-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

বেদ শুধু একটি গ্রন্থই নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থাগার ।

বেদ শুধু একটি গ্রন্থই নয়, একটি  পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থাগার । বেদ শব্দটি √বিদ্ ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার উৎপত্তিগত অর্থ জ্ঞান। এ জ্ঞান কোন সাধারণ জ্ঞান নয়; এক অতীন্দ্রিয় অপৌরুষেয় জ্ঞান। ঝর্ণাধারার মত স্নিগ্ধ এ জ্ঞান জীব কল্যাণে নেমে এসেছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। বেদে ঈশ্বর ঘোষণা করেছেন-  অহং বৃক্ষস্য রেরিবা। কীর্তিঃ পৃষ্ঠং গিরেরিব।   (তৈত্তিরীয় উপনিষদ: ১.১০) "আমিই এ জগৎ সংসারের প্রবর্তক। পর্বতশৃঙ্গের মতো সমুন্নত আমার কীর্তি।" ঈশ্বরই এ জগৎ সংসারের প্রবর্তক। তিনি পৃথিবী কিভাবে চলবে তার একটি নির্দেশিকা দিয়েছেন, সে নির্দেশিকাই বেদ। তাইতো ঋষি মনু বলেছেন, "বেদঃ অখিলধর্মমূলম্।"বেদ অখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধর্মের মূল। প্রায় একই কথা ধর্মসূত্রকার ঋষি গৌতমও বলেছেন- "বেদঃ ধর্মমূলম্।" বেদের জ্ঞানকে ঈশ্বরের নি:শ্বাসরূপে অবিহিত করা হয়েছে- অস্য মহতো ভূতস্য নি:শ্বসিতং যদেতদৃগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অর্থবাঙ্গিরসঃ।  (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ০২.০৪.১০) "সেই পরমেশ্বর থেকেই ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ব বেদের উৎপত্তি। স্বয়ংপ্রকাশ এই চতুর্বেদই পরমেশ্বরের নিঃশ্বাসস্বরূপ। " যেমন বায়ুপ্রবাহ বিহীন আমরা এক দণ্ডও বেঁচে থাকতে পারি না। তেমনি ঈশ্বরের নিঃশ্বাসরূপ বেদের জ্ঞানপ্রবাহহীন আমরা চলতে পারব না, আমাদের মানবসভ্যতার জ্ঞানপ্রবাহ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাইতো কল্পে কল্পে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে অনন্ত বেদজ্ঞান প্রবাহের প্রকাশ ঘটান। ঋষয়ো মন্ত্রদ্রষ্টারো ন তু বেদস্য কর্তারঃ। ন কশ্চিদদ্বেদ কর্ত্তা চ বেদস্মর্তা চতুর্ভুজঃ।। যুগান্তে অন্তর্হিতান্ বেদান্ সেতিহাসান্ মহর্ষয়ঃ। লেভিরে তপসা পূর্বমনুজ্ঞাতা স্বয়ম্ভূবা।                                             (মহাভারত: শান্তিপর্ব, ২১০.১৯)  "একমাত্র ভগবান ছাড়া কেউই বেদের স্রষ্টা নয়। বেদদ্রষ্টা ঋষিগণ মন্ত্রদ্রষ্টা মাত্র, বেদের রচনাকারী নন। যুগান্তে প্রলয়কালে ইতিহাস সহ বেদ অপ্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু সৃষ্টির শুরুতে মহর্ষিরা তপস্যার মাধ্যমে স্বয়ম্ভূ পরমেশ্বর থেকে এ জ্ঞানপ্রবাহ পুনরায় লাভ করেন।" অর্থাৎ কল্পে কল্পে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে মানবজাতিকে বেদ জ্ঞান দান করেন। ঋষিদের বলা হয় "সাক্ষাৎকৃতধর্মাণ।" যাঁরা অখিল ধর্মের মূল বেদকে সাক্ষাৎ দর্শন করেছেন, তাই তাঁরা ঋষি। নিরুক্তকার যাস্ক বলেছেন- তদ্ যদেনাংস্তপস্যমানন্ ব্রহ্ম স্বয়ম্ভ্বভ্যানর্ষত্ত ঋষয়ো অভবংস্তদৃষীণামৃষিত্বমিতি বিজ্ঞায়তে।। (নিরুক্ত : ০২.