-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি, এখানে থেম না (৪ নং সেক্টর কমান্ডার চিত্তরঞ্জন দত্ত)।

ও আলোর পথযাত্রী,  এ যে রাত্রি, এখানে থেম না।
মুক্তিযুদ্ধের ৪ নং সেক্টর কমান্ডার চিত্তরঞ্জন দত্ত, যিনি সংক্ষেপে আমাদের কাছে সি আর দত্ত নামেই পরিচিত তিনি আজ মৃত্যুবরণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরোত্তম সম্মানে ভূষিত করে। সি আর দত্ত সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধকালীন ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্তরঞ্জন দত্ত বীর উত্তম বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ২৫ আগস্ট মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯ টায় আমেরিকার ফ্লোরিডায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি আমেরিকার ফ্লোরিডার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সভাপতি হিসেবে আছেন মেজর জেনারেল চিত্তরঞ্জন দত্ত। তার জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মেঘালয়ের শিলংয়ে। বাবার পুলিশের বদলির চাকরির সূত্রে শিশুকালটা তার শিলংয়েই কাটে । পাঁচ ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বোনেরা ছিল তার বড়। বাল্যকালে তার ডাকনাম ছিল রাখাল। ছোটবেলায় ভাল ফুটবলার ছিলেন তিনি; খেলোয়াড় হিসেবে মোহনবাগান দলেও খেলেছেন। বাবা উপেন্দ্রচন্দ্র দত্ত ছিলেন ভীষণ কড়া পুলিশ অফিসার।মা লাবণ্যপ্রভা দত্ত ছিলেন গৃহিণী। তার পৈতৃক ভিটা ছিল হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানার মিরাশি গ্রামে । ঠাকুরদা ছিলেন চুনারুঘাট এলাকার এক খ্যাতিমান জমিদার। দত্তবাড়ির জমিতে তার ঠাকুরদার প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল এখনও আছে। শিলং থেকে এসে ভর্তি হন, হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে। ১৯৪৩ সালে এ স্কুল থেকেই তিনি ম্যাট্রিক (SSC) পাশ করেন। এরপর ইন্টারমিডিয়েট (HSC) পড়তে কলকাতার আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন। অবশ্য সেখানে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। পরে এসে ভর্তি হন খুলনার দৌলতপুরে অবস্থিত ব্রজলাল কলেজে। কলেজের হোস্টেলেই থাকতেন। এ ব্রজলাল কলেজ থেকেই পর্যায়ক্রমে আইএসসি ও বিএসসি পাস করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত দূরদর্শী সেক্টর কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ৪নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য তিনি 'বীর উত্তম' খেতাবে ভূষিত হন। তার মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ভূমিকাও বলে শেষ করার মত না। তিনি ১৯৭২ সালে রংপুরে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হয়ে সেখানে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন৷ ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকার৷ এই বিষয়ে তাকে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ সরকার৷ পরবর্তীকালে তিনি সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠন করেন এবং নাম দেন বাংলাদেশ রাইফেলস। বর্তমানে এ বাহিনীর নাম হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। চিত্তরঞ্জন দত্ত ছিলেন 'বাংলাদেশ রাইফেলসের' প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল। এছাড়া ১৯৭১-এর পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭৭ সালে 'মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট' এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন৷ ১৯৭৯ সালে 'বি আর টি সি' এর চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন৷
