ইদানীং সাত্ত্বিক প্রতিমা প্রসঙ্গটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে বঙ্গদেশে। আমরা অনেকেই বিষয়টি নিয়ে নিয়মিত কথা বললেও সুনির্দিষ্টভাবে সাত্ত্বিক পূজার সংজ্ঞা বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করতে পারি না। কারণ বিষয়টি সম্পর্কে আমরা কেউ খুব একটা সঠিক ধারণাসম্পন্ন নই। মোটাদাগে আমরা সাত্ত্বিক পূজা বলতে বুঝি, অতিরিক্ত লাইটিং বা সাউন্ডস থাকতে পারবে না। এবং সাত্ত্বিক পূজা সম্পর্কে বুঝি, প্রতিমাটি যেন অশ্লীল না হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই ভুলে যাই সব নগ্নতাই অশ্লীলতা নয়। মাকালীর প্রতিমা নগ্ন, কিন্তু তা চিন্ময়ী মার্তৃত্বের প্রকাশ। শিবলিঙ্গ পূজা, কামাখ্যায় যোনীপীঠে পূজা এ সকলের মধ্যেই আপাতদৃষ্টিতে নগ্নতা থাকলেও এতে সামান্যতম অশ্লীলতা নেই।সনাতন ধর্ম বিশ্বাসের সাথে প্রকৃতির এমন সম্পর্ক যে, চাইলেই এ সম্পর্ককে আলাদা করা যায় না। প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত রূপ রূপান্তরে সনাতন সংস্কৃতি আবর্তিত হয়, প্রয়োজনে যুগোপযোগী রূপান্তরিত হয়। এ কারণেই জগতের ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদগুলো সনাতন ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে শত প্রচেষ্টা করেও সামান্যতম বিচ্যুতি করতে পারেনি। সনাতন ধর্মকে বিচ্যুত বা ধ্বংস করতে হলে আগে এ বৈচিত্র্যময় প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে হবে।কিন্তু তা যেহেতু কোনদিনই সম্ভবপর নয়; তাই সনাতন ধর্মেরও বিনাশ করা সম্ভব নয়।
আমাদের উচিত দেববিগ্রহাদি শাস্ত্রীয় ধ্যানমন্ত্র অনুসরণে তৈরি করা। সনাতন প্রত্যকটি দেবতারই দেহের বর্ণনা দিয়ে সুস্পষ্ট ধ্যানমন্ত্র রয়েছে। তাই সকলের যথাসম্ভব সে সকল ধ্যানমন্ত্রকে অনুসরণ করা প্রয়োজন। সরস্বতী পূজায় ব্যবহৃত দেবী সরস্বতীর সম্পূর্ণ বর্ণনা দিয়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ধ্যানমন্ত্র রয়েছে। এ ধ্যানমন্ত্রটি 'সারদাতিলক' তন্ত্রে আছে।ষোড়শ শতাব্দীর বিখ্যাত স্মৃতিশাস্ত্রকার শ্রীরঘুনন্দন ভট্টাচার্যও তাঁর 'অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব' নামক স্মৃতিগ্রন্থে ধ্যানমন্ত্রটি উদ্ধৃত করেছেন।