০১.১১.০৬) দর্শন করেন বলেই তাঁদের ঋষি বলা হয়। তপস্যার গভীরে ঋষিদের কাছে স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মবাণী বেদ স্বয়ং আগমন করে এজন্যই তাঁদের ঋষি বলা হয়। ঋষিদের কাছে বেদবাণী ছবির মত ভেসে ওঠে ধ্যানের গভীরে। এ বেদবাণী দর্শনের জন্যই তাঁদের মন্ত্রদ্রষ্টা বলা হয়; মন্ত্রস্রষ্টা নয়। পরাশর সংহিতায় (১.২০) বলা হয়েছে-"ন কশ্চিৎ বেদকর্তাস্তি।"কোন মানুষ বেদের রচয়িতা নয়, স্বয়ং ঈশ্বরই এর রচয়িতা। দ্রষ্টা ঋষিরা অমৃতময় বেদকে শিষ্য পরম্পরায় শ্রুতির মাধ্যমে শিখিয়ে দিতেন। এভাবেই শ্রুতি পরম্পরায় বেদ ধরা ছিল বহুদিন। একারণেই এর অন্য নাম শ্রুতি। শতশত ঋষিদের নিকট থেকে লক্ষাধিক মন্ত্র নিয়ে একসাথে সম্পাদনার মাধ্যমে প্রকাশ করেন শ্রীকৃষ্ণ নামক এক ঋষি। তিনি যমুনা নদীর কূলে এক দ্বীপে জন্মেছেন, তাই তাঁর নামের সাথে এসে যুক্ত হয় দ্বৈপায়ন এবং তিনি বেদকে সম্পাদনা করেছেন তাই তাঁর নামের সাথে একটি উপাধি যুক্ত হয় "বেদব্যাস।" শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। ঋষি পরাশর এবং জেলে কন্যা সত্যবতীর পুত্র। যিনি পৃথিবীতে ‘ব্যাসদেব’ নামেই প্রাতঃস্মরণীয়। ব্যাসদেব চিন্তা করলেন অনন্ত এ বেদজ্ঞান একত্রে গ্রহণ করা মানবের পক্ষে দুঃসাধ্য। তাই তিনি বেদবিদ্যাকে চারভাগে বিভক্ত করে তাঁর প্রধান চার শিষ্যকে দান করলেন। পৈলকে দিলেন ঋগ্বেদ। জৈমিনিকে দিলেন সামবেদ। বৈশম্পায়নকে দিলেন যজুর্বেদ এবং পরিশেষে সুমন্তকে দিলে অথর্ববেদ। ব্যাসদেবের প্রধান এ চার শিষ্য জগতে বেদবিদ্যার প্রচার করেন তাঁদের শিষ্য-প্রশিষ্যের মাধ্যমে। এভাবেই গুরুশিষ্য পরম্পরায় বেদজ্ঞান শত শত শাখায় বিকশিত হয়ে ওঠে এবং জগতে বেদবিদ্যার অমৃতধারাকে দিকে দিকে প্রবাহিত করে তোলে। বেদ কোন একটি গ্রন্থ নয়, অসংখ্য গ্রন্থের সমষ্টি। এ গ্রন্থের সমষ্টি প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত- মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ। বেদের প্রাচীন কল্পসূত্রকার আপস্তম্ব তাঁর যজ্ঞপরিভাষাসূত্রে (১.৩৪) বলেছেন, "মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম্। " অর্থাৎ মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণকে একত্রে বেদ বলে। এ মতকেই সমর্থন করে চতুর্দশ শতাব্দীর বেদভাষ্যকার সায়ণাচার্য তাঁর ঋগ্বেদ ভাষ্যোপক্রমণিকায় বলেছেন-  "মন্ত্রব্রাহ্মণাত্মকঃ শব্দরাশির্বেদঃ।" মন্ত্র অংশকে সংহিতা বলা হয়। সংহিতা অর্থ সংকলন। অর্থাৎ এখানে বিভিন্ন ঋষিদৃষ্ট মন্ত্রগুলো গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে সাজানো থাকে বলে তাকে সংহিতা বলা হয়। সংহিতা অর্থ সংকলন। অর্থাৎ এখানে বিভিন্ন ঋষিদৃষ্ট মন্ত্রগুলো গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে সাজানো থাকে বলে তাকে সংহিতা বলা হয়। ব্রাহ্মণ অংশ দুটি ভাগে বিভক্ত- আরণ্যক এবং উপনিষদ। সুতরাং বেদ বলতে আমরা বুঝি চার প্রকার শাস্ত্রগ্রন্থকে যথা  ১. সংহিতা  ২. ব্রাহ্মণ  ৩.