১৯৮৪ সালে তিনি বাধ্য হয়ে অবসর গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক পালাবদলে সেইসময়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত শক্তি অনেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারা প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে ভেতরে তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে।তখন কোন কারণ ছাড়াই, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরি, কোকা-কোলার মত লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করে দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করে। রাজনৈতিক ক্ষমতাশীল অনেক ধনী ব্যবসায়ীরা সে প্রতিষ্ঠানগুলো কিনতে বিভিন্ন চেষ্টা-তদবির শুরু করে। তবে মেজর জেনারেল চিত্তরঞ্জন দত্ত সে প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রিতে ঘোরতর বিরোধিতা করেন ; কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। বিষয়টি নিয়ে সরকারের সাথে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। ফলশ্রুতিতে এরশাদ সরকারের সময়ে আইনবহির্ভূতভাবে এলপিআর ছাড়াই তাকে অবসর নিতে হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি হিন্দু অফিসার। পাক-ভারত যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। ১৯৮৮ সালের ৯ জুন সামরিক শাসক এরশাদ সরকার বাংলাদেশের সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে। এ ঘটনাটি ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার মূলে এক ভয়াবহ কুঠারাঘাত। আওয়ামী লীগ, বিএনপি সহ তৎকালীন সকল বিরোধী দল সহ দেশের অধিকাংশ মানুষই এই রাষ্ট্রধর্মের ঘোষণার বিরোধিতা করেছিল। ১৯৮৮ সালের ৯ জুনকে কাল দিবস ঘোষণা করে, সেদিনই ঐক্য পরিষদ গঠিত হয়। কিন্তু সাংগঠনিক আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয় কিছু দিন পরে।বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষা করতে প্রতিষ্ঠিত হয় অরাজনৈতিক এ সংগঠনটি। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল চিত্ত রঞ্জন দত্তের নেতৃত্বেই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি একটি বটবৃক্ষের মত ছিলেন বলেই, তিনি সফলভাবে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। এক্ষেত্রে তার সামরিক ব্যাকগ্রাউন্ড তাকে সহয়তা করেছিল।এ ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে তাকে খুব একটা কেউ ঘাটাতে আসেনি।
১৯৮৮ সালের ৯ জুন, সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির কাউন্সিলে মেজর জেনারেল সি.আর দত্তকে সভাপতি ও এড. রানা দাশগুপ্তকে সাধারণ সম্পাদক পদে পুনরায় নির্বাচিত করা হয়। মেজর জেনারেল সি আর দত্ত হলেন বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি অসহায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রধান মুখ। তাই এ মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সকল সংখ্যালঘু মানুষ। কালের কণ্ঠ পত্রিকার ওমর শাহেদ ও আবু রায়হান রাসেল ২০১৬ সালের ১৫ ও ২৯ নভেম্বর এক সাক্ষাৎকার নেন মেজর জেনারেল সি আর দত্তের ঢাকার বাসভবনে। সেই সাক্ষাৎকারেই তিনি খোলামেলাভাবে বলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ সংগঠনটির তৈরির প্রেক্ষাপট এবং দেশে মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে শক্তিশালী করতে সংগঠনটির প্রয়োজনীয়তা।
চিত্তরঞ্জন দত্ত সস্ত্রীক
"আমি মুক্তিযুদ্ধ করে এই দেশকে স্বাধীন করেছি। কখনোই ভাবিনি, আমাকে এ দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য লড়াই করতে হবে। কারণ আমি বাঙালিত্বের চেতনায় বিশ্বাস করি। তবে ১৯৮৮ সালের ২০ মে যখন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার বিল পার্লামেন্টে উঠল, দেশ পাকিস্তানি ধারায় প্রত্যাবর্তন করল, তখন কিন্তু সমসাময়িক অফিসার-অধীনস্থদের বলেছি, বাংলাদেশকে ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। এখনো এটিই বলি—এই আমার বিশ্বাস। যখন বিলটি পার্লামেন্টে গেল, বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য, আমি, বিচারপতি রণধীর সেন, কে বি রায় চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সুধাংশু