মুখে হয়ত অসাম্প্রদায়িকতার পরমতসহিষ্ণুতার অনেক বড় বড় লেকচার দিলেও, আমরা অনেকেই দেখি বা জানি দেশ কোন দিকে এগোচ্ছে । আপনি যদি দেশের এক বড় অংশের মানসিকতা দেখতে চান, আপনাকে বেশীদূর যেতে হবে না ; শুধু যেকোন হিন্দু এবং ভারতের সাথে সংস্পর্শ আছে এমন কোন নিউজের নিচে শুধু কমেন্টগুলি দেখবেন। অন্যকে আর বোঝাতে হবে না, নিজেই বুঝে যাবেন দেশ কোন অজানা তেঁতুলতলার দিকে যাচ্ছে। শুধু হিন্দু না, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মুক্তবুদ্ধির চর্চা যারা করেছেন, যারা জাতির বিবেক বলে খ্যাত, সেই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার, শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানি দেশের এ কৃতি সন্তানদের মৃত্যুর নিউজে জাতীয় দৈনিক পত্রিকার অনলাইন নিউজ ফিডের নিচে কমেন্ট দেখে আমাদের আৎকে উঠতে হয়।অজানা একটা ভয় কাজ করে। চারিপাশকে অপরিচিত মনে হয়।খ্যাতিমান শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার করোনা আক্রান্তের নিউজের নিচে, কিছু মানুষ নামধারী দু'পেয়ে জন্তুর বিকৃত আনন্দ উল্লাসে আমাদের ভাষা হারিয়ে যায়। বন্যা ম্যাডামের অপরাধ, সে কেন সংস্কৃতি চর্চা করে? রবীন্দ্র সংগীত চর্চা করে? এবং কপালে কেন লাল টিপ দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিছুদিন আগে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (BUET)-এর উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান, তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার। উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পাবার আগে তিনি ছিলেন ইইই বিভাগীয় প্রধান, ইইই অনুষদের ডিন, একাধিক হলের প্রভোষ্ট এবং বুয়েট ছাত্র কল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক। এছাড়াও তিনি সার্ক ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স-এর টেলিযোগাযোগ খাতের উন্নয়ন পরামর্শদাতা হিসাবে এবং ডিপিডিসি এবং বিটিসিএল-এর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য । অধ্যাপক সত্য প্রসাদ ১০০ টিরও বেশি এম. এসসি ইঞ্জিনিয়ারিং থিসিস এবং ৬টি পিএইচ. ডি গবেষণাগার তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০ টিরও অধিক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণামূলক প্রবন্ধ, রেফার্ড জার্নালস এবং কনফারেন্স প্রসিডিংস প্রকাশ করেছেন।
ড. সত্য প্রসাদ মজুমদারের একাডেমিক ক্যারিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান স্যার; জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ স্যার; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান স্যার সহ দেশের প্রায় অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের থেকেই সম্ভবত বেশী। কিন্তু এরপরেও বিধি বাম, কারণ তিনি এদেশে সংখ্যালঘু। যোগ্যতা থাকার পরেও নিউজ ফিডে নিকৃষ্টতর কমেন্ট করা ব্যক্তিদের মতে, তার অপরাধ সে হিন্দু, সে মালাউন, সে কাফের, সে ভারতের দালাল, সে জঙ্গি ইস্কনের সদস্য ইত্যাদি ইত্যাদি বহুকিছুই। ভয় ডয়ের কিছুই নেই, চামড়ার মুখ দিয়ে শুধু সংখ্যালঘু হিন্দুদের নামে যা কিছুই বলেন না কেন; এতে শুধু হিন্দুরা ছাড়া কারোই খুব একটা কিছুই যায় আসে না। যদি সত্যি কারো আসতো যেত, তাহলে প্রশাসন চাইলেই তাদের ধরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারত। বর্তমানে পূর্বের মত ফেক আইডি নেই। অধিকাংশ আইডিই রিয়েল। যারা অশ্লীল কমেন্ট করছে, তাদের অনেকের টাইমলাইনে যেয়ে দেখলাম, তারা তাদের বিভিন্ন পোস্টে বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থক হিসেবে পরিচয় দেয়া। উপলব্ধি করলাম, একটি মহত্তর আদর্শকে ঢাল হিসেবে সামনে রেখে ব্যক্তিগত সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি চরিতার্থ করছে এরা।
এ তো গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সংখ্যালঘু একজন মজুমদার শিক্ষকের গল্প, এখন একজন মজুমদার ছাত্রের গল্প করা যাক।আজ থেকে চারবছর আগে এ জুন মাসের শেষ সপ্তাহেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪ তম আবর্তনের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের এবং মীর মোশাররফ হোসেন হলের আবাসিক ছাত্র মৃন্ময় মজুমদার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটে যাওয়ার পথে ঘটে একটি অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ বিকৃতমস্তিষ্ক ঘটনা। ঘটনাটি খুবই ছোট, কিন্তু এর মাধ্যমে দেশের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কিছু পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের চিনতে এবং বুঝতে আশাকরি আমাদের সহায়তা করবে।
মৃন্ময় মজুমদার ২৭.৬.১৬ তারিখ সোমবার রাত্রে ঢাকা থেকে বাড়ি যাচ্ছিল। রাত্রি ৩ টার ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাসটি তাকে ফলতিতা বটতলা বাসস্টপে নামিয়ে দেয়। এ বাসস্টপ থেকে মৃন্ময় একটি ভ্যানে করে বাড়ির পথে অগ্রসর হয়। এমন সময়ে কলকলিয়া নামক স্থানে পৌছালে তিন অস্ত্রধারী আততায়ী তাকে জোর করে বেঁধে ফেলে এবং টাকা পয়সা,মোবাইল সহ যা কিছুই সাথে ছিল তা সকলই কেড়ে নেয়। গল্পের এতটুকু ঠিক আছে, একজন ছিনতাইকারীরা যা করে বা যেমন হয়। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ছিনতাইকারীরা এর পরে যা করেছে, তা একজন ছিনতাইকারীর কাজ না।