আরণ্যক ও  ৪. উপনিষদ  এদের মধ্যে সংহিতা এবং ব্রাহ্মণকে বলা হয় ক্রিয়া বা কর্মকাণ্ড। যেখানে যাগযজ্ঞ বিভিন্ন প্রকার বিধি ব্যবস্থার কথাই প্রধানত আছে। অবশিষ্ট আরণ্যক এবং উপনিষদকে বলা হয় জ্ঞানকাণ্ড; যেখানে বিভিন্ন প্রকার উপাসনা বিধি এবং অধ্যাত্মবিদ্যাই মূখ্য আলোচনার বস্তু। যার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বেদান্তদর্শন। শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস সম্পাদিত বেদবিদ্যা:  ১।ঋগ্বেদ (ঋষি পৈল) সংহিতা:  ১০২৮টি সূক্ত এবং ১০,৬০০ মন্ত্র বা ঋক্  (অষ্টম মণ্ডলের ৮০টি ঋক্ নিয়ে ১১টি সূক্ত আছে তাদের বালখিল্য সূক্ত বলা হয়; এ সূক্তগুলোর গ্রহণ এবং বর্জনের মাধ্যমে ঋগ্বেদ সংহিতায় সূক্ত এবং মন্ত্রে পার্থক্য হয়)  ব্রাহ্মণ:  ১. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ২. কৌষীতকি বা শাংখ্যায়ন ব্রাহ্মণ আরণ্যক:   ১. ঐতরেয় আরণ্যক ২. কৌষীতকি আরণ্যক বা শাংখ্যায়ন আরণ্যক উপনিষদ:  ১.ঐতরেয় উপনিষদ ২. কৌষীতকি উপনিষদ ২।সামবেদ (ঋষি জৈমিনি) সংহিতা:  ১৮১০ টি মন্ত্র বা সাম।  (এর মধ্যে ৭৫টি ছাড়া সবই ঋগ্বেদের মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি। আবার সামবেদ সংহিতায় একইমন্ত্রের পুনরাবৃত্তি আছে, এ পুনরাবৃত্তিগুলির কারণে মন্ত্র সংখ্যায় পার্থক্য হয়।) ব্রাহ্মণ:  ১. পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ ২. ষড়বিংশ ব্রাহ্মণ ৩. ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ ৪.জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ৫.সামবিধান ব্রাহ্মণ ৬. দেবতাধ্যায় ব্রাহ্মণ ৭. আর্ষের ব্রাহ্মণ ৮.বংশ ব্রাহ্মণ আরণ্যক:  ১. ছান্দোগ্য আরণ্যক উপনিষদ:  ১. ছান্দোগ্য উপনিষদ ২. কেন উপনিষদ ৩।যজুর্বেদ (কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয়) (ঋষি বৈশম্পায়ন)  সংহিতা:   ২১৮৪ টি কণ্ডিকা বা মন্ত্র। ব্রাহ্মণ:   ১. তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ  আরণ্যক:   ১. তৈত্তিরীয় আরণ্যক উপনিষদ:   ১. কঠ উপনিষদ ২.মৈত্রায়ণী উপনিষদ ৩. তৈত্তিরীয় উপনিষদ ৪.মহানারায়ণ উপনিষদ ৫.শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ  ৪।শুক্লযজুর্বেদ বা বাজসনেয়  (ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য) সংহিতা :   ১৯১৫টি কণ্ডিকা বা মন্ত্র ব্রাহ্মণ:   ১. শতপথ বাহ্মণ আরণ্যক:   ১. বৃহদারণ্যক উপনিষদ:   ১. বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২. ঈশ উপনিষদ ৫।অথর্ববেদ (ঋষি সুমন্ত) সংহিতা:   ৫৯৭৭টি মন্ত্র। ব্রাহ্মণ:   ১. গোপথ ব্রাহ্মণ আরণ্যক:  নেই উপনিষদ:   ১. প্রশ্ন উপনিষদ ২. মুণ্ডক উপনিষদ ৩. মাণ্ডুক্য উপনিষদ  শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।  বেদ সংক্রান্ত ধারাবাহিক লেখার দ্বিতীয় পর্বের লিংক।    এখানে ক্লিক করে পড়ুন : ২য় পর্ব :  বেদবিদ্যা-জ্ঞানরাজ্যের তালা খুলতে, বেদাঙ্গরূপ ছয়টি চাবির প্রয়োজন।  এখানে ক্লিক করে পড়ুন :  "শ্রুতিপ্রমাণো ধর্মঃ";  ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে ঋগ্বেদ ।