শেখর হালদার, নির্মল সেন প্রমুখ সংখ্যালঘু নেতৃস্থানীয় ভাবলাম, সংবিধানকে আজ শুধু সাম্প্রদায়িকীকরণই করা হয়নি, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার মাধ্যমে দেশ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের দিকেও চলে যাচ্ছে। আড়াই কোটি মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি, সেটি থেকে দেশ সরে যাচ্ছে। এ ঘটনার বছরখানেক পর পরিষদের জাতীয় সম্মেলন হলো। সেখানে বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের কাছ থেকে ঐক্য পরিষদের লড়াইয়ের মূল দায়িত্বটি গ্রহণ করলাম।
তখন এরশাদ বলতেন, স্বাধীন বঙ্গভূমির আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই গুজব তৈরি করে নানা জায়গা থেকে প্রায় ১৩০ জনকে গ্রেফতার করা হলো। যশোর পৌরসভার তখনকার চেয়ারম্যানকেও গ্রেফতার করা হলো। এর প্রতিবাদে ঢাকায় ঐক্য পরিষদের এক মিটিংয়ে পরিষ্কার বলেছি, স্বাধীন বঙ্গভূমির জন্য আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করিনি। এরপর আস্তে আস্তে এটি কেবল জাতীয় সংগঠনেই পরিণত হয়নি, আন্তর্জাতিক সংগঠনের রূপ পেয়েছে। প্রতিটি থানা ও জেলায় গিয়ে আমি একে বিস্তৃত করেছি। সেখানকার অনেককে নেতৃত্বে এনেছি। যখন যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ হয়েছে, আমরা পাশে দাঁড়িয়েছি। সেসব জায়গার ডিসি-এসপিকে বলে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি। নিজে গিয়েছি। মেয়েদের সংঘটিত করার জন্য নারী শাখা প্রতিষ্ঠা করেছি।"
("বাংলাদেশকে ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি",কালের কণ্ঠ, ২৫.৮.২০২০)
মৃত্যুর পূর্বে নব্বই ঊর্ধ্ব কৃতিমান ব্যক্তি সি আর দত্ত আজ বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে গেলেও সাংগঠনিক দায়িত্ব পরিত্যাগ করেননি। শেষদিকে চলাফেরাতে কষ্ট হত তার। কথাও অস্পষ্ট, ঠিকমত সকল কথা বোঝা যেত না।এমনকি স্মৃতিশক্তিও দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। এরপরেও বর্তমান বাস্তবতায় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থায় অসুস্থতাজনিত, বার্ধক্যজনিত প্রপঞ্চ নিয়েও তিনি সাধ্যমত আমৃত্যু কাণ্ডারী হয়ে সবাইকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছেন।
আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তখন তার অনেক বক্তব্যই ঢাকেশ্বরী মন্দির সহ বিভিন্ন স্থানে শুনেছি। তখন সে কথাগুলো ঠিকমত বুঝতে না পারলেও, এখন বুঝতে পারি কথাগুলোর মর্মার্থ। তখন ছিল বিএনপি জোট সরকারের শাসনামল। ২০০১ সালের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘা তখনও দগদগে। এ নির্মম অত্যাচারের বিষয়গুলো নিয়ে গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া, কেউ কথা বলতে সাহস পেত না। আমার এখনও মনে পরে তার বিভিন্ন সাহসী অকুতোভয় বক্তব্য, পুতুল ভাবিকে উদ্দেশ্য করে। সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যৎ এমন হওয়ার কথা ছিল না, এরজন্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি -এ বিষয়গুলোই উঠে আসত বিভিন্ন বক্তব্যে। তখন জানতাম না যে, তার বক্তব্যের এ পুতুল ভাবিটা কে? পরে জানতে পেরেছি বেগম খালেদা জিয়ার ডাকনাম হল পুতুল। জিয়াউর রহমান যেহেতু তার সহকর্মী ছিলেন, তাই তার স্ত্রীকে তিনি পুতুল ভাবি বলতেন। দেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ে করণীয় বর্জনীয় প্রসঙ্গে, ২০০৩-০৪ সালের বিভিন্ন সভায় সুস্পষ্ট দিকনির্দেশক সেই কথাগুলো এখনোও আমার মনে দাগ কেটে আছে।বক্তব্যের অধিকাংশ কথাই মনে আছে।মেঘের মত গমগমে ছিল তার কণ্ঠ। বক্তব্যের ধ্বনিগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে মানুষের অন্তঃস্থিত সত্ত্বাকে নাড়িয়ে উদ্দীপ্ত করে দিত।