নবদ্বীপের সুবিখ্যাত তান্ত্রিক শ্রীকৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তাঁর 'তন্ত্রসারঃ' গ্রন্থে দেবী সরস্বতীর বহুল প্রচলিত ধ্যানমন্ত্রটি প্রথমে উদ্ধৃত করে সাথে আরও পাঁচটি ধ্যানমন্ত্র উদ্ধৃত করেছেন। সেই সকল ধ্যানমন্ত্রে দেবী সরস্বতীর রূপ, অসাধারণ শব্দলালিত্যে বর্ণিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের তন্ত্রসারে প্রথমে উদ্ধৃত ধ্যানমন্ত্রটিতে বঙ্গদেশে পূজিতা শুভ্রবর্ণা, শ্বেতপদ্মাসনা, হাতে লেখনী ও পুস্তকশোভীত দ্বিভুজা সরস্বতীর বর্ণনা পাওয়া যায়।এ কারণেই হয়ত এ ধ্যানমন্ত্রটি বৃহত্তর বাংলা, বিহার, আসামে বহুল প্রচলিত এবং যুগপৎ অত্যন্ত জনপ্রিয়।
তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ।
কুচভরননমিতাঙ্গী সন্নিয়ন্না সিতাব্জে।।
নিজকরকমলােদ্যল্লেখনী পুস্তকশ্রীঃ।
সকলবিভবসিদ্ধ্যে পাতু বাগ্দেবতা নঃ॥
"ললাটে যাঁর বিরাজিত তরুণ শশিকলা, যিনি শুভ্রবর্ণা, কুচভারাবনতা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, যাঁর একহাতে উদ্যত লেখনী ও অন্যহাতে পুস্তক শােভা পায়; সেই বাগদেবতা সকল বিভব সিদ্ধির নিমিত্ত আমাদের রক্ষা করুন।"
দ্বিতীয় ধ্যানমন্ত্র:
শুভ্রাং স্বচ্ছবিলেপমাল্যবসনাং শীতাংশু
খণ্ডোজ্জ্বলাং ব্যাখ্যামক্ষগুণং সুধাঢ্যকলসং বিদ্যাঞ্চ হস্তাম্বুজৈঃ।
বিভ্রাণাং কমলাসনাং কুচলতাং বাগ্দেবতাং সস্মিতাং বন্দে বাগ্বিভবপ্রদাং ত্রিনয়নাং সৌভাগ্যসম্পৎকরীম্।।
"যিনি শেতাঙ্গী, শ্বেতচন্দন, শ্বেতমালা ও শ্বেতবসন পরিধান করে চারটি পদ্মরূপ হাতে জ্ঞানমুদ্রা, রুদ্রাক্ষমালা, সুধাপূর্ণকলস ও বিদ্যা ধারণ করে আছেন, যাঁর ললাটদেশে চন্দ্রকলা শােভিত, কুচভারে অবনতা হয়ে যিনি সহাস্যবদনে শ্বেতকমলে বিরাজ করছেন, যিনি ভক্তগণকে বাক্ সম্পত্তি ও সর্বপ্রকার সৌভাগ্য সম্পদ প্রদান করেন, সেই ত্রিনয়না বাকদেবীকে সদা বন্দনা করি।"
তৃতীয় ধ্যানমন্ত্র:
বাণীং পূর্ণনিশাকরােজ্জ্বলমুখীং কর্পূরকুন্দপ্রভাং অর্ধচন্দ্রাঙ্কিতমস্তকাং নিজকরৈঃ সংবিভ্রতীমাদরাৎ।
বীণামক্ষগুণং সুধাঢ্যকলসং বিদ্যাঞ্চ তু্ঙ্গস্তনীং দিব্যৈরাভরণৈর্বিভূষিততনুং হংসাধিরূঢ়াং ভজে।
"যাঁর বদনমণ্ডল পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় সমুজ্জল, কর্পূর ও কুন্দফুলের ন্যায় যাঁর শরীরের শ্বেতকান্তি, শিরোদেশে অর্ধচন্দ্র বিরাজমান, যিনি চারহাতে বীণা, রুদ্রাক্ষমালা, সুধাপূর্ণকলস ও পুস্তক ধারণ করে আছেন, যিনি দিব্য আভরণে বিভূষিতা হয়ে শ্বেত হংসের উপরে বিরাজিতা, সেই উন্নতস্তনী বাকদেবীকে ভজনা করি।"
