্ঘসময় অতিক্রম করে, কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে তাদেরটা সবাই টের পেয়ে দৃষ্টান্ত হয়ে যায়।
প্রযুক্তির কল্যাণে জগত আমাদের যতই হাতের মুঠোয় চলে আসছে, আমরা ততই একজন আর একজনের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলি দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সম্পর্ক বলতে আমরা গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ডই বুঝি। বন্ধুত্বের কারো মাঝে হঠাৎ অবসাদ, অন্যমনস্কতা, একটু ভিন্ন অস্বাভাবিক আচরণ, নিঃসঙ্গতা, মাদকগ্রহণের প্রবণতা, কিংবা আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়, তবে তাদের নিয়ে উপহাস করে তাদের দূরে ঠেলে দেয়া নয়। তাদের আরও বেশী ভালবাসা দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতে হবে। নিজের মত নয়, তাদেরকে তাদের মত করে বুঝতে হবে। সাধ্যমত সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা যাদের আছে বা যারা করেছে, একটু লক্ষ্য করলে যেখা যায়; তারা আগে থেকেই ব্যক্তিগত কথাবার্তায় বা ফেসবুকে এ টাইপের নিরাশাজনক হতাশাবাদী বিভিন্ন পোস্ট করেছে। আমরা অনেক বন্ধুরা না বুঝে হয়ত সে পোস্টগুলিতে লাইক দিয়ে এসেছি। ঘুণাক্ষরেও পোস্টদাতার মনের ভূগোলের সামান্যতম পাঠ করার চেষ্টা করেনি, পরে যা হওয়ার তাই হয়েছে। যে আত্মহত্যা করেছে, সে হয়ত একটি নিউজ হয়েছে ; কখনও হয়ত নিউজও হতে পারেনি। আর সরকারের খাতায় হয়েছে গবেষণার স্বার্থে একটি পরিসংখ্যান। কিন্তু যারা পরিজন হারায়, তারা বোঝে এর মর্ম, সারাজীবন কাঁদিয়ে ফেরে তাদের।
এই যে আশেপাশের মানুষেগুলি আত্মহত্যার অন্ধকার পথ বেছে নিচ্ছে এর পিছনে হয়ত কোন আবেগঘন যৌক্তিক কারণ আছে।কিন্তু এর দায় আমরাও এড়িয়ে যেতে পারি না। আমাদের একটু সচেতনতা, একটু সক্রিয়তা, একটু ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়ানোর মানসিকতা পারে আশেপাশের অনেকের জীবনের সন্ধ্যাকালীন ভুতপ্রেতের আক্রমণে সংগঠিত অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করতে।
নাম, যশ, যৌবন, টাকাপয়সা, ক্ষমতা সকলই অসার হয়ে যায় মানসিক অবসাদে উৎপন্ন একাকিত্বে। তাই আসুন সবাই সর্তক হই। সকলে সকলের একটু খোঁজ নেই। যে প্রযুক্তি আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে দূরে ঠেলে দিয়েছে; সেই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেই আমরা একজন অন্যজনের পাশে থাকি, একটু ভালবাসি, সম্ভব হলে বুকে জড়িয়ে ধরি, কারণ ভালবাসার প্রকাশ দেহ।
(সুশান্ত সিং রাজপুতের অনাকাঙ্ক্ষিত আত্মহত্যায় ব্যথিত হয়ে লেখাটি লেখা । গত ছয়মাস ধরে তিনি অবসাদে ভুগছিলেন। তার বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। সাফল্য, অর্থ, শিক্ষা, ফিটনেস, দিল্লির ইঞ্জিনিয়ার থেকে মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তারকা খ্যাতি সকলই করায়ত্ব ছিল তার।সেই তিনিও এভাবে জীবনকে শেষ করে দিলেন! চাইনা, আর কারো জীবন এভাবে ঝরে যাক।)
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।