এর পরে ছিনতাইকারীরা মৃন্ময় মজুমদারের কাছে তার ধর্মীয় পরিচয় জানতে চায়। মৃন্ময় চুপ থাকে। কিন্তু তারা উত্তেজিত হয়ে বারবার তার ধর্মীয় পরিচয় জানতে চায়। ওদের বারবার বলাতেও মৃন্ময় তার ধর্মীয় পরিচয় না দেয়ায় ; এ ছিনতাইকারী নামক সাম্প্রদায়িক আততায়ীরা মৃন্ময়কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের স্টাইলে তার প্যান্ট খুলে তার ধর্মীয় পরিচয় পরীক্ষা করে।
যখন বুঝতে পারে মৃন্ময় হিন্দু, তখন মালাউনের বাচ্চা সহ অসংখ্য গালাগালি করে তাকে এলোপাতারি চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকে। কোপগুলো মৃন্ময়ের গলা, হাত, বুকসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানকে প্রচণ্ড আহত করে। সে তখন মৃত্যুর অভিনয় করে, এতে কোনমতে তার জীবন রক্ষা পায়। পরবর্তীতে সে খুলনা মেডিকেল কলেজে দীর্ঘসময় চিকিৎসাধীন থেকে সুস্থ হয়।
ভারতের উত্তর প্রদেশে এক সংখ্যালঘু হত্যাকে কেন্দ্র করে ভারতে রাষ্ট্রযন্ত্রের কথিত অসহিষ্ণুতার অভিযোগে ভারতের অসংখ্য সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা তাদের সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার সহ বিভিন্ন পুরস্কার ফেরত দিয়ে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা এত এত সংখ্যালঘু নির্যাতন, হত্যায় রাস্তায় নেমে সামান্য প্রতিবাদ বা তাদের পুরস্কার ফেরত দেয়াতো দূরে থাক, তারা সামান্য টুঁ-শব্দটিও না করে মৌনীবাবা হয়ে বসে থাকেন। পাছে তাদের সুযোগ সুবিধা হাতছাড়া হয়। দেশে সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন হলে শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক আবুল বারাকাত, অধ্যাপক রেবায়েত ফেরদৌস স্যারদের মত কয়েকজনকে বাদ দিলে অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী নামধারীদের মুখমণ্ডলেই বিরাজ করে শ্মশানের নিরবতা। এ সময়ে এরা মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। দেশীয় আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া কথিত জাতির বিবেকদের টকশোতে টকাশ-টকাশ কথা বলা ছাড়া আর খুঁজেও পাওয়া যায় না।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যেমন করে
লুঙ্গি, প্যান্ট খুলে ধর্ম নির্ধারণ করা হত, বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীর ২০১৬ সালে এসেও যদি সংখ্যালঘু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের একই পদ্ধতিতে ধর্ম নির্ধারণকারী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়; ২০২০ সালে এসে নিজের যোগ্যতায় উপাচার্য হওয়া একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের হওয়ার অপরাধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অখাদ্য গালি শুনতে হয়; তবে আর আমাদের কিছুই বলার নেই।
সংখ্যাগুরুদের রাষ্ট্রধর্মের দেশে, সংখ্যালঘু হতে হতে শুধু কথিত অসাম্প্রদায়িক ঝর্ণাধারায় স্নান করতে করতে আমরা কি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব দেশ থেকে? প্রতি দশকের জনগণনায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ১৯৭১ এর অভিশপ্ত দিনগুলোর মত টুকরো টুকরো ঘটনাবহুল দিন, কেন বারবার ফিরে আসবে সংখ্যালঘুদের জীবনে? বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত উপাচার্যকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথার মারপ্যাঁচে যারা অপমানিত করে উলঙ্গ করতে চেষ্টা করেছে এবং তেমনিভাবে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে ধর্মের কারণে দৈহিক উলঙ্গ - এ মজুমদার ছাত্রশিক্ষকের দুটি ঘটনায় একটিই যোগসূত্র আছে ; সে যোগসূত্রটি হল স্বাধীনতাবিরোধী তীব্র সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ।
২০১৬ সালে দেখেছি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুরোহিত, মন্দিরের সেবায়েত, বৌদ্ধ ভিক্ষু, পাদ্রী, ব্যবসায়ী, কলেজ শিক্ষক, কবিরাজের সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ অকারণে হিংস্র শ্বাপদের চাপাতির শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। একটু সচেতন ভাবে কান পাতলে, টের পাওয়া যায় পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা দেশে এখনও কতটা সক্রিয়। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। ২০১৩ সাল থেকে ধারাবাহিক হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, ২০১৬ সালে এসে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক ঘটনায় তা চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। ঘটনাগুলি অনেকেই দেখেছি, শুনেছি এবং যথারীতি ভুলেও গিয়েছি।শুনেছি গোল্ডফিশের মেমোরি নাকি এক সেকেন্ড থাকে, আমার মনে হয় বিভিন্ন ঘটনার ঘনঘটায় হিন্দুসম্প্রদায়ের মেমোরি এ গোল্ডফিশের মতই হয়ে গেছে।সংখ্যালঘু নির্যাতনে অধিকাংশ ঘটনাতে বিচারহীনতা তাদের আরও ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে।ঘটনা ঘটলে গালভরা অসাম্প্রদায়িকতার বাণী শুনতে শুনতে সংখ্যালঘুরা আজ ক্লান্ত, অনেকটাই দিশেহারা।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