চতুর্থ ধ্যানমন্ত্র :
আসীনা কমলে করৈর্জপবটীং পদ্মদ্বয়ং পুস্তকং
বিভ্রাণা তরুণেন্দুবদ্ধমুকুটা মুক্তেন্দুকুন্দপ্রভা। ভালােন্মীলিতলােচনা কুচভারক্লান্ত্যা ভবদ্ভূতয়ে ভূয়াদ্বাগধিদেবতা মুনিগণৈরাসেব্যমানানিশম্।।
"যিনি পদ্মের উপর সমাসীনা, চারটি হাতে জপমালা, দু'টি পদ্ম ও পুস্তক ধারণ করে আছেন, মস্তকে চন্দ্রকলার মুকুট ধারণ করেছেন; যাঁর দেহকান্তি মুক্তা, চন্দ্র ও কুন্দফুলের ন্যায় শুভ্র, ললাটদেশেও একটি লােচনে যিনি ত্রিনয়নী, মুনিগণ সর্বদা যাঁর সেবা-বন্দনা করেন; সেই কুচভারে আনতা বাগদেবী সদা কল্যাণ করুন।"
পঞ্চম ধ্যানমন্ত্র:
মুক্তাহারাবদাতাং শিরসি শশিকলালঙ্কৃতাং বাহুভিঃ স্বৈর্ব্যাখ্যাং বর্ণাখ্যমালাং মণিময়কলসং পুস্তকঞ্চোদ্বহস্তীম্।
আপীনােত্তুঙ্গবক্ষোরুহভরবিলসন্মধ্যদেশামধীশাং
বাচমীড়ে চিরায় ত্রিভুবনমিতাং পুণ্ডরীকে নিষণ্ণাম্॥
"মুক্তাহারের ন্যায় যাঁর দেহের শুভ্রকান্তি, মস্তকে চন্দ্রকলা বিরাজিতা, চারটি হাতে বাখ্যামুদ্রা, মাতৃকাবর্ণমালা, মণিময় কলস ও পুস্তক ধারণ করে আছেন, পীনােত্তুঙ্গস্তনভারে যাঁর মধ্যভাগ অবনত, শ্বেতপদ্মে সমাসীনা ত্রিলােকে পূজিতা সেই বাগ্দেবীকে সদা পূজা করি।"
ষষ্ঠ ধ্যানমন্ত্র:
হংসারূঢ়া হরহসিতহারেন্দু কুন্দাবদাতা
বাণী মন্দস্মিততরমুখী মৌলিবন্ধেন্দুলেখা।
বিদ্যাবীণামৃতময়ঘটাক্ষস্রজাদীপ্তহস্তা
শ্বেতাব্জস্থা ভবদভিমত প্রাপ্তয়ে ভারতী স্যাৎ।।
"যিনি হংসােপরি উপবিষ্টা, শিবহাস্য, হার, চন্দ্র ও কুন্দফুলের ন্যায় যিনি শ্বেতবর্ণা, যাঁর বদনে সর্বদা মন্দস্মিতহাস্য ও কপালে অর্ধচন্দ্র বিরাজমান, হস্তে পুস্তক, বীণা, অমৃতকুম্ভ এবং রুদ্রাক্ষমালা শোভিত; সেই শ্বেতকমলবাসিনী ভারতী অভীষ্ট সিদ্ধি প্রদান করুন।"
তন্ত্রসারে উদ্ধৃত সরস্বতী দেবীর ষষ্ঠধ্যানমন্ত্রটি প্রপঞ্চসার তন্ত্র থেকে উদ্ধৃত হয়েছে।এই এক থেকে ছয়টি ধ্যানমস্ত্রে সরস্বতীর বেশ কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। সেই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হল:
১.দেবীর ললাটে অর্ধচন্দ্র: দেবীর প্রায় সকল ধ্যানমন্ত্রেই দেবীর ললাটে অর্ধচন্দ্র এবং শ্বেতশুভ্র গায়ের বর্ণ পাওয়া যায়।শাস্ত্রে চন্দ্র সৌন্দর্য, শ্রী এবং অমৃতের প্রতীক।
"তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী", ললাটে যাঁর বিরাজিত তরুণ শশিকলা।