বেদ শব্দটি √বিদ্ ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার উৎপত্তিগত অর্থ জ্ঞান। এ জ্ঞান কোন সাধারণ জ্ঞান নয়; এক অতীন্দ্রিয় অপৌরুষেয় জ্ঞান। ঝর্ণাধারার মত স্নিগ্ধ এ জ্ঞান জীব কল্যাণে নেমে এসেছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। বেদে ঈশ্বর ঘোষণা করেছেন-

অহং বৃক্ষস্য রেরিবা। কীর্তিঃ পৃষ্ঠং গিরেরিব।  
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ: ১.১০)
"আমিই এ জগৎ সংসারের প্রবর্তক। পর্বতশৃঙ্গের মতো সমুন্নত আমার কীর্তি।"
ঈশ্বরই এ জগৎ সংসারের প্রবর্তক। তিনি পৃথিবী কিভাবে চলবে তার একটি নির্দেশিকা দিয়েছেন, সে নির্দেশিকাই বেদ। তাইতো ঋষি মনু বলেছেন, "বেদঃ অখিলধর্মমূলম্।"বেদ অখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধর্মের মূল। প্রায় একই কথা ধর্মসূত্রকার ঋষি গৌতমও বলেছেন- "বেদঃ ধর্মমূলম্।" বেদের জ্ঞানকে ঈশ্বরের নি:শ্বাসরূপে অবিহিত করা হয়েছে-
অস্য মহতো ভূতস্য নি:শ্বসিতং যদেতদৃগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অর্থবাঙ্গিরসঃ।
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ০২.০৪.১০)
"সেই পরমেশ্বর থেকেই ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ব বেদের উৎপত্তি। স্বয়ংপ্রকাশ এই চতুর্বেদই পরমেশ্বরের নিঃশ্বাসস্বরূপ। "
যেমন বায়ুপ্রবাহ বিহীন আমরা এক দণ্ডও বেঁচে থাকতে পারি না। তেমনি ঈশ্বরের নিঃশ্বাসরূপ বেদের জ্ঞানপ্রবাহহীন আমরা চলতে পারব না, আমাদের মানবসভ্যতার জ্ঞানপ্রবাহ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাইতো কল্পে কল্পে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে অনন্ত বেদজ্ঞান প্রবাহের প্রকাশ ঘটান।
ঋষয়ো মন্ত্রদ্রষ্টারো ন তু বেদস্য কর্তারঃ।
ন কশ্চিদদ্বেদ কর্ত্তা চ বেদস্মর্তা চতুর্ভুজঃ।।
যুগান্তে অন্তর্হিতান্ বেদান্ সেতিহাসান্ মহর্ষয়ঃ।
লেভিরে তপসা পূর্বমনুজ্ঞাতা স্বয়ম্ভূবা।

                                            (মহাভারত: শান্তিপর্ব, ২১০.১৯)