এ স্পষ্টবাদী সত্য বক্তব্যের জন্যে বিভিন্ন সময়ে তাকে মেরে ফেলার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।১৯৮৮ সালে ঐক্য পরিষদের সভাপতি হিসেবে কনফারেন্স করার এক সপ্তাহের মধ্যেই, পহেলা বৈশাখ বাংলা একাডেমির সামনে, তিন নেতার মাজারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে তার গাড়িকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। আক্রমণকারীদের লক্ষ্য ছিল, তাকে মেরে ফেলা। মাথা নিচু করে ফেলাতে গায়ে বন্ধুকের গুলি না লাগলেও, গাড়ির কাচ ভেঙে অসংখ্য ভাঙা কাচের টুকরা ঢুকে যায় তার শরীরে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে অস্ত্রোপচার করে সেই কাচের টুকরাগুলো পরে বের করা হয়। এ ঘটনার পরবর্তীকালে তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য জগন্নাথ কলেজের দুজন ছাত্র সর্বদা তার সঙ্গে থাকত। সেই দুজন ছাত্র খাবার নিজেরা আগে খেয়ে, খাবারটি বিষমুক্ত কিনা তা নিশ্চিত হয়ে; পরে মেজর জেনারেল দত্তকে খেতে দিত।
আজ মেজর জেনারেল সি আর দত্ত আমাদের মাঝে নেই ; আজ তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। বড় অসময়ে অধিকাংশ অসমাপ্ত কাজ উত্তরসূরিদের উপরে অর্পণ করে তিনি চলে গেলেন। এখন তার সেই গুরুদায়িত্ব আমাদের সকলকেই বহন করে নিতে হবে। তার মৃত্যুতে আমার সলীল চৌধুরীর একটি গানের কথাই বারবার মনে হচ্ছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ের তিনি এক মহান আলোর পথযাত্রী ছিলেন। এ আলোর প্রেরণার মশাল গন্তব্যে পৌছানোর আগে পর্যন্ত সদা অনির্বাণ থাকবে।
"ও আলোর পথযাত্রী,এ যে রাত্রি, এখানে থেম না
এ বালুরচরে আশার তরণী তোমার যেন বেঁধো না,
আমি শ্রান্ত যে, তবু হাল ধর
আমি রিক্ত যে, সেই সান্তনা,
তব ছিন্ন পালে জয় পতাকা তুলে,
তূর্য তোরণ দাও হানা।
আহা বুক ভেঙ্গে ভেঙ্গে,পথে থেমে শোণিত কণা।
কত যুগ ধরে ধরে, করেছে তারা সূর্য রচনা।
আর কত দূর, ওই মোহনা,
এ যে কুয়াশা, এ যে ছলনা
এই বঞ্চনাকে পার হলেই পাবে,
জনসমুদ্রের ঠিকানা।"
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদানকে স্মরণে নিয়ে ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি 'বীরউত্তম সি আর দত্ত' সড়ক নামে নামকরণ করে তাকে সম্মান জানায়।এমন একটি সময়ে মৃত্যুবরণ করলেন, যখন তাকে এদেশের সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। আজ সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার্থে দেশে নেই কোন সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়, তাদের সুরক্ষার জন্যে নেই কোন সংখ্যালঘু কমিশন। অবহেলিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে নেই কোন কোটা সহ বিশেষ সুযোগ সুবিধা।
ব্যক্তিগতভাবে হয়ত মেজর জেনারেল সি আর দত্তের বা তার সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের হয়ত অনেক ব্যর্থতা আছে। অনেকে বিভিন্ন সময়ে এ সংগঠনের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ অসন্তোষের অন্যতম কারণ, এ সংগঠনের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা প্রচুর। ব্যর্থতা থাকার পরেও আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের সংখ্যালঘুদের ভাগ্য পরিবর্তনের চাবিকাঠি এখনও এ সংগঠনের হাতে। অন্যান্য সংগঠনগুলো এখনো পর্যন্ত সে স্থানটি নিতে পারেনি। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় লুকানো মৌলবাদী গোষ্ঠীদের মোকাবেলা করার সামর্থ্য অন্যান্য সংখ্যালঘু সংগঠনের এখনো পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি। তবে অনলাইন প্রচারণার ব্যর্থতা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সংগঠনটিকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। এরপরেও যখন এদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সংখ্যালঘুদের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস লেখা হবে, সে ইতিহাসে অনেকটাই জুড়ে থাকবে ঐক্য পরিষদ; জ্বাজ্জল্যমান নক্ষত্র হয়ে সদা আলো ছড়াবে মেজর জেনারেল সি আর দত্ত এবং তার অবিনশ্বর কীর্তি।
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