"শীতাংশু খণ্ডোজ্জ্বলাং",যাঁর ললাটদেশে চন্দ্রকলা শােভিত।
"অর্ধচন্দ্রাঙ্কিতমস্তকাং", শিরোদেশে অর্ধচন্দ্র বিরাজমান।
"তরুণেন্দুবদ্ধমুকুটা",মস্তকে চন্দ্রকলার মুকুট ধারণ করেছেন।
"শিরসি শশিকলালংকৃতাং",মস্তকে চন্দ্রকলা বিরাজিতা।
"মৌলিবন্ধেন্দুলেখা"কপালে অর্ধচন্দ্র বিরাজমান।
২.দেবীর গায়ের বর্ণ শ্বেতশুভ্র: কর্পূর, কুন্দফুল,
চন্দ্র ও মুক্তাহারের মত দেবীর দেহের বর্ণ শ্বেতশুভ্র।
"শুভ্রকান্তিঃ",যিনি শুভ্রবর্ণা।
"শুভ্রাং",যিনি শেতাঙ্গী।
"কর্পূরকুন্দপ্রভাং",কর্পূর ও কুন্দফুলের ন্যায় যাঁর শরীরের শ্বেতকান্তি।
"মুক্তেন্দুকুন্দপ্রভা",যাঁর দেহকান্তি মুক্তা, চন্দ্র ও কুন্দফুলের ন্যায় শুভ্র।
"মুক্তাহারাবদাতাং", মুক্তাহারের ন্যায় যাঁর দেহের শুভ্রকান্তি।
"হারেন্দু কুন্দাবদাতা",হার, চন্দ্র ও কুন্দফুলের ন্যায় যিনি শ্বেতবর্ণা।
৩.দেবী চতুর্ভুজা:ষোড়শ শতাব্দীতে বিখ্যাত স্মৃতিশাস্ত্র প্রণেতা রঘুনন্দন ভট্টাচার্য "সারদাতিলকতন্ত্র" থেকে "তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ" সরস্বতীর একটি ধ্যানমন্ত্র উদ্ধৃত করেন। এ ধানমন্ত্রটি নবদ্বীপের সুবিখ্যাত তান্ত্রিক শ্রীকৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশও তাঁর 'তন্ত্রসার' গ্রন্থে উদ্ধৃত করেন।
সেই বহুল প্রচলিত ধ্যানমন্ত্র দেবী সরস্বতী দ্বিভুজা। "নিজকরকমলােদ্যল্লেখনী পুস্তকশ্রীঃ"- দেবীর একহাতে উদ্যত লেখনী ও অন্যহাতে পুস্তক শোভিত। এ প্রচলিত জনপ্রিয় ধ্যানমন্ত্রটি ছাড়া অন্যসকল ধ্যানমন্ত্রেই দেবী চতুর্ভুজা।
"ব্যাখ্যামক্ষগুণং সুধাঢ্যকলসং বিদ্যাঞ্চ হস্তাম্বুজৈঃ",
চারটি পদ্মরূপ হাতে জ্ঞানমুদ্রা, রুদ্রাক্ষমালা, সুধাপূর্ণকলস ও বিদ্যা ধারণ করে আছেন।
"নিজকরৈঃ সংবিভ্রতীমাদরাৎ।
বীণামক্ষগুণং সুধাঢ্যকলসং বিদ্যাঞ্চ";যিনি চারহাতে বীণা, রুদ্রাক্ষমালা, সুধাপূর্ণকলস ও পুস্তক ধারণ করে আছেন।
"করৈর্জপবটীং পদ্মদ্বয়ং পুস্তকং বিভ্রাণা", চারটি হাতে জপমালা, দু'টি পদ্ম ও পুস্তক ধারণ করে আছেন।
"বাহুভিঃ স্বৈর্ব্যাখ্যাং বর্ণাখ্যমালাং মণিময়কলসং পুস্তকঞ্চোদ্বহস্তীম্", দেবীর চারটি হাতে বাখ্যামুদ্রা, মাতৃকাবর্ণমালা, মণিময় কলস ও পুস্তক ধারণ করে আছেন।
"বিদ্যা বীণামৃতময়ঘটাক্ষস্রজাদীপ্তহস্তা", দেবীর হস্তে পুস্তক, বীণা, অমৃতকুম্ভ এবং রুদ্রাক্ষমালা শোভিত।