"একমাত্র ভগবান ছাড়া কেউই বেদের স্রষ্টা নয়। বেদদ্রষ্টা ঋষিগণ মন্ত্রদ্রষ্টা মাত্র, বেদের রচনাকারী নন। যুগান্তে প্রলয়কালে ইতিহাস সহ বেদ অপ্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু সৃষ্টির শুরুতে মহর্ষিরা তপস্যার মাধ্যমে স্বয়ম্ভূ পরমেশ্বর থেকে এ জ্ঞানপ্রবাহ পুনরায় লাভ করেন।"
অর্থাৎ কল্পে কল্পে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে মানবজাতিকে বেদ জ্ঞান দান করেন। ঋষিদের বলা হয় "সাক্ষাৎকৃতধর্মাণ।" যাঁরা অখিল ধর্মের মূল বেদকে সাক্ষাৎ দর্শন করেছেন, তাই তাঁরা ঋষি। নিরুক্তকার যাস্ক বলেছেন-
তদ্ যদেনাংস্তপস্যমানন্ ব্রহ্ম স্বয়ম্ভ্বভ্যানর্ষত্ত
ঋষয়ো অভবংস্তদৃষীণামৃষিত্বমিতি বিজ্ঞায়তে।।
(নিরুক্ত : ০২.০১.১১.০৬)
দর্শন করেন বলেই তাঁদের ঋষি বলা হয়। তপস্যার গভীরে ঋষিদের কাছে স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মবাণী বেদ স্বয়ং আগমন করে এজন্যই তাঁদের ঋষি বলা হয়। ঋষিদের কাছে বেদবাণী ছবির মত ভেসে ওঠে ধ্যানের গভীরে। এ বেদবাণী দর্শনের জন্যই তাঁদের মন্ত্রদ্রষ্টা বলা হয়; মন্ত্রস্রষ্টা নয়। পরাশর সংহিতায় (১.২০) বলা হয়েছে-"ন কশ্চিৎ বেদকর্তাস্তি।"কোন মানুষ বেদের রচয়িতা নয়, স্বয়ং ঈশ্বরই এর রচয়িতা। দ্রষ্টা ঋষিরা অমৃতময় বেদকে শিষ্য পরম্পরায় শ্রুতির মাধ্যমে শিখিয়ে দিতেন। এভাবেই শ্রুতি পরম্পরায় বেদ ধরা ছিল বহুদিন। একারণেই এর অন্য নাম শ্রুতি। শতশত ঋষিদের নিকট থেকে লক্ষাধিক মন্ত্র নিয়ে একসাথে সম্পাদনার মাধ্যমে প্রকাশ করেন শ্রীকৃষ্ণ নামক এক ঋষি। তিনি যমুনা নদীর কূলে এক দ্বীপে জন্মেছেন, তাই তাঁর নামের সাথে এসে যুক্ত হয় দ্বৈপায়ন এবং তিনি বেদকে সম্পাদনা করেছেন তাই তাঁর নামের সাথে একটি উপাধি যুক্ত হয় "বেদব্যাস।" শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। ঋষি পরাশর এবং জেলে কন্যা সত্যবতীর পুত্র। যিনি পৃথিবীতে ‘ব্যাসদেব’ নামেই প্রাতঃস্মরণীয়।
ব্যাসদেব চিন্তা করলেন অনন্ত এ বেদজ্ঞান একত্রে গ্রহণ করা মানবের পক্ষে দুঃসাধ্য। তাই তিনি বেদবিদ্যাকে চারভাগে বিভক্ত করে তাঁর প্রধান চার শিষ্যকে দান করলেন। পৈলকে দিলেন ঋগ্বেদ। জৈমিনিকে দিলেন সামবেদ। বৈশম্পায়নকে দিলেন যজুর্বেদ এবং পরিশেষে সুমন্তকে দিলে অথর্ববেদ। ব্যাসদেবের প্রধান এ চার শিষ্য জগতে বেদবিদ্যার প্রচার করেন তাঁদের শিষ্য-প্রশিষ্যের মাধ্যমে। এভাবেই গুরুশিষ্য পরম্পরায় বেদজ্ঞান শত শত শাখায় বিকশিত হয়ে ওঠে এবং জগতে বেদবিদ্যার অমৃতধারাকে দিকে দিকে প্রবাহিত করে তোলে।
বেদ কোন একটি গ্রন্থ নয়, অসংখ্য গ্রন্থের সমষ্টি। এ গ্রন্থের সমষ্টি প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত- মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ। বেদের প্রাচীন কল্পসূত্রকার আপস্তম্ব তাঁর যজ্ঞপরিভাষাসূত্রে (১.৩৪) বলেছেন, "মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম্। "
অর্থাৎ মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণকে একত্রে বেদ বলে। এ মতকেই সমর্থন করে চতুর্দশ শতাব্দীর বেদভাষ্যকার সায়ণাচার্য তাঁর ঋগ্বেদ ভাষ্যোপক্রমণিকায় বলেছেন-
"মন্ত্রব্রাহ্মণাত্মকঃ শব্দরাশির্বেদঃ।"
মন্ত্র অংশকে সংহিতা বলা হয়। সংহিতা অর্থ সংকলন। অর্থাৎ এখানে বিভিন্ন ঋষিদৃষ্ট মন্ত্রগুলো গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে সাজানো থাকে বলে তাকে সংহিতা বলা হয়। সংহিতা অর্থ সংকলন। অর্থাৎ এখানে বিভিন্ন ঋষিদৃষ্ট মন্ত্রগুলো গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে সাজানো থাকে বলে তাকে সংহিতা বলা হয়। ব্রাহ্মণ অংশ দুটি ভাগে বিভক্ত- আরণ্যক এবং উপনিষদ। সুতরাং বেদ বলতে আমরা বুঝি চার প্রকার শাস্ত্রগ্রন্থকে যথা
১. সংহিতা
২. ব্রাহ্মণ
৩.আরণ্যক ও
৪. উপনিষদ
এদের মধ্যে সংহিতা এবং ব্রাহ্মণকে বলা হয় ক্রিয়া বা কর্মকাণ্ড। যেখানে যাগযজ্ঞ বিভিন্ন প্রকার বিধি ব্যবস্থার কথাই প্রধানত আছে। অবশিষ্ট আরণ্যক এবং উপনিষদকে বলা হয় জ্ঞানকাণ্ড; যেখানে বিভিন্ন প্রকার উপাসনা বিধি এবং অধ্যাত্মবিদ্যাই মূখ্য আলোচনার বস্তু। যার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বেদান্তদর্শন।
শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস সম্পাদিত বেদবিদ্যা:

১।ঋগ্বেদ
(ঋষি পৈল)
সংহিতা:
১০২৮টি সূক্ত এবং ১০,৬০০ মন্ত্র বা ঋক্

(অষ্টম মণ্ডলের ৮০টি ঋক্ নিয়ে ১১টি সূক্ত আছে তাদের বালখিল্য সূক্ত বলা হয়; এ সূক্তগুলোর গ্রহণ এবং বর্জনের মাধ্যমে ঋগ্বেদ সংহিতায় সূক্ত এবং মন্ত্রে পার্থক্য হয়)
ব্রাহ্মণ:
১. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ
২. কৌষীতকি বা শাংখ্যায়ন ব্রাহ্মণ
আরণ্যক:  
১. ঐতরেয় আরণ্যক
২. কৌষীতকি আরণ্যক বা শাংখ্যায়ন আরণ্যক
উপনিষদ:
১.ঐতরেয় উপনিষদ
২. কৌষীতকি উপনিষদ
২।সামবেদ
(ঋষি জৈমিনি)
সংহিতা:
১৮১০ টি মন্ত্র বা সাম।
(এর মধ্যে ৭৫টি ছাড়া সবই ঋগ্বেদের মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি। আবার সামবেদ সংহিতায় একইমন্ত্রের পুনরাবৃত্তি আছে, এ পুনরাবৃত্তিগুলির কারণে মন্ত্র সংখ্যায় পার্থক্য হয়।)
ব্রাহ্মণ:
১. পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ
২. ষড়বিংশ ব্রাহ্মণ
৩. ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ
৪.জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ
৫.সামবিধান ব্রাহ্মণ
৬. দেবতাধ্যায় ব্রাহ্মণ
৭. আর্ষের ব্রাহ্মণ
৮.বংশ ব্রাহ্মণ
আরণ্যক:
১. ছান্দোগ্য আরণ্যক
উপনিষদ:
১. ছান্দোগ্য উপনিষদ
২. কেন উপনিষদ
৩।যজুর্বেদ (কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয়)
(ঋষি বৈশম্পায়ন) 
সংহিতা:  
২১৮৪ টি কণ্ডিকা বা মন্ত্র।
ব্রাহ্মণ:  
১. তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ 
আরণ্যক:  
১. তৈত্তিরীয় আরণ্যক
উপনিষদ:  
১. কঠ উপনিষদ
২.মৈত্রায়ণী উপনিষদ
৩. তৈত্তিরীয় উপনিষদ
৪.মহানারায়ণ উপনিষদ
৫.শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ 
৪।শুক্লযজুর্বেদ বা বাজসনেয়
(ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য)
সংহিতা :  
১৯১৫টি কণ্ডিকা বা মন্ত্র
ব্রাহ্মণ:  
১. শতপথ বাহ্মণ
আরণ্যক:  
১. বৃহদারণ্যক
উপনিষদ:  
১. বৃহদারণ্যক উপনিষদ
২. ঈশ উপনিষদ
৫।অথর্ববেদ
(ঋষি সুমন্ত)
সংহিতা:  
৫৯৭৭টি মন্ত্র।
ব্রাহ্মণ:  
১. গোপথ ব্রাহ্মণ
আরণ্যক: নেই
উপনিষদ:  
১. প্রশ্ন উপনিষদ
২. মুণ্ডক উপনিষদ
৩. মাণ্ডুক্য উপনিষদ

সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।

বেদ সংক্রান্ত ধারাবাহিক লেখার দ্বিতীয় পর্বের লিংক।   
এখানে ক্লিক করে পড়ুন :

মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