৪.সরস্বতী দেবী ত্রিনেত্রা : সরস্বতী দেবীর ধ্যানমন্ত্রে তিনি দুর্গা-কালীর মত ত্রিনয়নী হলেও, বর্তমান বঙ্গদেশে প্রায় সকল সরস্বতী প্রতিমারই দুটি নয়ন। কোথাও ত্রিনয়নী প্রতিমা দেখা যায় না। মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যের সময়েই সনাতন দেবদেবীদের এমন মানবায়ন ঘটে। মধ্যযুগের কবিরা দেবদেবীদের ঘরের মানুষ হিসেবে, একান্ত আপনজন হিসেবে প্রচার করেছেন। সেই লক্ষ্যই লক্ষ্মী এবং সরস্বতী বাংলার ঘরে ঘরে আদরের দুইমেয়ে হিসেবে পূজিত। শ্রীচণ্ডীতে আমরা দেখতে পাই, আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গারই তিনটি প্রধানরূপ। সত্ত্বগুণে তিনি ব্রহ্মাণী বা সরস্বতী ; রজোগুণে তিনি বৈষ্ণবী বা বিষ্ণুর শক্তি লক্ষ্মী এবং তমোগুণে তিনি মাহেশ্বরী বা কালী। অর্থাৎ যিনিই দুর্গা তিনিই সরস্বতী, তিনিই লক্ষ্মী এবং তিনিই কালী। কিন্তু মধ্যযুগের কল্যাণে আমরা লক্ষ্মী এবং সরস্বতীকে দেবী দুর্গার দুটি আদরের কন্যা হিসেবে জানি।
"ত্রিনয়নাং"সেই বাগ্দেবী ত্রিনয়না।
"ভালােন্মীলিতলােচনা" ললাটদেশেও একটি লােচনে যিনি ত্রিনয়নী।
৫.দেবী উন্নতস্তনী: বর্তমানে অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেবতত্ত্বকে আমরা বিদেশী বিশেষ করে আব্রাহামিকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শুরু করেছি। তাই আমরা নিজেদের অজান্তে নিজেদের বিশ্বাস এবং স্বাভিমানকেই অবহেলা করা শুরু করেছি। দেবীর ধ্যানমত্রে এই স্তোনের উল্লেখ দেখে আমরা অনেকেই লজ্জাবনত হয়ে যায়। ভেবে ধর্মীয় বিষয়ে এ সকল শব্দের উল্লেখ কেন? কিন্তু একবার আমরা ভেবে দেখি না, একটি শিশুর জন্মের সাথে সাথেই তার মাতৃস্তনের প্রসঙ্গ আসে। কারণ এই মাতৃস্তনের অমৃততুল্য মার্তৃদুগ্ধ পান করে শিশুটি বেঁচে থাকবে। মা এবং সন্তানের সাথে যেমন স্তনের বেঁচে থাকার সম্পর্ক, ঠিক তেমনি আদ্যাশক্তি মহামায়ার দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কালী ইত্যাদি সকল রূপের বর্ণনাতে উন্নতস্তন প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু আমরা অনেকেই বিষয়টিকে অন্যদের দৃষ্টিতে দেখতে লজ্জিত হয়ে 'কুচ' বা 'স্তন' শব্দগুলোকে অশাস্ত্রীয় হাস্যকরভাবে বিবিধ প্রকারের অর্থ করার প্রয়াস করি। এই শব্দগুলোর আভিধানিক অর্থকে যথাসম্ভব পরিবর্তন করে অন্য কোন নতুন কাল্পনিক অর্থের আমদানি করার প্রচেষ্টা করি। এ বিষয়টি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা প্রতিমা পূজা সমর্থন করে না, সেই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশী দেখা যায়।
"কুচভারাবনতা", -দেবী কুচভারাবনতা।
"তু্ঙ্গস্তনীং"- দেবী উন্নতস্তনী।
"কুচভারক্লান্ত্যা",-কুচভারে আনতা।
"আপীনােত্তুঙ্গবক্ষো"-পীনােত্তুঙ্গ স্তনভাবে দেবীর মধ্যভাগ অবনত।
৬. সরস্বতী বিবিধ দিব্য আভরণে বিভূষিতা: "দিব্যৈরাভরণৈর্বিভূষিততনুং",-যিনি দিব্য আভরণে বিভূষিতা।
৭.সরস্বতী শ্বেতপদ্মাসীনা: "সিতাব্জে"- দেবী শ্বেতপদ্মে আসীনা।"বিভ্রাণাং কমলাসনাং"-দেবী শ্বেতকমলে বিরাজ করছেন।"আসীনা কমলে", -যিনি পদ্মের উপর সমাসীন।"পুণ্ডরীকে নিষণ্ণাম্"-দেবী শ্বেতপদ্মে সমাসীনা। "শ্বেতাব্জস্থা" -সেই দেবী শ্বেতকমলবাসিনী।
৮.সরস্বতী হংসারঢ়া: "হংসাধিরূঢ়াং" -দেবী সরস্বতী শ্বেত হংসের উপরে বিরাজিতা।
"হংসারূঢ়া",-যিনি হংসােপরি উপবিষ্টা।
৯.সরস্বতী সহাস্যবদনা:
"সস্মিতাং", -দেবী সরস্বতী সহাস্যবদনা।"মন্দস্মিততরমুখী",যাঁর বদনে সর্বদা মন্দস্মিতহাস্য।
১০.সরস্বতী সৌভাগ্য ও সম্পদদাত্রী:
"সকলবিভবসিদ্ধ্যে",- দেবী সকল বৈভবের সিদ্ধি দান করেন।"সৌভাগ্যসম্পৎকরীম্",-সর্বপ্রকার সৌভাগ্য সম্পদ দেবী প্রদান করেন।
১১.বাক এবং বিদ্যাশক্তির অধিষ্ঠাত্রী সরস্বতী :
"বাগ্বিভবপ্রদাং",যিনি ভক্তগণকে বাকশক্তি সম্পত্তি প্রদান করেন। তাই তিনি বাগ্দেবী। "প্রাপ্তয়ে ভারতী স্যাৎ",ভারতী অভীষ্ট সিদ্ধি প্রদান করুন।দেবী সরস্বতী বিদ্যা কলায় ভারতী অভীষ্ট সিদ্ধি প্রদান করেন।
পুরাণ, তন্ত্রশাস্ত্রে (হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন) সরস্বতীর আরও বহুবিধরূপ দৃষ্ট হয়। পুরাণ তন্ত্রের মত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও দেবী সরস্বতীর অত্যন্ত মাধুর্যমণ্ডিত বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত 'সোনার তরী' কাব্যগ্রন্থের 'পুরষ্কার' নামক এক বৃহৎ কবিতায় কবিগুরু প্রচণ্ড আবেগঘনভাবে অনন্যসাধারণ সরস্বতী বন্দনাটি করেছেন।
'প্রকাশো জননী নয়নসমুখে
প্রসন্ন মুখছবি।
বিমল মানসসরস-বাসিনী
শুক্লবসনা শুভ্রহাসিনী
বীণাগঞ্জিতমঞ্জুভাষিণী
কমলকুঞ্জাসনা,
তোমারে হৃদয়ে করিয়া আসীন
সুখে গৃহকোণে ধনমানহীন
খ্যাপার মতন আছি চিরদিন
উদাসীন আনমনা।
চারি দিকে সবে বাঁটিয়া দুনিয়া
আপন অংশ নিতেছে গুনিয়া,
আমি তব স্নেহবচন শুনিয়া
পেয়েছি স্বরগসুধা।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।